সাবিহা সুলতানা
আষাঢ়ের আগমনীতে মাঠ-ঘাট নির্মল-নিঘূর জল আবাহনীর গান গায়। শুরু হয় বর্ষা। বর্ষায় পানিতে ডুবে থাকা ফসলী জমি ও হাওড়-বাওড়ে দেখা যায় প্রকৃতি আর জলের উল্লাস নৃত্য। লক লক করে পানির নীচে ও উপরিভাগে জন্ম নেয় নানা জাতের উদ্ভিদ। এর মধ্যে পানির উপরিভাগে যা উপর থেকেই চাক্ষুস হয় এমন জলজ উদ্ভিদের মধ্যে আছে পদ্ম, শাপলা, বিভিন্ন জাতের ঘাস, কচুরিপানাসহ নানা উদ্ভিদ। এর মধ্যে শাক-সবজির আকালী বর্ষায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিল প্রধান এলাকায় শাপলা অন্যতম সবজি।
বর্ষার শুরুতেই ধানী জমি-হাওড়-বাওড়-বিলে শাপলা ও শাপলা জাতীয় জলজ উদ্ভিদ মাথা উচু করে দাড়ায়। মাটির নীচে থাকা শাপলা গাছের কন্দ থেকে বের হয়ে আসা শাপলা, বিস্তীর্ন এলাকা জুওে, পানির উপরিভাগে- ফুটে থাকে।
শাপলা ভাজি :
পানির নীচে মাটি থেকে পানির উপরিভাগ, এর মধ্যবর্তী অংশটুকু ডাটার মতো কেটে রসুন তেলে দিয়ে সেখানে ভেঁজে খাওয়া হয়। এছাড়া শাপলা মাছে তরকারি হিসেবে ও ব্যবহৃত হয়। সারা বর্ষা জুড়ে বিলের শাপলা তুলে গ্রাম বাংলার মানুষ রসনায় তৃপ্ত হয়।
শাপলা ভাজি রান্নার পদ্ধতি :
১। শাপলা (আবরন ছাড়িয়ে ছোট ছোট করে কেটে নিতে হবে) – পাঁচটি
২। রসুন কুচি – ২ কোয়া
৩। তেল – ২ চা চামচ
৪। লবন – পরিমান মত
চুলার আগুনে হাড়ি চড়িয়ে তেল দিতে হবে। তেল গরম হলে রসুন দিয়ে দিতে হবে। রসুন লাল হয়ে গেলে, কাটা শাপলা দিয়ে দিতে হবে। লবন দিয়ে ঢেকে ৫ মিনিট রেখে নেড়ে দিতে হবে। আরো ৫ মিনিট আচে রেখে নামিয়ে নিতে হবে।
হয়ে গেলো শাপলা ভাজি।
ঢেপ :
আষাঢ়-শ্রাবণ পেরিয়ে ভাদ্রে এসে অবশিষ্ট শাপলার ফুল ফুটে ঝড়ে গিয়ে সেখানে একটি ফল হয়। এই শাপলা ফলকে ঢেপ বলে। গ্রামে কৈশোরে ঢেপ একটি উৎকৃষ্ট ফল বা খাদ্য। ঢেপের চামড়া ছিড়ে, কোয়া কোয়া অংশে খাওয়া যায়। ঢেপ সাধারণত শুধু বিচির সমাহার।
এই ঢেপ পেকে ফেটে গেলে সেই বিচিগুলো সংগ্রহ করে শুকিয়ে খৈ ভাজা হয়। এক সময় ঢেপের খৈ ছিলো কিংবদন্তিতুল্য।
ঢেপের খৈ ভাজার পদ্ধতি :
১। চুলায় ঢালাই লোহার কড়াই গরম করতে হবে। (এছারা কড়াইতে বালি দিয়েও করা যায়)
২। গরম কড়াইতে অনবরত নাড়তে হবে।
বিচি গুলো ফুটে ফুটে সাদা হয়ে যাবে।
শালুক :
এবার শালুক। বর্ষায় গ্রামের কিশোর বয়সীরা নৌকা নিয়ে বিলের পানিতে শালুক তুলে। শাপলা গাছে শালুক হয় না। শালুকের গাছগুলো আলাদা। শালুক গাছের পাতা আকৃতিতে ছোট এবং খুবই বাহারী আকারের। প্রথমে বাহারী পাতা খুঁজে বের করা হয়। সেই পাতার ট্রেইল ধরে পানির নীচে নিঃস্বাস নিয়ে গাছের গোড়া খুঁজে বের করা হয়। কাঁদা মাটির নীচে গোড়া থেকে কন্দ বা শালুকটা তুলে আবার ভুস করে পানির উপরে উঠে আসতে হয়। গাছ শুদ্ধ শালুক উপরে তুলে শালুক থেকে পাতাও ডাটি গুলো হাতে মোচর দিয়ে ছিড়ে ফেলে দেয়া হয়। পাওয়া গেলো আস্ত একটা শালুক। এভাবে শালুকে হাড়ি বোঝাই করে তবেই বাড়ি ফিরে কিশোরদল। যার নিঃশ্বাস যত বড় সে তত বেশি শালুক সংগ্রহ করতে পারে।
শলুক সাধারণত পানিতে সিদ্ধ করে উপরের চামড়া ছাড়িয়ে খাওয়া হয়।
এছাড়া কাচা শালুক চামরা ছাড়িয়ে , জুলুপ দিয়ে মুড়ালি তৈরি হয়।
শলুক এর মুড়ালি তৈরির পদ্ধতি :
গোল গোল অথবা লম্বা লম্বা আকারে কেটে রোধে শুকাতে হবে।
হাড়িতে গুড় গরম করে সেখানে শুকানো শালুক গুলো দিয়ে নাড়তে হবে। লাল হয়ে গেলে নামিয়ে নিতে হবে।
এবার গরম থাকতেই, যে যেমন চাই আকার দিয়ে ঠান্ডা হতে দিতে হবে।
হয়ে গেলো জুলুপ শালুক।
লেখক : খাদ্য বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষক।