নিসার হোসেন

এদেশের লোকসমাজের ওপর নির্ভর করে তাদের রুচি ও চাহিদামাফিক শিল্প সামগ্রী নির্মাণের যে ঐতিহ্যগুলো সহ¯্র বছর আগেই গড়ে উঠেছে এবং আজও যে সৃজন প্রক্রিয়াগুলো পরম্পরার মধ্য দিয়ে চর্চিত হয়ে চলেছে তাদের মধ্যে মৃৎশিল্পই সর্বপ্রাচীন এবং তা মানের দিক থেকেও সর্বশ্রেষ্ঠদেরই পর্যায়ভুক্ত। আমাদের ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পের এই মূল্যায়ন শুধু গবেষকদের বা পন্ডিতদেরই নয়; সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এবং শ্রেষ্ঠ মূল্যায়নকারী যে আমজনতা (যাদের পৃষ্ঠপোষকতায় চরম প্রতিকূলতার মধ্যেও এ ঐতিহ্যটি অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী শিল্পের তুলনায় মাথা যথেষ্ঠ উঁচু করেই টিকে আছে), এ তাদেরই মূল্যায়ন। মৃৎশিল্পীদের মধ্যে যারা মূর্তি নির্মাণে দক্ষ বা ভাস্কর্যধর্মী কাজে পারদর্শী তারা সাধারণ মানুষের কাছে ‘গুণরাজ’ নামে পরিচিত। এর কারণ সম্ভবত এই যে, এ ধরনের কাজে নৃত্যকলা, চিত্রকলা, স্থাপত্যকলা, অলঙ্কার নির্মাণকলাসহ অন্য কলাজ্ঞানও প্রয়োগ করতে হয়। যে কোনো শিল্প সামগ্রী নির্মাণের ক্ষমতা অবশ্যই একটি গুণবিশেষ; কিন্তু সকল গুণের শ্রেষ্ঠ গুণটি যে কুম্ভকার সম্প্রদায়ের একচ্ছত্র দখলে চলে গেছে সেই বিষয়টি আমরা আমজনতা প্রদত্ত এই ‘গুণরাজ’ উপাধিটির মাধ্যমেই নিশ্চিত হতে পেরেছি। তবে মূর্তি বা ভাস্কর্য নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় গুণটুকু রপ্ত করার ইতিহাস সম্ভবত এতটা প্রাচীন নয়, যতটা প্রাচীন তাদের হাঁড়ি-কুড়ি-ঘট-কলসি নির্মাণের ইতিহাস। কেননা প্রাচীনকাল থেকেই এই উপমহাদেশের মৃৎশিল্পীরা কুম্ভকার নামেই পরিচিত, যার অর্থ ঘট বা কলসি নির্মাতা। কুম্ভকাররাও বিশ্বাস করেন, “শিবের বিয়েতে যখন ঘটের প্রয়োজন হলো, তখন শিব তার রুদ্রাক্ষের মালা থেকে একটি রুদ্রাক্ষ নিয়ে তাই দিয়ে মানুষ তৈরি করলেন, ঘট তৈরি করে দেওয়ার জন্য…”। সেই ঘট বা কুম্ভ নির্মাতাই কুম্ভকার। অর্থাৎ কুম্ভকারই প্রথম মানুষ বা প্রথম মানুষই কুম্ভকার। সুতরাং এরা মৃণ¥য় মূর্তি নির্মাণের কাজে নিশ্চয়ই যুক্ত হয়েছেন এরও অনেক পরে, কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে। ধারণা করা হয় যে, পাথর বা কাঠ দিয়ে দীর্ঘস্থায়ী মূর্তি নির্মাণের যে প্রাচীন ধারাটি এ অঞ্চলে বহমান ছিল, তা মূর্তি উপাসনাবিরোধী শক্তির দ্বারা আক্রান্ত হতে শুরু করলে ক্ষণস্থায়ী উপাদান দিয়ে দ্রুত মূর্তি নির্মাণ এবং নির্ধারিত আচার শেষে তা দ্রুত বিলুপ্ত (বিসর্জন) করে ফেলার রীতি যখন চালু হলো, তখন কাঁচা মাটিকেই এ ধরনের মূর্তি নির্মাণের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত বলে বিবেচনা করা হলো। আর সেই সুযোগে এই বাংলার সূত্রধর আর ভাস্করদের পেছনে ফেলে মাটি নিয়ে যাদের কারবার, সেই