সুশান্ত ঘোষ
সভ্যতার সূচনা মৃৎশিল্পের হাত ধরেই। একদিকে দৈনন্দিন প্রয়োজন, অন্যদিকে শিল্প ভাবনা দুইই মিলেছে মৃৎশিল্পের মধ্যে দিয়ে। মৃৎশিল্পের প্রধান কাঁচামাল মাটি আমাদের দেশে সহজলভ্য হওয়ায় এই শিল্প ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। দামে অত্যন্ত সস্তা, পরিবেশ বান্ধব এই মৃৎশিল্প বাংলার আদিশিল্প হিসেবে স্বীকৃত যা আজও বহমান রয়েছে। বাংলার ‘টেরাকোটা’ আজ বিশ্ব শিল্পের অন্যতম নিদর্শণ। নদ নদী নির্ভর দক্ষিণাঞ্চল মৃৎশিল্পের অন্যতম ঠিকানা। মৃৎশিল্পের অন্যতম কাচামাল ‘মাটি’র সহজলভ্যতা, নদী-খালে নৌ -পরিবহনের মধ্যে দিয়ে এই মৃৎশিল্প এই অঞ্চলে বিশেষভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এ ছাড়াও দৈনন্দিন প্রয়োজনে বরিশাল অঞ্চলের এই মৃৎশিল্পের রয়েছে বিশেষ বৈশিষ্ট্য যা এই শিল্পকর্মকে অন্য অঞ্চল থেকে পৃথক করেছে। বরিশাল অঞ্চলে যারা মৃৎশিল্পের সাথে যুক্ত রয়েছেন তাদেরকে স্থানীয় ভাবে ‘পাল’ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। এই পাল দুই শ্রেণীতে বিভক্ত। যারা শুধুমাত্র মূর্তি তৈরী করেন তাদেরকে স্থানীয়ভাবে ‘গুণরাজ’ অভিধায় সিক্ত করা হয়। অন্যদিকে কুম্ভকার- যারা হাড়ি, পাতিল সহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় তৈজস তৈরী করে থাকেন, তারা শুধু পাল নামে স্থানীয় ভাবে পরিচিত।
বরিশাল অঞ্চলে দেড় থেকে দুই হাজার পরিবার রয়েছেন যারা বংশ পরম্পরায় এই পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। বরিশাল জেলায় এই পেশায় রয়েছে অন্তত ৫’শ পরিবার। বংশ পরম্পরায় এই পেশায় নিয়োজিত হলেও পিরোজপুরের নাজিরপুর ও স্বরুপকাঠী উপজেলা ও ঝালকাঠীতে বংশ পরম্পরার বাইরেও বেশ কিছু পরিবার এই পেশায় নিয়োজিত দেখা যায়।
বরিশাল অঞ্চলের মৃৎশিল্পের প্রধান কেন্দ্রগুলো হল, বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার কলসকাঠী ও মহেশপুর, আগৈলঝারা উপজেলার গৈলা ইউনিয়নের উত্তর সিহিপাশা গ্রাম, ঝালকাঠী জেলার পালবাড়ি- হিমানন্দকাঠী, শিমুলেশ্বর গ্রাম, পিরোজপুর জেলার- কাউখালী ও পিরোজপুর পালপাড়া, পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলার মদনপুরা, বগা এলাকায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বসতি রয়েছে। বর্তমানে পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলার ‘মদনপুরা’ ব্রান্ড সারা বাংলাদেশে বিখ্যাত। এই অঞ্চলের মৃৎসামগ্রী বিভিন্ন বাণিজ্যিক কারুশিল্প প্রতিষ্ঠান হয়ে বিদেশেও রপ্তানি হয়ে থাকে।
