রঞ্জনা বিশ্বাস
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সবচেয়ে বেশি রচিত হয়েছে ১৯৯৬ এরপর, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার মধ্য দিয়ে। প্রায় সাড়ে চার হাজারের বেশি গ্রন্থ রচিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে। এর বেশির ভাগই ঐতিহাসিকের গভীর দৃষ্টিভঙ্গীতে রচিত নয়। যে দু একজন সত্যনিষ্ঠ ‘নিরপেক্ষ’ ইতিহাসের কথা ভেবেছেন তারাও জনজীবনকে উপেক্ষা করেছেন। আলোচনায় এনেছেন যুক্তিতর্ক আর ‘বঙ্গবন্ধু’কে মহান করে দেখাবার প্রচেষ্টা। বর্তমানে আওয়ামী গণরাজনীতির চাপে নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকের আরাধ্য বিষয়বস্তু একেবারই সংকুচিত হয়ে গেছে, কখনও কখনও উপেক্ষিত হয়েছে। ফলে ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে উঠেছেন একটি বিশেষ দলের নেতা। সামগ্রীকতাকে পরিহার করে সংকীর্ণ গোষ্ঠীচেতনায় সংকুচিত করে ফেলার এই প্রবনতার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে এক একটি আকবরনামা। অথচ বাংলাদেশে ‘বঙ্গবন্ধু’ বাঙালি জাতীয় ঐক্যের প্রতীক রূপে প্রতিভাত হন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের ‘গণরাজনীতির চাপে তিনিও হয়ে উঠছেন বিশেষ দলের প্রতীক। এ থেকে মুক্তির উপায় কী? মুক্তির উপায় জনজীবনের সঙ্গে ঐতিহাসিকের সামাজিক কমিটমেন্ট রক্ষা করা। আমরা যাদের ‘জন’ বলি এরা কারা? এদের সঙ্গে কেন্দ্রিয় শাসকদের সম্পর্ক কতটুকু? মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে এদের সম্পর্ক কেমন ছিল ? এই সব প্রশ্নের উত্তর কি আমাদের পাঠ্যবইয়ের চিন্তা ও রচনার সাহায্যে পাওয়া সম্ভব ? পাওয়া সম্ভব নয়, কেননাÑ সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক চেতনা ও তাদের সমাজচেতনার মুখ্য উপাদান এসব রচনায় উপস্থিত নয়। আর তাই ‘উচ্চবর্গের দৃষ্টিভঙ্গীর বাহন ইতিহাসবিদ্যার সাধ্য নেই যে জাতীয়তাবাদের এই গুরুত্বপূর্ণ দিকটাকে স্বীকার করে কিংবা ব্যাখ্যা করে।’১ অথচ বঙ্গবন্ধু জনসাধারনের ঐক্যের প্রতীক আকাক্সক্ষার ফল, যার মধ্য দিয়ে জনসমাজ স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহন করার চেষ্টায় রত হয়েছিল এবং জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে তারা ছিনিয়ে এনেছিল বিজয়। কিন্তু উচ্চবর্গ তাকে আত্মসাৎ করার চেষ্টা করেছে, তাকে চালিয়ে দিচ্ছে বিশেষ একটি গোষ্ঠীর মহানায়ক হিসেবে। তাই এই জাতীয় ইতিহাস হয়ে উঠছে একপেশে ভাবনায় পূর্ণ, নিরানন্দময়, অগভীর , অপ্রশস্ত আর চাটুকারিতায় পূর্ণ কীর্তিগাথা।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এটুকু বলেই সব শেষ হয়ে যায় না যে, ৭ই মার্চের ভাষণ বাঙালিদের বিজয়ের যথাযথ কাল নির্দেশক অবস্থানকে খুঁজে বের করার জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ কিংবা শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের সংকট ও উত্তরণ পন্থার অভিনবত্ব শাশ্বতরূপে চিত্রিত করার চেষ্টাই হবে ঐতিহাসিকের কাজ। কিন্তু এতে করে যে বিষয়টি আড়ালে থেকে যায় তা হলো জনগণের সঙ্গে ‘নায়ক’ মানুষটির পরিবর্তনের মুহূর্তটিকে চিহ্নিত করা, স্থীর করা। আবার সেই মুহূর্তটাও তো কোনো স্থীর সময় নয় বরং নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহের ভিতর দিয়ে অবিরাম পরিবর্তন। এই প্রবাহ যতটা না উপর থেকে নিচের দিকে ধাবমান ছিল তার চেয়ে বেশি নিচ থেকে উপরের দিকে উৎসারিত হয়েছিল ফোয়ারার মত। সেই প্রবাহকে অস্বীকার করা হয় প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাস চর্চায়। এখানে ঐতিহাসিকের দায়িত্ব কেবল নায়কের দিক থেকে ঘটনা সমুহকে বর্ণনা করা। অথচ তার একটি বিশেষ সামাজিক দায়িত্বও ছিল। জনজীবনের সঙ্গে নায়কের অবস্থানের যে স্বাভাবিক ও চিরন্তন ‘ঐক্য’ ও ‘সমগ্রভাবনা’ আছে তার অভেদতত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব সব সময়ই এড়িয়ে গেছেন তারা। কেন এড়িয়ে গেছেন ? কারণ Ñ জনজীবনে রাজনৈতিক নায়কের ইতিহাস কিভাবে প্রতিভাত হয়েছিল তার সন্ধান পাওয়ার চেষ্টা তারা করেননি। আবার মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক রচিত ইতিহাসেও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। যায়নি কারণ, ‘ নি¤œবর্গের রাজনীতির চরিত্র নির্ধারিত হচ্ছে নি¤œবর্গের নিজস্ব চেতনার রূপরেখানুসারে। সেই চেতনা গড়ে উঠেছে অধীনতার অভিজ্ঞতা থেকে।’২
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের জনযোদ্ধাগণ যুদ্ধ করেছেন ১১টা সেক্টরের অধীনে। যাদের অধীনে তারা যুদ্ধ করেছেন তারা প্রায় সকলেই সামরিক কর্মকর্তা, তাদের চেয়ে শিক্ষিত, সামরিক বিষয়ে প্রশিক্ষিত অতএব যুদ্ধের প্রসাশনিক বিন্যাসানুযায়ি ক্ষমতাটা চলে যায় উচ্চবর্গেরই হাতে। ফলে পরবর্তী ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধের কীর্তিগাথা ও চেতনার সাক্ষ্য প্রমাণ সংরক্ষিত হয়েছে উচ্চবর্গের দিক থেকে তাদের অধীনে এবং তাদেরকে ঘিরে। বলা বাহুল্য যে, স্বাধীনতার পরে ক্ষমতার কেন্দ্রেও তারাই ছিলেন। এমতাবস্থায় নি¤œবর্গের জনজীবন স্বাভাবিক ভাবেই ইতিহাসে উপেক্ষিত হয়েছে। তাই বলে কি নি¤œবর্গের উপস্থিতি একেবারেই অস্বীকার করা সম্ভব? সম্ভব নয়। ‘ একমাত্র একটি মুহূর্তেই শাসককুলের মানসপটে নি¤œবর্গ আবির্ভূত হয় স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের অধীকারি হয়ে। সেই মুহুর্তটি হল বিদ্রোহের মুহূর্ত।’