কুম্ভকাররাই শ্রেষ্ঠ শিল্পীর মর্যাদাপূর্ণ আসনটি দখল করে নিল। পশ্চিমবাংলার বেশিরভাগ অঞ্চলে এ আসনটি এখনও সূত্রধর এবং ভাস্করদের দখলেই রয়ে গেছে। বাংলাদেশের কুম্ভকাররা তাদের সহজাত শৈল্পিক প্রতিভার জোরে হাল আমলে স্বর্ণকারদের পেশাটিও কব্জা করে নিচ্ছেন। সব রকম কলাকৌশলকে রপ্ত করে নেওয়ার এই সহজাত ক্ষমতাটি রয়েছে বলেই প্রবল প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়েও বহু কুম্ভকার পরিবার নতুন যুগের চাহিদার সঙ্গে বনিবনা করে নিয়ে আজও মৃৎশিল্পকে আঁকড়ে ধরে যথেষ্ট সচ্ছলভাবেই জীবনযাপন করছেন।
গত শতকের আশির দশকের প্রথমভাগে নক্সাকেন্দ্র বিসিকের উদ্যোগে যে জরিপ চালানো হয় (যা বই আকারে ‘বাংলার কারুপল্লী’ নামে ১৯৮৫ সালে মুদ্রিত হয়েছে), তাতে বাংলাদেশের প্রায় ৭০-৭৫ শতাংশ লোকশিল্পী ও কারুশিল্পী পরিবারকে তালিকাভুক্ত করা সম্ভব হয়েছিল বলে মনে করা হয়। সেই জরিপে মৃৎশিল্পীদের ৬৮০টি গ্রাম, পল্লী বা পাড়াকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছিল, যেখানে ১৫ হাজারেরও বেশি পরিবার সম্পূর্ণভাবে এই পেশার ওপর নির্ভর করেই জীবিকা নির্বাহ করছে। যদিও এই সংখ্যা ১৮৭২ সালের জরিপ থেকে পাওয়া সংখ্যার তুলনায় অনেক কম (১৮৭২-এর জরিপে পাওয়া সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৫-৪০ হাজার পরিবার; ২ লাখ ৮১ হাজার ৭৫৮ জন সদস্য)। সুতরাং উল্লিখিত পরিসংখ্যান দুটোর তুলনা করলে কুম্ভকারদের সার্বিক পরিস্থিতির ক্রমাবনতির একটা চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী শিল্পধারার সঙ্গে তুলনা করলে ওই ১৫ হাজার পরিবারের সংখ্যাটিকেও যথেষ্ট সন্তোষজনক সংখ্যা বলেই বিবেচনা করতে হয়।
মৃৎশিল্পীদের ক্রমাগত সংখ্য া হ্রাসের কারণটি কিন্তু কেবল মৃৎশিল্পের চাহিদা কমে যাওয়ার সঙ্গেই যুক্ত নয়। তার চেয়ে অনেক বড় কারণ, যা কখনোই আলোচিত হয় না, তা হচ্ছে- যুগ যুগ ধরে হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার মৃৎশিল্পীর দেশত্যাগ। সেই ১৯৪৭-এর দেশভাগ, ‘৫২ সালের মুলাদি রায়ট, ‘৬৫-এর পাক-ভারত যুদ্ধ, ‘৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যা ইত্যাদি বিভিন্ন সময়ে অশুভ শক্তির উত্থানে ভীত হয়ে হিন্দু সম্প্রদায় ক্রমাগত দেশত্যাগ করে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা ইত্যাদি অঞ্চলে স্থায়ীভাবে চলে যাওয়ার কারণেও মৃৎশিল্পীদের সংখ্যা কমতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন কুম্ভকার পল্লীগুলোতে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, সেখানকার প্রায় অর্ধেক মৃৎশিল্পী আমাদের দেশ থেকে অভিবাসিত। এখানে বিশেষ একটি মৃৎ সামগ্রী নিয়ে আমার সমীক্ষা লব্ধ ধারণার কথা জানাচ্ছি-