বরিশাল অঞ্চলে অধিকাংশ মৃৎকেন্দ্রগুলিতে চাকা ঘুরিয়েই মৃৎসামগ্রী তৈরী করা হয়। অধিকাংশ এলাকায় রয়েছে মৃৎপাত্র পোড়ানোর প্রথাগত ব্যবস্থা যাকে স্থানীয় ভাষায় ‘পুইন’ বলা হয়ে থাকে। শুধুমাত্র বাউফল ও ঝালকাঠীতে ইলেকট্রিক-মটর চালিত চাকা রয়েছে। এই চাকা ১৫-২৫ হাজার টাকার মধ্যে হয়ে থাকে। এ ছাড়াও বাউফলে মাটি প্রস্তুত করার মিক্সার মেসিন রয়েছে। এসব মেসিন দিয়ে খুব দ্রুতগতিতে বিপুল সংখ্যক পণ্য সামগ্রী তৈরী হয়ে থাকে। শুধুমাত্র বাউফলে নিজস্ব ব্রান্ডের ছাপ দেয়ার ব্যবস্থা থাকেলেও অন্যত্র তা নেই। মৃৎকেন্দ্র গুলিতে বাউফলে কাপাসিয়া মাটির সাথে খয়ের মিশিয়ে পরিবেশ বান্ধব রং তৈরী করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া অন্যত্র লাল মাটি তরল করে কলসকাঠী, মহেশপুর ও উত্তর সিহিপাশা এলাকায় হাড়ি পাতিলে রং দেয়া হয়ে থাকে।
এলাকা ভিত্তিক বিখ্যাত মৃৎসামগ্রী হল-

জেলা উপজেলা এলাকা উৎপাদিত উল্লেখযোগ্য শিল্পকর্ম

১. বরিশাল বাকেরগঞ্জ কলসকাঠী প্রতিমা নির্মাণ, মুড়ি ভাজার পাত্র, মাটির সাজ, হাড়ি, কলস, বিভিন্ন আকারের মৃৎপাত্র
২.বরিশাল বাকেরগঞ্জ মহেশপুর সানকি, কয়েলদানি, মাটির পাত্র, জালেরকাঠী, খোরা, বিভিন্ন আকৃতির প্লেট, পা-ঘষার দন্ড, পিঠার সাজ
৩. বরিশাল আগৈলঝারা উত্তর সিহিপাশা বিভিন্ন ধরনের মাটির পাত্র, প্রতিমা নির্মাণ, মনসার ঘট নির্মাণ
৪. পিরোজপুর কাউখালি কাউখালি পালপাড়া প্রতিমা নির্মাণ, মনসার ঘট, হাড়ি পাতিল
৫. পিরোজপুর সদর পিরোজপুর পালপাড়া প্রতিমা নির্মাণ, টালি, হাড়ি পাতিল
৬. ঝালকাঠী সদর ঝালকাঠী পাল পাড়া প্রতিমা নির্মাণ, হাড়ি পাতিল
৭. ঝালকাঠী হিমানন্দকাঠী মনসারঘট, প্রতিমা নির্মাণ, ঘট, মাটির খেলনা, সামগ্রী তৈরী
৮. ঝালকাঠী শিমুলেশ্বর গ্রাম প্রতিমা নির্মান, মনসারঘট, মাটির কয়েল দানি, ঘট, পাখির বাসা, খেলনা সামগ্রী তৈরী
৯.পটুয়াখালী বাউফল মদনপুরা আধুনিক মৃৎসামগ্রী- ডিনারসেট, তৈজসপত্র, ফুলদানী, জার , টেরাকোটা, আধুনিক ডিজাইনে বিপুল আকারে উৎপাদিত হয়ে থাকে
১০.পটুয়াখালী বগা জালের কাঠি, মাটির ডিনারসেট, বিভিন্ন আধুনিক নকশার পাত্র
বরিশালের মৃৎপাত্রের বৈশিষ্ট্য
দৈনন্দিন কাজের জন্য যে ধরনের মৃৎপাত্র প্রয়োজন হয় তার সব কিছুই বরিশালের মৃৎশিল্পীরা তৈরী করে থাকেন, আগে এর সবই হাতে তৈরী করা হলেও বর্তমানে কিছু কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ চালিত চাক রয়েছে।
বরিশালে হিন্দু ধর্মীয় ও লোকাচার উপকরণ তৈয়ার কাজের সাথে যুক্ত বরিশালের চরকাউয়া, আগৈলঝারা উপজেলার গৈলা, ঝালকাঠীর নবগ্রাম ও হিমানন্দকাঠী, উজিরপুর, বাকেরগঞ্জের কলসকাঠী। মনসাঘটের জন্য বিখ্যাত আগৈলঝারা উপজেলার গৈলা, ঝালকাঠীর নবগ্রাম ও হিমানন্দকাঠী, উজিরপুর। মেলার সামগ্রীর জন্য হিমান্দকাঠী, কলসকাঠী বিখ্যাত। প্রতিমা তৈরীতে গৈলা, পিরোজপুর ও কলসকাঠীর আলাদা সুনাম রয়েছে। কলসকাঠীতে মুরি ভাজার সামগ্রী তৈরীতে সুনাম রয়েছে। বগা, বাউফলে জালের কাঠিসহ মাছ ধরার উপকরণের জন্য বিখ্যাত বাউফল ও বগায় বর্তমান সময়ে আধুনিক ডিজাইনের ডিনারসেটসহ বিভিন্ন গৃহ সজ্জার জন্য উপকরণ তৈরী করে থাকে। বিল্বগ্রাম মটকা তৈরীর জন্য বিখ্যাত।