৩ তাই সাবল্টার্ন স্টাডিজের গবেষনায় সবচেয়ে বড় অংশ জুড়ে রয়েছে বিদ্রোহের ইতিহাস, বিশেষত কৃষক বিদ্রোহ। এখানে নি¤œবর্গের চিন্তার স্বরূপটি কেমন ছিল তার কিছুটা হদিস পাওয়া যায়। আর তাই সাবল্টার্ন স্টাডিজের ঐতিহাসিক গণ বিদ্রোহের ইতিহাসগুলির মধ্যে নি¤œবর্গের চেতনার সন্ধান করেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া জনযোদ্ধারাও তো এক বিশেষ চেতনার বশবর্তী হয়ে যুদ্ধে নেমেছিলেন। সেই চেতনার পরিচয়টি পাবার জন্য আমরা কতটা এগিয়ে এসেছি? উচ্চবর্গের হাতে রচিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ভিতরে কোনো সাবল্টার্ন স্টাডিজের ঐতিহাসিকও ‘নি¤œবর্গের অবস্থান’ সনাক্ত করার জন্য আগ্রহী হননি। অথচ ইতিহাসের কর্মকান্ডের মধ্যে নি¤œবর্গের একটি স্বতন্ত্র ভূমিকা রয়েছে। সাবল্টার্ন স্টাডিজের ঐতিহাসিকের কাজ যদি হয় প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাসের সমালোচনা করা৪ তাহলেও আমাদের দেশে সেই অর্থে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নি¤œবর্গের ঐতিহাসিকের ভূমিকা চোখে পড়ে না। তবে সাবলটার্ন স্টাডিজের ঐতিহাসিকের কাজ যেখানে প্রচলিত ইতিহাসের মধ্যে নি¤œবর্গের অবস্থান সনাক্ত করা ও ব্যাখ্যা করা সেখানে ‘জনইতিহাসের ’ স জ্ঞা সে রকম নয়। আমরা জানি , বিশ্বাস করি, জনজীবনের মধ্যেই ইতিহাসের ঘটনা রয়ে গেছে। তাদের চেতনায় উপস্থিত ঐতিহাসিক ঘটনা, বিপ্লবী নায়কের চরিত্র ও তাদের প্রেষণা সমুহ তাদের ধর্মবিশ্বাস, সমাজ সংস্কৃতি, জীবনাচার, অলৌকিকতার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে লোকগান, লোকছড়া, কবিতায় রূপ নিয়েছে। রূপ নিয়েছে মিথ বা জনশ্রুতিতে। সেই সব উপাদানগুলি সংরক্ষণ করা গেলে তার ভেতরে নি¤œবর্গের যে ইতিহাস চেতনা কাজ করেছে তার স্বরূপ উদঘাটন করা সম্ভব হবে। আর তাই আমরা এই সব উপাদানগুলোকে প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসের ছকে ফেলে নি¤œবর্গের চেতনার সন্ধান পেতে চাই।
জনজীবনের মধ্যে ইতিহাসের কোন অংশগুলি কিভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে এবং তাদের ভাবনাকে উজ্জীবিত করেছে তার সন্ধান পেতে আমরা দ্বারস্থ হই লোকগান, লোকছড়া, লোক কবিতা প্রভৃতির কাছে। এই সব উপাদান লোকসংস্কৃতির অংশ বলে গবেষকগণ মনে করতেই পারেন জনইতিহাসও লোকসংষ্কৃতির অংশ। কিন্তু আমরা জনজীবনের সঙ্গে সম্পর্কহীন প্রচলিত ইতিহাসের বিপরীত অবস্থাকেই জনইতিহাস বলতে চাই। রাজ-রাজড়াদের বাইরে যে বিশাল জনতা, যারা যোদ্ধা, ভূক্তভোগী তারাও তো ইতিহাসের অংশ, যারা নিজেদের মধ্যে ইতিহাসের ঘটনা সমূহ বা মূলসূত্রটুকু সযতেœ আত্মস্থ করেন নিজেদের সুখ-দুঃখ-ব্যথা বেদনার সংমিশ্রণে। এই পাঠ কখনই প্রচলিত ইতিহাসবিদের বিবেচ্য নয় বলে তা জনগণের কাছে উম্মোচিত হয় না।
নি¤œবর্গের ইতিহাসবিদগণ নি¤œবর্গের চেতনা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখেছেন যে, তাদের চেতনা স্বতন্ত্র হয়েও পরাধীন, বহুধাবিভক্ত। ফলে তারা কখনওই গোটা সমাজের হয়ে কথা বলতে পারে না। তাই তাদের ইতিহাস চেতনা অসম্পূর্ণ, আংশিক। একারণে ভারতবর্ষের সকল নি¤œবর্গের বিদ্রোহ অসফল হয়েছে। কিন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী নি¤œবর্গের চেতনায় এক ধরনের বিশেষত্ব আছে। আর সেটা হল সমগ্র পূর্ববঙ্গের শোষিত মানুষের সংগঠিত স্বতস্ফুর্ত আন্দোলনের সচেতনতা। এই দিক থেকে ’৭১ এ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীগণ নি¤œবর্গ নন, তারা জনগণ (ঢ়বড়ঢ়ষব)।
‘জনে’র সঙ্গায় বলা হয়েছে Ñ লোক, (নর ও নারী) লোকসমুহ, শ্রমজীবী মজুর পামর ইত্যাদি। ‘জনে’র ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে কলিম খান ও রবী চক্রবর্তী তাদের বঙ্গীয় শব্দার্থ কোষে বলেন, ‘জন হচ্ছে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী আত্মবিক্রয় জীবী জন বা মজুর। যতদিন সে যৌথ সমাজব্যবস্থার অধীন ছিল – ততদিন ছিল Ñগণ” গণের সঙ্গায় মেধাতিথি বলেনÑ ‘যাহারা মিলিত ভাবে এক কার্য দ্বারা জীবীকার্জন করে তাদেরই গণ বলা হয়।’৫ গণের লোকেরা ব্যাক্তিস্বাতন্ত্র দাবী করে না। গোষ্ঠীর চেতনা দ¦ারা তারা পরিচালিত হয়। অন্য দিকে ‘জন’ এর লোকেরা প্রত্যেকেই ব্যাক্তি স্বাতন্ত্রবাদী। এই দু শ্রেণিকে একত্রে বলা হয় জনগণ। মুক্তিযুদ্ধের সময় শোষকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের যে অংশ রাজনৈতিক চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে জনযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল এখানে তারাই মুলত ‘জন’ নামে পরিচিত হবে। আর এই জনগণের ভেতরকার ইতিহাস চেতনাকেই আমরা বলছি জনইতিহাস। এই জনইতিহাসের উপাত্ত পাওয়া যাবে জনগনের স্মৃতিতে সংরক্ষিত লোককবিতায়, লোকছড়ায় ও গানে। সন্দেহ নাই যে সেই সব উপাদানের ভিত্তিতে একটি পূর্ণাঙ্গ এবং বিশুদ্ধ ইতিহাস রচনা সম্ভব নয় কিন্তু আমরা এতে করে একটা বিশেষ সত্যের মুখোমুখি হতে পারব। রবীন্দ্রনাথ এ প্রসঙ্গে বলেন- ‘ঐতিহাসিকের ঘটনার জনশ্রুতি বহুতর লোকের মন হইতে প্রতিফলিত হইয়া আসে এবং সেই ঘটনার বিবরনে সাময়িক লোকের মনের ছাপ পড়িয়া যায় তাহা হইতে ঘটনার বিশুদ্ধ সত্যতা আমরা না পাইতেও পারি কিন্তু তৎসাময়িক অনেক লোকের মনে তাহা কিরূপ প্রতিভাত হইয়াছিল সেটা পাওয়া যাইতে পারে। অতীত সময়ের অবস্থা কেবল ঘটনার দ্বারা নির্ণয় হয় না। লোকের কাছে তাহা কিরূপ ঠেকিয়াছিল সে ও একটা প্রধান দ্রষ্টব্য বিষয়। অতএব ঐতিহাসিক ঘটনার জনশ্রুতিতে বাস্তব ঘটনার সহিত মনব মন মিশ্রিত হইয়া যে পদার্থ উদ্ভুত হয় তাহাই ঐতিহাসিক সত্য। সেই সত্যের বিবরনই মানবের নিকট চিরন্তন কৌতুকাবহ এবং শিক্ষার বিষয়’।৬ আমরা এই সত্যের বিবরণকেই জনইতিহাসের বিষয় বস্তু রূপে উপস্থাপন করতে চাই। তাই লোকসংস্কৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে এখানে যে আলোচনা তা একপ্রকার জনইতিহাস।
