সাইমন জাকারিয়া
বাংলাদেশের ফোকলোর চর্চার ইতিহাসে মোহাম্মদ সাইদুর একজন সাধক-সংগ্রাহক হিসেবে অনন্য ভূমিকা রেখে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন পর্যন্ত অধিকাংশ মনীষী বাংলার ফোকলোর বলতে যেখানে শুধু গ্রামীণ সংগীতের ধারা তথা বাউলগান, মুশির্দি-মারফতি গান, মেয়েলিগীত ইত্যাদি এবং তার অন্তর্গত জ্ঞান, সাধনা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের বিশ্লেষণের ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। অবশ্য, এ কথাও বলে রাখা ভালো যে রবীন্দ্রনাথের আগ্রহের সঙ্গে বাংলার ছড়া, রূপকথা, নাট্যপালার পরিবেশনা, লোকশিল্প ও গ্রামীণ জীবনের নানা বিষয় যুক্ত ছিল; দীনেশচন্দ্র সেন ও চন্দ্রকুমার দে থেকে ক্ষিতিশচন্দ্র মৌলিক প্রমুখের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল আখ্যান-গীতির ধারা, তাঁদের ভাষায় ‘গীতিকা’, ‘পল্লীগাথা’ বা ‘পালাগান’; অন্যদিকে কবি জসীমউদ্দীনের মূল আগ্রহ ছিল গ্রামীণ সংগীত ও নাট্যপালার দিকে, গুরুসদয় দত্তের আগ্রহের বিষয় ছিল ‘পটুয়াসঙ্গীত’, বাংলার লোকনৃত্য ইত্যাদি এবং এমনকি উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কালের লোকজ্ঞান গবেষকদের মধ্যে শক্তিনাথ ঝা, সুধীর চক্রবর্তী, আবুল আহসান চৌধুরী প্রমুখ খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বদের প্রধান আগ্রহের স্থানে রয়েছে বাউল-সাধকদের জীবন ও সংগীত।
এই বিচারে মোহাম্মদ সাইদুর ছিলেন একেবারেই ব্যতিক্রম। তিনি জন্ম সূত্রে লোকজ্ঞানের প্রাণবন্ত ভুবনের অকৃত্রিম এক উত্তরাধিকারী হিসেবে অনেকটা স্বপ্রণোদিতভাবেই বাংলাদেশের বৈচিত্র্যময় ফোকলোর চর্চায় ব্রতী হন। একদিকে তিনি গ্রথিত করেছেন-বাংলাদেশের মৌখিক সংস্কৃতির কিচ্ছা, পালা, নাট্য, গীতি, কথা, পুথি, কাব্য, আখ্যান, ধাঁধা, প্রবাদ ইত্যাদি গ্রামীণ সাহিত্যের অমূল্য ভাণ্ডার। অন্যদিকে বস্তুগত সংস্কৃতির কাব্যিক আধার সূচিশিল্প, নকশীকাঁথা, শখের হাড়ি, টেপা পুতুল, কাঠের পুতুল, লোক অংলকার, কাগজ কাটা শিল্প, নকশী শিকা, কুটির শিল্পের প্রাচীন ঐতিহ্য বস্ত্রশিল্প ইত্যাদি; বাংলাদেশের কৃত্যমূলক ফোকলোর মুহররম, বেড়া ভাসান ইত্যাদি। এদেশের স্থানীয় লোকক্রীড়া, পেশাজীবী সম্প্রদায়ের পরিচয়, ব্যাঙ বিয়ে ও পুতুলের বিয়ে। এছাড়া, বাংলাদেশের মেলা ও উৎসবের প্রথম পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়নের ব্যাপারে নিঃসন্দেহে তিনিই পথিকৃৎ। এক্ষেত্রে, ইতিহাসের আলোকে বাংলার ফোকলোর গবেষণার ক্ষেত্রে মোহাম্মদ সাইদুরের ফোকলোর সংগ্রহের দুইটি বিশেষত্বের কথা উল্লেখ করা যায়-
১. তিনি বাংলাদেশের সামগ্রিক ফোকলোর চর্চার সংগ্রহের ব্যাপারে একনিষ্ঠ ছিলেন, এক্ষেত্রে খুব সম্ভবত তাঁর আগ্রহ ছিল বাংলাদেশের ফোকলোর চর্চার একটি সামগ্রিক ইতিহাস প্রণয়ন,
২. মোহাম্মদ সাইদুরের ফোকলোর সংগ্রহের পদ্ধতি আধুনিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক, কেননা তিনি তাঁর সংগ্রহের প্রায় সকল ক্ষেত্রে সংগ্রহ সম্পর্কিত সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বস্তগত সামগ্রিক তথাদি প্রদান করেছেন, যার ওপর ভিত্তি করে মোহাম্মদ সাইদুর সংগৃহীত ফোকলোর উপাদানের একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস রচনা করা সম্ভব। এছাড়া, ব্যক্তিগতভাবে তাঁর এলাকায় জনসংস্কৃতি সমীক্ষণে গিয়ে প্রত্যক্ষ করেছি যে মোহাম্মদ সাইদুর তাঁর ফোকলোর সংগ্রহের মাধ্যমে আরেকটি খুবই গুরুত্বপূণ কাজ সম্পন্ন করেছেন, যার প্রভাব আজো তাঁর জন্মস্থান বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে রয়ে গেছে। কেননা, তিনি যেসব শিল্প ও সাধকদের কাছ থেকে সরাসরি গান, কিচ্ছা, পুথি ইত্যাদি সংগ্রহ করেছিলেন, তাঁরা মোহাম্মদ সাইদুরের সংগ্রহ পদ্ধতিতে এতোটাই আবিষ্ট হয়েছিলেন যে এখনো উক্ত অঞ্চলের মানুষ তাঁদের নিজের ঐতিহ্য রক্ষা ও চর্চার ব্যাপারে অত্যন্ত সক্রিয় রয়েছেন।
একথা বলতে দ্বিধা নেই, বাংলাদেশের অন্তত তিনটি জাদুঘর তথা- বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মোহাম্মদ সাইদুরের সংগ্রহে অনেকটাই সমৃদ্ধ হয়েছে। এর বাইরে বাংলা একাডেমীর লোকঐতিহ্য সংগ্রহশালা খুব সম্ভবত মোহাম্মদ সাইদুরের সংগ্রহের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছিল, বর্তমানে যার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর!