বরিশাল অঞ্চলের মৃৎকেন্দ্র গুলোর মধ্যে বাউফল ও বগা ছাড়া আর সকল কেন্দ্রেই প্রাচীন ডিজাইনে মৃৎসামগ্রী তৈরী হয়ে থাকে। প্রশিক্ষিত ও আধুনিক বাজার সম্পর্কে ধারনা না থাকায় তারা অত্যন্ত দরিদ্র অবস্থায় শত শত বছর ধরে তাদের উৎপাদিত শিল্পকর্মগুলি তৈরী করে থাকে। এ অবস্থা নিরসনে এইসব মৃৎশিল্পীদের যথাযথ প্রশিক্ষণ ও বিক্রয়কেন্দ্র থাকা জরুরী। পূর্বে বিসিক এর পক্ষ থেকে বহু আগে ট্রেণিং কার্যক্রম করা হলেও দীর্ঘদিন ধরে এই কার্যক্রম চলছে না। কিন্ত এই শিল্প বর্তমানে টিকে থাকার জন্য প্রাচীন ডিজাইনের সাথে সাথে বাজারের চাহিদা অনুসারে উৎকৃষ্ট মান ও নকশার শিল্পদ্রব্য তৈরী করা জরুরী। দেশে উৎকৃষ্ট কাঁচামাল ও বৃহৎ শিল্প পরিবার থাকা সত্বেও এই শিল্পের প্রতি যথযথ গুরত্ব না দেয়া হতাশাজনক। আদিমতম এই পেশাটি টিকিয়ে রাখতে হলে – উৎকৃষ্ট মানের সৃজনশীল শিল্পকর্ম তৈরী করা জরুরী, আর এ জন্য দরকার যথাযথ প্রশিক্ষণ ও বাজার, আর এর মাধ্যমেই মৃৎশিল্পের সম্ভাবনা ও বিকাশ বিস্তৃতি লাভ করবে। বহু শিল্পী পরিবার বাদেও দরিদ্র পরিবারের কর্মসংস্থান সম্ভব হবে ।
মৃৎশিল্পী সম্মেলন ও সম্মাননা : সূচনা যে ভাবে
মৃৎশিল্পীদের উজ্জীবিত করতে ২০০৯ সাল থেকে মৃৎশিল্পীদের বিভিন্ন পুরষ্কার ও সম্মাননা দিয়ে আসছে ‘মৃৎশিল্পী সম্মেলন ও সম্মাননা’ বরিশাল থেকে। ২০০৯ সালে আমি (লেখক নিজে) ও আমার বন্ধু শিল্পী আমিনুল হাসন লিটু একটি পূজামন্ডপে স্থানীয় গুণরাজদের প্রতিমা তৈয়ারকর্ম দেখতে যাই এবং সেখানে জানতে পারি – এই গুণরাজরা পূজার সময়ে তাদের সন্তানদের কোন দিনই পূজার জামা দিতে পারেন না। যারা সমাজে সবাইকে উৎসবের আনন্দে ভাষিয়ে দেবার মূল কাজটি করেন, তারাই গৃহে ফেরেন নিরানন্দে। কারণ বারোয়ারী পূজাগুলো তাদের পূজার আর্থিক বাজেটের সব অর্থ ষষ্ঠীর আগে সংগ্রহ করতে পারেন না বিধায় মন্দির কমিটিগুলো গুণরাজদের সাথে প্রতিমা তৈয়ার করার যে আর্থিক চুক্তি করেন তার কিছু অংশ পূজার আগে দিতে পারলেও গুণরাজদের অধিকাংশ পাওনা অর্থ মন্দির কমিটিগুলো সাধারণত দিয়ে থাকেন পুজার পরে। কাজ শেষে প্রতিমা নির্মাণের অর্থ না পাওয়ায় গুণরাজদের একপ্রকার খালি হাতেই ঘরে ফিরতে হয়। আর গুণরাজদের ছেলে মেয়েদের মলিন মুখে সামিল হতে হয় পুজোর উৎসবে। কোন দিনই তারা পূজার এই সময়ে নতুন জামা-কাপড় পায়না।
