নিসার হোসেন এদেশের লোকসমাজের ওপর নির্ভর করে তাদের রুচি ও চাহিদামাফিক শিল্প সামগ্রী নির্মাণের যে ঐতিহ্যগুলো সহ¯্র বছর আগেই গড়ে উঠেছে এবং আজও যে সৃজন প্রক্রিয়াগুলো পরম্পরার মধ্য দিয়ে চর্চিত হয়ে চলেছে তাদের মধ্যে মৃৎশিল্পই সর্বপ্রাচীন এবং তা মানের দিক থেকেও সর্বশ্রেষ্ঠদেরই পর্যায়ভুক্ত। আমাদের ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পের এই মূল্যায়ন শুধু গবেষকদের বা পন্ডিতদেরই নয়; সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এবং শ্রেষ্ঠ মূল্যায়নকারী যে আমজনতা (যাদের পৃষ্ঠপোষকতায় চরম প্রতিকূলতার মধ্যেও এ ঐতিহ্যটি অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী শিল্পের তুলনায় মাথা যথেষ্ঠ উঁচু করেই টিকে আছে), এ তাদেরই মূল্যায়ন। মৃৎশিল্পীদের মধ্যে যারা মূর্তি নির্মাণে দক্ষ বা ভাস্কর্যধর্মী কাজে পারদর্শী তারা সাধারণ মানুষের কাছে 'গুণরাজ' নামে পরিচিত। এর কারণ সম্ভবত এই যে, এ ধরনের কাজে নৃত্যকলা, চিত্রকলা, স্থাপত্যকলা, অলঙ্কার নির্মাণকলাসহ অন্য কলাজ্ঞানও প্রয়োগ করতে হয়। যে কোনো শিল্প সামগ্রী নির্মাণের ক্ষমতা অবশ্যই একটি গুণবিশেষ; কিন্তু সকল গুণের শ্রেষ্ঠ গুণটি যে কুম্ভকার সম্প্রদায়ের একচ্ছত্র দখলে চলে গেছে সেই বিষয়টি আমরা আমজনতা প্রদত্ত এই 'গুণরাজ' উপাধিটির মাধ্যমেই নিশ্চিত হতে পেরেছি। তবে মূর্তি বা ভাস্কর্য নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় গুণটুকু রপ্ত করার ইতিহাস সম্ভবত এতটা প্রাচীন নয়, যতটা প্রাচীন তাদের হাঁড়ি-কুড়ি-ঘট-কলসি নির্মাণের ইতিহাস। কেননা প্রাচীনকাল থেকেই এই উপমহাদেশের মৃৎশিল্পীরা কুম্ভকার নামেই পরিচিত, যার অর্থ ঘট বা কলসি নির্মাতা। কুম্ভকাররাও বিশ্বাস করেন, “শিবের বিয়েতে যখন ঘটের প্রয়োজন হলো, তখন শিব তার রুদ্রাক্ষের মালা থেকে একটি রুদ্রাক্ষ নিয়ে তাই দিয়ে মানুষ তৈরি করলেন, ঘট তৈরি করে দেওয়ার জন্য...”। সেই ঘট বা কুম্ভ নির্মাতাই কুম্ভকার। অর্থাৎ কুম্ভকারই প্রথম মানুষ বা প্রথম মানুষই কুম্ভকার। সুতরাং এরা মৃণ¥য় মূর্তি নির্মাণের কাজে নিশ্চয়ই যুক্ত হয়েছেন এরও অনেক পরে, কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে। ধারণা করা হয় যে, পাথর বা কাঠ দিয়ে দীর্ঘস্থায়ী মূর্তি নির্মাণের যে প্রাচীন ধারাটি এ অঞ্চলে বহমান ছিল, তা মূর্তি উপাসনাবিরোধী শক্তির দ্বারা আক্রান্ত হতে শুরু করলে ক্ষণস্থায়ী উপাদান দিয়ে দ্রুত মূর্তি নির্মাণ এবং নির্ধারিত আচার শেষে তা দ্রুত বিলুপ্ত (বিসর্জন) করে ফেলার রীতি যখন চালু হলো, তখন কাঁচা মাটিকেই এ ধরনের মূর্তি নির্মাণের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত বলে বিবেচনা করা হলো। আর সেই সুযোগে এই বাংলার সূত্রধর আর ভাস্করদের পেছনে ফেলে মাটি নিয়ে যাদের কারবার, সেই কুম্ভকাররাই শ্রেষ্ঠ শিল্পীর মর্যাদাপূর্ণ আসনটি দখল করে নিল। পশ্চিমবাংলার বেশিরভাগ অঞ্চলে এ আসনটি এখনও সূত্রধর এবং ভাস্করদের দখলেই রয়ে গেছে। বাংলাদেশের কুম্ভকাররা তাদের সহজাত শৈল্পিক প্রতিভার জোরে হাল আমলে স্বর্ণকারদের পেশাটিও কব্জা করে নিচ্ছেন। সব রকম কলাকৌশলকে রপ্ত করে নেওয়ার এই সহজাত ক্ষমতাটি রয়েছে বলেই প্রবল প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়েও বহু কুম্ভকার পরিবার নতুন যুগের চাহিদার