এবারের এই কৃর্তিমান ফোকলোরবিদ মোহাম্মদ সাইদুরের ব্যক্তিগত ও কর্মজীবনের অন্যান্য পরিচয় দেওয়া যাক। তিনি ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জ জেলার চরবগাতিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা কুতুবদ্দিন আহমদ ছিলেন একজন পুথি পাঠক ও লোকগীতি গায়ক। তিনি ১৯৫৬ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে একটি জারিগানের দল নিয়ে মওলানা ভাসানীর ডাকে ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনে যোগ দেন। কর্মজীবনের শুরুতেই মোহাম্মদ সাইদুর দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। নিজ জেলার সংবাদ পরিবেশনের সময় তিনি চন্দ্রকুমার দে’র মতো নিজ অঞ্চলের লোকসংস্কৃতির পরিচয় প্রদান করতে শুরু করেন। এরপর ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বাংলা একাডেমীর সংগ্রাহক হিসেবে কাজ শুরু করেন। চাকরিরত অবস্থায় ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এস.এস.সি. পাস করেন। বাংলা একাডেমীর চাকরি জীবনে তিনি অঞ্চলের বাইরে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে গিয়ে গান, কবিতা, কাহিনী, কিচ্ছা, নাট্যপালা, পুথি ও লোকজীবনের অন্যান্য উপাদান সংগ্রহের সুযোগ গ্রহণ করে। একই সঙ্গে বাংলা একাডেমী থেকে তাঁর সংগ্রহ ও সংকলনের ওপর ভিত্তি করে প্রকাশিত হতে থাকে বেশ কিছু গ্রন্থ, যেমন- জামদানি এবং বাংলা একাডেমী ফোকলোর সংকলন-এর তিনটি খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত “পালাগান”, “বেড়াভাসান”, “মুহররম অনুষ্ঠান”। এছাড়া, দেশে-বিদেশের পত্র-পত্রিকায় তাঁর শতাধিক প্রবন্ধ, নিবন্ধ, প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা একাডেমীতে এবং ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে শিল্পকলা একাডেমীতে তাঁর সংগৃহীত নিদর্শন প্রদর্শিত হয়েছে। ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপেল আর্ট গ্যালারিতে তাঁর সংগৃহীত লোকশিল্প নিদর্শনের প্রদর্শনী হয়। বাংলা একাডেমী থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে যোগ দেন, সেখানে তিনি আমৃত্যু কর্মরত অবস্থায় ছিলেন। একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মীর প্রতি শ্রদ্ধায় ও কৃতজ্ঞতায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মোহাম্মদ সাইদুরের তিরোধানের মাত্র এক মাসের মাথায় ২০-৩০ এপ্রিল ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে “মোহাম্মদ সাইদুর স্মরণ”-এর অংশ হিসেবে তাঁর সংগৃহীত “লোকঐতিহ্য প্রদর্শনী : কাঁথা” শীর্ষক শিল্পকর্ম প্রদর্শন করে।
বিভিন্ন জাদুঘর ও প্রতিষ্ঠানে অকাতরে নিজের সংগ্রহ বিলিয়ে দিয়েও মোহাম্মদ সাইদুর বোধ করে শেষ পর্যন্ত এদেশের শিল্পকর্মের যথার্থ সম্মান প্রদর্শন প্রত্যক্ষ করতে পারেননি, অথবা নিজের সংগ্রহের যথার্থ প্রদর্শনী কোথাও দেখে খুশী হতে পারেননি। তাই তিনি এক পর্যায়ে নিজের বাড়িতেই প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন এদেশীয় লোকশিল্পের একটি পূর্ণাঙ্গ ও ব্যতিক্রমী সংগ্রহশালা। সেই লক্ষ্যে বিশ্ববিখ্যাত ফোকলোরবিদ ও আমেরিকার ফোকলোর গবেষক হেনরি গ্লাসিকে দিয়ে নিজের বাড়িতে উদ্বোধন করান একটি ‘লোকশিল্প সংগ্রহশালা’। কিন্তু বিধি বাম, ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের ৪ মার্চ মোহাম্মদ সাইদুর আকস্মিকভাবে প্রাণ হারান। সম্প্রতি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তৎপরতায় বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের তত্ত্বাবধানে স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান পুনঃসংস্কারের কার্যক্রম চলছে। আমাদের বিশ্বাস, মোহাম্মদ সাইদুরের নামে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের ফোকলোরের বিকাশ ও বিস্তারে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।
লেখক : লোক গবেষক।