গুণরাজদের এমন দুখ-বেদনাদায়ক বাস্তবতার পূজার গল্প শুনে সেদিনই দুই বন্ধু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম – গুণরাজরা হাসি মুখে যাতে ঘরে ফিরতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। এই চিন্তা নিয়ে আমরা দ্বারস্থ হই বরিশালের সমাজসেবী শিল্পপতি বিজয় কৃষ্ণ দে’র কাছে। তিনি শুধু এটি সমর্থনই করেননি, এই কাজে যে অর্থ খরচ হবে সেটি দিতে তিনি রাজী হন। তাৎক্ষণিক ‘মৃৎশিল্পী সম্মেলন ও সম্মাননা’ নামে একটি কমিটির আহবায়কের দ্বায়িত্ব পালন করেন বরিশালের বিশিষ্ট সমাজসেবী রাখাল চন্দ্র দে। বিশিষ্ট আইনজীবী ফনী ভূষণ দাস সামগ্রিক ভাবে এই অনুষ্ঠানকে সফল করতে ব্যাপক পরিশ্রম করেন। শুরু হয় মৃৎশিল্পীদের সম্মানিত করার অভিনব প্রয়াস। নগরীর কালিবাড়ী রোডের ধর্মরক্ষিণী সভা গৃহে প্রথম সম্মাননা অনুষ্ঠানে বরণ্যে চিত্রশিল্পী শহিদ কবীর এই আয়োজনে সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। মাটি তার কাছে প্রিয়। মাটির মানুষদের তিনি মমতামাখা কন্ঠে অনুভূতি প্রকাশ করেন। অনুষ্ঠানে সভাতিত্ব করেন রাখাল চন্দ্র দে। অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট গণসংগীত শিল্পী আক্কাস হোসেন, সংস্কৃতিজন নিখিল সেন সহ সমাজের বহু গণ্যমান্য ব্যাক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। গুণরাজদের সবাইকে অর্থ, বস্ত্র দেয়া হল। প্রথম বছর সবাইকে সম্মাননা ক্রেস্ট দেয়া হল। মাটির শিল্পীরা আপ্লুত হল। এই প্রথম তাদেরকে সম্মানিত করার প্রয়াসে তারা অনেকেই চোখের জল ধরে রাখতে পারছিলেননা। যে শিল্পীরা ছিল অবহেলিত, যাদের নির্মিত প্রতিমা শিল্পকর্ম হিসেবে মানুষের কাছে পেতনা কদর, সেই মানুষকে সম্মাননা দেয়ার এই প্রয়াসে সমাজের বিশিষ্ট ব্যাক্তিরা এই প্রয়াসকে অভিনন্দিত করলেন। সম্মাননা আয়োজনের ফলশ্রুতিতে পরের বছরই বরিশালের মন্দিরগুলোর দুর্গাপূজা আয়োজক কমিটি পূজার নিমন্ত্রণপত্রে প্রথমবারের মতো তাদের মন্ডপে নির্মিত প্রতিমার নির্মাণকারীর নাম ও নামের পূর্বে ‘মৃৎশিল্পী’ শব্দটি জুরে দিতে লাগলেন। প্রথম বছর চল্লিশ জন মৃৎশিল্পী যোগ দিয়েছিলেন এবং প্রতিবছর এই যোগদানের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েছে।
প্রথমবছর থেকেই আমরা চেয়েছিলাম পরম্পরার এই মৃৎশিল্পীদের সাথে প্রাতিষ্ঠানিক মৃৎ, চারুশল্পী ও গবেষকসহ দেশের আলোকিত মানুষদের মেল বন্ধন করতে। একারনেই শুরু থেকেই প্রতিবছর এই অনুষ্ঠান আয়োজনে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়- চারুকলা অনুষদের বর্তমান ডিন, শিল্পী নিসার হোসেন প্রধান উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করেন। চারুশিল্পী, সাংবাদিক, গবেষক, সংস্কৃতিজনদের ইতোমধ্যে যারা এই সম্মিলনে অতিথি হিসেবে যুক্ত হয়েছিলেন; তারা হলেন বরণ্যে শিল্পী রফিকুন নবী, শিল্পী ড. কাজী মোজাম্মেল হোসেন, শিল্পলেখক সৈয়দ আজিজুল হক, শিল্পী সৈয়দ এনায়েত হোসেন, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন পুত্র শিল্পানুরাগী ময়নুল আবেদিন, শিল্পলেখক বুলবন ওসমান, শিল্পলেখক মইনুদ্দিন খালেদ, শিল্পী শেখ আফজাল হোসেন, শিল্পী নাইমা হক, শিল্পী মো. মনিরুজ্জামান, শিল্পী রবিউল ইসলাম, শিল্পী চিন্ময়ী সিকদার, শিল্পী আবদুস সাত্তার তৌফিক, সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত, সাংবাদিক সোহরাব হোসেন, সাংবাদিক জ.ই. মামুন, লেখক আহমাদ মোস্তফা, কিশোরগঞ্জ শেখ হাসিনা বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল্লা খান প্রমুখ।
২০১৭ সালে প্রথমবারে মতো এই সম্মাননার সাথে মৃৎশিল্প মেলা ও শিশু শিল্পীদের আঁকা চিত্রপ্রদর্শনী যুক্ত হয়। তখন অনুষ্ঠান স্থানটি পরিবর্তিত হয়ে অশ্বিনী কুমার হলে নেয়া হয়। ঐ বছর ভারপ্রাপ্ত সংস্কৃতি সচিব আকতারী মমতাজ প্রধান অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠানে যোগ দেন। তিনি প্রদর্শনী ঘুরে দেখেন। এই সম্মাননাকে ঘিরে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আয়োজনে মুখরিত হয় বরিশাল অঞ্চল। বরিশালের বাইরে থেকে বিশেষ করে টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, শেরপুর, নওগা, রাজশাহী থেকে মৃৎশিল্পীরা এসে যোগ দেয় এই আয়োজনে। বরিশালের এই আয়োজনটি রূপ নেয় জাতীয় ভিত্তিক মৃৎপ্রদর্শনী ও আয়োজনে। ২০২১ সাল থেকে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় এই আয়োজনটিতে আংশিক আর্থিক সহযোগিতা শুরু করে – যা আজও অব্যাহত রয়েছে। গত দুই বছর থেকে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী এই আয়োজনে ভার্চুয়ালী উপস্থিত থেকে উৎসবের উদ্বোধন করে আসছেন।
বরিশালে মৃৎশিল্পী সম্মেলন ১৪২৮ ও পনেরো মৃৎশিল্পীকে সম্মাননা প্রদান
২৭ আশ্বিন ১৪২৮ (১২অক্টোবর ২০২১) মঙ্গলবার বরিশালের ঐতিহ্যবাহী ১৩তম মৃৎশিল্পী সম্মেলন ও সম্মাননা অনুষ্ঠান সকাল দশটায় বরিশাল জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের প্রতিমন্ত্রী, কে এম খালিদ এম.পি. মহোদয় অন্তর্জাল মাধ্যমে এই অনুষ্ঠানের শুভ উদ্বোধন করেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে অন্তর্জাল মাধ্যমে যুক্ত ছিলেন বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের পরিচালক জনাব ড. আহমেদ উল্লাহ ও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন এর পুত্র শিল্পানুরাগী প্রকৌশলী ময়নুল আবেদিন। বিশেষ অতিথি হিসেবে বরিশালের জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার উপস্থিত থেকে মৃৎশিল্পীদের সম্মাননা ও উৎসব উপহার এবং অর্থ সম্মাননা প্রদান করেন। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে আরও উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদের মৃৎশিল্প বিভাগের সহকারী অধ্যাপক চিন্ময়ী সিকদার, নজরুল গবেষক ড. কাজী মোজাম্মেল হোসেন, শিক্ষাবিদ শাহ সাজেদা ও সামিট বরিশাল পাওয়ার লিমিটেডের প্লান্ট ম্যানেজার ফকির মাহাদী হাসান। অনুষ্ঠানে বরিশালের সংস্কৃতি ও সামাজিক অঙ্গনের ব্যাক্তিরা ছাড়াও বরিশাল ও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গুণী মৃৎশিল্পীরা ও তাদের সহযোগীরা অংশ নেন। এই উপলক্ষে নকশী পিঠার ছাঁচের এক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।
