ড. সুমনা দত্ত

বীরভূম লাগোয়া ঝাড়খন্ড সীমান্তে একটি বর্ধিষ্ণু কৃষিপ্রধান গ্রাম মূলুটি। দেবী মৌলিক্ষা এই গ্রামের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। সারা বীরভূম জুড়েই তন্ত্রযানের প্রভাব অতি প্রবল। হিন্দু তন্ত্রযানের সঙ্গে বৌদ্ধ তন্ত্রযানও এখানে সক্রিয় ছিল। অনুমান করা হয়, বৌদ্ধ তান্ত্রিক দেবী পান্ডরা-ই পরবর্তীকালে হিন্দু তান্ত্রিক দেবী মৌলিক্ষারূপে পরিচিত হয়েছেন। কয়েক কিলোমিটার দূরে তারাপীঠে দেবী তারাও বৌদ্ধ তান্ত্রিক দেবী তারার সঙ্গে মিশে গেছেন। বাংলার মন্দির নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন তাঁদের কাছে মূলুটি একটি অতি পরিচিত নাম, কারণ এইটুকু ছোট্ট গ্রামে এতগুলো পোড়ামাটির মন্দিরের সমাবেশ আর বিশেষ কোথাও দেখা যায় না। ৭২টি মন্দিরের কয়েকটির অবস্থা খারাপ হয়ে গেলেও বেশীরভাগ মন্দির ভালো অবস্থাতেই আছে। এই ৭২টি অপরূপ মন্দিরই আমাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল ঐ গ্রামে। বেশ সম্পন্ন গ্রাম। ইতিউতি পাকা বাড়ি দাঁড়িয়ে থাকলেও বেশীরভাগ বাড়িই মাটির। অনেকগুলি দোতলা মাটির বাড়িও আছে। অগ্রহায়ণ সংক্রান্তির আগের দিন বেলাবেলি আমরা যখন গ্রামে ঢুকলাম তখন গ্রামের সংকীর্ণ রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে সার সার ধান বোঝাই গোরুর গাড়ি। মাটির রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ছে ঝরা ধানের শীষ। আর আমার শহুরে ঘ্রাণকোষ ভরে উঠছিল সোনালি হৈমন্তি ধানের সুগন্ধে।
দুধের সরের মতো কুয়াশা ছিঁড়ে সূর্যের আলো ফোটার আগে থেকে গ্রামের গৃহপ্রাঙ্গনগুলি গোবোরের প্রলেপ দিয়ে নিকিয়ে পরিস্কার করে নেওয়া হয়েছে। আজ ইতু পুজো। কার্তিক সংক্রান্তির শেষ দিনে একটি মাটির সরায় পঞ্চশষ্য, পঞ্চমটর, হলুদ, মানকচু, সরষে, শুষনী, ধান পোঁতা হয়। মাঝখানে বসানো হয় একটি ঘট। একমাস ধরে ইতুব্রত উদযাপন করা হয় এবং প্রত্যেক রোববার পুজো করে অগ্রহায়ণ সংক্রান্তির দিন সরাটি ভাসিয়ে দিয়ে ঘট নিয়ে চলে আসা হয়। ইতু পুজোর কথায় পাই –
অষ্টচাল অষ্টদূর্বা কলসপাতের থুইয়ে।
শুনো এক মনে ইতুর কথা সবে প্রাণ ভরে।।
ইতু দেন বর।
ধনধান্যে পুত্রপৌত্রে বাড়ুক তাদের ঘর।।
কাঠিকুটি কুড়োতে গেলাম ইতুর কথা শুনে এলাম।
একথা শুনলে কি হয়।
নির্ধনের ধন হয়।।
অপুত্রেও পুত্র হয়।
অশরণের শরণ হয়।।
অন্ধের চক্ষু হয়, আইবুড়োর বিয়ে হয়, অন্তিমকালে স্বর্গে যায়।।