লক্ষ্মী পূজায় লক্ষ্মীসরা নামে পরিচিত যে মৃৎ সামগ্রীটি নির্মাণ করা হয় তার ক্রেতা প্রায় সম্পূর্ণভাবেই ফরিদপুর, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, ঢাকা এবং বিক্রমপুরের মানুষ। এর বাইরে কিছু ক্রেতার বসবাস বরিশাল, যশোর, টাঙ্গাইল, নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জ (তুলনামূলকভাবে খুবই অল্প); উল্লিখিত অঞ্চলগুলোয় যত সংখ্যক লক্ষ্মীসরা উৎপাদিত হয় তা মিলিতভাবে ৭০-৮০ হাজারের বেশি নয়। অথচ পশ্চিমবঙ্গে শুধু নদিয়ার তাহেরপুর গ্রামেই চিত্রিত সরার উৎপাদন সংখ্যা ১ লাখ ২০ হাজার! মনে রাখতে হবে, পশ্চিমবঙ্গেও এই সরা ক্রয় করেন কেবল পূর্ববঙ্গের উল্লিখিত অঞ্চল সমূহ থেকে অভিবাসিত হয়ে যাওয়া পরিবারগুলো এবং একটি পরিবার প্রতি বছর লক্ষ্মী পূজায় কেবল মাত্র একটি সরাই ক্রয় করে থাকে। তাহেরপুর ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের পানিহাটি, দত্তপুকুর, উল্টোডাঙ্গা, হাবরা সহ আরও অনেক অঞ্চলেই লক্ষ্মীসরা নির্মাণ করা হয়। সুতরাং দেশত্যাগ করে চলে যাওয়া এবং দেশে থেকে যাওয়া মৃৎশিল্পীদের সংখ্যা যদি একত্র করে দেখার সুযোগ থাকত, তাহলে বাংলাদেশে মৃৎশিল্পের বর্তমান অবস্থাকে রীতিমতো ‘রমরমা’ই বলা যেত।
আবার একথাও সত্য যে, ক্রেতা সাধারণের চাহিদা ও রুচিতে কিছু পরিবর্তন, জীবনযাপনের ধরন-ধারণ বদলে যাওয়া ইত্যাদি কারণে অতীতের অনেক উন্নত শিল্পমান সম্পন্ন মৃৎসামগ্রী যেমন এখন আর তৈরি হয় না, তেমনি একই কারণে অনেক নিম্নমানের মৃৎ পণ্যেও বাজার ছয়লাব হয়ে গেছে। তবু আশার কথা এই, আমাদের ঐতিহ্যবাহী লোক ও কারুশিল্পের উৎকৃষ্ট নিদর্শনগুলোর সঙ্গে ক্রেতা সাধারণকে পরিচয় করিয়ে দিতে গত শতকের আশির দশক থেকেই কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান (নকশা কেন্দ্র বিসিক, বাংলা একাডেমি, সোনারগাঁর লোকশিল্প সংগ্রহশালা এবং পরবর্তীকালে জাতীয় জাদুঘর ও ক্রাফ্ট কাউন্সিল) নিয়মিতভাবে মেলার আয়োজন ও শ্রেষ্ঠ কারুশিল্পী পুরস্কার প্রদান করে যাচ্ছে। আর একটি আশাপ্রদ ঘটনা এই যে, ওইসব মেলায় দূর-দূরান্ত থেকে বয়ে আনা লোকশিল্প ও কারুসামগ্রী যথেষ্ট উচ্চমূল্যে খুব দ্রুত বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।
ঢাকার বড় বড় বুটিকগুলোতেও আজকাল সেই সব পণ্যই ক্রেতাদের বেশি আকৃষ্ট করছে, যেগুলোর আকৃতি এবং অলঙ্করণ আধুনিক হওয়া সত্ত্বেও আমাদের লোক ঐতিহ্যের কিছু বৈশিষ্ট্যকে মিশিয়ে নিতে পেরেছে (ঠিক যেমনটি ব্যান্ড সঙ্গীতের বেলাতেও লক্ষ করা গেছে)। এ ধরনের নবউদ্ভাবিত শিল্প-সামগ্রী ও কারুপণ্যের একটি বড় অংশই মৃৎশিল্প, যা আমাদের ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পের সেই আদি প্রসিদ্ধ কেন্দ্রগুলো থেকেই তৈরি হয়ে আসছে। এখানে যে বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষণীয় তা হচ্ছে- অতীতকাল থেকে যে অঞ্চলটি যে