সম্মাননাপ্রাপ্ত মৃৎশিল্পীদের প্রত্যোককে নগদ পাঁচ থেকে দশ হাজার টাকা, ক্রেস্ট উত্তরীয় ও বস্ত্র এবং অংশগ্রহণকারীদের প্রত্যেককে এক হাজার টাকাসহ বস্ত্র প্রদান করা হয়। এ আয়োজন উপলক্ষে সংক্ষিপ্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন আলতাফ হোসেন।
এবছর যারা সম্মাননা পদক পেয়েছেন-
জীবন সম্মাননা
‘শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন মৃৎশিল্পী জীবন সম্মাননা পদক’কে ভূষিত হয়েছেন – বরিশাল জেলার আগৈলঝারা উপজেলার গৈলা গ্রামের গুণরাজ জয়দেব পাল। যিনি প্রতিমা শিল্পী।
‘শিল্পী চিত্ত হালদার সৃজনশীল মৃৎশিল্পী জীবন সম্মাননা পদক’কে ভূষিত হয়েছেন- মাদারীপুর জেলার ডাসার উপজেলার শশীকর গ্রামের উমা রানী বিশ্বাস। যিনি নকশী পিঠার ছাঁচ শিল্পী করেন।
সম্মাননা পদক
মৃৎপাত্র বিভাগ :
সাথী রানী দে মৃৎশিল্পী সম্মাননা পেয়েছেন শোভা রানী পাল মহেশপুর, বাকেরগঞ্জ, বরিশাল। ক্রাফটস ভিলেজেস লি: মৃৎশিল্পী সম্মাননা পেয়েছেন কানাই চন্দ্র পাল, মদনপুরা, বাউফল, পটুয়াখালী। দৈনিক শাহনামা মৃৎশিল্পী সম্মাননা পেয়েছেন তপন কুমার পাল- নবগ্রাম ঝালকাঠী।
সৃজণশীল মৃৎশিল্প বিভাগে
শিল্পী বলহরি সাহা মৃৎশিল্পী সম্মাননা পেয়েছেন শখের হাড়ি শিল্পী সুশান্ত কুমার পাল, রাজশাহী। রাজ্জাক মমতাজ সেবা সংগঠন মৃৎশিল্পী সম্মাননা পেয়েছেন মনসার ঘট শিল্পী তুলশী রানী পাল, হিমানন্দকাঠী, ঝালকাঠী। অনিমা রানী খা মৃৎশিল্পী সম্মাননা পেয়েছেন মাটির পুতুল শিল্পী শোভা রানী পাল, টাঙ্গাইল। সংগ্রামী সুধীর সেন মৃৎশিল্পী সম্মাননা পেয়েছেন মাটির পুতুল শিল্পী বিশ্বনাথ পাল, নওগা।
প্রতিমা বিভাগ :
শহীদ কুমুদবন্ধু রায় চৌধুরী নাটু বাবু গুণরাজ সম্মাননা পেয়েছেন গুণরাজ রূপক পাল, কলসকাঠী, বাকেরগঞ্জ, বরিশাল। এস এস হেলেঞ্চা লি: গুণরাজ সম্মাননা পেয়েছেন গুণরাজ বিনোদ পাল, পিরোজপুর। শৈলবালা ঘোষ গুণরাজ সম্মাননা পেয়েছেন গুণরাজ নিতাই পাল, রাজবাড়ি। মঙ্গল শোভাযাত্রা গবেষণা ও প্রসার কেন্দ্র গুণরাজ সম্মাননা পেয়েছেন গুণরাজ অসীম পাল, রাজবাড়ি।
পি এ্যান্ড পি গুণরাজ সম্মাননা পেয়েছেন শেখর পাল পিরোজপুর। মৃৎশিল্পী সম্মেলন ও সম্মাননা গুণরাজ সম্মাননা পেয়েছেন – গুণরাজ রণজিৎ পাল ভাঙ্গা, ফরিদপুর। বিশেষ সম্মাননা : আগৈলঝারা উপজেলার গৈলা গ্রামের মৃৎশিল্পী জয়দেব পাল এর ছেলে সুজন পালকে রোবট প্রস্তুত করার জন্য বিশেষ সম্মাননা প্রদান করা হয়। সম্মাননা প্রদান করেন সামিট বরিশাল পাওয়ার লিমিটেডের প্লান্ট ম্যানেজার ফকির মাহাদী হাসান ।

লেখক:
সুশান্ত ঘোষ, সাংবাদিক, গবেষক ও সংগঠক।

Leave a comment