বাংলায় প্রাতিষ্ঠানিক ফোকলোর-চর্চার সূচনা-পর্ব

উদয় শংকর বিশ্বাস

সূচনা
বাংলার ফোকলোরের ইতিহাস ব্যাখ্যায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কিছু প্রতিষ্ঠানের কথা প্রথমে বলতে হয়। বিভিন্ন মনীষীদের শ্রমে গড়া প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলার ফোকলোর-চর্চার ধারাবাহিকতা ইতিহাস তৈরি করেছে। যদিও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বর্তমানে সীমিত। অল্প কিছু প্রতিষ্ঠান বর্তমানেসচল আছে। ব্রিটিশভারতে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহ ফোকলোরের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নেই বরং স্বাধীন ভারতে প্রতিষ্ঠিত সংগঠনগুলোই সচল আছে। যদিও ভারতের অন্য রাজ্যর তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক বেশি গবেষণামুখী এবং তা সর্বভারতীয় ফোকলোর গবেষণায় যথেষ্ট প্রভাব রাখছে। ফোকলোরকে ভারতে প্রথম পরিচয় করিয়েছে কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি। প্রতিষ্ঠানটির গবেষণামূলক পত্রিকায় ফোকলোর-নৃবিজ্ঞান-সমাজবিজ্ঞান সম্পর্কিত দেশি-বিদেশি লেখকদের প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। যদিও এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ইংরেজরা। অপরদিকে, বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়া প্রতিষ্ঠান ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ’-এর কার্যক্রম প্রথম দিকে ফোকলোরের জন্য অনেকটাই সহায়ক ছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ও ফোকলোর-চর্চায় জোরালো ভূমিকা রেখেছে।
এশিয়াটিক সোসাইটি
ভারতবর্ষে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ফোকলোর-চর্চার শুরু হয় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে। এশিয়ার অধিবাসীদের প্রাচীন সভ্যতা, কলা, বিজ্ঞান এবং সাহিত্যের ইতিহাস অনুসন্ধানের লক্ষ্যে কলকাতা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি উইলিয়াম জোনস্-এর উদ্যোগে ১৭৮৪ সালের ১৫ই জানুয়ারি কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়। জোনস্ ছিলেন প্রাচ্যবিদ্যার একজন অসাধারণ প-িত। ভাষা ও সাহিত্যে তাঁর প্রগাঢ় অনুরাগ ছিল। তিনি সংস্কৃত, লাতিন, আরবি, ফারসিসহ বেশ কয়েকটি ভাষা জানতেন। কালিদাসের অভিজ্ঞান শকুন্তলম ইংরেজিতে অনুবাদ করে যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছিলেন। ভারতের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস (১৭৩২-১৮১৮)-কে জোনস্ সোসাইটির প্রথম সভাপতি হওয়ার অনুরোধ জানান। কিন্তু হেস্টিংস সৌজন্যবশত তা প্রত্যাখ্যান করেন, তিনি বরং প্রতিষ্ঠানটির পৃষ্ঠপোষক হতে সম্মতি জানান। হেস্টিংসের অস্বীকৃতিতে অনেকটা বাধ্য হয়ে জোনস্ এশিয়াটিক সোসাইটির প্রথম সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রথম দশ বছর (১৭৮৪-১৭৯৪) একই পদে তিনি আসীন থাকেন। ইতিহাস বলে, প্রতিষ্ঠানটি প্রথমে ‘ঞযব অংরধঃরপশ ঝড়পরবঃুʼ নামে পরিচিত ছিল। বেশ কয়েকবার এর নাম পরিবর্তন হয়। ১৯৫১ সালে ‘ঞযব অংরধঃরপ ঝড়পরবঃুʼ নাম হয়। শুরুর দিকে এর সদস্যপদ ইংরেজদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। ১৮২৯ সালে ভারতীয়রা প্রথম সদস্য হন। বাঙালিদের মধ্যে সদস্যপদ লাভ করেন রসময় দত্ত (১৭৭৯-১৮৫৪), রামকমল সেন (১৭৮৩-১৮৪৪), দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৭৯৪-১৮৪৬), প্রসন্নকুমার ঠাকুর (১৮০১-১৮৬৮), হরময় দত্ত, শিবচন্দ্র সেন প্রমুখ ব্যক্তি। রামকমল সেন ১৮৩৩ সালে সোসাইটির প্রথম অ-ইংরেজ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এশিয়াটিক সোসাইটির বহুমুখী জ্ঞানচর্চা দু’টি কমিটির মাধ্যমে হতো। যার একটি ছিল বিজ্ঞান-বিষয়ক এবং অপরটি সাহিত্য-বিষয়ক। উইলিয়াম কেরি সাহিত্য-বিষয়ক কমিটির সদস্য ছিলেন। এই কমিটির মাধ্যমে ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস ও পুরাতত্ত্ব বিষয়ের চর্চা হতো। এশিয়াটিক সোসাইটিতে শুরু থেকেই গুরুত্ব পেয়েছে ভারতের সংস্কৃত, পালি, প্রাকৃত, আরবি ও ফারসি সাহিত্য। কিন্তু দেশজ ভাষাও যে অবহেলিত ছিল না, তার সাক্ষ্য বাংলা ভাষাচর্চায় পথিকৃৎ উইলিয়াম কেরির স্বীকৃতি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এশিয়াটিক সোসাইটি চারটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। আর তা হলো :
১. ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাতে লেখা পুঁথি, মুদ্রা, চিত্র, অনুশাসন, ভূতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, প্রাণিবিদ্যা প্রভৃতির নিদর্শন সংগ্রহ করা;
২. জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা;
৩. পাঠাগার স্থাপন এবং
৪. গবেষণামূলক পত্রিকা, বুলেটিন ও প্রসিডিংস প্রকাশ করা।
প্রতিষ্ঠানটি ফোকলোর-চর্চায় আজও এই চারটি বিষয়কে গুরুত্ব দিচ্ছে। ভারতীয় প্রাচীন ইতিহাস-সাহিত্য বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে সোসাইটি পাথর খোদাই লিপি, পুথি, হস্তশিল্প, পোড়ামাটির ফলক এবং দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহƒত নানা উপাদানের সন্ধান পায়। ১৭৯৬ সালে এসব বস্তুধর্মী সংগ্রহ নিয়ে এশিয়াটিক সোসাইটি তার নিজস্ব ভবনে একটি সমৃদ্ধ সংগ্রহশালা গড়ে তোলে। চিত্রকলা, প্রাচীন পুথি, মূর্তি, তাম্রশাসন, মুদ্রাসহ বস্তুধর্মী নানা জিনিসে সোসাইটির সংগ্রহশালা ধীরে-ধীরে গড়ে ওঠে। ১৮১৪ সালে সোসাইটির সংগৃহীত উপাদান নিয়ে কলকাতায় গড়ে তোলা হয় ভারতবর্ষের প্রথম জাদুঘর। সংগ্রহশালার প্রথম তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন ডেনমার্কের উদ্ভিদতত্ত্ববিদ নাথানিয়েল ওয়ালিক। এশিয়ার বৃহত্তম এই সংগ্রহশালা আজ সকলের কাছে ʻওহফরধহ ঘধঃরড়হধষ গঁংবঁসʼ নামে পরিচিত। ভারতীয় জাদুঘরে ‘শনির পাঁচালি’, ‘খনার বচন’, ‘ষষ্ঠী মঙ্গল’, ‘সত্যপীরের পাঁচালি’, ‘গঙ্গার পাঁচালি’, ‘চিকিৎসার জলপড়া’, ‘চিকিৎসার চাউল পড়া’, ‘শিবরাত্রীর ব্রতকথা’– এই আটটি ফোকলোর-সংশ্লিষ্ট পাঁচালি আছে। জাদুঘরে লোকশিল্পের বিশেষত শোলা, পাট, বয়নশিল্প, বাঁশের কাজের নিদর্শন সংরক্ষিত আছে। সংগৃহীত এসব উপকরণ সংগ্রহশালাটিকে সমৃদ্ধ করেছে। এ ছাড়া এশিয়াটিক সোসাইটির উদ্যোগেই ʻঅহঃযৎড়ঢ়ড়ষড়মরপধষ ঝঁৎাবু ড়ভ ওহফরধʼ, ʻএবড়ষড়মরপধষ ঝঁৎাবু ড়ভ ওহফরধʼ, ʻঝরাঢ়ঁৎ ইড়ঃধহরপধষ এধৎফবহʼ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানসহ বেশ কয়েকটি সারস্বত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়।
এশিয়াটিক সোসাইটির গ্রন্থাগারটি বেশ সমৃদ্ধ। এই গ্রন্থাগারে প্রায় ৪৭ হাজার পা-ুলিপি সংরক্ষিত আছে। এর মধ্যে অধিকাংশ দুর্লভ। এখানে হর্ষবর্ধনের সময়কার পা-ুলিপি যেমন আছে, তেমনি অতিদুর্লভ প্রজ্ঞাপারমিতার একটি পা-ুলিপি সংরক্ষিত আছে। এখানে প্রায় ১০ হাজার আরবি ও ফারসি ভাষার পা-ুলিপি আছে। এর মধ্য থেকে বাছাই করে কিছু পুথি অনুবাদ করা হয়েছে। বিশাল আকারের কাঠ খোদাই লিথোগ্রাম আছে প্রায় সাড়ে সাতশ। যদিও এই বিপুল সংগ্রহ এক দিনে গড়ে ওঠেনি। দেশি-বিদেশি অসংখ্য প-িতের শ্রমে গড়ে উঠেছে এশিয়ার অন্যতম সমৃদ্ধ এশিয়াটিক সোসাইটির গ্রন্থাগারটি। এটি এ অঞ্চলের মানুষের এগিয়ে যাওয়ার পথে আলোকবর্তিকা হিসেবে সব সময় ভূমিকা পালন কর আসছে। বাঙালি মনীষীদের মধ্যে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮৫৩-১৯৩১), যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি, যদুনাথ সরকার (১৮৭০-১৯৫৮), রমেশচন্দ্র মজুমদার (১৮৮৮-১৯৮০), সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় (১৮৯০-১৯৭৭), সত্যেন্দ্রনাথ বসু (১৮৯৪-১৯৭৪), চিন্তাহরণ চক্রবর্তী (১৯০০-১৯৭২), নির্মলকুমার বসু (১৯০১-১৯৭২), নীহাররঞ্জন রায় (১৯০৩-১৯৮১), বিনয় ঘোষ (১৯১৭-১৯৮০) প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ বিভিন্ন সময় সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
এশিয়াটিক সোসাইটির মুখপত্র হিসেবে ১৭৯০ সালে অংরধঃরপশ জবংবধৎপয নামে একটি গবেষণা পত্রিকা প্রকাশিত হয়। সম্পাদক ছিলেন উইলিয়াম জোনস্ নিজে। তাঁর সম্পাদনায় ১৭৯০, ১৭৯২, ১৭৯৪ এবং ১৭৯৭ সালে পত্রিকাটির চারটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। অল্প সময়ের মধ্যে পত্রিকাটি সুধীমহলে পরিচিতি লাভ করে। বিভিন্ন সময়ে এর বিন্যাসগত কিছু পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে এটি ঞযব ঔড়ঁৎহধষ ড়ভ ঃযব অংরধঃরপ ঝড়পরবঃু ড়ভ ইবহমধষ নামে সাহিত্য ও বিজ্ঞান- এই দুই ভাগে প্রকাশিত হচ্ছে। সাহিত্য শাখায় ফোকলোরের বিভিন্ন ধারা, যেমন : লোককাহিনী, লোকক্রীড়া, লোকভাষা, লোকচিকিৎসা, গীতিকা, বিশ্বাস-সংস্কার, উৎসব, আচার-অনুষ্ঠান, প্রবাদ, ধাঁধা, মন্ত্র, লৌকিক দেবদেবী ইত্যাদি বিষয়ে অসংখ্য প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া এর বিভিন্ন সংখ্যায় দেশি-বিদেশি লেখকদের আদিবাসী সংস্কৃতি নিয়ে শতাধিক প্রবন্ধ প্রকাশ পেয়েছে। ১৮৩৩ সালে ইংরেজ লেখক ঔ. ঝ. খঁংযরহমঃড়হ-এর ফোকলোর-বিষয়ক প্রথম যে প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়, তার শিরোনাম ছিল ʻঙহ ঃযব গধৎৎধমব জরঃবং ধহফ টংধমবং ড়ভ ঃযব ঔধঃং ড়ভ ইযধৎধঃঢ়ঁৎʼ। তাঁর দেখানো পথে পরবর্তীকালে অনেকে হেঁটেছেন। বিদেশিদের মধ্যে ফোকলোর নিয়ে সবচেয়ে বেশি প্রবন্ধ লিখেছেন চ. ঙ. ইড়ফফরহম. তিনি সাঁওতাল আদিবাসীদের আচার-বিশ্বাস-লোকচিকিৎসা প্রভৃতি বিষয়ে এই পত্রিকায় বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ হলো : ʻঙহ ঞধনড়ড় ধহফ ঈঁংঃড়সং ঈড়হহবপঃবফ ঃযবৎবরিঃয ধসড়হমংঃ ঃযব ঝধহঃধষʼ (১৮৯৮), ʻঙহ ঃযব উরভভবৎবহঃ করহফং ড়ভ ঝড়ষঁঃরড়হ টংবফ নু ঝধহঃধষংʼ (১৮৯৮), ʻগড়হমড়ষরধহ জধপব-সধৎশং অসড়হমংঃ ঃযব ঝধহঃধষংʼ (১৯০৪), ʻঝঃঁফরবং রহ ঝধহঃধষ গবফরপরহব ধহফ ঈড়হহবপঃবফ ঋড়ষশ-ষড়ৎবʼ (১৯২৫), ʻঅ ঘড়ঃব ড়হ ঃযব ডরষফ চবড়ঢ়ষব ড়ভ ঃযব ঝধহঃধষংʼ (১৯৩১) ইত্যাদি। বিদেশি প্রাবন্ধিকদের মধ্যে আরো ছিলেন ঔধসবং অননড়ঃঃ, ঊফধিৎফ এৎববহ ইধষভড়ৎব, ঈ. অ. ইবষষ, ঈ. ঐ. ইধসঢ়ধং, খ. ঈড়ৎফড়হ, চ. উবযড়হ, অ. ঐ. ঋৎধহবশব, ঔ. এবৎমধহ, এ. অ. এৎরবৎংড়হ, জ. এ. খবরিংড়হ, ডরষষরধস অহফবৎংড়হ, ঝ. ঝষধঃবৎ, ঊফধিৎফ ঝঃরৎষরহম, ঐ. ঈ. ঝঃৎবধঃভবরষফ প্রমুখ। আর ভারতীয়দের মধ্যে এই পত্রিকায় প্রথম ফোকলোর নিয়ে প্রবন্ধ লেখেন রাসবিহারী বসু। ১৮৭১ সালে গীতিকা ও কিংবদন্তী নিয়ে লেখা তাঁর প্রবন্ধটির শিরোনাম ছিল ʻখবমবহফ ধহফ ইধষষধফং ঈড়হহবপঃবফ রিঃয চবৎংড়হং ফবরভরবফ ড়ৎ যবষফ রহ মৎবধঃ ঠবহবৎধঃরড়হ রহ ইযধমধষঢ়ঁৎ ধহফ ঃযব ঘবরমযনড়ঁৎরহম উরংঃৎরপঃং (নবরহম বীঃৎরপঃং ভৎড়স ফরধৎরবং)ʼ। ভারতীয় তথা বাঙালিদের মধ্যে নৃবিজ্ঞানী শরৎচন্দ্র মিত্রেরই বেশিসংখ্যক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর লিখিত প্রবন্ধের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ʻঘড়ৎঃয ওহফরধহ ভড়ষশষড়ৎব ধনড়ঁঃ ঃযরবাবং ধহফ জড়ননবৎংʼ (১৮৮৫), ʻঞযরৎফ ওহংঃধষসবহঃ ড়ভ ওহফরধহ ঋড়ষশষড়ৎব নবষরবভং ধনড়ঁঃ ঃযব ঞরমবৎʼ (১৮৮৫), ʻঙহ ঃযব ঐধৎঢ়ধৎড়ৎির ড়ৎ ঃযব ইরযধৎর ড়িসধহ’ং পবৎবসড়হু ভৎড়স ঃযব ফরংঃৎরপঃ ড়ভ গঁৎংযরফধনধফ, ইবহমধষʼ (১৮৮৯), ʻজরফফষবং পঁৎৎবহঃ রহ ইরযধৎʼ (১৯০১), ʻজরফফষবং পঁৎৎবহঃ রহ ঃযব উরংঃৎরপঃ ড়ভ ঝুষযবঃ রহ ঊধংঃবৎহ ইবহমধষʼ (১৯১৭) ইত্যাদি। এ ছাড়া ভারতীয়দের মধ্যে অনেকেই নানা বিষয়ে একাধিক প্রবন্ধ লিখেছেন। ই. অ. এঁঢ়ঃধ রচিত ʻঋড়ষশষড়ৎব ড়ভ ঃযব ড়ৎরমরহ ড়ভ ঃযব পড়হংঃবষষধঃরড়হ গৎরমধ-ংযড়ৎংযধʼ (১৯১১), গ. গ. ঈযধঃঃবৎলবব রচিত ʻঝড়সব সধৎৎরধমব পঁংঃড়সং রহ ইবহমধষʼ (১৯২৬), ক. চ. ঈযধঃঃবৎলবব রচিত ʻঞযব পধফধশ ভবংঃরাধষ রহ ইবহমধষʼ (১৯৩৫) প্রভৃতি প্রবন্ধ উল্লেখযোগ্য। এশিয়াটিক সোসাইটির পত্রিকায় প্রকাশিত ফোকলোর-বিষয়ক প্রবন্ধের অধিকাংশ আঞ্চলিক বিষয়ে রচিত। প্রবন্ধগুলি একই সঙ্গে বর্ণনামূলক আবার বিশ্লেষণধর্মী।
মূলত এশিয়াটিক সোসাইটির পত্রিকায় প্রকাশিত ফোকলোর-বিষয়ক নানা প্রবন্ধের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির ফোকলোর-চর্চা অব্যাহত আছে। ফোকলোর নিয়ে বড় পরিসরে প্রতিষ্ঠানটি কাজ করেনি। ভারতে তথা বাংলায় ফোকলোর-চর্চার সূচনায় প্রতিষ্ঠানটির অবদান ছিল।
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ
এশিয়াটিক সোসাইটির অনুসরণে উনিশ শতকের শেষভাগে বাঙালিদের উদ্যোগে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ’। প্রতিষ্ঠার পেছনে কাজ করেছে বাঙালিদের স্বদেশ চেতনাবোধ। যদিও অবাঙালি জন বিমস্ (১৮৩৭-১৯০২) ছিলেন পরিষদের প্রথম উদ্যোক্তা। বিমস্ কর্মজীবনে ছিলেন বাংলা প্রেসিডেন্সির বিভিন্ন বিভাগে কমিশনার ও বোর্ড অব রেভিনিউয়ের সম্মানিত সদস্য। বাংলায় কর্মরত অবস্থায় বাংলা ভাষার ঐশ্বর্যের প্রতি অনুুরাগী হয়ে পড়েন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতি বিধানে নিরলস কাজ শুরু করেন। ১৮৭২ সালে প্রকাশিত একটি পুস্তিকায় অন্যান্য দেশের মতো কলকাতাতেও বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে বিমস্ একটি প্রতিষ্ঠান গড়ার বিষয়ে সুধীজনের কাছে প্রস্তাব রাখেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪) সম্পাদিত বঙ্গদর্শন পত্রিকায় এই বিষয়ে তাঁর একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। নিবন্ধটি প্রকাশের একুশ বছর পর বিমস্রে স্বপ্ন পূরণে কলকাতার কতিপয় বাঙালি মনীষী এগিয়ে আসেন, তাঁরা প্রতিষ্ঠা করেন ʻঞযব ইবহমধষ অপধফবসু ড়ভ খরঃবৎধঃঁৎবʼ নামক প্রতিষ্ঠানটি। ১৮৯৩ সালের জুলাইয়ের ২৩ তারিখ কলকাতার শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিটে মহারাজা কুমার বিনয়কৃষ্ণ বাহাদুরের বাসভবনে ঞযব ইবহমধষ অপধফবসু ড়ভ খরঃবৎধঃঁৎব-এর প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৮৯৫ সালের মে মাসের সভায় বেঙ্গল একাডেমি অব লিটারেচারকে ভিত্তি করে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ’ নামক প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠিত হয়। পরিষৎ-এর প্রথম সভার সভাপতি ছিলেন রমেশচন্দ্র দত্ত (১৮৪৮-১৯০৯)। এই সভায় বিনয়কৃষ্ণ দত্ত (১৮৬৬-১৯১২)-এর প্রস্তাবে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় (১৮৪৭-১৯১৯)-এর সমর্থনে সকল সদস্যের অনুমোদনে নবীনচন্দ্র সেন (১৮৪৭-১৯০৯)-কে পরিষৎয়ের সহকারি সভাপতি এবং রজনীকান্ত গুপ্ত (১৮৪৯-১৯০০) ও চ-ীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৫৮-১৯১৬)-কে সদস্য নির্বাচন করা হয়। ১৮৯৩ সালের ১৭ই জুন তারিখে অনুষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানটির দ্বিতীয় অধিবেশনে তিন মাস অন্তর পরিষৎ-এর পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এর সঙ্গে বাঙালি-অবাঙালি, দেশি-বিদেশি বিদ্যোৎসাহী বিভিন্ন মনীষী সরাসরি যুক্ত হন। তাঁদের কর্ম-উৎসাহে পরিষৎ বিচিত্রমুখী কাজ সম্পাদন করে। পরিষৎ কর্তৃক সম্পাদিত কাজের মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করা যায়, ১৮৯৩ সালের ২৯শে অক্টোবরে প্রতিষ্ঠিত গ্রন্থাগারটির কথা। সমৃদ্ধ এই গ্রন্থাগারে বিচিত্র বিষয়ের প্রায় আড়াই লক্ষ গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা সংরক্ষিত আছে। এখানে সংরক্ষিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকার সিংহভাগ-ই দুর্লভ। ন্যাশনাল লাইব্রেরির পরে সাহিত্য পরিষৎ-এর সংগ্রহে এতো বিপুল বৈচিত্র্যপূর্ণ গ্রন্থরাজি আছে। শতবর্ষ অতিক্রান্ত গ্রন্থাগারটি সমৃদ্ধ হয়েছে দেশি-বিদেশি মনীষীদের দানকৃত গ্রন্থে। ক্রয়কৃত ও দানের মাধ্যমে প্রাপ্ত বিপুল এই গ্রন্থ প্রতিদিন ব্যবহার করছেন অসংখ্য গবেষক, বিশেষত বাংলা ও বাঙালির সামাজিক ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তিবর্গ। ফোকলোরের সঙ্গে পুথি-সাহিত্যের সম্পর্ক অনেক গভীর। এ গ্রন্থাগারে শুধু যে বিভিন্ন ভাষার গ্রন্থ আছে তাই নয়; এখানে বাংলা, সংস্কৃত, তিব্বতি, ওড়িয়া, হিন্দি, অসমিয়া, ফারসি ভাষায় লিখিত প্রায় ৭ হাজারের ওপর পুথি সংগৃহীত আছে। পরিষৎ কর্তৃক প্রকাশিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যটি এর অন্যতম। গ্রন্থ প্রকাশের পাশাপাশি পরিষৎ ১৮৯৩ সাল থেকে তাদের মুখপত্র হিসেবে সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা নামক ত্রৈমাসিক পত্রিকাটিও প্রকাশ হয়ে চলেছে। এই পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধের মধ্যে আছে ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, জাতিতত্ত্ব, প্রাচীন সাহিত্য, গ্রাম্য সাহিত্য প্রভৃতি বিচিত্র বিষয়। প্রথম থেকেই পত্রিকাটিতে ফোকলোরের বিভিন্ন বিষয়, যেমন : ছড়া, ধাঁধা, প্রবাদ-প্রবচন, পাঁচালি, মঙ্গলকাব্য, লোকক্রীড়া, লোককাহিনী, লোকাচার, লোকসংগীত, লোকদেবতা, লোকশিল্প, আঞ্চলিক শব্দ ইত্যাদি বিষয়ে প্রবন্ধ প্রকাশ হয়ে আসছে। বাংলা ১৩০১সন থেকে ১৪১০ সন পর্যন্ত শতবর্ষ সময়কালে পরিষৎ-এর পত্রিকার পাতায় শতাধিক ফোকলোর-বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এটা বেশ উৎসাহব্যঞ্জক।
১৩০১ সনের সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকার প্রথম ভাগ তৃতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছেলে ভুলানো ছড়া’ নামে উৎকৃষ্ট মানের প্রবন্ধটি। এই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতা থেকে সংগৃহীত ৩০টি ছড়ার উল্লেখ করেছিলেন। প্রবন্ধটি পাঠ করে সে সময় অনেকেই ফোকলোর বিষয়ে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। ছড়া নিয়ে আরো লিখেছেন বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বলভ ‘ছেলে ভুলানো ছড়া’, রজনীকান্ত গুপ্ত ‘ছেলেভুলানো ছড়া’, কুঞ্জলাল রায় ও অম্বিকাচরণ গুপ্ত ‘ছড়া’, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ‘চট্টগ্রামী ছেলে ভুলান ছড়া’ শীর্ষক নানা প্রবন্ধ। এ ছাড়া ছড়া নিয়ে আরো লিখেছেন তারাপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় ‘দেলপূজার ছড়া’, অনিমা মুখোপাধ্যায় ‘ছড়া ও গাথায় আঠার শতকের বাঙলার বিপর্যয়ের ইতিহাস’ ইত্যাদি প্রবন্ধ।
শুধু ছড়া নয়, ফোকলোরের অন্যান্য উপাদান- ধাঁধা, প্রবাদ, লোকসংগীত, লোকশিল্প, লোকদেবতা, লোকভাষা, লোকাচার, লোকক্রীড়া, লোককবি, লোকধর্ম, লোকাচার, লোকউৎসব, গীতিকা, পাঁচালি, কিংবদন্তী ইত্যাদি বিষয়ে সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায় অনেক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ধাঁধাবিষয়ক প্রবন্ধের মধ্যে আছে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের ‘চট্টগ্রামী ছেলে ঠকান ধাঁধা’, প্রভাষচন্দ্র ভট্টাচার্যের ‘কোচবিহারের হেঁয়ালী’, দেবেন্দ্র নারায়ণ রায়ের ‘মুর্শিদাবাদে প্রচলিত কতিপয় হেঁয়ালী’, দ্বারকানাথ চৌধুরীর ‘শ্রীহট্টের পইঁ’ ইত্যাদি। লোকসাহিত্যের অন্যতম উপাদান প্রবাদ নিয়ে প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা খুব কম, কল্যাণী দত্তের ‘অতিরিক্ত বাংলা প্রবাদ’, জগদীশ গণ চৌধুরীর ‘ত্রিপুরার কক-বরক প্রবাদ প্রবচন’ প্রবন্ধ দুটি উল্লেখ করার মতো।
সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা-র পাতায় লোকসংগীত নিয়ে বেশ কিছু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে আছে কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্রাচীন কবি সঙ্গীত’, রাজেন্দ্রকুমার মজুমদারের ‘বরিশালের গ্রাম্য-গীতি’, হরিদাস পালিতের ‘আদ্যের গম্ভীরা’, জীবেন্দ্রকুমার দত্তের ‘কয়েকটি প্রাচীন পল্লী সংগীত’, নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘খুলনা জেলার মাঝির গান’, নগেন্দ্রনাথ বসুর ‘গাজী সাহেবের গান’, শরৎচন্দ্র মিত্রের ‘ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমার গ্রাম্য সংগীত’, প্রিয়নাথ সেনের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ও জাগের গান’, মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের ‘কয়েকটি জাগের গান’, অমলেন্দু মিত্রের ‘বোলান গান’, অমরকৃষ্ণ চক্রবর্তীর ‘ওলাবিবির গান’ ইত্যাদি প্রবন্ধ।
লোকদেবতা-লোকধর্মবিষয়ক প্রবন্ধের মধ্যে আছে : বিশ্বেরাজ চৌধুরীর ‘ত্রিনাথের উপাখ্যান’, রঞ্জনবিলাস রায় চৌধুরীর ‘একখানি সত্যপীরের পুথি’, অমলেন্দু রায়ের ‘রাঢ়ে ধর্মঠাকুরের পূজা’, অমলেন্দু মিত্রের ‘ধর্মঠাকুরের সূর্যমূর্তি’, চিন্তাহরণ চক্রবর্তীর ‘ত্রিনাথ’, ‘বাংলার লৌকিক দেবদেবী’, ‘লৌকিক বারা ঠাকুর’, ‘মদনপালা’ প্রভৃতি প্রবন্ধ। বস্তুধর্মী ফোকলোরের অন্যতম উপাদান লোকশিল্প বিষয়ক প্রবন্ধ সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে আছে হরিদাস পালিতের ‘রাঢ়ী-বাংলার আলপনা-চিত্র’, বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মেদিনীপুর জেলার চিত্রকর’, অমরেন্দ্রনাথ রায়ের ‘বাংলার মধ্যযুগীয় মৃৎশিল্প’, হিতেশরঞ্জন সান্ন্যালের ‘বাংলার মধ্যযুগীয় মৃৎশিল্প’, অদ্রীশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চালশৈলীর ঐতিহ্য’, অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বাংলার মধ্যযুগীয় মন্দির গার্হস্থ্য ভাস্কর্যে প্রতিফলিত সমাজ চিত্র’ ইত্যাদি প্রবন্ধ।
১৯০৭ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎয়ের একটি কক্ষে অস্থায়ীভাবে ‘চিত্রশালা’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর আগে, অর্থাৎ ১৯০৬ সালের ২১শে ডিসেম্বর শুরু হওয়া এবং ১৯০৭ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারিতে শেষ হওয়া কলকাতার জাতীয় মহাসভার অধিবেশনে ‘ভারতীয় শিল্প ও কৃষি প্রদর্শনী’তে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ সংগৃহীত দুর্লভ হস্তলিখিত প্রাচীন পুথি, বাংলায় মুদ্রিত দুষ্প্রাপ্য বইপত্র, তাম্রশাসন, খোদিত লিপি, প্রাচীন চিত্র, টেরাকোটা, ধাতুমূর্তি ও শিল্পকলার নিদর্শন এবং মনীষীদের ব্যবহƒত দ্রব্য, হস্তাক্ষর ও পা-ুলিপি প্রদর্শন করা হয়। প্রদর্শনীটি জনসাধারণের মধ্যে প্রাচীন ইতিহাস ও প্রতœবস্তু সংগ্রহে আগ্রহ তৈরি করে। এ থেকে উৎসাহিত হয়ে পরিষৎ অযতœরক্ষিত লুপ্তপ্রায় প্রতœবস্তু ও শিল্পকলার নিদর্শন সংগ্রহ-সংরক্ষণে আরো বেশি যতœবান হয়। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎয়ের উল্লেখযোগ্য সংগ্রহের মধ্যে আছে ১১শ শতকের তিনটি ব্রোঞ্জের দুর্লভ বিষ্ণুমূর্তি, হরপার্বতী, সপ্তমাতৃকা, দুর্গামূর্তি প্রভৃতি। এ ছাড়া প্রাচীন মুদ্রা সংগ্রহও চিত্রশালার এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র ও মিশ্র ধাতুর কয়েক হাজার মুদ্রা চিত্রশালায় সংগৃহীত আছে। বাংলার মৃৎশিল্পীদের অনুপম সৃষ্টি পোড়ামাটির সূক্ষ্ম কারুকাজ পরিষৎয়ের চিত্রশালাকে আরো বেশি আকর্ষণীয় করে তুলেছে। মিনা করা ইট থেকে শুরু করে বাংলার বিভিন্ন স্থান থেকে সংগৃহীত টেরাকোটার অলংকার ও মূর্তি চিত্রশালাকে সমৃদ্ধতর করেছে। এসব টেরাকোটার নিদর্শন মূলত সংগৃহীত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের বিষ্ণুপুর, সপ্তগ্রাম, গৌড়, পান্ডুয়া, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, হুগলি, চব্বিশ পরগনা এবং বাংলাদেশের ফরিদপুর, পাবনা, ময়মনসিংহ, যশোর প্রভৃতি এলাকা থেকে। শুধু তা-ই নয়, বাংলার বাইরে রাজগৃহ, বুদ্ধগয়া, বৃন্দাবন থেকেও বেশ কিছু পোড়ামাটির ভাস্কর্য সংগ্রহ করা হয়েছিল। বাংলায় ঘটে যাওয়া ঐতিহাসিক বিভিন্ন যুদ্ধের স্মারকও সংগৃহীত আছে এই সংগ্রহশালায়। ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় (১৮৬১-১৯৩০)-র দানকৃত পলাশী যুদ্ধে ব্যবহƒত একটি কামানের গোলা পরিষৎ-এ সযতেœ রক্ষিত আছে। এ ছাড়া রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩), দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫), ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১), রাজেন্দ্রলাল মিত্র (১৮২৪-১৮৯১), দীনবন্ধু মিত্র (১৮৩০-১৮৭৩), কেশবচন্দ্র সেন (১৮৩৮-১৮৮৪), বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৯০৩), দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪০-১৯২৬), শিবনাথ শাস্ত্রী (১৮৪৭-১৯১৯), রমেশচন্দ্র দত্ত (১৮৪৮-১৯০৯), স্বর্ণকুমারী দেবী (১৮৫৫-১৯৩২), তরু দত্ত (১৮৫৬-১৮৭৭), গিরিন্দ্রমোহন দাসী (১৮৫৮-১৯২৪), বিপিনচন্দ্র পাল (১৮৫৮-১৯৩২), জগদীশচন্দ্র বসু (১৮৫৮-১৯৩৭), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), প্রফুল্লচন্দ্র রায় (১৮৬১-১৯৪৪), চিত্তরঞ্জন দাস (১৮৭০-১৯২৫), সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮২-১৯২২), রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৮৬-১৯৩০) প্রমুখ বাঙালি মনীষীদের ব্যক্তিগত ব্যবহার্য জিনিসপত্র বা স্মৃতিচিহ্ন সযতেœ রক্ষিত আছে এই সংগ্রহশালায়। বিশিষ্ট ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ চিত্রশালার অন্যতম প্রাণপুরুষ। তাঁর অক্লান্ত চেষ্টায় বহু প্রাচীন মুদ্রা ও মূর্তি সংগৃহীত হয়েছে। ১৯১২ সালের ২৮শে এপ্রিল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ চিত্রশালাটি স্বতন্ত্র বিভাগরূপে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। চিত্রশালা পরিচালনা ও সংরক্ষণের জন্য অন্যতম অবৈতনিক ‘চিত্রশালাধ্যক্ষ’ পদের সৃষ্টি করা হয়। নগেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন পরিষৎ-এর প্রথম চিত্রশালাধ্যক্ষ। পরে এই পদ অলংকৃত করেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রমেশচন্দ্র মজুমদার, মনোমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, অজিত ঘোষ প্রমুখ ব্যক্তি। চিত্রশালাটি ফোকলোরের বস্তুগত সংস্কৃতি সংরক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি করেছিল।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
১৮৫৭ সালে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইনের বলে কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজÑ এই তিন শহরে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল সবার শীর্ষে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, রামগোপাল ঘোষ (১৮১৫-১৮৬৮), রমাপ্রসাদ রায় (১৮১৭-১৮৬২), মৌলবী মুহম্মদ ওয়াজি, প্রিন্স গোলাম মহম্মদ প্রমুখ ব্যক্তি। প্রতিষ্ঠার প্রায় ৭২ বছর পর ১৯১৯ সালে ফেব্রুয়ারির ৩ তারিখে ভারতীয় ভাষা (বঙ্গভাষা ও সাহিত্য) বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বিভাগের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি ছিলেন বিশিষ্ট ভাষাবিদ দীনেশচন্দ্র সেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং দীনেশচন্দ্র সেনের উদ্যোগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে লোকসাহিত্য-চর্চার সূচনা হয়। দীনেশচন্দ্র সেন ‘রামতনু লাহিড়ী রিসার্চ ফেলোশিপ’-এর আওতায় ‘বঙ্গসাহিত্য পরিচয়’, ‘চৈতন্য ও তাঁর পার্ষদগণ’, ‘বাংলা রামায়ণ’, ‘বাংলার লোকসাহিত্য’, ‘বাংলার লোকজীবন’ ইত্যাদি বিষয়ে বক্তব্য রাখেন। ১৯২০ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ঞযব ঋড়ষশ খরঃবৎধঃঁৎব ড়ভ ইবহমধষ গ্রন্থটি। রূপকথা ও উপকথা-সংবলিত সংকলনধর্মী এই গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি বাংলা লোকসাহিত্য বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেন।
১৯২০ সালে দীনেশচন্দ্র সেনের উদ্যোগে নলিনীকান্ত ভট্টশালী (১৮৮৮-১৯৪৭) সম্পাদিত ময়নামতীর গান গ্রন্থটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এমএ পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯২২ সালে দীনেশচন্দ্র সেন ও বসন্তরঞ্জন রায়ের যুগ্ম সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় গোপীচন্দ্রের গান গ্রন্থের প্রথম খ-। গানগুলো সঞ্চয়ন করেন বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য। এর দ্বিতীয় খ- প্রকাশিত হয় ১৯২৪ সালে। সংকলিত গ্রন্থের তিনটি পাঠের প্রথমটি হলো ‘গোপীচন্দ্রের গান’। এটি মৌলিক সংগ্রহ। দ্বিতীয় পাঠটি ভবানীদাস বিরচিত ‘গোপীচন্দ্রের পাঁচালি’ ও সুকুর মামুদ বিরচিত ‘গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাস’। ১৯২০-এর দশকের সূচনায় দীনেশচন্দ্র সেন হাত দেন ময়মনসিংহ ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা সংগ্রহে। বেশ কয়েকটি খ-ে তা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ১৯২৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয় মৈমনসিংহ গীতিকার প্রথম খ-। এতে ‘মহুয়া’, ‘মলুয়া’, ‘চন্দ্রাবতী’, ‘কমলা’, ‘দেওয়ান ভাবনা’, ‘দস্যু কেনারামের পালা’, ‘রূপবতী’, ‘কঙ্ক ও লীলা’, ‘কাজলরেখা’, ‘দেওয়ানা মদিনা’ প্রভৃতি গীতিকা মুদ্রিত হয়। এগুলো বৃহত্তর ময়মনসিংহ থেকে সংগৃহীত। গীতিকাগুলির মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত দ্বিজ কানাই প্রণীত ‘মহুয়া’ পালাটি। এটি পূর্ব ময়মনসিংহ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন বিশিষ্ট সংগ্রাহক চন্দ্রকুমার দে। অন্য পালাগুলো তাঁর-ই সংগ্রহ। তিনি কিছু কিছু পালার নামকরণ বদল করেছিলেন। যেমন : ‘বাদিয়ানির পালা’র ‘মহুয়া’ নামকরণ অথবা ‘উনার বাইদ্যা’কে ‘মহুয়াবেদে’ বলে উল্লেখ করেছিলেন, ‘আলাল দুলাল’ পালার ‘দেওয়ানা মদিনা’ নামকরণ ইত্যাদি।
১৯২৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চৌদ্দটি গীতিকা নিয়ে প্রকাশিত হয় পূর্ববঙ্গ গীতিকার দ্বিতীয় সংখ্যা। এতে স্থান পায় ‘ধোপার পাট’, ‘মইষাল বন্ধু’, ‘কাঞ্চন মালা’, ‘শান্তি’, ‘নীলা’, ‘ভেলুয়া’, ‘কমলা রানীর গান’, ‘মানিকতারা পালা’, ‘মদনকুমার ও মধুমালা’, ‘সাঁওতাল হাঙ্গামার ছড়া’, ‘নেজাম ডাকাইতের পালা’, ‘দেওয়ান ঈশা খাঁ মসনদ আলি’, ‘সুরৎ জামাল ও অধুয়া’ এবং ‘ফিরোজ খাঁ দেওয়ান’ নামক গীতিকাসমূহ। চার বছর পর ১৯৩০ সালে এর তৃতীয় খ- প্রকাশিত হয়। এখানে ‘মাঞ্জুর মা’, ‘কাফন চোরা’, ‘ভেলুয়া’, ‘হাতীখেদা’, ‘আয়না বিবি’, ‘কমল সদাগর’, ‘শ্যাম রায়’, ‘চৌধুরীর লড়াই’, ‘গোপিনী কীর্তন’, ‘সুজা তনয়ার বিলাপ’, ‘বয়াতীর গান’ ইত্যাদি গীতিকা স্থান পায়। পূর্ববঙ্গ গীতিকার চতুর্থ তথা শেষ খ-টি প্রকাশিত হয় ১৯৩২ সালে। এই খ-ে দীনেশচন্দ্র সেন ‘নছর মালুম’, ‘শীলা দেবী’, ‘রাজা রঘুর পালা’, ‘নুরন্নেছা ও কবরের কথা’, ‘মুকুট রায়’, ‘ভরাইয়া রাজার কাহিনী’, ‘আন্ধা বন্ধু’, ‘বগুলার বারমাসী’, ‘চন্দ্রাবতীর রামায়ণ’, ‘সন্নমালা’, ‘বীর নারায়ণের পালা’, ‘রতন ঠাকুরের পালা’, ‘পীরবাতাসী’, ‘রাজা তিলক বসন্ত’, ‘মলয়ার বারমাসী’, ‘জিরালনী’, ‘পরীবানুর হাঁহলা’, ‘সোনারায়ের জন্ম’, ‘সোনাবিবির পালা’ নামক উনিশটি পালা সংকলিত করেন। মৈমনসিংহ গীতিকা এবং পূর্ববঙ্গ গীতিকার তিনটি খ-ে সংকলিত ৫৪টি মধ্যে বেশ কয়েকটি গীতিকা আছে, যেগুলো গীতিকা হিসেবে বিবেচিত হবার যোগ্য নয়। কিন্তু দীনেশচন্দ্র সেন সেগুলোকে গীতিকা বলেই বিবেচনা করেছেন। সামান্য কিছু ভুল-ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও দীনেশচন্দ্র সেনের গীতিকা সংগ্রহের এই উদ্যোগ বাংলা লোকসাহিত্য তথা গীতিকা সংগ্রহের ইতিহাসে অনন্য ঘটনা হিসেবে আজও বিবেচিত হচ্ছে। গীতিকা সংগ্রহে তিনি সংগ্রাহক নিযুক্ত করেছিলেন। সংগ্রাহকদের মধ্যে ছিলেন চন্দ্রকুমার দে, আশুতোষ চৌধুরী, জসীম উদ্দীন, মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন প্রমুখ। এঁদের পাশাপাশি নগেন্দ্রচন্দ্র দে, মনোরঞ্জন চৌধুরী, বিহারীলাল রায়, বিজয় নারায়ণ আচার্য (১৮৬৯-১৯২৭), শিবরতন মিত্র প্রমুখ সংগ্রাহকও গীতিকা সংগ্রহ করে জমা দিয়েছিলেন দীনেশচন্দ্রকে। সংগ্রাহকদের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক গীতিকা সংগ্রাহক ছিলেন চন্দ্রকুমার দে। সংগ্রহকর্মের কাজটি পরিচালিত হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নে এবং এর মূল পৃষ্ঠপোষক ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। এই উদ্যোগের ফলে বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ গীতিকাসমূহ বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল। ক্রমশ বিলীয়মান এসব গীতিকা ইংরেজিভাষীদের কাছে পৌঁছানোর লক্ষ্যে দীনেশচন্দ্র সেন ১৯২৩, ১৯২৬, ১৯২৮ এবং ১৯৩২ সালে তা ইংরেজিতে ঊধংঃবৎহ ইবহমধষ ইধষষধফং গুসবহংরহময নামে প্রকাশ করেন। যদিও দীনেশচন্দ্র পূর্ববঙ্গগীতিকার সব পালাগুলিকে ঊধংঃবৎহ ইবহমধষ ইধষষধফং গুসবহংরহময-এ স্থান দেননি। যেমন পূর্ববঙ্গগীতিকার দ্বিতীয় খ-ের দ্বিতীয় সংখ্যায় ‘নীলা’ এবং ‘মদনকুমার মধুমালা’ পালাটি ঊধংঃবৎহ ইবহমধষ ইধষষধফং গুসবহংরহময, াড়ষ-ষষ, চধৎঃ ষ-এ বাদ দিয়েছেন। ঊধংঃবৎহ ইবহমধষ ইধষষধফং এর তৃতীয় খ-টিকে তিনি াড়ষ-ষষষ, চধৎঃ ষ-এ বলে চিহ্নিত করেছেন। এটিতে স্থান দিয়েছেন পূর্ববঙ্গ গীতিকার তৃতীয় খ-ের দ্বিতীয় সংখ্যার পালাগুলির সংক্ষিপ্ত অনুবাদ। ঊধংঃবৎহ ইবহমধষ ইধষষধফং -এর াড়ষ-ষঠ, চধৎঃ ষ-এ রয়েছে পূর্ববঙ্গ গীতিকার চতুর্থ খ-ের ধৃত পালাগুলির অনুবাদ। দীনেশচন্দ্র সেনের এই উদ্যোগ প্রশংসিত হয়। যদিও গীতিকাগুলির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন। সুকুমার সেন (১৯০১-১৯৯২), নন্দগোপাল সেনগুপ্তসহ অনেকের ধারণা, এসব দীনেশচন্দ্র সেন বানিয়ে লিখেছেন। পালাগুলির অস্তিত্ব জনসমাজে নেই অথবা তা আর মঞ্চস্থ হয় না। তাই, বাংলা গীতিকার বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্নে চেক গবেষক দুশান জাভিতাল (১৯২৫-২০১২) জসীম উদ্দীনকে সঙ্গে করে বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিস্তৃত অঞ্চল ঘুরে বেড়ান। তাঁর প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল গীতিকাগুলির স্বরূপ অনুসন্ধান। যদিও তিনি এসব অঞ্চলে গীতিকাগুলির জীবন্ত প্রদর্শন সেভাবে দেখতে পাননি, তবে তিনি এ কথা নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছেন, লোক মনোরঞ্জনের জন্য এসব গীতিকা একসময়ে বহুলভাবে এসব অঞ্চলে প্রদর্শিত হতো। মৈয়মনসিংহ গীতিকার বিশ্বাসযোগ্যতা, মূল বিষয়বস্তু এবং গঠনবৈশিষ্ট্য নিয়ে তাঁর লেখা ইবহমধষ ঋড়ষশ-ইধষষধফং ভৎড়স গুসবহংরহম ধহফ ঃযব ঢ়ৎড়নষবস ড়ভ ঃযবরৎ অঁঃযবহঃরপরঃু গ্রন্থটি ১৯৬৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়। গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি দীনেশচন্দ্র সেন ও চন্দ্রকুমার দে-র উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত গীতিকার মতো আরেকটি উল্লেখযোগ্য ফোকলোর-বিষয়ক গ্রন্থ পটুয়া সঙ্গীত। এটি ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত হয়। শশীচিত্রকর, পঞ্চানন চিত্রকর, উপেন্দ্র চিত্রকর, ভূপতি চিত্রকর প্রমুখ চিত্রকরের কাছ থেকে সংগৃহীত ২৯টি পটুয়াসংগীত সংকলিত করে প্রকাশ করেন গুরুসদয় দত্ত। গানগুলো তিনি সংগ্রহ করেন ১৯৩০-১৯৩৩ সালের মধ্যে, যখন তিনি বীরভূমে কর্মরত ছিলেন। গুরুসদয় দত্তই প্রথম বাঙালি, যিনি হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের কাছে অবহেলিত পটুয়া সম্প্রদায়ের পট ও পটের গান সংগ্রহ করেছিলেন। সামাজিক ইতিহাস রচনায় মূল্যবান এই গ্রন্থের ২৯টি পটুয়াসংগীতের মধ্যে ১২টিই কৃষ্ণলীলা-বিষয়ক। এর মধ্যে আছে ‘শ্রীকৃষ্ণের জন্ম’, ‘পুতনা বধ’, ‘নন্দোৎসব’, ‘বস্ত্রহরণ’, ‘ননীচুরি’, ‘দানখ-’, ‘কালিয় দমন’ প্রভৃতি বিষয়। এ ছাড়া ‘সিন্ধুবধ’, ‘শ্রীরামের বিবাহ’ ‘তাড়কাবধ’, ‘অহল্যা উদ্ধার’, ‘শ্রীরামের বনবাস’ ইত্যাদি রামলীলা-বিষয়ক গান আছে ছয়টি। এ সংকলনে ‘শিবের মাছধরা’, ‘ভগবতীর শঙ্খপরাণ পালা’, ‘গৌরাঙ্গ অবতার’, ‘জগন্নাথ ও গৌরাঙ্গের গান’ ইত্যাদি বিষয়েও বেশ কয়েকটি গান আছে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত ফোকলোর-বিষয়ক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের হারামণি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশীর্বাদধন্য বাউল সংগীতের সংকলন গ্রন্থটিতে বাউল বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে। রবীন্দ্রনাথের বাউল প্রীতির কথা সর্বজনস্বীকৃত। তিনি লেখককে আশীর্বাদ করে বলেন :
মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন বাউল-সঙ্গীত সংগ্রহে প্রবৃত্ত হয়েছেন। এ-সম্বন্ধে পূর্ব্বেই তার সঙ্গে আমার মাঝে মাঝে আলাপ হয়েছিল, আমিও তাঁকে অন্তরের সঙ্গে উৎসাহ দিয়েছি। আমার লেখা যাঁরা পড়েছেন, তাঁরাও জানেন, বাউল পদাবলীর প্রতি আমার অনুরাগ আমি অনেক লেখায় প্রকাশ করেছি। শিলাইদহে যখন ছিলাম, বাউল দলের সঙ্গে আমার সর্বদাই দেখাসাক্ষাৎ ও আলাপ-আলোচনা হ’ত। আমার অনেক গানেই আমি বাউল সুর গ্রহণ করেছি। এবং অনেক গানে অন্য রাগরাগিণীর সঙ্গে আমার জ্ঞাত ও অজ্ঞাতসারে বাউল সুরের মিল ঘটেছে। এর থেকে বোঝা যাবে, বাউল সুর বাণী কোন এক সময়ে আমার মনের মধ্যে সহজ হ’য়ে মিশে গেছে।
রবীন্দ্রনাথের এ বক্তব্যে বাংলার মরমি সংগীত বাউল গানের প্রতি তাঁর তীব্র অনুরাগের কথা প্রতিফলিত হয়েছে। ফোকলোর-বিষয়ক এ ধরনের প্রকাশনা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরো হয়েছে। ক্ষিতিমোহন সেন (১৮৮০–১৯৬০)-এর বাউল সঙ্গীত এমনই আরেকটি প্রকাশনা।
১৯৬৬ সালে নির্মলেন্দু ভৌমিকের সম্পাদনায় গুরুসদয় দত্তের শ্রীহট্টের লোকসঙ্গীত গ্রন্থটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়। সিলেট অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা প্রায় চারশ গানের সংকলন শ্রীহট্টের গণগীতি শীর্ষক গ্রন্থের পা-ুলিপি গুরুসদয় দত্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৩৯ সালে জমা দিয়েছিলেন কিন্তু অনিবার্য কারণবশত তাঁর মৃত্যুর পরে শ্রীহট্টের লোকসঙ্গীত নামে প্রকাশিত হয়। গানের সংখ্যা সম্পাদনা কালে ৪৩টি কমে যায়। ফলে গানের মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৮০টি। গ্রন্থের নাম পরিবর্তন ও গানের সংখ্যা কমানোর ব্যাখ্যা হিসেবে সম্পাদক নির্মলেন্দু ভৌমিক বলেন :
দত্ত মহাশয়ের পা-ুলিপিতে গান ছিল মোট ৪২৩টি। বইয়ের নাম ছিল, “শ্রীহট্টের গণগীতি”। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনা বিভাগের অনুমোদনক্রমে বর্তমানে তাহা ‘শ্রীহট্টের লোকসঙ্গীত’ নামে প্রকাশিত হইল। পা-ুলিপিতে রক্ষিত ৪২৩টি গানের মধ্যে অনাবশ্যক মনে হওয়ায় ৪৩টি পরিত্যক্ত হইল। গানের সংখ্যা তাই দাঁড়াইয়াছে ৩৮০।
ফোকলোরিক দৃষ্টিতে এই ধরনের কাজ সমর্থনযোগ্য নয়। কী কারণে ৪৩টি গানকে পরিত্যক্ত করা হয়েছে তার ব্যাখ্যা সম্পাদক যথার্থভাবে দেননি, তাছাড়া কারো সংগ্রহকর্মের ওপর নিজের ভালো-মন্দ বোধকে চাপিয়ে দেওয়া ফোকলোর গবেষকের পক্ষে সমীচীন নয়। ভবিষ্যৎ গবেষকেরা ঐতিহাসিক মূল্যবান এই গান থেকে যে বঞ্চিত হয়েছে সে কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। সংকলনটিতে ৫৯টি ভাটিয়ালি গান, ১৪টি রাগ প্রধান গান, ৩৮টি ধামাইল গান, ৯টি সারি গান, ১৯টি বিয়ের গান এবং অল্প কিছু বাউল গান আছে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে ফোকলোরকে যুক্ত করেন বিশিষ্ট ফোকলোরবিদ আশুতোষ ভট্টাচার্য। তিনি ১৯৬০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগদান করে এই বিভাগের পাঠ্যক্রমে কিছুটা পরিবর্তন আনেন। শশিভূষণ দাশগুপ্ত (১৯১১-১৯৬৪)-এর সহযোগিতায় বঙ্গভাষা ও সাহিত্যের এমএ-র পাঠ্যক্রমের সপ্তম পত্রে ‘লোকসাহিত্য’ বিশেষ পত্র যুক্ত করেন। এ ছাড়া আশুতোষ ভট্টাচার্য বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন যা ফোকলোরকে নতুন মাত্রা দেয়। তিনি দীর্ঘদিন বিশিষ্ট নৃবিজ্ঞানী ভেরিয়ার এলুইন (১৯০২-১৯৬৪)-এর গবেষণা সহকারি ছিলেন। এলুইনের সঙ্গে ক্ষেত্রসমীক্ষার অভিজ্ঞতা তাঁকে ভাবী জীবনে গবেষণামনস্ক করে। সঞ্চিত অভিজ্ঞতা তিনি প্রয়োগ করেন বাংলা বিভাগের শিক্ষাকার্যক্রমে। তিনি বিশ্বাস করতেন, ক্ষেত্রসমীক্ষা ছাড়া ফোকলোর চর্চা কখনোই সম্পূর্ণ হতে পারে না। তাই তিনি বিশেষ পত্রের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রসমীক্ষা করান। ১৯৬২ সালের এপ্রিল মাসে আশুতোষ ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গ ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের বিশেষ পত্রের একদল ছাত্রছাত্রী পুরুলিয়া জেলার বাগমু-ী থানার অন্তর্গত অযোধ্যা পাহাড়ে লোকসাহিত্য সংগ্রহের জন্য শিবির স্থাপন করেন। এই শিবিরে ১৬ জন শিক্ষার্থী ছিলেন। তারা বিপুল পরিমাণ লোকউপাদান সংগ্রহ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৩ সালে মেদিনীপুর জেলার ঝাড়গ্রাম মহকুমার বাঁশপাহাড়ীতে দ্বিতীয় ক্ষেত্রসমীক্ষা করা হয়েছিল। অংশগ্রহণ নিয়েছিলেন ২৫ জন শিক্ষার্থী এবং তাঁরা পাতানাচের গান, কাঠিনাচের গান, করমগীতি, ঢেঁকির গান, বাউল, ভাদু গান, টুসু গান, গাজনের গান ইত্যাদি সংগ্রহ করেছিল। ১৯৬৪ সালে একই এলাকায় প্রাক্তন ও বর্তমান ২৫ জন সংগ্রহকারীকে নিয়ে তৃতীয়বারের মতন ক্ষেত্রসমীক্ষা করা হয়। ১৯৬৫ সালের ক্ষেত্রসমীক্ষাকর্ম হয় মেদিনীপুর জেলার বেলপাহাড়ীতে, এখানে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ২০ জন। ১৯৬৬ সালের এপ্রিল-মে মাসে মেদিনীপুর জেলার ঝাড়গ্রাম মহকুমার হাতিবাড়ি অঞ্চলে একইভাবে ক্ষেত্রসমীক্ষা করা হয়। অংশগ্রহণ করা ২০ জন শিক্ষার্থী বিপুল পরিমাণ লোককাহিনী, ছড়া, ধাঁধাসহ লোকসাহিত্যের নানা উপাদান সংগ্রহ করে। ১৯৬৭ সালের সমীক্ষাকর্মটি হয় পুরুলিয়ার কুইলাপালে ও বাঁকুড়ার কয়েকটি গ্রামে। লোকসংগীত, লোককাহিনী, ধাঁধা, প্রবাদ সংগৃহীত হয়। ১৯৬৮ সালে পুরুলিয়ার বাগমু-ীতে সমীক্ষাকর্ম করে বিশেষ পত্রের ২৫ জন শিক্ষার্থী। ১৯৬৯ ও ১৯৭১ সালে যথাক্রমে মাঠা ও বাঁকুড়ার শালতোড়া থানার মুরুল গ্রামে ক্ষেত্রসমীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ১০ বছর পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় শিবির স্থাপন করে আশুতোষ ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ক্ষেত্রসমীক্ষাকর্ম পরিচালিত হয়। এসব ক্ষেত্রসমীক্ষায় অংশগ্রহণ করা শিক্ষার্থীদের অনেকেই পরবর্তীকালে ফোকলোর-চর্চায় উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন। তুষার চট্টোপাধ্যায়, দিব্যজ্যোতি মজুমদার, সুভাষ বন্দ্যোপাধ্যায়, সনৎকুমার মিত্র, দুলাল চৌধুরী, বরুণকুমার চক্রবর্তী, শীলা বসাক, বিমলকুমার মুখোপাধ্যায়, সত্যবতী গিরি, পল্লব সেনগুপ্ত প্রমুখ ফোকলোরবিদদের সবাই-ই ছিলেন আশুতোষ ভট্টাচার্যের প্রত্যক্ষ ছাত্র। এঁদের প্রত্যেকেই ফোকলোর বিষয়ক একাধিক গ্রন্থের রচয়িতা। পশ্চিমবঙ্গে আশুতোষ ভট্টাচার্যের শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ফোকলোর বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে ফোকলোরপ্রীতি জন্মানোর ক্ষেত্রে আশুতোষ ভট্টাচার্য একক ভূমিকা পালন করেছিলেন । শুধু তা-ই নয়, তিনি ক্ষেত্রসমীক্ষায় প্রাপ্ত বিভিন্ন লোকউপাদান ব্যবহার করে নিজে ফোকলোর-বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে প্রথমেই বলতে হয় বাংলার লোকসাহিত্যর কথা। এর বেশ কয়েকটি খ- প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত এর দ্বিতীয় খ-ের পুরোটাই ছড়া বিষয়ক। তৃতীয় খ-টি গীত ও নৃত্য বিষয়ক, এটি ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত হয়। লোককথা-বিষয়ক চতুর্থ খ-টি প্রকাশিত হয় ১৯৬৬ সালে। লোকসাহিত্যের অন্যতম উপাদান ধাঁধা নিয়ে পঞ্চম খ- প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে। ষষ্ঠ খ-টি প্রবাদ-বিষয়ক, তা প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালে। লোকসংগীত নিয়ে পাঁচ খ-ের বাংলার লোকসঙ্গীত ((১৯৬৩৮-১৯৬৬) এবং চার খ-ের বঙ্গীয় লোকসঙ্গীত রতœাকর (১৯৬৬-১৯৬৭) গ্রন্থসমূহ তাঁর ক্ষেত্রসমীক্ষারই ফসল। এ ছাড়া দুই খ-ের বাংলার লোকনৃত্য শিক্ষার্থীদের সংগৃহীত কাজের ওপর রচিত। আশুতোষ ভট্টাচার্য ফোকলোর-বিষয়ক এসব গ্রন্থ রচনা করতে পেরেছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থীদের সংগৃহীত উপাদান-উপকরণের সাহায্যে। তাই বলাই যায়, ফোকলোরের উপাদান সংগ্রহে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু লোকউপাদান-উপকরণ সংগ্রহ করেছে তা-ই নয়, বরং এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফোকলোরে বেশ কিছু উচ্চতর গবেষণাও সম্পাদিত হয়েছে। বাংলা বিভাগের শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, সুকুমার সেন, শশিভূষণ দাশগুপ্ত, আশুতোষ ভট্টাচার্য, বিজনবিহারী ভট্টাচার্য, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, মানস মজুমদার, ক্ষুদিরাম দাস, দুলাল চৌধুরী, তুষার চট্টোপধ্যায়, হরিপদ চক্রবর্তী, নির্মলেন্দু ভৌমিক প্রমুখ অধ্যাপকের তত্ত্বাবধানে লোকসাহিত্য, লোকউৎসব, লোকধর্ম, লোকসংগীত, লোককাহিনী, লোকাচার-লোকবিশ্বাস, গীতিকাসহ লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয়ে সম্পাদিত পিএইচডি গবেষণাপত্রের বেশিরভাগই উচ্চমানসম্পন্ন। এসব গবেষণাপত্রের উল্লেখযোগ্য হলো : হরিপদ চক্রবর্তীর ‘দাশরথি রায় ও তাঁহার পাঁচালী’ (১৯৫৮), সুধীরকুমার করণের ‘পশ্চিমবঙ্গের আঞ্চলিক লোকযানের কতিপয় বৈশিষ্ট্য’ (১৯৬১), নির্মলেন্দু ভৌমিকের ‘প্রান্তউত্তরবঙ্গের লোকসঙ্গীত’ (১৯৬১), দুলাল চৌধুরীর ‘লোকসংস্কৃতি ও বাংলার লোকউৎসব’ (১৯৬৯), সুভাষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আধুনিক বাংলা সাহিত্যে লোকঐতিহ্য’ (১৯৭২), প্রদোষকুমার দত্তের ‘রূপকথার গানবৈচিত্র্য ও ভাষা বৈশিষ্ট্য’ (১৯৮৬), শীলা বসাকের ‘বাংলা ধাঁধার বিষয় বৈচিত্র্য ও সামাজিক পরিচয়’ (১৯৮৮), মৃত্যুঞ্জয় গুঁইয়ের ‘পশ্চিমবাংলার সাহিত্যে লোকাচার ও লোকবিশ্বাস’ (১৯৮৮), মধুপকুমার দের ‘জঙ্গলমহলের লোককথা’ (১৯৯০), চিত্তরঞ্জন মাইতির ‘বাংলা লোকসঙ্গীতে লোকজগৎ’ (১৯৯১), সন্ধ্যা রায়চৌধুরীর ‘লোকসাহিত্য ও গণমাধ্যম’ (১৯৯৩), আয়েত্রী শীলের ‘বাংলার মৌখিক ঐতিহ্য খোশগল্প’ (১৯৯৪), শশাঙ্কশেখর দাসের ‘বনবিবি ও গ্রামবাংলা’ (১৯৯৫), শেখ মকবুল ইসলামের ‘বাংলা-ওড়িয়া প্রবাদ ও তুলনামূলক আলোচনা’ (১৯৯৭), নির্মলেন্দু দের ‘জেতোর লোকজীবন ও লোকসংস্কৃতি’ (১৯৯৮), সত্যরঞ্জন বিশ্বাসের ‘দেল বা চড়ক-গাজন উৎসব ও লোকসাহিত্য’ (১৯৯৮), মুনমুন চট্টোপাধ্যায়ের ‘মৈমনসিংহ গীতিকা : পুনর্বিচার’ (১৯৯৯), সুব্রত মান্নার ‘পটচিত্র, পটুয়া সঙ্গীত ও লোকসংস্কৃতি বিজ্ঞান’ (২০০৮) ইত্যাদি। ডিগ্রিপ্রাপ্ত গবেষকদের অনেকেই পরবর্তীকালে ফোকলোরের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত রেখেছেন। তাঁদের লেখা গ্রন্থসমূহ আজ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত, যেমন : সুধীরকুমার করণের সীমান্তবাংলার লোকযান (১৯৬৪), দুলাল চৌধুরীর বাংলার লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতি (১৯৬৯), নির্মলেন্দু ভৌমিকের বাংলা ধাঁধার ভূমিকা (১৯৮৮), শক্তিনাথ ঝার বস্তুবাদী বাউল (১৯৯৯), সুভাষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলার লোকসংস্কৃতি চর্চা ও আশুতোষ ভট্টাচার্য (২০০৯), পুষ্পজিৎ রায়ের গম্ভীরা (২০০০), শীলা বসাকের বাংলার নকশী কাঁথা (১৯৯৮), নির্মলেন্দু দের জেতোর লোকসাহিত্য (১৯৯৮), মুনমুন চট্টোপাধ্যায়ের মৈমনসিংহ গীতিকা : পুনর্বিচার (২০০৩), শেখ মকবুল ইসলামের লোকসংস্কৃতিবিজ্ঞান : তত্ত্ব পদ্ধতি ও প্রয়োগ (২০১১) ইত্যাদি।
ফোকলোর যে শুধু এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তা নয় বরং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গের রবীন্দ্রভারতী, কল্যাণী, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের এমএ পাঠ্যক্রমে ‘লোকসাহিত্যে’র স্থলে ‘ফোকলোর’ বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
লোকশিল্পের বিভিন্ন উপাদানের সঙ্গে সাধারণ মানুষকে পরিচিত করতে ১৯৩৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয় অনন্য এক সংগ্রহশালা, যা ‘আশুতোষ সংগ্রহশালা’ নামে পরিচিত। এটি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রতিষ্ঠিত প্রথম সংগ্রহশালা। স্বনামখ্যাত শিক্ষাবিদ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের নামাঙ্কিত এই সংগ্রহশালার অন্যতম লক্ষ্য ছিল পূর্বভারতের প্রাচীন শিল্পকীর্তির যথাযথ সংরক্ষণ ও তার প্রদর্শন। সংগ্রহশালাটির অধিকাংশ উপাদান লোকশিল্পজাত আর তা অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন জেলা থেকে সংগৃহীত। ভারতের অন্যান্য রাজ্য যথা : বিহার, উড়িষ্যা ও রাজস্থানের বেশ কিছু লোকশিল্পের উপাদান এখানে সংরক্ষিত আছে। খেলনা ও পুতুল সংগ্রহশালাটির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। শিশুরা তাদের খেলার অনুষঙ্গ হিসেবে পুতুল ব্যবহার করে। পোড়ামাটি, কাঠ, বাঁশ, শোলার তৈরি এসব খেলনা-পুতুলের গুরুত্ব বস্তুধর্মী ফোকলোরের ক্ষেত্রে অনেক। সংরক্ষিত পোড়ামাটি পুতুলের মধ্যে আছে গৌরাঙ্গ, গৌর-নিতাই, পাখি, টেপা-পুতুল, ছেলেকোলে মা, নাড়–গোপাল, মাছ, ঘোড়া, মহিষ, হাতির পিঠে মানুষ, তেলের ঘানি, পক্ষীরাজ ঘোড়া, নকশা করা কলসি কাঁখে বউ এবং বিভিন্ন ধরনের ছোট মূর্তি। কাঠের কাজের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের পুতুল, গৌরাঙ্গ, কালী, ঘোড়া, পেঁচা, বাঘের মুখ, এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের ছোট-বড় মূর্তি আছে। শোলার কাজের মধ্যে আছে ময়ূর, ছেলে কোলে মা, বউ, পুতুল, শিব, হাতির উপর মূর্তি, ঘোড়ায় চড়া পুতুল, চৌকিদার ইত্যাদি। বাঁশের কাজের মধ্যে রয়েছে ময়ূর, হরিণ, ঘোড়া ইত্যাদি। এছাড়া আছে পোড়ামাটির তৈরি ধর্মীয় পুতুল : মনসা, গণেশ, দুর্গার কোলে গণেশ, রাধাকৃষ্ণ, বাঘের উপর বনবিবি, শিবের উপর কালী ইত্যাদি। উড়িষ্যা থেকে সংগৃহীত লোকশিল্পের মধ্যে আছে কাঠের তৈরি মন্দির, হাতি, ঘোড়া, হরিণ, সিংহ, হাতির পিঠে সিংহ, জগন্নাথ, পাখি, হনুমানের কাঁধে রাম ইত্যাদি। বিহারের লোকশিল্পের মধ্যে আছে ঘোড়ায় চড়া মূর্তি, শস্যদানীর নিদর্শন, বিভিন্ন ধরনের লোকাচারে ব্যবহƒত পাত্র, বাস্তু নিদর্শন, দীপলক্ষ্মী ও লৌকিক দেবদেবীর মৃন্ময় মূর্তি। আর মধ্যপ্রদেশের লোকশিল্পের মধ্যে আছে মাটির তৈরি পুতুল ও খেলনা হিসেবে মহিষ ও ষাঁড়। পুতুল সংগ্রহের পাশাপাশি এই সংগ্রহশালার অন্যতম সংগ্রহ পটচিত্র। এখানে জড়ানো ১৯টি ও চৌকো ২৪টি পট আছে। পটগুলো মূলত পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর থেকে সংগৃহীত। পটচিত্রের মতো বাংলার অন্যতম লোকশিল্পের স্মারক সরাচিত্রের বিপুল সংগ্রহ আছে। সরাচিত্রগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে বাংলাদেশ থেকে। সরার মতো পাটাচিত্র আছে। ৬৮টি পাটাচিত্রের বেশিরভাগ উড়িষ্যার পুরী থেকে সংগৃহীত। বাংলার গৌরবময় শিল্প নকশিকাঁথা আছে ৩১টি। সুজনী, বেতন, লেপ, আরশিলতা, বটুয়া ও জোথ কাঁথাগুলো বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে সংগৃহীত। মুখোশ শিল্পে এ সংগ্রহশালা সমৃদ্ধ। পুরুলিয়ার ছৌ নাচের অনুষঙ্গ দৃষ্টিনন্দিত মুখোশ আছে সংগ্রহশালাটিতে। এ ছাড়া হুগলি, মেদিনীপুরের বিভিন্ন লোকনৃত্যে ব্যবহƒত মুখোশ সযতেœ সংরক্ষিত আছে এখানে। বরিশাল ও বাঁকুড়ার মনসার ঘট, পিঠার ছাঁচ, বিষ্ণুপুরের দশাবতার তাস প্রভৃতি লোকশিল্পের উপাদান সংগ্রহশালাটিকে সমৃদ্ধ করেছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর চর্চায় আশুতোষ সংগ্রহশালার কথা স্মরণে রাখতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত প্রথম সংগ্রহশালাটি বাংলার লোকশিল্পের ঐতিহ্যকে বারংবার স্মরণ করিয়ে দেয়।
উপসংহার
ফোকলোর-চর্চার সূচনাকারী প্রতিষ্ঠান তিনটির কার্যক্রম বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ফোকলোর কার্যক্রম বর্তমানে স্তিমিত আছে। যদিও বাঙালিদের কাছে ফোকলোরের মতো আপাত-অপরিচিত বিষয়টিকে সূচনাকারী এসব প্রতিষ্ঠান একসময় পরিচয় করিয়েছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান কোনো না কোনোভাবে ফোকলোর নিয়ে কাজ করেছে। যেমন : এশিয়াটিক সোসাইটির কার্যক্রম সীমাবদ্ধ ছিল ফোকলোর-বিষয়ক গ্রন্থ ও প্রবন্ধ প্রকাশের মধ্যে। বিশেষত প্রতিষ্ঠানটির জার্নালে ফোকলোর-বিষয়ক অসংখ্য প্রবন্ধ প্রকাশ হয়েছে কিন্তু বর্তমানে প্রবন্ধ প্রকাশের সেই ধারা এখন নেই বললেই চলে। প্রতিষ্ঠানটির গ্রন্থ প্রকাশনাও আর অব্যাহত নেই। একই চিত্র বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এর ক্ষেত্রেও। সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকাটি অনেক দিন ধরে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে না। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের তুলনায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর গবেষণার চরিত্র কিছুটা ভিন্ন। আজও প্রতিষ্ঠানটি ফোকলোর বিষয়ে উচ্চতর গবেষণার ধারা অব্যাহত রেখেছে। মাঝেমধ্যে বিশিষ্ট ফোকলোর-তাত্ত্বিকদেরকে দিয়ে আলোচনাচক্রের আয়োজন করে। যদিও এখন পর্যন্ত স্বতন্ত্র ফোকলোর বিভাগ প্রতিষ্ঠা করতে না পারাকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম ব্যর্থতা বলা যায়। অনেক পরে হলেও সে দায়িত্ব পালন করেছে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়। পশ্চিমবঙ্গে একমাত্র কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘লোকসংস্কৃতি বিভাগ’-এ ফোকলোর বিষয়ে উচ্চতর পড়াশোনার সুযোগ আছে। অনেক আগেই যে সুযোগটা তৈরি করার কথা ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের। এসব কথা মাথায় রেখে বলা যায় আলোচিত তিনটি প্রতিষ্ঠান বাংলা অঞ্চলে ফোকলোর-চর্চার পথপ্রদর্শকের ভূমিকাই পালন করেছে।

তথ্যসূত্র
সিরাজুল ইসলাম ‘এশিয়াটিক সোসাইটি, কলকাতা’, সিরাজুল ইসলাম (সম্পা.), বাংলা পিডিয়া, দ্বিতীয় খ- (ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ২০১১), পৃ. ২৩০।
মুহম্মদ আবদুল জলিল, বাংলাদেশের ফোকলোর চর্চার ইতিবৃত্ত (ঢাকা: অনার্য, ২০১১), পৃ. ১৫১।
দুলাল চৌধুরী ‘দি এশিয়াটিক সোসাইটি”, ঐতিহ্য, তৃতীয় বর্ষ (২০১০), পৃ. ২৩০।
বাংলা পিডিয়া, দ্বিতীয় খ-, পৃ. ২৩০।
অশোক ভট্টাচার্র্য, ‘এশিয়াটিক সোসাইটি ও বাংলাভাষাচর্চা’, অরুণকুমার বসু (সম্পা.), সারস্বত (কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ২০০৮), পৃ. ১২৫।
অমিতা চৌধুরী, প্রতিষ্ঠান ও লোকসংস্কৃতিচর্চা (দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা: আশুরালী গ্রামোন্নয়ন পরিষদ, ২০০৫), পৃ. ১৮।
মুহম্মদ আবদুল জলিল, বাংলাদেশের ফোকলোর চর্চার ইতিহাস (ঢাকা: আফসার ব্রাদার্র্স, ২০০০), পৃ. ৪০।
রমাকান্ত চক্রবর্তীর সাক্ষাৎকার ‘নাড়ির টানে ৬০ বছর পর: এশিয়াটিক সোসাইটি কলকাতার ২২৫ বছর ’, রুটস, প্রথম বর্ষ, নবম সংখ্যা (২০০৯), পৃ. ৪৪।
প্রতিষ্ঠান ও লোকসংস্কৃতিচর্চা, পৃ. ২১।
রমাকান্ত চক্রবর্তী, ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ’, অরুণকুমার বসু (সম্পা.), সারস্বত (কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ২০০৮), পৃ. ২৫।
‘বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষদের কার্য্যবিবরণ ও সভ্যগণের তালিকা’, সাহিত্য-পরিষদ পত্রিকা, প্রথম ভাগ, প্রথম সংখ্যা (১৩০১), পৃ. ৫২।
তদেব, পৃ. ৫৩।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ছেলেভুলানো ছড়া’, সাহিত্য-পরিষদ পত্রিকা, প্রথম ভাগ, তৃতীয় সংখ্যা (১৩০১), পৃ. ১৮৯-২০২।
সুনীল দাস, ‘সাহিত্য পরিষদের আত্মা ’, দেশ, ৬৭ বর্ষ, ১৯ সংখ্যা (২০০০), পৃ. ৩২-৩৩।
দীনেশচন্দ্র সিংহ, প্রসঙ্গ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (কলকাতা: কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ২০০৭), পৃ. ১।
রওশন ইজদানী, মোমেনশাহীর লোকসাহিত্য (ঢাকা: বাংলা একাডেমি, ১৯৬৮), পৃ. ৫৭।
সুভাষচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলার লোকসংস্কৃতি চর্চা ও ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য (কলকাতা: একুশশতক, ২০০৯), পৃ. ৩৮-৩৯।
বরুণকুমার চক্রবর্তী, বাংলা লোকসাহিত্য চর্চার ইতিহাস (কলকাতা, পুস্তক বিপণি, ১৯৯৯), পৃ. ৪৯৮।
উঁংধহ তনধারঃবষ, ইবহমধষ ঋড়ষশ-ইধষষধফং ভৎড়স গুসবহংরহময ধহফ ঃযব ঢ়ৎড়নষবসং ড়ভ ঃযবরৎ অঁঃযবহঃরপরঃু (কড়ষশধঃধ: টহরাবৎংরঃু ড়ভ ঈধষপঁঃঃধ, ১৯৬৩), ঢ়. ী.
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘আশীর্বাদ’, মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন, হারামণি, প্রথম খ- (কলকাতা: কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৪২)।
গুরুসদয় দত্ত ও নির্মলেন্দু ভৌমিক (সম্পা.), শ্রীহট্টের লোকসঙ্গীত (কলকাতা: কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৬৬), ভূমিকাংশ দ্রষ্টব্য।
বাংলার লোকসংস্কৃতি চর্চা ও ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য, পৃ. ৫৫।
প্রতিষ্ঠান ও লোকসংস্কৃতিচর্চা, পৃ. ৫৭।

লেখক : উদয় শংকর বিশ্বাস, সহযোগী অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

দক্ষিণাঞ্চলের সম্ভাবনাময় মৃৎশিল্প

সুশান্ত ঘোষ
সভ্যতার সূচনা মৃৎশিল্পের হাত ধরেই। একদিকে দৈনন্দিন প্রয়োজন, অন্যদিকে শিল্প ভাবনা দুইই মিলেছে মৃৎশিল্পের মধ্যে দিয়ে। মৃৎশিল্পের প্রধান কাঁচামাল মাটি আমাদের দেশে সহজলভ্য হওয়ায় এই শিল্প ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। দামে অত্যন্ত সস্তা, পরিবেশ বান্ধব এই মৃৎশিল্প বাংলার আদিশিল্প হিসেবে স্বীকৃত যা আজও বহমান রয়েছে। বাংলার ‘টেরাকোটা’ আজ বিশ্ব শিল্পের অন্যতম নিদর্শণ। নদ নদী নির্ভর দক্ষিণাঞ্চল মৃৎশিল্পের অন্যতম ঠিকানা। মৃৎশিল্পের অন্যতম কাচামাল ‘মাটি’র সহজলভ্যতা, নদী-খালে নৌ -পরিবহনের মধ্যে দিয়ে এই মৃৎশিল্প এই অঞ্চলে বিশেষভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এ ছাড়াও দৈনন্দিন প্রয়োজনে বরিশাল অঞ্চলের এই মৃৎশিল্পের রয়েছে বিশেষ বৈশিষ্ট্য যা এই শিল্পকর্মকে অন্য অঞ্চল থেকে পৃথক করেছে। বরিশাল অঞ্চলে যারা মৃৎশিল্পের সাথে যুক্ত রয়েছেন তাদেরকে স্থানীয় ভাবে ‘পাল’ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। এই পাল দুই শ্রেণীতে বিভক্ত। যারা শুধুমাত্র মূর্তি তৈরী করেন তাদেরকে স্থানীয়ভাবে ‘গুণরাজ’ অভিধায় সিক্ত করা হয়। অন্যদিকে কুম্ভকার- যারা হাড়ি, পাতিল সহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় তৈজস তৈরী করে থাকেন, তারা শুধু পাল নামে স্থানীয় ভাবে পরিচিত।
বরিশাল অঞ্চলে দেড় থেকে দুই হাজার পরিবার রয়েছেন যারা বংশ পরম্পরায় এই পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। বরিশাল জেলায় এই পেশায় রয়েছে অন্তত ৫’শ পরিবার। বংশ পরম্পরায় এই পেশায় নিয়োজিত হলেও পিরোজপুরের নাজিরপুর ও স্বরুপকাঠী উপজেলা ও ঝালকাঠীতে বংশ পরম্পরার বাইরেও বেশ কিছু পরিবার এই পেশায় নিয়োজিত দেখা যায়।
বরিশাল অঞ্চলের মৃৎশিল্পের প্রধান কেন্দ্রগুলো হল, বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার কলসকাঠী ও মহেশপুর, আগৈলঝারা উপজেলার গৈলা ইউনিয়নের উত্তর সিহিপাশা গ্রাম, ঝালকাঠী জেলার পালবাড়ি- হিমানন্দকাঠী, শিমুলেশ্বর গ্রাম, পিরোজপুর জেলার- কাউখালী ও পিরোজপুর পালপাড়া, পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলার মদনপুরা, বগা এলাকায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বসতি রয়েছে। বর্তমানে পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলার ‘মদনপুরা’ ব্রান্ড সারা বাংলাদেশে বিখ্যাত। এই অঞ্চলের মৃৎসামগ্রী বিভিন্ন বাণিজ্যিক কারুশিল্প প্রতিষ্ঠান হয়ে বিদেশেও রপ্তানি হয়ে থাকে।
বরিশাল অঞ্চলে অধিকাংশ মৃৎকেন্দ্রগুলিতে চাকা ঘুরিয়েই মৃৎসামগ্রী তৈরী করা হয়। অধিকাংশ এলাকায় রয়েছে মৃৎপাত্র পোড়ানোর প্রথাগত ব্যবস্থা যাকে স্থানীয় ভাষায় ‘পুইন’ বলা হয়ে থাকে। শুধুমাত্র বাউফল ও ঝালকাঠীতে ইলেকট্রিক-মটর চালিত চাকা রয়েছে। এই চাকা ১৫-২৫ হাজার টাকার মধ্যে হয়ে থাকে। এ ছাড়াও বাউফলে মাটি প্রস্তুত করার মিক্সার মেসিন রয়েছে। এসব মেসিন দিয়ে খুব দ্রুতগতিতে বিপুল সংখ্যক পণ্য সামগ্রী তৈরী হয়ে থাকে। শুধুমাত্র বাউফলে নিজস্ব ব্রান্ডের ছাপ দেয়ার ব্যবস্থা থাকেলেও অন্যত্র তা নেই। মৃৎকেন্দ্র গুলিতে বাউফলে কাপাসিয়া মাটির সাথে খয়ের মিশিয়ে পরিবেশ বান্ধব রং তৈরী করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া অন্যত্র লাল মাটি তরল করে কলসকাঠী, মহেশপুর ও উত্তর সিহিপাশা এলাকায় হাড়ি পাতিলে রং দেয়া হয়ে থাকে।
এলাকা ভিত্তিক বিখ্যাত মৃৎসামগ্রী হল-

জেলা উপজেলা এলাকা উৎপাদিত উল্লেখযোগ্য শিল্পকর্ম

১. বরিশাল বাকেরগঞ্জ কলসকাঠী প্রতিমা নির্মাণ, মুড়ি ভাজার পাত্র, মাটির সাজ, হাড়ি, কলস, বিভিন্ন আকারের মৃৎপাত্র
২.বরিশাল বাকেরগঞ্জ মহেশপুর সানকি, কয়েলদানি, মাটির পাত্র, জালেরকাঠী, খোরা, বিভিন্ন আকৃতির প্লেট, পা-ঘষার দন্ড, পিঠার সাজ
৩. বরিশাল আগৈলঝারা উত্তর সিহিপাশা বিভিন্ন ধরনের মাটির পাত্র, প্রতিমা নির্মাণ, মনসার ঘট নির্মাণ
৪. পিরোজপুর কাউখালি কাউখালি পালপাড়া প্রতিমা নির্মাণ, মনসার ঘট, হাড়ি পাতিল
৫. পিরোজপুর সদর পিরোজপুর পালপাড়া প্রতিমা নির্মাণ, টালি, হাড়ি পাতিল
৬. ঝালকাঠী সদর ঝালকাঠী পাল পাড়া প্রতিমা নির্মাণ, হাড়ি পাতিল
৭. ঝালকাঠী হিমানন্দকাঠী মনসারঘট, প্রতিমা নির্মাণ, ঘট, মাটির খেলনা, সামগ্রী তৈরী
৮. ঝালকাঠী শিমুলেশ্বর গ্রাম প্রতিমা নির্মান, মনসারঘট, মাটির কয়েল দানি, ঘট, পাখির বাসা, খেলনা সামগ্রী তৈরী
৯.পটুয়াখালী বাউফল মদনপুরা আধুনিক মৃৎসামগ্রী- ডিনারসেট, তৈজসপত্র, ফুলদানী, জার , টেরাকোটা, আধুনিক ডিজাইনে বিপুল আকারে উৎপাদিত হয়ে থাকে
১০.পটুয়াখালী বগা জালের কাঠি, মাটির ডিনারসেট, বিভিন্ন আধুনিক নকশার পাত্র
বরিশালের মৃৎপাত্রের বৈশিষ্ট্য
দৈনন্দিন কাজের জন্য যে ধরনের মৃৎপাত্র প্রয়োজন হয় তার সব কিছুই বরিশালের মৃৎশিল্পীরা তৈরী করে থাকেন, আগে এর সবই হাতে তৈরী করা হলেও বর্তমানে কিছু কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ চালিত চাক রয়েছে।
বরিশালে হিন্দু ধর্মীয় ও লোকাচার উপকরণ তৈয়ার কাজের সাথে যুক্ত বরিশালের চরকাউয়া, আগৈলঝারা উপজেলার গৈলা, ঝালকাঠীর নবগ্রাম ও হিমানন্দকাঠী, উজিরপুর, বাকেরগঞ্জের কলসকাঠী। মনসাঘটের জন্য বিখ্যাত আগৈলঝারা উপজেলার গৈলা, ঝালকাঠীর নবগ্রাম ও হিমানন্দকাঠী, উজিরপুর। মেলার সামগ্রীর জন্য হিমান্দকাঠী, কলসকাঠী বিখ্যাত। প্রতিমা তৈরীতে গৈলা, পিরোজপুর ও কলসকাঠীর আলাদা সুনাম রয়েছে। কলসকাঠীতে মুরি ভাজার সামগ্রী তৈরীতে সুনাম রয়েছে। বগা, বাউফলে জালের কাঠিসহ মাছ ধরার উপকরণের জন্য বিখ্যাত বাউফল ও বগায় বর্তমান সময়ে আধুনিক ডিজাইনের ডিনারসেটসহ বিভিন্ন গৃহ সজ্জার জন্য উপকরণ তৈরী করে থাকে। বিল্বগ্রাম মটকা তৈরীর জন্য বিখ্যাত।
বরিশাল অঞ্চলের মৃৎকেন্দ্র গুলোর মধ্যে বাউফল ও বগা ছাড়া আর সকল কেন্দ্রেই প্রাচীন ডিজাইনে মৃৎসামগ্রী তৈরী হয়ে থাকে। প্রশিক্ষিত ও আধুনিক বাজার সম্পর্কে ধারনা না থাকায় তারা অত্যন্ত দরিদ্র অবস্থায় শত শত বছর ধরে তাদের উৎপাদিত শিল্পকর্মগুলি তৈরী করে থাকে। এ অবস্থা নিরসনে এইসব মৃৎশিল্পীদের যথাযথ প্রশিক্ষণ ও বিক্রয়কেন্দ্র থাকা জরুরী। পূর্বে বিসিক এর পক্ষ থেকে বহু আগে ট্রেণিং কার্যক্রম করা হলেও দীর্ঘদিন ধরে এই কার্যক্রম চলছে না। কিন্ত এই শিল্প বর্তমানে টিকে থাকার জন্য প্রাচীন ডিজাইনের সাথে সাথে বাজারের চাহিদা অনুসারে উৎকৃষ্ট মান ও নকশার শিল্পদ্রব্য তৈরী করা জরুরী। দেশে উৎকৃষ্ট কাঁচামাল ও বৃহৎ শিল্প পরিবার থাকা সত্বেও এই শিল্পের প্রতি যথযথ গুরত্ব না দেয়া হতাশাজনক। আদিমতম এই পেশাটি টিকিয়ে রাখতে হলে – উৎকৃষ্ট মানের সৃজনশীল শিল্পকর্ম তৈরী করা জরুরী, আর এ জন্য দরকার যথাযথ প্রশিক্ষণ ও বাজার, আর এর মাধ্যমেই মৃৎশিল্পের সম্ভাবনা ও বিকাশ বিস্তৃতি লাভ করবে। বহু শিল্পী পরিবার বাদেও দরিদ্র পরিবারের কর্মসংস্থান সম্ভব হবে ।
মৃৎশিল্পী সম্মেলন ও সম্মাননা : সূচনা যে ভাবে
মৃৎশিল্পীদের উজ্জীবিত করতে ২০০৯ সাল থেকে মৃৎশিল্পীদের বিভিন্ন পুরষ্কার ও সম্মাননা দিয়ে আসছে ‘মৃৎশিল্পী সম্মেলন ও সম্মাননা’ বরিশাল থেকে। ২০০৯ সালে আমি (লেখক নিজে) ও আমার বন্ধু শিল্পী আমিনুল হাসন লিটু একটি পূজামন্ডপে স্থানীয় গুণরাজদের প্রতিমা তৈয়ারকর্ম দেখতে যাই এবং সেখানে জানতে পারি – এই গুণরাজরা পূজার সময়ে তাদের সন্তানদের কোন দিনই পূজার জামা দিতে পারেন না। যারা সমাজে সবাইকে উৎসবের আনন্দে ভাষিয়ে দেবার মূল কাজটি করেন, তারাই গৃহে ফেরেন নিরানন্দে। কারণ বারোয়ারী পূজাগুলো তাদের পূজার আর্থিক বাজেটের সব অর্থ ষষ্ঠীর আগে সংগ্রহ করতে পারেন না বিধায় মন্দির কমিটিগুলো গুণরাজদের সাথে প্রতিমা তৈয়ার করার যে আর্থিক চুক্তি করেন তার কিছু অংশ পূজার আগে দিতে পারলেও গুণরাজদের অধিকাংশ পাওনা অর্থ মন্দির কমিটিগুলো সাধারণত দিয়ে থাকেন পুজার পরে। কাজ শেষে প্রতিমা নির্মাণের অর্থ না পাওয়ায় গুণরাজদের একপ্রকার খালি হাতেই ঘরে ফিরতে হয়। আর গুণরাজদের ছেলে মেয়েদের মলিন মুখে সামিল হতে হয় পুজোর উৎসবে। কোন দিনই তারা পূজার এই সময়ে নতুন জামা-কাপড় পায়না।