ধরনের তৈজস বা শিল্প সামগ্রী তৈরি করে খ্যাতি পেয়েছিল আজ শত শত বছর পর কলাকৌশলে, গড়ন ও অলঙ্করণে নানা রকম পরিবর্তন আসার পরও ওইসব কেন্দ্রই খ্যাতির শীর্ষে অবস্থান করছে। যেমন জেমস ফওন্স নর্টন ওয়াইজ (ঔধসবং ঋধহিং ঘড়ৎঃড়হ ডরংব) তার ১৮৮৩ সালে প্রকাশিত গ্রন্থ ‘ঘড়ঃবং ড়হ জবপবং, ঈধংঃবং ধহফ ঞৎধফবং ড়ভ ঊধংঃবৎহ ইবহমধষদ-এ লিখেছেন, ‘গোটা পূর্ববঙ্গে ঢাকার রায়েরবাজারের কুমারদের কাজ প্রসিদ্ধ।… মাটির কাজের জন্য ত্রিপুরার বিজয়পুরও (বর্তমানে কুমিল্লার বিজয়পুর) প্রসিদ্ধ। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আজ প্রায় ১৩০ বছর পরও এ দেশে মরণচাঁদ পাল কিম্বা সুভাষ পালের মতো অতুলনীয় মৃৎশিল্পীদের ঠিকানা সেই রায়েরবাজারই (যদিও তাদের একজন পরলোকগত এবং একজন দেশত্যাগী। আর রায়েরবাজার অঞ্চলে এখন একটি কি দুটি মাত্র পরিবার মৃৎশিল্পে যুক্ত)। মৃৎশিল্পের প্রাচীন কেন্দ্র বিজয়পুরের আধুনিক মৃৎপাত্রের খ্যাতিও এখন দেশের সীমানা পেরিয়ে সুদূর ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত।
ইংল্যান্ডে ভারতীয় পণ্যের প্রদর্শনী উপলক্ষে ১৮৮৮ সালে ত্রৈলক্যনাথ মুখোপাধ্যায় ‘অৎঃ সধহঁভধপঃঁৎবং ড়ভ ওহফরধ’ নামক যে গ্রন্থটি রচনা করেন, তাতে চিত্রিত মৃৎপাত্রের মধ্যে উৎকৃষ্ট হিসেবে বিবেচনা করে যে মৃৎপাত্রকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন তা হচ্ছে রাজশাহীর শখের হাঁড়ি। খুবই আশ্চর্যের বিষয়, আজ শতাধিক বছর পরও হাঁড়ি চিত্রণে শ্রেষ্ঠ শিল্পী ওই রাজশাহীরই সুশান্ত পাল। ২০০০ সালে বৃহদাকার মৃৎপাত্র ‘মটকা’ বা ‘জালা’ তৈরি করে যিনি শ্রেষ্ঠ কারুশিল্পী পদক লাভ করেছিলেন (জহর পাল) তিনি সেই স্মরণাতীতকাল থেকে জালা নির্মাণে প্রসিদ্ধ গ্রাম কার্ত্তিকপুরেরই সন্তান। এই কার্ত্তিকপুরকেই ফরিদপুরী রীতির লক্ষ্মীসরা নির্মাণের আদিকেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করে ১৯৮৪ সালে তোফায়েল আহমেদ এই গ্রামের হেরেম্ব পালকে শ্রেষ্ঠ সরাশিল্পী হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। সেই হেরেম্ব পালেরই পুত্র বিমল পাল এখনও কালে-ভদ্রে যে দু-একটি সরা আঁকেন তার তুলনা গোটা বাংলা অঞ্চলেই নেই। ঢাকার নবাবগঞ্জ-বান্দুরা অঞ্চলের জয়পাড়া নিকটবর্তী পালপাড়ার রঙবিলাসী পাল গত দু-তিন যুগ ধরে খুবই পাতলা, হালকা এবং নিখুঁত আকৃতির যে মৃৎপাত্রগুলো তৈরি করছেন তা নিঃসন্দেহে জয়পাড়ার মৃৎশিল্পের অতীত সুনামকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম। রঙবিলাসী পালের আঁকা সরাগুলো একদিকে যেমন সারা বাংলার একমাত্র চালচিত্র সমৃদ্ধ লক্ষ্মীসরা (ইদানীং অবশ্যই এই সরার অনুকরণে অন্য অঞ্চলেও কিছু নিম্নমানের সরাও হচ্ছে), তেমনি এই সরায় রঙ-রেখার চমৎকার প্রয়োগ দেখে দীনেশ চন্দ্র সেন এবং গুরুসদয় দত্তের সঙ্গে সহমত পোষণ করে স্বীকার করতেই হয় যে, আজও বাংলার রমণীরা চিত্রাঙ্কন দক্ষতায় পুরুষ শিল্পীদের সমতুল্য, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে আরও উত্তম।
মৃৎপাত্র নির্মাণ এবং চিত্রণ- এই দুটো কাজেই নারী ও পুরুষরা সমানভাবে অংশগ্রহণ করেন কালিয়াকৈর, আশুলিয়া, ধামরাই, মানিকগঞ্জ, বিক্রমপুর, নবাবগঞ্জ, রাজবাড়ী, ভাঙ্গা, কার্ত্তিকপুর, সিড্ডা, গৈলা, স্বরূপকাঠি, চাউলাকাঠি ইত্যাদি অঞ্চলে। এসব অঞ্চলের চিত্রিত মৃৎপাত্রগুলো হচ্ছে লক্ষ্মীসরা, মনসাঘট, নাগঘট, লক্ষ্মীঘট, মঙ্গলঘট, এয়োসরা প্রভৃতি। এ ছাড়া নানা ধরনের চিত্রিত পুতুলগুলোতেও নারী মৃৎশিল্পীদের আঁকা-গড়ার দক্ষতা প্রকাশ পায় (বিশেষ করে রাজবাড়ী, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, মির্জাপুর, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চলে)। তবে ময়মনসিংহ অঞ্চলের টেপা পুতুলগুলোতে অঙ্কন দক্ষতার বিশেষ পরিচয় ধরা না পড়লেও দেহের গড়নের অন্তর্নিহিত জ্যামিতিকে অনুসরণ করে রূপের সংক্ষেপিত উপস্থাপনায় দৈনন্দিন জীবনের নানা কর্মকান্ডভিত্তিক দেহভঙ্গিগুলোকে (শিশু লালন-পালন, মসলা পেষা, চুল বাঁধা ইত্যাদি) কেবল আঙুলে টিপে অতিদ্রুত নিমার্ণ করে ফেলার মাধ্যে যে মুন্সিয়ানা ও রসবোধের পরিচয় পাওয়া যায়, তা এক কথায় অতুলনীয় বা বিস্ময়কর। একসময় ধারণা করা হয়েছিল, এ ধরনের টেপা পুতুল ক্রমেই লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এ ধারণাটিই সম্ভবত আংশিক সত্য, কেননা বেশকিছু বিষয়বস্তু তথা ভঙ্গি ও আয়োজন এখন আর টেপা পুতুলে দেখতে পাওয়া যায় না। হাতের কাজের মানকেও আর ততটা উৎকৃষ্ট বলা যায় না। তবু আশার কথা এই যে, আজও ঈদ, মহররম, দুর্গাপূজা আর পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে ময়মনসিংহ ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলগুলোতে ছোট-বড় যেসব মেলাগুলো হয় তাতে সাধারণ মানুষের জন্য প্লাস্টিকের পুতুলের তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যক টেপা পুতুলই দেখতে পাওয়া যায়। ক্রেতারাও কিন্তু ছাঁচে তৈরি প্লাস্টিকের পুতুলের মতো একচেহারার পুতুল থেকে যে কোনো একটি পুতুল তুলে নিয়েই সন্তুষ্ট হন না; বরং টেপা পুতুলগুলো প্রতিটি আলাদা আলাদাভাবে হাতে তৈরি হওয়ার কারণে প্রত্যেকটির মধ্যে যে কিঞ্চিৎ স্বাতন্ত্র্য তৈরি হয় তা ভালোভাবে পরখ করে, পছন্দমাফিক (বেশ কয়েকটি) বাছাই করে নেন। অনেক ক্ষেত্রে দক্ষ হাতের কাজ আকৃতিতে ছোট হলেও রসিক ক্রেতারা তা বেশি মূল্যে ক্রয় করতেও দ্বিধা বোধ করেন না। এই রসিক ক্রেতারাই আমজনতার লোকশিল্পকে এত রসালো ও হৃদয়গ্রাহী করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় অনুপ্রেরণার জোগান দিচ্ছেন।