আর একথা একান্তভাবেই স্বীকার্য যে বাঙালির লোকসংস্কৃতিই শেষ পর্যন্ত তাকে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলো, যুদ্ধে যাওয়ার প্রেরণা যুগিয়েছিল। আর সেই ইতিহাসের যে ভিত্তি রচিত হয়েছিল এদেশের জনজীবনে, জনমানসে রবীন্দ্রনাথ একেই বলতে চেয়েছেন জনপ্রবাহের ভিতরকার ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধে বিদ্রোহী কৃষক শ্রমিক, মুটে, মজুর, কুলি, কামার, কুমার, জেলে, মাঝির যে চেতনার পরিচয় পাওয়া যায় তাতে উপস্থিত ধর্মভাব, অলৌকিকতা, দৈবশক্তিতে আস্থা ইত্যাদির ভেতর মোড়ানো যে রাজনৈতিক চেতনা, যে ইতিহাস চেতনা তাকে উচ্চবর্গের চেতনার ছকে ফেরে আত্মস্থ করার চেষ্টাও ঠিক জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের শর্ত নয়। এরকম চেষ্টার ফলে নি¤œবর্গের নিজস্ব ইতিহাস চেতনা ও কীর্তি হারিয়ে যেতে বাধ্য। নি¤œবর্গের ইতিহাস রচয়িতাগণ জাতীয়তাবাদী ও মার্কসবাদী ইতিহাসের ভেতর নি¤œবর্গের যে স¦তন্ত্র ঐতিহাসিক ভূমিকা উপেক্ষিত হয়েছে তা প্রমাণ করার উদ্দেশ্যেই নি¤œবর্গের ইতিহাস রচনার কথা বলেন। কিন্তু ইতিহাসে নি¤œবর্গের মানুষের চেতনা ও উচ্চবর্গের মানুষের চেতনা স্বতন্ত্র ভাবে প্রবাহিত হয়ে কোথায় কিভাবে মিলিত হয়েছে এবং বিদ্রোহের জন্ম দিয়েছে তার সম্মিলিত কর্মসূচি নিয়ে ইতিহাস লেখার চেষ্টাই হতে পারে বিকল্প ইতিহাস রচনার পদ্ধতি।
ইতিহাস শব্দটি এতটাই প্রাতিষ্ঠানিক অর্থে ব্যবহৃত হয় যেÑ শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে বেশির ভাগ সময় আমাদের মনে কেবলই অতীতের রাজ-রাজড়াদের কাহিনি ভিড় করে। আমাদের মন তখন ঝিমিয়ে পড়ে আর আমরা ক্লান্ত বোধ করি। এর কারণ আমাদের প্রচলিত ইতিহাস চর্চার শুরু হয়েছিল ইংরেজ শাসন ব্যবস্থা থেকে যেখানে ইতিহাস বিষয়টির সামগ্রীক ব্যাখ্যান অনুপস্থিত। ‘জয় যখন বিজিত দেশের ক্ষমতা কায়েম করার আকাক্সক্ষায় পরিণত হয়, বিজেতাকে ইতিহাস চেতনা ব্যবহার করতে হয় প্রভুসংস্কৃতির একটি উপাদান হিসেবে।’৭ ফলে সেই সব ইতিহাসে ইংরেজ শাসকদের শাসন ব্যবস্থার প্রয়োজনকেই কোনো না কোনো ভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং পরবর্তী কালে এই ধারাবাহিকতায়ই রচিত হয়েছে ভারতবর্ষের ইতিহাস। এই সব ইতিহাসে ঘটনার বর্ণনা আছে, সন-তারিখ উল্লেখ আছে, আছে রাজনৈতিক মতবাদ, সভা, সেমিনার, ভাষণের সংকলন কিন্তু প্রাণ নেই। আর একারণেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আক্ষেপ করে বলেনÑ‘ আজও ভারত বর্ষের একখানি পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচিত হয়নি।’ হয়নি, কারণÑ‘ তা জনপ্রবাহের দিক’ থেকে রচিত হয়নি। এই একই অভিযোগ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রসঙ্গেও উত্থাপন করা যায়।
জাতীয় জীবনে সাধারণ মানুষের ভেতর বা ‘জনপ্রবাহে’র ভেতর ইতিহাস বোধ কিভাবে দানা বেধেছিল, কিভাবে তা জাতীয় ঐক্যে পরিণত হয়েছিল তার হদিস আমরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কতটুকু পাই ? আমাদের পাঠ্যপুস্তকের ইতিহাসে কেবল জাতীয়তাবাদী ঐক্যের কল্পনা কাজ করেছে কিন্তু জনযুদ্ধের সামনে দাঁড়িয়ে সেই ইতিহাস চেতনা যতটুকু বস্তুনিষ্ঠ হয়েছে ততটুক কি সত্যনিষ্ঠ হয়েছে ? কেন সত্যনিষ্ঠ হয়ে উঠছে না ? এর কারণও রবীন্দ্রনাথ বলেছেনÑ‘ জনসমাজের সহিত শিক্ষিত সমাজের নানা প্রকারেই বিচ্ছেদ ঘটাতে জাতির ঐক্যবোধ সত্য হইয়া উঠিতেছে না।’৮ স্যার যদুনাথ সরকার বলেন,‘ … মানব সঙ্ঘের চিত্তের ভাব ও উদ্যম কোন পথে চলিয়াছিল, জাতীয় জীবনে পূর্ব্বপুরুষদের মনোবৃত্তি ও সভ্যতার প্রভাব কতদূর গিয়া দাঁড়ায়, মহাপুরুষ জননেতারা কিরূপে দেশমধ্যে বিপ্লবের সমান পরিবর্তন সংঘটিত করেন, নতুনকে ঝড়ের মত আনিয়া দিয়া প্রতিষ্ঠিত করিয়া দিয়া জাতিকে নবীন পথে প্রচলিত করেন, সেই সব মনস্তÍত্ত্বের কথা কাব্যের তুলিতে ইতিহাসে প্রকাশ করিতে পারিলে তবে সে ইতিহাসগ্রন্থ প্রকৃত ফলবান হইবে, অমর হইয়া থাকিবে Ñ নচেৎ নহে।’৯ তা হলে কী দাঁড়াচ্ছে ? আমাদের ইতিহাসে কি ‘জনপ্রবাহ’ ‘জনসমাজ’ কিংবা ‘মানব-সঙ্ঘ’ যাই বলি না কেন তাদের ‘চিত্তের ভাব বা উদ্যম’ ধরা পরেছে ? পরেনি কারণ তাদের সঙ্গে শিক্ষিত সমাজের ঐতিহাসিকদের দূরত্ব রয়েছে ফলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে জনযুদ্ধ সব সময়ই উপেক্ষিত হয়েছে। এই বক্তব্যে একটা কথা পরিস্কার যে আমরা এখানে দুটি শ্রেণির সন্ধান পাচ্ছি। একটা শ্রেণি ‘জনসমাজ’ আর অপরটি হচ্ছে জনসমাজ বহির্ভূত অপর সমাজ যারা জনসমাজের সঙ্গে সম্পর্ককে স্বীকার করে না, তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ। সাবল্টার্ন স্টাডিজে এদের একটি নি¤œবর্গ অন্যটি উচ্চবর্গ। নি¤œবর্গের ইতিহাস গবেষক রণজিৎ গুহ উচ্চবর্গ বলতে ইংরেজ শাসিত ভারত বর্ষে যারা প্রভুশক্তির অধিকারী ছিলেন তাদেরই বুঝিয়েছেন। এই প্রভুগোষ্ঠীকে তিনি আবার দুই ভাগে ভাগ করেছেনÑ বিদেশি ও দেশি। এদের মধ্যেও দুটি ভাগ ছিলÑ সরকারি ও বেসরকারি। এদের মধ্যে সরকারি ভাবে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের অভারতীয় কর্মচারী ও ভৃত্য সকলে, বেসরকারি অর্থে বিদেশি শিল্পপতি, বণিক, অর্থব্যবসায়ী, খনির মালিক, জমিদার, নীলকুঠি চা-বাগান কফিক্ষেত বা ওই জাতীয় যে সব সম্পত্তি প্লানটেশন প্রণালীতে চাষ করা হয় তার মালিক ও কর্মচারী, খ্রিষ্টান মিশনারি, যাজক, পরিব্রাজক ইত্যাদি। আর দেশি প্রভুগোষ্ঠীরা আঞ্চলিক বা স্থানীয় প্রতিনিধিদের স্বার্থ ও দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী কাজ করে। এরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাবে উচু শ্রেণির এবং এই সঙ্গা অনুযায়ী যারা উচ্চবর্গের মধ্যে পড়ল তাদেরকে সমগ্র জনসংখ্যা থেকে বাদ দিলে যারা থাকে তাদেরকেই রণজিৎ গুহ নি¤œবর্গ বলে চিহ্নিত করেছেন। আমরাও যদি সাবল্টার্নের এই সঙ্গা অনুসরন করি তাহলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে আশ্রয় করে যে জনসমাজকে আবর্তিত হতে দেখব তারা সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারী, কিছু জনপ্রতিনিধি, সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণি যারা মুসলিম লীগের সমর্থক এবং যুদ্ধের সময় শাসকগোষ্ঠীর চিন্তার সমর্থনকারী সম্প্রদায়। এরাই এখানে উচ্চবর্গ। অন্যদিকে এদের বিপরীতে যারা এদের নির্যাতন, শাসন ও শোষণের শিকার, সাধারণ মানুষ, তারাই নি¤œবর্গভুক্ত। এই যে শেষোক্ত শোষিত সমাজ এদের সঙ্গে শাসকগোষ্ঠীর এবং উচ্চবর্গের সম্পর্ক কী ? এই সম্পর্কের কি কোনো সমতা আছে ? সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাবে এরা বৈষম্যের শিকার । এদের চেতনার গড়নও তাই উচ্চবর্গের চেতনার গড়ন থেকে আলাদা। ফলে উচ্চবর্গের অন্তর্গত ইতিহাস চেতনার মধ্যে নি¤œবর্গের মানুষের চেতনার বাস্তবতা উপেক্ষিত হবে এটাই স্বাভাবিক। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যারা ইতিহাস রচনা করেছেন তারা কি এই আদর্শিক দন্দ্ব ও তার পরিনামের কথা মাথায় রেখেছেন ? কেন রাখেননি ? এটাই তো ঐতিহাসিকের কাজ, গবেষকের দায়িত্ব। গবেষক সাংবাদিক মোস্তফা হোসেইন জানানÑ‘ মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর প্রশাসন চলে যায় পাকিস্তানি ভাবাদর্শের কর্মকর্তাদের হাতে। স্বাধীনতা লাভের পরপর রাজনৈতিক সরকারকে ব্য¯ত থাকতে হয় নাগরিক অস্তিত্ব রক্ষায়, এককোটি মানুষের পুনর্বাসন, যোগাযোগসহ অবকাঠামোগত উন্নয়নে। প্রশাসনিক ব্যবস্থা রক্ষায় পাকিস্তানি বংশবদদের ওপর নির্ভর করতে হয় সরকারকে। যারা একাত্তরে পাকিস্তানি সামরিক সরকারকে সহযোগিতা করেছে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সুযোগ থাকার পরও , তারা যুদ্ধ পরবর্তীকালে সাদা কাগজে মুচলেকা দিয়ে নিজ নিজ অবস্থানে বহাল থেকেছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাদের আনুগত্য তাই প্রশ্নবিদ্ধই থেকে যায়।’১০ এ তো গেল উচ্চবর্গের ভাবাদর্শগত দিক। অন্যদিকে সামাজিক ভাবে যদি বিবেচনা করা হয় তা হলে দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী জনযোদ্ধাদের অবস্থান একেবারেই প্রান্তিক পর্যায়ে। অর্থনৈতিকভাবে এবং চিন্তাগত দিক থেকে তাদের অবস্থান ছিল একেবারেই প্রান্তে যেখানে উচ্চবর্গের ইতিহাস রচয়িতার দৃষ্টি কখনওই পড়েনি।।
এদিকে মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধের যে প্রশাসনিক কাঠামো আমরা দেখি সেখানে বাংলাদেশ তথা পূর্বপাকিস্তানকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছে। এই সেক্টরের অধিপতিরা সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে আদর্শিক ভাবে নি¤œবর্গেরই মানুষ ছিলেন। শাসক শোষকের বিপরীতেই ছিল তাদের অবস্থান। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আদর্শিকভাবে এই সামগ্রীক জনগোষ্ঠীর মধ্যেও উচ্চবর্গ ও নি¤œবর্গের ধারনা তৈরি হয়ে যায়। ফলে জনযোদ্ধাদের কেউ বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত হতে পারেননি। তারা সবাই সামরিক ব্যক্তি। জনযোদ্ধারা এখানে উপেক্ষিত। আবার মুক্তিযুদ্ধ শেষে যারা ইতিহাস রচনা করেছেন তারাও যুদ্ধের প্রশাসনিক অবকাঠামোগত দিক থেকেই একে বর্ণনা করেছেন। ফলে ্সামরিক কর্মকর্তা, বিডিআর, পুলিশবাহিনির ভূমিকা ও দলিলপত্র সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের নজর যতটা তিক্ষè ছিল ততটা সাধারন যোদ্ধাদের দিকে ছিল না। ফলে সে সব ইতিহাসে উপেক্ষিত হয়েছে জনযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা। তা ছাড়া এ যাবৎকালে যারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চা করেছেন তাদের একটা বড় অংশই সামরিক কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও বিভিন্ন পেশাজীবীর মানুষ। এদের রচনায় ব্যক্তিগত চিন্তার প্রতিফলন যতটা দেখা যায় ততটা নি¤œবর্গের পরিপ্রেক্ষিতের গভীরতা দেখা যায় না। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে যে উদ্যোগ তা নি¤œবর্গের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট নয়। ঔপনিবেশিক আমলের প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মনীতি ও আদর্শ ভেঙ্গে এদেশে এখনও কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে পারেনি। ফলে একাডেমিক ভাবে রচিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেও নি¤œবর্গের রাজনৈতিক চেতনা ও ইতিহাস চেতনা এক বিশেষ কায়দায় উপেক্ষিত হয়। অথচ ‘ রবীন্দ্রনাথ, অক্ষয়কুমার, যদুনাথÑ এরা সবাই চেয়েছিলেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠিত ও চর্চিত বিষয়গুলির ভিত্তি থাকুক জনজীবনে। ইতিহাস গবেষণার বিষয়টি এর ব্যতিক্রম নয়। জাতীয়তাবাদী চিন্তায় ইতিহাস অনুশীলন ইতিহাসের জনজীবনেরই অংশ।’১১ অথচ সেখানেও জনজীবনের দেখা মেলে না। রবীন্দ্রনাথ এ কথাও বলেন যে, বঃযহড়ষড়মুর বই পড়ে যদি দেখা যায় যে ‘আমাদের ঘরের পাশে যে হাড়ি- ডোম -কৈবর্ত-বাগদী রহিয়াছে তাহার সম্পূর্ণ পরিচয় পাইবার জন্য আমাদের লেশমাত্র ঔৎসুক্য জন্মে না তখনই বুঝিতে পারি, পুঁথি সমন্ধে আমাদের কতবড় একটা কুসংস্কার জন্মিয়া গেছে।…’১২ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ক্ষেত্রেও এই কুসংস্কার তৈরি হয়েছে সেই সব ঐতিহাসিকদের কারণে যারা শাসনদ-কে আশ্রয় করে ইতিহাস চর্চা করছেন। এরা শাসকের সুবিধাভোগী লোক। এদের দৃষ্টিতে জনযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী নি¤œবর্গের মানুষের যে নিজস্ব ইতিহস জ্ঞান আছে, যে সমাজ ভাবনা আছে, রাষ্ট্রভাবনা আছে তা উপেক্ষিত থেকে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের জাতীয়তাবাদী চেতনায় যে ঐক্যের সুর বেজেছিল তা পাঠ্যপুস্তকের ইতিহাসের এক তারে গ্রন্থিত হতে পারেনি। ফলে রবীন্দ্রনাথ যে তার সময়ে ‘ইতিহাস উৎসাহ’ জেগে উঠতে দেখেছিলেন তার প্রভাব এখানে লক্ষ করা যায় না।
২
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সবচেয়ে বেশি রচিত হয়েছে ১৯৯৬ এরপর, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার মধ্য দিয়ে। প্রায় সাড়ে চার হাজারের বেশি গ্রন্থ রচিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে। এর বেশির ভাগই ঐতিহাসিকের গভীর দৃষ্টিভঙ্গীতে রচিত নয়। যে দু একজন সত্যনিষ্ঠ ‘নিরপেক্ষ’ ইতিহাসের কথা ভেবেছেন তারাও জনজীবনকে উপেক্ষা করেছেন। আলোচনায় এনেছেন যুক্তিতর্ক আর ‘বঙ্গবন্ধু’কে মহান করে দেখাবার প্রচেষ্টা। বর্তমানে আওয়ামী গণরাজনীতির চাপে নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকের আরাধ্য বিষয়বস্তু একেবারই সংকুচিত হয়ে গেছে, কখনও কখনও উপেক্ষিত হয়েছে। ফলে ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে উঠেছেন একটি বিশেষ দলের নেতা। সামগ্রীকতাকে পরিহার করে সংকীর্ণ গোষ্ঠীচেতনায় সংকুচিত করে ফেলার এই প্রবনতার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে এক একটি আকবরনামা। অথচ বাংলাদেশে ‘বঙ্গবন্ধু’ বাঙালি জাতীয় ঐক্যের পতীক রূপে প্রতিভাত হন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের ‘গণরাজনীতির চাপে তিনিও হয়ে উঠছেন বিশেষ দলের প্রতীক। এ থেকে মুক্তির উপায় কী ? মুক্তির উপায় জনজীবনের সঙ্গে ঐতিহাসিকের সামাজিক কমিটমেন্ট রক্ষা করা। আমরা যাদের ‘জন’ বলি এরা কারা ? এদের সঙ্গে কেন্দ্রিয় শাসকদের সম্পর্ক কতটুকু ?মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে এদের সম্পর্ক কেমন ছিল ? এই সব প্রশ্নের উত্তর কি আমাদের পাঠ্যবইয়ের চিন্তা ও রচনার সাহায্যে পাওয়া সম্ভব ? পাওয়া সম্ভব নয়, কেননাÑ সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক চেতনা ও তাদের সমাজচেতনার মুখ্য উপাদান এসব রচনায় উপস্থিত নয়। আর তাই ‘ উচ্চবর্গের দৃষ্টিভঙ্গীর বাহন ইতিহাস বিদ্যার সাধ্য নেই যে জাতীয়তাবাদের এই গুরুত্বপূর্ণ দিকটাকে স্বীকার করে কিংবা ব্যাখ্যা করে।’১৩ অথচ বঙ্গবন্ধু জনসাধারনের ঐক্যের প্রতীক আকাক্সক্ষার ফল, যার মধ্য দিয়ে জনসমাজ স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহন করার চেষ্টায় রত হয়েছিল এবং জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে তারা ছিনিয়ে এনেছিল বিজয়। কিন্তু উচ্চবর্গ তাকে আত্মসাৎ করার চেষ্টা করেছে, তাকে চালিয়ে দিচ্ছে বিশেষ একটি গোষ্ঠীর মহানায়ক হিসেবে। তাই এই জাতীয় ইতিহাস হয়ে উঠছে একপেশে ভাবনায় পূর্ণ, নিরানন্দময়, অগভীর, অপ্রশস্ত আর চাটুকারিতায় পূর্ণ কীর্তিগাথা।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এটুকু বলেই সব শেষ হয়ে যায় না যে, ৭ই মার্চের ভাষণ বাঙালিদের বিজয়ের যথাযথ কাল নির্দেশক অবস্থানকে খুঁজে বের করার জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ কিংবা শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের সংকট ও উত্তরণ পন্থার অভিনবত্ব শাশ্বতরূপে চিত্রিত করার চেষ্টাই হবে ঐতিহাসিকের কাজ। কিন্তু এতে করে যে বিষয়টি আড়ালে থেকে যায় তা হলো জনগণের সঙ্গে ‘নায়ক’ মানুষটির পরিবর্তনের মুহূর্তটিকে চিহ্নিত করা, স্থীর করা। আবার সেই মুহূর্তটাও তো কোনো স্থীর সময় নয় বরং নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহের ভিতর দিয়ে অবিরাম পরিবর্তন। এই প্রবাহ যতটা না উপর থেকে নিচের দিকে ধাবমান ছিল তার চেয়ে বেশি নিচ থেকে উপরের দিকে উৎসারিত হয়েছিল ফোয়ারার মত। সেই প্রবাহকে অস্বীকার করা হয় প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাস চর্চায়। এখানে ঐতিহাসিকের দায়িত্ব কেবল নায়কের দিক থেকে ঘটনা সমুহকে বর্ণনা করা। অথচ তার একটি বিশেষ সামাজিক দায়িত্বও ছিল। জনজীবনের সঙ্গে নায়কের অবস্থানের যে স্বাভাবিক ও চিরন্তন ‘ঐক্য’ ও ‘সমগ্রভাবনা’ আছে তার অভেদতত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব সব সময়ই এড়িয়ে গেছেন তারা। কেন এড়িয়ে গেছেন ? কারণ Ñ জনজীবনে রাজনৈতিক নায়কের ইতিহাস কিভাবে প্রতিভাত হয়েছিল তার সন্ধান পাওয়ার চেষ্টা তারা করেননি। আবার মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক রচিত ইতিহাসেও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। যায়নি কারণ, ‘ নি¤œবর্গের রাজনীতির চরিত্র নির্ধারিত হচ্ছে নি¤œবর্গের নিজস্ব চেতনার রূপরেখানুসারে। সেই চেতনা গড়ে উঠেছে অধীনতার অভিজ্ঞতা থেকে।’১৪