সরা ভর্তি গাছ এবং বীজ, একমাস ধরে জল ও পরিচর্চা পেয়ে ফনফনিয়ে বেড়ে ওঠে। এই ইতুর সরা মূলতঃ একটি কৃষিক্ষেত্রেরই প্রতীক। গোলাকার মাটি ভর্তি সরা ধরিত্রীর ক্ষুদ্ররূপ এবং সরায় উদ্গত শাক ও শস্যসম্ভার উদ্ভিদ জগতের উর্বরতার প্রকাশ। এ যেন শস্যে পরিপূর্ণ ক্ষেত্রভূমির ক্ষুদ্র প্রতিরূপ তৈরী করার প্রয়াস। এটি একপ্রকার সাদৃশ্যমূলক যাদুক্রিয়া যেখানে মানুষ যা কামনা করে তার একটি ক্ষুদ্র প্রতিরূপ তৈরী করে এবং মনে করে সেটি বাস্তবেও সংঘটিত হবে। এই সাদৃশ্যমূলক যাদুক্রিয়ার আদিরূপ পাওয়া যায় পুরা প্রস্তর যুগের গুহাচিত্রে। আদিম যুগের মানুষরা গুহার অগম্য অন্ধকারে পশুর ছবি আঁকতেন এবং সেই অঙ্কিত পশুর গায়ে অস্ত্র ছুড়ে তাকে বধ করার অভিনয় করতেন এবং মনে করতেন বাস্তবেও এইভাবে বিশালকায় পশুগুলি বধ করতে সক্ষম হবেন। মানব সংস্কৃতিতে সাদৃশ্যমূলক যাদুক্রিয়ার সূত্রপাত এখান থেকেই যার উত্তরাধিকার বিভিন্ন ব্রতগুলি এখনও বহন করে চলেছে।
সাদৃশ্যমূলক যাদুক্রিয়ার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হল বসুধারা ব্রত। এই ব্রতে তুলসীগাছের ওপর একটি ছিদ্রযুক্ত জলভর্তি ঘট ঝুলিয়ে দেওয়া হয় যেখান থেকে টপটপ করে জল তুলসীগাছের ওপর পড়তে থাকে। এই ব্রতটি পালন করা হয় চৈত্র সংক্রান্তির দিন থেকে বৈশাখ মাসের শেষ দিন পর্যন্ত। চৈত্র ও বৈশাখে বৃষ্টিহীণ রৌদ্রতপ্ত ধরিত্রী শুষ্ক হয়ে ওঠে। সমস্ত উদ্ভিদ জগৎ জলের অভাবে অস্তিত্ব সংকটে পড়ে। এই ফোঁটা ফোঁটা জল বৃষ্টি পতনের আকাঙ্খারই ক্ষুদ্ররূপ, যাতে ধরিত্রী পুনরায় শস্য শ্যামল হয়ে ওঠে। ব্রতর পাঁচালীতে শস্য ও বৃষ্টি কামনার চিত্রটি সুস্পষ্টভাবে পরিস্ফুট –
বট আছেন, পাকুড় আছেন, তুলসী আছেন পাটে।
বসুধারা ব্রত করলাম তিন বৃক্ষের মাঝে।
মায়ের কুলে ফুল, বাপের কুলে ফল, শ্বশুরের কুলে তারা।
তিন কুলে পড়বে জলগঙ্গার ধারা।
পৃথিবী জলে ভাসবে, অষ্টদিকে ঝাঁপুই খেলবে।
যে সময় ধরে ইতুপুজো হয় সে সময়েই কুমারী মেয়েরা সেঁজুতি ব্রত করে। সেঁজুতি ব্রতের আলপনায় বাহান্নটা ঘরে বাহান্নটি ছবি পিটুলি দিয়ে আঁকতে হয়। এগুলি হল – জলভরা ঘট, শিব, দোলা, কোঁড়া, বেগুনপাতা, শরগাছ, বেনাগাছ, বাঁশের কোড়া, গঙ্গা যমুনা, সুপুরি গাছ, চন্দ্র-সূর্য্য, হাট ঘাট, গোয়াল, অশত্থগাছ, বঁটি, খ্যাংরা, শিবমন্দির, লতাপাতা, নাটমন্দির, পাকা পান, ত্রিকোনা প্রদীপ, হাতে ছেলে কাঁখে ছেলে, ঢেঁকি, খাট পালঙ্ক, গহনা প্রভৃতি। ব্রতী প্রত্যেকটি ছবিতে হাত দিয়ে দূর্ব্বা দিয়ে সেই ছবিটির জন্য নির্দিষ্ট মন্ত্র বলে। যেমন, গহনার ক্ষেত্রে গহনার প্রত্যেকটির নাম নিয়ে বলে –
আমি দি পিটুলির বালা।
আমার হোক সোনার বালা।।
আমি দি পিটুলির নথ।
আমার হোক সোনার নথ।।
হাতে ছেলে কাঁখে ছেলের ছবিতে হাত রেখে বলে –
হাতে পো কাঁখে পো।
পৃথিবীতে আমার যেন না পড়ে লো।।