গুণরাজদের এমন দুখ-বেদনাদায়ক বাস্তবতার পূজার গল্প শুনে সেদিনই দুই বন্ধু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম – গুণরাজরা হাসি মুখে যাতে ঘরে ফিরতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। এই চিন্তা নিয়ে আমরা দ্বারস্থ হই বরিশালের সমাজসেবী শিল্পপতি বিজয় কৃষ্ণ দে’র কাছে। তিনি শুধু এটি সমর্থনই করেননি, এই কাজে যে অর্থ খরচ হবে সেটি দিতে তিনি রাজী হন। তাৎক্ষণিক ‘মৃৎশিল্পী সম্মেলন ও সম্মাননা’ নামে একটি কমিটির আহবায়কের দ্বায়িত্ব পালন করেন বরিশালের বিশিষ্ট সমাজসেবী রাখাল চন্দ্র দে। বিশিষ্ট আইনজীবী ফনী ভূষণ দাস সামগ্রিক ভাবে এই অনুষ্ঠানকে সফল করতে ব্যাপক পরিশ্রম করেন। শুরু হয় মৃৎশিল্পীদের সম্মানিত করার অভিনব প্রয়াস। নগরীর কালিবাড়ী রোডের ধর্মরক্ষিণী সভা গৃহে প্রথম সম্মাননা অনুষ্ঠানে বরণ্যে চিত্রশিল্পী শহিদ কবীর এই আয়োজনে সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। মাটি তার কাছে প্রিয়। মাটির মানুষদের তিনি মমতামাখা কন্ঠে অনুভূতি প্রকাশ করেন। অনুষ্ঠানে সভাতিত্ব করেন রাখাল চন্দ্র দে। অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট গণসংগীত শিল্পী আক্কাস হোসেন, সংস্কৃতিজন নিখিল সেন সহ সমাজের বহু গণ্যমান্য ব্যাক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। গুণরাজদের সবাইকে অর্থ, বস্ত্র দেয়া হল। প্রথম বছর সবাইকে সম্মাননা ক্রেস্ট দেয়া হল। মাটির শিল্পীরা আপ্লুত হল। এই প্রথম তাদেরকে সম্মানিত করার প্রয়াসে তারা অনেকেই চোখের জল ধরে রাখতে পারছিলেননা। যে শিল্পীরা ছিল অবহেলিত, যাদের নির্মিত প্রতিমা শিল্পকর্ম হিসেবে মানুষের কাছে পেতনা কদর, সেই মানুষকে সম্মাননা দেয়ার এই প্রয়াসে সমাজের বিশিষ্ট ব্যাক্তিরা এই প্রয়াসকে অভিনন্দিত করলেন। সম্মাননা আয়োজনের ফলশ্রুতিতে পরের বছরই বরিশালের মন্দিরগুলোর দুর্গাপূজা আয়োজক কমিটি পূজার নিমন্ত্রণপত্রে প্রথমবারের মতো তাদের মন্ডপে নির্মিত প্রতিমার নির্মাণকারীর নাম ও নামের পূর্বে ‘মৃৎশিল্পী’ শব্দটি জুরে দিতে লাগলেন। প্রথম বছর চল্লিশ জন মৃৎশিল্পী যোগ দিয়েছিলেন এবং প্রতিবছর এই যোগদানের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েছে।
প্রথমবছর থেকেই আমরা চেয়েছিলাম পরম্পরার এই মৃৎশিল্পীদের সাথে প্রাতিষ্ঠানিক মৃৎ, চারুশল্পী ও গবেষকসহ দেশের আলোকিত মানুষদের মেল বন্ধন করতে। একারনেই শুরু থেকেই প্রতিবছর এই অনুষ্ঠান আয়োজনে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়- চারুকলা অনুষদের বর্তমান ডিন, শিল্পী নিসার হোসেন প্রধান উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করেন। চারুশিল্পী, সাংবাদিক, গবেষক, সংস্কৃতিজনদের ইতোমধ্যে যারা এই সম্মিলনে অতিথি হিসেবে যুক্ত হয়েছিলেন; তারা হলেন বরণ্যে শিল্পী রফিকুন নবী, শিল্পী ড. কাজী মোজাম্মেল হোসেন, শিল্পলেখক সৈয়দ আজিজুল হক, শিল্পী সৈয়দ এনায়েত হোসেন, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন পুত্র শিল্পানুরাগী ময়নুল আবেদিন, শিল্পলেখক বুলবন ওসমান, শিল্পলেখক মইনুদ্দিন খালেদ, শিল্পী শেখ আফজাল হোসেন, শিল্পী নাইমা হক, শিল্পী মো. মনিরুজ্জামান, শিল্পী রবিউল ইসলাম, শিল্পী চিন্ময়ী সিকদার, শিল্পী আবদুস সাত্তার তৌফিক, সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত, সাংবাদিক সোহরাব হোসেন, সাংবাদিক জ.ই. মামুন, লেখক আহমাদ মোস্তফা, কিশোরগঞ্জ শেখ হাসিনা বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল্লা খান প্রমুখ।
২০১৭ সালে প্রথমবারে মতো এই সম্মাননার সাথে মৃৎশিল্প মেলা ও শিশু শিল্পীদের আঁকা চিত্রপ্রদর্শনী যুক্ত হয়। তখন অনুষ্ঠান স্থানটি পরিবর্তিত হয়ে অশ্বিনী কুমার হলে নেয়া হয়। ঐ বছর ভারপ্রাপ্ত সংস্কৃতি সচিব আকতারী মমতাজ প্রধান অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠানে যোগ দেন। তিনি প্রদর্শনী ঘুরে দেখেন। এই সম্মাননাকে ঘিরে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আয়োজনে মুখরিত হয় বরিশাল অঞ্চল। বরিশালের বাইরে থেকে বিশেষ করে টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, শেরপুর, নওগা, রাজশাহী থেকে মৃৎশিল্পীরা এসে যোগ দেয় এই আয়োজনে। বরিশালের এই আয়োজনটি রূপ নেয় জাতীয় ভিত্তিক মৃৎপ্রদর্শনী ও আয়োজনে। ২০২১ সাল থেকে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় এই আয়োজনটিতে আংশিক আর্থিক সহযোগিতা শুরু করে – যা আজও অব্যাহত রয়েছে। গত দুই বছর থেকে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী এই আয়োজনে ভার্চুয়ালী উপস্থিত থেকে উৎসবের উদ্বোধন করে আসছেন।
বরিশালে মৃৎশিল্পী সম্মেলন ১৪২৮ ও পনেরো মৃৎশিল্পীকে সম্মাননা প্রদান
২৭ আশ্বিন ১৪২৮ (১২অক্টোবর ২০২১) মঙ্গলবার বরিশালের ঐতিহ্যবাহী ১৩তম মৃৎশিল্পী সম্মেলন ও সম্মাননা অনুষ্ঠান সকাল দশটায় বরিশাল জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের প্রতিমন্ত্রী, কে এম খালিদ এম.পি. মহোদয় অন্তর্জাল মাধ্যমে এই অনুষ্ঠানের শুভ উদ্বোধন করেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে অন্তর্জাল মাধ্যমে যুক্ত ছিলেন বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের পরিচালক জনাব ড. আহমেদ উল্লাহ ও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন এর পুত্র শিল্পানুরাগী প্রকৌশলী ময়নুল আবেদিন। বিশেষ অতিথি হিসেবে বরিশালের জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার উপস্থিত থেকে মৃৎশিল্পীদের সম্মাননা ও উৎসব উপহার এবং অর্থ সম্মাননা প্রদান করেন। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে আরও উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদের মৃৎশিল্প বিভাগের সহকারী অধ্যাপক চিন্ময়ী সিকদার, নজরুল গবেষক ড. কাজী মোজাম্মেল হোসেন, শিক্ষাবিদ শাহ সাজেদা ও সামিট বরিশাল পাওয়ার লিমিটেডের প্লান্ট ম্যানেজার ফকির মাহাদী হাসান। অনুষ্ঠানে বরিশালের সংস্কৃতি ও সামাজিক অঙ্গনের ব্যাক্তিরা ছাড়াও বরিশাল ও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গুণী মৃৎশিল্পীরা ও তাদের সহযোগীরা অংশ নেন। এই উপলক্ষে নকশী পিঠার ছাঁচের এক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।
সম্মাননাপ্রাপ্ত মৃৎশিল্পীদের প্রত্যোককে নগদ পাঁচ থেকে দশ হাজার টাকা, ক্রেস্ট উত্তরীয় ও বস্ত্র এবং অংশগ্রহণকারীদের প্রত্যেককে এক হাজার টাকাসহ বস্ত্র প্রদান করা হয়। এ আয়োজন উপলক্ষে সংক্ষিপ্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন আলতাফ হোসেন।
এবছর যারা সম্মাননা পদক পেয়েছেন-
জীবন সম্মাননা
‘শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন মৃৎশিল্পী জীবন সম্মাননা পদক’কে ভূষিত হয়েছেন – বরিশাল জেলার আগৈলঝারা উপজেলার গৈলা গ্রামের গুণরাজ জয়দেব পাল। যিনি প্রতিমা শিল্পী।
‘শিল্পী চিত্ত হালদার সৃজনশীল মৃৎশিল্পী জীবন সম্মাননা পদক’কে ভূষিত হয়েছেন- মাদারীপুর জেলার ডাসার উপজেলার শশীকর গ্রামের উমা রানী বিশ্বাস। যিনি নকশী পিঠার ছাঁচ শিল্পী করেন।
সম্মাননা পদক
মৃৎপাত্র বিভাগ :
সাথী রানী দে মৃৎশিল্পী সম্মাননা পেয়েছেন শোভা রানী পাল মহেশপুর, বাকেরগঞ্জ, বরিশাল। ক্রাফটস ভিলেজেস লি: মৃৎশিল্পী সম্মাননা পেয়েছেন কানাই চন্দ্র পাল, মদনপুরা, বাউফল, পটুয়াখালী। দৈনিক শাহনামা মৃৎশিল্পী সম্মাননা পেয়েছেন তপন কুমার পাল- নবগ্রাম ঝালকাঠী।
সৃজণশীল মৃৎশিল্প বিভাগে
শিল্পী বলহরি সাহা মৃৎশিল্পী সম্মাননা পেয়েছেন শখের হাড়ি শিল্পী সুশান্ত কুমার পাল, রাজশাহী। রাজ্জাক মমতাজ সেবা সংগঠন মৃৎশিল্পী সম্মাননা পেয়েছেন মনসার ঘট শিল্পী তুলশী রানী পাল, হিমানন্দকাঠী, ঝালকাঠী। অনিমা রানী খা মৃৎশিল্পী সম্মাননা পেয়েছেন মাটির পুতুল শিল্পী শোভা রানী পাল, টাঙ্গাইল। সংগ্রামী সুধীর সেন মৃৎশিল্পী সম্মাননা পেয়েছেন মাটির পুতুল শিল্পী বিশ্বনাথ পাল, নওগা।
প্রতিমা বিভাগ :
শহীদ কুমুদবন্ধু রায় চৌধুরী নাটু বাবু গুণরাজ সম্মাননা পেয়েছেন গুণরাজ রূপক পাল, কলসকাঠী, বাকেরগঞ্জ, বরিশাল। এস এস হেলেঞ্চা লি: গুণরাজ সম্মাননা পেয়েছেন গুণরাজ বিনোদ পাল, পিরোজপুর। শৈলবালা ঘোষ গুণরাজ সম্মাননা পেয়েছেন গুণরাজ নিতাই পাল, রাজবাড়ি। মঙ্গল শোভাযাত্রা গবেষণা ও প্রসার কেন্দ্র গুণরাজ সম্মাননা পেয়েছেন গুণরাজ অসীম পাল, রাজবাড়ি।
পি এ্যান্ড পি গুণরাজ সম্মাননা পেয়েছেন শেখর পাল পিরোজপুর। মৃৎশিল্পী সম্মেলন ও সম্মাননা গুণরাজ সম্মাননা পেয়েছেন – গুণরাজ রণজিৎ পাল ভাঙ্গা, ফরিদপুর। বিশেষ সম্মাননা : আগৈলঝারা উপজেলার গৈলা গ্রামের মৃৎশিল্পী জয়দেব পাল এর ছেলে সুজন পালকে রোবট প্রস্তুত করার জন্য বিশেষ সম্মাননা প্রদান করা হয়। সম্মাননা প্রদান করেন সামিট বরিশাল পাওয়ার লিমিটেডের প্লান্ট ম্যানেজার ফকির মাহাদী হাসান ।

লেখক:
সুশান্ত ঘোষ, সাংবাদিক, গবেষক ও সংগঠক।