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের জনযোদ্ধাগণ যুদ্ধ করেছেন ১১টা সেক্টরের অধীনে। যাদের অধীনে তারা যুদ্ধ করেছেন তারা প্রায় সকলেই সামরিক কর্মকর্তা, তাদের চেয়ে শিক্ষিত, সামরিক বিষয়ে প্রশিক্ষিত অতএব যুদ্ধের প্রসাশনিক বিন্যাসানুযায়ি ক্ষমতাটা চলে যায় উচ্চবর্গেরই হাতে। ফলে পরবর্তী ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধের কীর্তিগাথা ও চেতনার সাক্ষ্য প্রমাণ সংরক্ষিত হয়েছে উচ্চবর্গের দিক থেকে তাদের অধীনে এবং তাদেরকে ঘিরে। বলা বাহুল্য যে, স্বাধীনতার পরে ক্ষমতার কেন্দ্রেও তারাই ছিলেন। এমতাবস্থায় নি¤œবর্গের জনজীবন স্বাভাবিক ভাবেই ইতিহাসে উপেক্ষিত হয়েছে। তাই বলে কি নি¤œবর্গের উপস্থিতি একেবারেই অস্বীকার করা সম্ভব ? সম্ভব নয়। ‘ একমাত্র একটি মুহূর্তেই শাসককুলের মানসপটে নি¤œবর্গ আবির্ভূত হয় স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের অধীকারি হয়ে। সেই মুহুর্তটি হল বিদ্রোহের মুহূর্ত।’১৫ তাই সাবল্টার্ন স্টাডিজের গবেষনায় সবচেয়ে বড় অংশ জুড়ে রয়েছে বিদ্রোহের ইতিহাস, বিশেষত কৃষক বিদ্রোহ। এখানে নি¤œবর্গের চিন্তার স্বরূপটি কেমন ছিল তার কিছুটা হদিস পাওয়া যায়। আর তাই সাবল্টার্ন স্টাডিজের ঐতিহাসিক গণ বিদ্রোহের ইতিহাসগুলির মধ্যে নি¤œবর্গের চেতনার সন্ধান করেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া জনযোদ্ধারাও তো এক বিশেষ চেতনার বশবর্তী হয়ে যুদ্ধে নেমেছিলেন। সেই চেতনার পরিচয়টি পাবার জন্য আমরা কতটা এগিয়ে এসেছি ? উচ্চবর্গের হাতে রচিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ভিতরে কোনো সাবল্টার্ন স্টাডিজের ঐতিহাসিকও ‘নি¤œবর্গের অবস্থান’ সনাক্ত করার জন্য আগ্রহী হননি। অথচ ইতিহাসের কর্মকান্ডের মধ্যে নি¤œবর্গের একটি স্বতন্ত্র ভূমিকা রয়েছে। সাবল্টার্ন স্টাডিজের ঐতিহাসিকের কাজ যদি হয় প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাসের সমালোচনা করা১৬ তাহলেও আমাদের দেশে সেই অর্থে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নি¤œবর্গের ঐতিহাসিকের ভূমিকা চোখে পড়ে না। তবে সাবলটার্ন স্টাডিজের ঐতিহাসিকের কাজ যেখানে প্রচলিত ইতিহাসের মধ্যে নি¤œবর্গের অবস্থান সনাক্ত করা ও ব্যাখ্যা করা সেখানে ‘জনইতিহাসের ’ সঙ্গা সে রকম নয়। আমরা জানি, বিশ্বাস করি, জনজীবনের মধ্যেই ইতিহাসের ঘটনা রয়ে গেছে। তাদের চেতনায় উপস্থিত ঐতিহাসিক ঘটনা, বিপ্লবী নায়কের চরিত্র ও তাদের প্রেষণা সমুহ তাদের ধর্মবিশ্বাস, সমাজ সংস্কৃতি, জীবনাচার, অলৌকিততার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে লোকগান, লোকছড়া, কবিতায় রূপ নিয়েছে। রূপ নিয়েছে মিথ বা জনশ্রুতিতে। সেই সব উপাদানগুলি সংরক্ষণ করা গেলে তার ভেতরে নি¤œবর্গের যে ইতিহাস চেতনা কাজ করেছে তার স্বরূপ উদঘাটন করা সম্ভব হবে। আর তাই আমরা এই সব উপাদানগুলোকে প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসের ছকে ফেলে নি¤œবর্গের চেতনার সন্ধান পেতে চাই।
৩
জনজীবনের মধ্যে ইতিহাসের কোন অংশগুলি কিভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে এবং তাদের ভাবনাকে উজ্জীবিত করেছে তার সন্ধান পেতে আমরা দ্বারস্থ হই লোকগান, লোকছড়া, লোক কবিতা প্রভৃতির কাছে। এই সব উপাদান লোকসংস্কৃতির অংশ বলে গবেষকগণ মনে করতেই পারেন জনইতিহাসও লোকসংষ্কৃতির অংশ। কিন্তু আমরা জনজীবনের সঙ্গে সম্পর্কহীন প্রচলিত ইতিহাসের বিপরীত অবস্থাকেই জনইতিহাস বলতেচাই। রাজ-রাজড়াদের বাইরে যে বিশাল জনতা, যারা যোদ্ধা, ভূক্তভোগী তারাও তো ইতিহাসের অংশ, যারা নিজেদের মধ্যে ইতিহাসের ঘটনা সমুহ বা মূলসূত্রটুকু সযতেœ আত্মস্থ করেন নিজেদের সুখ-দুঃখ-ব্যথা বেদনার সংমিশ্রণে। এই পাঠ কখনই প্রচলিত ইতিহাসবিদের বিবেচ্য নয় বলে তা জনগণের কাছে উম্মোচিত হয় না।
নি¤œবর্গের ইতিহাসবিদগণ নি¤œবর্গের চেতনা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখেছেন যে, তাদের চেতনা স্বতন্ত্র হয়েও পরাধীন, বহুধাবিভক্ত। ফলে তারা কখনওই গোটা সমাজের হয়ে কথা বলতে পারে না। তাই তাদের ইতিহাস চেতনা অসম্পূর্ণ, আংশিক। একারণে ভারতবর্ষের সকল নি¤œবর্গের বিদ্রোহ অসফল হয়েছে। কিন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী নি¤œবর্গের চেতনায় এক ধরনের বিশেষত্ব আছে। আর সেটা হল সমগ্র পূর্ববঙ্গের শোষিত মানুষের সংগঠিত স্বতস্ফুর্ত আন্দোলনের সচেতনতা। এই দিক থেকে ’৭১ এ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীগণ নি¤œবর্গ নন, তারা জনগণ (ঢ়বড়ঢ়ষব)।
আর এই জনগণের ভেতরকার ইতিহাস চেতনাকেই আমরা বলছি জনইতিহাস। এই জনইতিহাসের উপাত্ত পাওয়া যাবে জনগনের স্মৃতিতে সংরক্ষিত লোককবিতায়, লোকছড়ায় ও গানে। সন্দেহ নাই যে সেই সব উপাদানের ভিত্তিতে একটি পূর্ণাঙ্গ এবং বিশুদ্ধ ইতিহাস রচনা সম্ভব নয় কিন্তু আমরা এতে করে একটা বিশেষ সত্যের মুখোমুখি হতে পারব। রবীন্দ্রনাথ এ প্রসঙ্গে বলেন-‘ ঐতিহাসিকের ঘটনার জনশ্রুতি বহুতর লোকের মন হইতে প্রতিফলিত হইয়া আসে এবং সেই ঘটনার বিবরনে সাময়িক লোকের মনের ছাপ পড়িয়া যায় তাহা হইতে ঘটনার বিশুদ্ধ সত্যতা আমরা না পাইতেও পারি কিন্তু তৎসাময়িক অনেক লোকের মনে তাহা কিরূপ প্রতিভাত হইয়াছিল সেটা পাওয়া যাইতে পারে। অতীত সময়ের অবস্থা কেবল ঘটনার দ্বারা নির্ণয় হয় না। লোকের কাছে তাহা কিরূপ ঠেকিয়াছিল সে ও একটা প্রধান দ্রষ্টব্য বিষয়। অতএব ঐতিহাসিক ঘটনার জনশ্রুতিতে বাস্তব ঘটনার সহিত মনব মন মিশ্রিত হইয়া যে পদার্থ উদ্ভুত হয় তাহাই ঐতিহাসিক সত্য। সেই সত্যের বিবরনই মানবের নিকট চিরন্তন কৌতুকাবহ এবং শিক্ষার বিষয়’।১৭ আমরা এই সত্যের বিবরণকেই জনইতিহাসের বিষয় বস্তু রূপে পেতে চাই।
১৯৪৭ সালের পরে বাংলাদেশে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে এবং বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামে অগ্রগামী ছিলেন এদেশের নি¤œবর্গের মানুষÑ ¤িœধ্যবিত্ত কৃষক,শ্রমিক, দিনমজুর। এমন কি এদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির সঙ্গে এদেরই সম্পর্ক ছিল গভীর। এক গবেষণায় দেখা গেছেন ১৯৬৯ এর আগে পূর্ব পাকিস্তানে কৃষিজীবীর সংখ্যা ছিল ৭৬.৯৬%।১৩ আবার দেশের বর্গাচাষী, কৃষিমজুর এবং শিল্পশ্রমিক (যাদের মোট পরিমান প্রায় ৬০ শতাংশ) ছিলেন মোট শ্রম শক্তির সংখ্যা গরিষ্ঠ অংশ।১৮ বাঙালিরা ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানি শাসন শোষনের বিরুদ্ধে ২৮১ বার ধর্মঘটের ডাক দেয়। এই আন্দোলনগুলির মধ্যে শিল্প ও অন্যান্য শ্রমিকদের ডাকা ধর্মঘটের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১০৫ ও ৪২।১৯ এদিকে ছাত্রদের ডাকা ধর্মঘটের সংখ্যা ছিল ১০৬। বলাই বাহুল্য যে এই ছাত্রদের বড় অংশই ছিল গ্রামের কৃষকের সন্তান। একটি সাধারণ সমীক্ষায় দেখা গেছে বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারীদের ৬০ শতাংশ ছিলেন গ্রামের অধিবাসী। সমীক্ষায় দেখা যায় যে, ৮৩ শতাংশের পারিবারিক আয়ের উৎস ছিল আংশিক অথবা পুরোপুরি কৃষি নির্ভর।২০ তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, গ্রামীন কৃষি সমাজই ছিল বাংলার অর্থনীতির প্রাণ। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে এবং উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটিশরা ভারতের জমিসংক্রান্ত নীতি নির্ধারণের কাজে নিজেদের ব্যস্ত রেখেছে।২১ তারা মুঘল আমলের কৃষিব্যবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন সাধন না করে তাদের আদলেই নিজেদের সুবিধা মাফিক জমিদারী প্রথা বহাল রেখে নীতি নির্ধারণ করে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হলে বাঙালিরা মনে করে যে, এখন তাদের সরকার হয়তো ভূমি সংস্কার ও কৃষি উন্নয়নে গুরুত্ব দেবে। কিন্তু ১৯৫১ সালে পাকিস্তান পার্লামেন্টে যে ভূমি সংস্কার বিল পাশ করা হয় তাতে জোতদারদের স¦ার্থ সংরক্ষিত হয়।২২ শাসকদের অসম ভূমি ব্যবস্থাপনা, জমির মালিক ও বর্গা চাষীদের মধ্যে ফসলেরর বন্টন প্রক্রিয়ায় আসমতা, ফসল ফলানোর ওপর নানারকম নিষেধাজ্ঞা জারি, কৃষকের কাছ থেকে বেশি করে ভূমি রাজস্ব আদায়, কর্ডন আইনের মাধ্যমে কৃষিদিনমজুরকে প্রতারনাসহ নানা রকম নিপীড়ন চলতে থাকে। এমতাবস্থায় বাঙলার গ্রামীন সমাজে অস্তিত্বের সংকট দেখা দেয়। খাদ্যাভাবে অনাহার অর্ধাহারে দিন কাটাতে শুরু করে মানুষ। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে বাড়তে থাকে অস্থিরতা। বিক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে গ্রামীন সমাজের মধ্যে। ১৯৫৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন-‘ গু য়ঁবংঃরড়হ রং যিড়ংব সড়হবু বি ধৎব ংঢ়বহফরহম হড়?ি ঞযরং সড়হবু নবষড়হমং ঃড় ঃযব ঢ়ড়ড়ৎ ভধৎসবৎ ড়ভ ঃযরং পড়ঁহঃৎুৃ’২৩ এই বিষয়টিও ততদিনে গ্রামীন কৃষক সমাজের কাছে পরিস্কার হয়ে গেছে। তাই
লোককবি মফিজ উদ্দিন বলেন-
দুইশ বছর গোলামির পর পেয়েচিলাম পাকিস্তান
কেউ হয়েছি নেস্তইনাবুদ কেউ হতেছে অপমান ॥
আজাদী পাইলো চাষী কাগজে আর কলমে
দুনিয়াতে বদনাম তোদের মরিবে এই শরমে ॥
চপ কাটরেট লুচি মাখন কর্তারা খায় দিনরাত
চাষীর ভাগ্যে জুটে নারে পোড়া মরিচ পান্তা ভাত ॥
তোদের ক্ষেতে জন্মে উঠে সোনার দানা সেরা পাট
তোরাই আজ পথের কাঙাল খালি তোদের তোদের হাত ॥
আন্য কলাই যব মুসুরি জন্মে তোদের ক্ষেতে
ছেলে মেয়ে নিয়ে আজ মরিস তোরা ভাতে ॥২৪
যেহেতু পূর্ব পাকিস্তানের বেশির ভাগ মানুষ ছিল কৃষির ওপর নির্ভরশীল তাই পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর সকল ধরনের বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হতেন সরাসরি এই সম্প্রদায়ের মানুষ। আর তাই ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট তাদের ইশতেহারের কারণে কৃষককূলের আস্তাভাজন হয়েছিল। তারা ২১ দফারমধ্যে কৃষকের মুক্তির বিষয়টি উপস্থাপন করতে সক্ষম হন। আর একারণে লোক কবি দেওয়ান ফরিদ উদ্দিন তার কবিতায় বলেন-
‘ মন্ত্রি সভা গঠন করে, ২১ দফা ওয়াদারে
পালন করো একে একে, নইলে হবে পরমাদ ॥
আমাদের এই মিনতি হক-আতা- ভাসানীর প্রতি
নিজ হাতে খুইদো গো নূরুল আমিনের খাদ ॥’২৫
কৃষকের একচেটিয়া সমর্থনের ফলে পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। কিন্তু শেষপর্যন্ত বেনিয়া শাসকদল তাদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেয়। বাঙালির ওপর নির্যাতন নিপীড়নের মাত্রা বাড়তে থাকে। শরীরের তল্লাশী থেকে শুরু করে স্থাবর- অফস্থাবর সম্পত্তি দখল, কৃষকদের ওপর নির্বিচারে পুলিশি গুলিবর্ষণ ইত্যাদি ছিল নিত্যকার ঘটনা।২৬ ১৯৬৯ সালে ৪ জানুয়ারি দৈনিক সংবাদের শিরোনাম-‘ খুলনার পল্লীতে ধান কাটা লইয়া হাঙ্গামায় পুলিশের গুলীবর্ষণে ১২ জন ব্যক্তি আহত।’ অপর শিরোনাম- ‘হাতিরদিয়ায় পুলিশের গুলীর প্রতিবাদে কৃষকদের সংঘবদ্ধ হওয়ার আহ্বান।’ ৯ জানুয়ারির একটি শিরোনাম- ‘ কুষ্টিয়ার আখচাষীরাও সরকারী পীড়নের শিকারে পরিণত হইয়াছে’। ১০ জানুয়ারির একটি শিরোনাম-‘ দিনাজপুর রাজশাহীর লক্ষ লক্ষ আধিয়া চাষী জোতদারদের সামন্তবাদী শোষণে মধ্যযুগীয় ভূমিদাসে পরিণত।’ এর সঙ্গে পাল্লাদিয়ে চলছিল নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল বৃদ্ধির উর্দ্ধোগতি, খাদ্য সংকট যা নিয়ন্ত্রণ ও নিরসনের জন্য সরকারে কোনো বাস্তব উদ্যোগই ছিল না। ১৯৬৯ এর ১৪ জানুয়ারি দৈনিক সংবাদের একটি শিরোনাম-‘ পাবনায় খাদ্য সংকট চূড়ান্ত: চাষীরা জমি বিক্রি করিতেছে।’ ৬ মার্চের শিরোনাম ‘ মাদারীপুর মহকুমায় চরম খাদ্যাভাব: শতকরা ৯০জন লোক অনাহারে দিন কাটাইতেছে।’ ২২ মার্চ একই পত্রিকার শিরোনাম ছিল- ক্ষুধার জ্বালায় মানুষ হন্যে হইয়া ফিরিতেছে: পাবনায় চাউলের মণ ৬০ টাকা। ১৩ ডিসেম্বরের ভয়াবহ শিরোনাম-‘ মাগুরা মহকুমায় আত্মহত্যার হিড়িক: অভাব অনটনই কারণ বলিয়া ধারণা।’ সংবাদপত্রের এই শিরোনাম থেকেই পাকিস্তানি শাসকদের নির্যাতন নিপীড়ন ও অত্যাচারের প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা করা যায়। পূর্ব বাংলার কৃষকদের দুর্দশা আরও চরম আকার ধারণ করছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে। কিন্তু তাতে পশ্চিমা পাকিস্তানি শাসকদের কোনও রকম সহমর্মিতা প্রকাশ পেত না। সংবাদ পত্রে এইসব দুর্যোগের খবর প্রচার পেলেও কর্তৃপক্ষ সে বিষয়ে একেবারেই উদাসীন থাকত। এর ওপর চাষীদের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থাও ছিল ভঙ্গুর। কলেরা বসন্তে হাজার হাজার লোক মারা গেলেও প্রশাসন ছিল এ বিষয়েও নিস্পৃহ। এতে পূর্ব বাংলার কৃষক সমাজ মুসলিম লীগের শাসন ব্যবস্থার প্রতি হতাশ হয়ে পড়ে এবং বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার দাবীতে তারা স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে অংশগ্রহণ করে। ফলে ৭০ এর নির্বচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্রাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী নির্বচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চ লাইট পরিচালনা করে। শুরু হয় বাঙালিদের মুক্তির সংগ্রাম। গবেষনায় দেখা গেছে- ‘প্রায় চার-পঞ্চমাংশ মুক্তিযোদ্ধাই ছিলেন কৃষক পরিবারের সন্তান।’২৭ পশ্চিম পাকিস্তানিদের শাসন শোষন ও অত্যাচারে নিঃস্ব কৃষকেরা ভাগ্যের কাছে নতি স্বীকার না করে, ভবিতব্যের কাছে আত্ম সমার্পন না করে তারা এক এক জন যোদ্ধা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। কেননা পাকিস্তান আমলের কৃষিজ সমাজের অর্থনৈতিক সংকটই তাদের সামগ্রীকভাবে অস্তিত্বের সংকট তৈরি করে যার ফলে তারা বাধ্য হয়েছিল মরণকে তুচ্ছ করে মুক্তির সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই জনমানুষের উপস্থিতি আমরা লক্ষ করি না। তবু তারা নিজেদের মতো করেই ইতিহাসের বয়ান করে নিজেদের ভাষায়। সেখানে তারা তাদের কথা বলে, তাদের নেতার কথা বলে। আর সেটাই হচ্ছে জনইতিহাস, লোক সংস্কৃতির ভেতরকার নির্যাস। এর মধ্যে স্বার্থন্বেষণের চেষ্টা নেই, খ্যাতির মোহ নেই, প্রাপ্তির আকাক্সক্ষা নেই। তাই লোকসংস্কৃতির মধ্যে লুকিয়ে থাকা এই ইতিহাস যদি ছড়িয়ে পড়ে জাতীয় জীবনে, বৃহত্তর সমাজে তাহলে আমরা একটি সামগ্রীক ইতিহাসের ধারণা লাভ করতে সক্ষম হব। নইলে যে ইতিহাসে জনজীবন উপেক্ষিত হয় তার কাছ থেকে আমাদের কিছুই শেখার থাকবে না। আমাদের চেতনার মধ্যে ঐক্যের বন্ধন স্থাপিত হবে না। আমাদের মধ্যে বাঙালি হিসেবে গর্ববোধ করার প্রত্যয় প্রতিষ্ঠিত হবে না। আর তা না হলে আমাদের চিন্তা ভাবনা ক্রমেই অসংহত হয়ে পড়বে, সেই ফাঁকগলে ঢুকে পরবে সাম্প্রদায়িকতার নানা ভেদজ্ঞান।
তথ্যসূত্র:
১. দীপেশ চক্রবর্তী, ইতিহাসের জনজীবন ও অন্যান্য প্রবন্ধ, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা: লি:, ৩য় মুদ্রণ, পৃ: ২৯।
২. পার্থ চট্টপাধ্যায়. ভ’মিকা: নি¤œবর্গের ইতিহাস চর্চার ইতিহাস, নি¤œবর্গের ইতিহাস, প্রাগুক্ত, পৃ: ১২।
৩. প্রাগুক্ত, পৃ: ১২।
৪. প্রাাগুক্ত, পৃ: ১৩।
৫. রবি চক্রবর্তী ও কলিমখান,বঙ্গীয় শব্দার্থ কোষ,ভাষাবিন্যাস, কলকাতা, প্রথমখন্ড, পুনর্মদ্রণ ১৪১৭, পৃ ২৫৮।
৬. ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়,২২ শ্রাবণ,১৩৬২,পৃ:১১৭-১১৮।
৭. রণজিৎ গুহ, নি¤œবর্গের ইতিহাস, নি¤œবর্গের ইতিহাস, সম্পাদনা: গৌতম ভদ্র ও পার্থ চট্টোপাধ্যায়, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা:লি:, ষষ্ঠ মুদ্রণ, পৃ: ২৩।
৮. দীপেশ চক্রবর্তী, প্রাগুক্ত, ৩য় মুদ্রণ, পৃ: ৩৩।
৯. যদুনাথ সরকার, যদুনাথ সরকার রচনা সম্ভার, সম্পাদক: নিখিলিশ গুহ ও রাজনারায়ণ পাল, এম সি সরকার এ- প্রাইভেট লি:, ২য় সংস্করণ২০১২, পৃ:২১।
১০. মোস্তফা হোসেইন, উপেক্ষিত জনযুদ্ধ, বাংলা ট্রিবিউন, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৬।
১১. দীপেশ চক্রবর্তী, প্রাগুক্ত, পৃ: ৩২।
১২. প্রাগুক্ত, পৃ: ৩০।
১৩. প্রাগুক্ত, পৃ: ২৯।
১৪. পার্থ চট্টপাধ্যায়. ভ’মিকা: নি¤œবর্গের ইতিহাস চর্চার ইতিহাস, নি¤œবর্গের ইতিহাস, প্রাগুক্ত,পৃ: ১২।
১৫. প্রাগুক্ত, পৃ: ১২।
১৬. প্রাাগুক্ত, পৃ: ১৩।
১৭. রবি চক্রবর্তী ও কলিমখান,বঙ্গীয় শব্দার্থ কোষ,ভাষাবিন্যাস, কলকাতা, প্রথমখন্ড, পুনর্মদ্রণ ১৪১৭, পৃ ২৫৮।
১৮. ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়,২২ শ্রাবণ,১৩৬২,পৃ:১১৭-১১৮।
১৯. মহিউদ্দিন আলমগীর এবং লড উইক জে. বি বারলেজ, (১৯৭৪); বাংরাদেশ: ন্যাশনাল ইনকামএন্ডএক্সপেন্ডিচার ১৯৪৯-১৯৬৯-৭১, বিআইডিএস, পৃ: ১৭৫-৭৬। উদ্ধৃত, আতিউর রহমান, মুক্তিযুদ্ধ জনযুদ্ধ আর্থ- সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০০৩, পৃ:৪৪।
২০. আতিউর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ:৫০।
২১. প্রাগুক্ত, পৃ:৫১।
২২. প্রাগুক্ত, পৃ: ৫৩।
২৩. গৌতম ভদ্র, মুঘলযুগে কৃষি অর্থনীতি ও কৃখশ বিদ্রোহ, সুবর্ণরেখা, ৫ম সংস্করণ, কলকাতা, ১৪২০, পৃ:২।
২৪. আতিউর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ: ৫৫।
২৫. প্রাগুক্ত,পৃ: ৫৭।
২৬. মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান, বাংলাদেশের ভাট-কবি ও কবিতা, অনিন্দ্য প্রকাশ, ঢাকা- ২০১২,পৃ :২২২, রঞ্জনা বিশ্বাস, লোকসংস্কৃতিতে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ,রোদেরা প্রকাশনী ,ঢাকা, ২০১৭,পৃ:১০৩।
২৭. মুহম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান, প্রাগুক্ত, পৃ: ১৯৬। রঞ্জনা বিশ্বাস, প্রাগুক্ত,পৃ: ৯৪।