সেঁজুতি ব্রতে নারীদের কামনা এবং সমসাময়িক সমাজচিত্র খুব ভালোভাবে ফুটে উঠেছে। উপরের পঙতিদুটি সাদৃশ্যমূলক যাদুক্রিয়ার সুস্পষ্ট উদাহরণ। পিটুলি দিয়ে আঁকা মনোমত অলঙ্কার বাস্তবে যাতে স্বর্ণালঙ্কারে রূপান্তরিত হয়-সেঁজুতি ব্র্রত সেই কামনাই করে নারীরা। ঘরভরা সন্তান প্রতিটি নারীর কামনা, যার প্রতিফলন ঘটে হাতে ছেলে কাঁখে ছেলের ছবিতে। এই ব্রতে মানব কামনার মৌলিকরূপটি ধরা পড়েছে। নারীরা যা চায়, যা তীব্রভাবে কামনা করে তাই সেঁজুতি ব্রতে ংুসঢ়ধঃযবঃরপ সধমরপ নির্মাণ করে।

ব্রততে মানুষ মূলতঃ যা চায় তারই ক্ষুদ্ররূপ নির্মিত হয়। ব্রতকথা তার হধৎৎধঃরড়হ, ব্রতের আলপনা তার চিত্ররূপ এবং ব্রতের উপাচার সেই কামনার প্রতিচ্ছবি। কখনও কখনও ব্রতকথার সম্পূরক হিসাবে নাচ, গানও থাকে। এই সব কিছু মিলিয়েই পূর্ণাঙ্গ ব্রত। কিন্তু অনেক সময়ে দেখা যায় ব্রতর প্রতিটি অঙ্গ পরস্পরের সঙ্গে সাযুজ্যযুক্ত নয়। সেঁজুতি বা বসুধারা ব্রতে, ব্রতের কথা, আলপনা বা উপাচার কামনার সঙ্গে মিলে যায়। কিন্তু ইতু ব্রতে এটি সুসম্পর্কিত নয়। ইতুর উপাচার দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় এটি মূলতঃ শস্য কামনার ব্রত। কিন্তু শাস্ত্রজ্ঞরা এটিকে সূর্য্য দেবতার পুজো বলে মনে করেন। এই কারণে ইতু ব্রত রবিবার রবিবার পালিত হয়। শস্যের সঙ্গে সূর্য্যের সম্পর্ক সুপ্রাচীন। কিন্তু ব্রতকথায় না আছে সূর্য্যের কথা না আছে শস্যের কথা। উমনো ঝুমনো নামের দুটি চরিত্রের কথা এই ব্রতকথায় বলা হয়েছে। এই ব্রতকথার সঙ্গে এই দুটি চরিত্রের সম্পর্ক ধূসর। এই গল্পে ধরিত্রীর উর্বরতা, শস্য বা সূর্য্যের কোন সম্পর্কই খুঁজে পাওয়া যায় না, যা প্রকৃত ব্রতের স্বভাববিরুদ্ধ। এই কারণেই মনে হয় আদি ইতু ব্রতর কথা পরিবর্তিত হয়ে এই প্রক্ষিপ্ত গল্পটির আগমন ঘটেছে।

মূলুটী গ্রামের ইতুর আলপনা খুবই জাঁকজমকপূর্ণ এবং বিস্তারিত। প্রতিটি গৃহস্থ বাড়ীর প্রশস্ত উঠোনে আতপ চাল বাটা সাদা পিটুলি দিয়ে আলপনা দেওয়া হয়। এখানে কিন্তু ইতু, লক্ষ্মীরূপেই সমাদৃতা, যিনি শস্য প্রজননের দেবী। ইতুর সরার পাশে রাখা থাকে খড়সুদ্ধ পাকা ধানের একটি বড় আঁটি, যা লক্ষ্মীস্বরূপা। ইতুর আলপনার মূল সড়ঃরভ এখানে ধানের ছড়া লক্ষ্মীর পদচিহ্ন। বাড়ির বাইরে থেকে ধানের ছড়া ও লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ ঢোকে গৃহপ্রাঙ্গনে যেখানে ইতুর সরা রাখা থাকে এবং সেখান থেকে আলপনা প্রসারিত হতে থাকে গৃহস্থের ধানের গোলা, পাকশালে, গোয়ালঘরে, হাঁস-মুরগীর খামারে, অস্থায়ী গোলায় ও অন্যান্য ঘরগুলিতে। আলপনাটি যেন একটি ম্যাপের মতো, যা লক্ষ্মীকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে। একটা দিক থেকে অন্য দিক পরিবর্তন করার স্থানে একটি গোলাকৃতি সড়ঃরভ আঁকা হয় ঠিক যেন ৎড়ধফ পৎড়ংংরহম-এর মতো পথ নির্দেশ করে। ধূসর মাটির ওপর সাদা আলপনার পথ ধরে লক্ষ¥ীএগিয়ে চলেন গৃহস্থের প্রাঙ্গনের প্রতিটি কোনে। কার্তিক মাসের শেষ থেকে অগ্রহায়ণ মাস জুড়ে কাটা হয় সোনার ধান। এখানে লক্ষ্মী যেন ইতুরূপে গৃহস্থের সমৃদ্ধি দেখতে আসেন এবং গৃহকর্তী বাউনী দিয়ে তাঁকে বেঁধে ফেলেন।
কৃষিপ্রধান মূলুটী গ্রামে ইতুপুজো খুব ভক্তি ভরে পালিত হয়। বিশাল গৃহ প্রাঙ্গনগুলি সেজে ওঠে আলপনায়। সারা প্রাঙ্গন জুড়ে আলপনা দেওয়ার জন্য বাড়ীর একাধিক নারীরা অংশগ্রহণ করে। ব্রতের কথা যাই হোক না কেন এখানে ইতুব্রত কিন্তু শস্য উদ্গমের উৎসব হিসাবেই পালিত হয়। একই সঙ্গে এই ব্রত সংরক্ষণ করে উদ্ভিদ জগৎ। লোকাচার বাঁচিয়ে রাখে প্রাণের প্রবাহমানতা। অবলুপ্ত হয়না উদ্ভিদের প্রজাতিগুলি। ব্রতর মাধ্যমে বেঁচে থাকে তারা।

Leave a comment