বাংলাদেশের মৃৎশিল্পের বহুকিছু নিয়ে আমরা যেমন এখনও আশাবাদী, তেমনি কিছু কিছু দিক এতটাই উদ্বেগজনক যে, ঠিক এই মুহূর্তে পর্যাপ্ত উদ্যোগ নেওয়া না হলে হাজার বছরে গড়ে ওঠা আমাদের মহামূল্যবান ঐতিহ্যের অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান চিরদিনের মতো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এই আশঙ্কার তালিকায় এ মুহূর্তে ‘এসওএস’ পর্যায়ে রয়েছে রাজশাহীর শখের হাঁড়ি, যা উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ ঐতিহ্য পোড়ামাটির ফলকচিত্রের মতোই করুন পরিণতি লাভ করবে। শখের হাঁড়ির ঐতিহ্যটি বিরাট অঞ্চলজুড়ে বিস্তার লাভ করেছিল। নওগাঁ, রাজশাহী এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে গড়ে ওঠা এ ঐতিহ্য যে খুবই প্রাচীন তার প্রমাণ আমরা নানাভাবে পেয়েছি। শখের হাঁড়ি শুধু লোক ঐতিহ্যই নয়, এ হচ্ছে সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্যর প্রতীক। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিনির্ভর লোকসমাজে লক্ষ্মী এবং সরস্বতীর যে জনপ্রিয়তা একসময় হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ সব সম্প্রদায়েই বিরাজ করত, তা এই হাঁড়ির জমিনের রঙ (একটি সাদা এবং অন্যটি হলুদ) এবং উৎকীর্ণ মটিফগুলো (মাছ, হাঁস, পদ্মফুল, চিরুনি, সিঁদুরের কৌটা, ধানের মঞ্জরি ইত্যাদি) অনুশীলন করলে নিশ্চিত হওয়া যায়। গত শতকের আশির দশকেও ওইসব অঞ্চলে অসংখ্য কুম্ভকার এই হাঁড়ি নির্মাণ ও চিত্রণের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। নব্বই দশকের শেষভাগ পর্যন্ত চাঁপাইনবাবগঞ্জের বারোঘরিয়া থেকে আমার ঘনিষ্ঠজনেরা শখের হাঁড়ি এনে দিতেন। শখের হাঁড়িকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ক্রেতারা বলতেন রঙ্গের পাতিল বা শিকার হাঁড়ি; আর নক্সাবহুল ছোট খেলনা-হাঁড়িগুলোকে বলতেন চুকাই। সম্প্রতি ক্ষেত্র অনুশীলন করে বিস্মিত হলাম এই তথ্য পেয়ে যে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে গড়ে ওঠা সেই শখের হাঁড়ি বা শিকার হাঁড়ির ঐতিহ্যটির শতভাগ পৃষ্ঠপোষক ছিল বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ। ৮-১০ বছর আগেও এই হাঁড়ি প্রচুর পরিমাণে তৈরি হতো মূলত ঈদের জামাত এবং ঈদ উপলক্ষে জমে ওঠা মেলাগুলোকে উদ্দেশ্য করে। ঈদের নামাজ শেষে মুসল্লিরা ঘরে ফিরতেন রঙিন শিকায় ঝুলানো, শখের হাঁড়ি হাতে নিয়ে। তা ছাড়া মেয়ের বিয়েতে উপঢৌকন বহন করতে কিংবা বিবাহিত মেয়েকে দেখতে যাওয়ার কালে মিষ্টি বা যে কোনো শৌখিন দ্রব্যে পরিপূর্ণ একটি শিকায় ঝোলানো শখের হাঁড়ি বহন করা ছিল পিতার জন্য অপরিহার্য কর্তব্য। সেই চাঁপাইনবাবগঞ্জ আজ সম্পূর্ণভাবেই শখের হাঁড়ি শূন্য।

লেখক :
নিসার হোসেন, চিত্রশিল্পী এবং অধ্যাপক, চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

Leave a comment