সঙ্গে বনিবনা করে নিয়ে আজও মৃৎশিল্পকে আঁকড়ে ধরে যথেষ্ট সচ্ছলভাবেই জীবনযাপন করছেন। গত শতকের আশির দশকের প্রথমভাগে নক্সাকেন্দ্র বিসিকের উদ্যোগে যে জরিপ চালানো হয় (যা বই আকারে 'বাংলার কারুপল্লী' নামে ১৯৮৫ সালে মুদ্রিত হয়েছে), তাতে বাংলাদেশের প্রায় ৭০-৭৫ শতাংশ লোকশিল্পী ও কারুশিল্পী পরিবারকে তালিকাভুক্ত করা সম্ভব হয়েছিল বলে মনে করা হয়। সেই জরিপে মৃৎশিল্পীদের ৬৮০টি গ্রাম, পল্লী বা পাড়াকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছিল, যেখানে ১৫ হাজারেরও বেশি পরিবার সম্পূর্ণভাবে এই পেশার ওপর নির্ভর করেই জীবিকা নির্বাহ করছে। যদিও এই সংখ্যা ১৮৭২ সালের জরিপ থেকে পাওয়া সংখ্যার তুলনায় অনেক কম (১৮৭২-এর জরিপে পাওয়া সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৫-৪০ হাজার পরিবার; ২ লাখ ৮১ হাজার ৭৫৮ জন সদস্য)। সুতরাং উল্লিখিত পরিসংখ্যান দুটোর তুলনা করলে কুম্ভকারদের সার্বিক পরিস্থিতির ক্রমাবনতির একটা চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী শিল্পধারার সঙ্গে তুলনা করলে ওই ১৫ হাজার পরিবারের সংখ্যাটিকেও যথেষ্ট সন্তোষজনক সংখ্যা বলেই বিবেচনা করতে হয়। মৃৎশিল্পীদের ক্রমাগত সংখ্য া হ্রাসের কারণটি কিন্তু কেবল মৃৎশিল্পের চাহিদা কমে যাওয়ার সঙ্গেই যুক্ত নয়। তার চেয়ে অনেক বড় কারণ, যা কখনোই আলোচিত হয় না, তা হচ্ছে- যুগ যুগ ধরে হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার মৃৎশিল্পীর দেশত্যাগ। সেই ১৯৪৭-এর দেশভাগ, '৫২ সালের মুলাদি রায়ট, '৬৫-এর পাক-ভারত যুদ্ধ, '৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যা ইত্যাদি বিভিন্ন সময়ে অশুভ শক্তির উত্থানে ভীত হয়ে হিন্দু সম্প্রদায় ক্রমাগত দেশত্যাগ করে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা ইত্যাদি অঞ্চলে স্থায়ীভাবে চলে যাওয়ার কারণেও মৃৎশিল্পীদের সংখ্যা কমতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন কুম্ভকার পল্লীগুলোতে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, সেখানকার প্রায় অর্ধেক মৃৎশিল্পী আমাদের দেশ থেকে অভিবাসিত। এখানে বিশেষ একটি মৃৎ সামগ্রী নিয়ে আমার সমীক্ষা লব্ধ ধারণার কথা জানাচ্ছি- লক্ষ্মী পূজায় লক্ষ্মীসরা নামে পরিচিত যে মৃৎ সামগ্রীটি নির্মাণ করা হয় তার ক্রেতা প্রায় সম্পূর্ণভাবেই ফরিদপুর, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, ঢাকা এবং বিক্রমপুরের মানুষ। এর বাইরে কিছু ক্রেতার বসবাস বরিশাল, যশোর, টাঙ্গাইল, নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জ (তুলনামূলকভাবে খুবই অল্প); উল্লিখিত অঞ্চলগুলোয় যত সংখ্যক লক্ষ্মীসরা উৎপাদিত হয় তা মিলিতভাবে ৭০-৮০ হাজারের বেশি নয়। অথচ পশ্চিমবঙ্গে শুধু নদিয়ার তাহেরপুর গ্রামেই চিত্রিত সরার উৎপাদন সংখ্যা ১ লাখ ২০ হাজার! মনে রাখতে হবে, পশ্চিমবঙ্গেও এই সরা ক্রয় করেন কেবল পূর্ববঙ্গের উল্লিখিত অঞ্চল সমূহ থেকে অভিবাসিত হয়ে যাওয়া পরিবারগুলো এবং একটি পরিবার প্রতি বছর লক্ষ্মী পূজায় কেবল মাত্র একটি সরাই ক্রয় করে থাকে। তাহেরপুর ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের পানিহাটি, দত্তপুকুর, উল্টোডাঙ্গা, হাবরা সহ আরও অনেক অঞ্চলেই লক্ষ্মীসরা নির্মাণ করা হয়। সুতরাং দেশত্যাগ করে চলে যাওয়া এবং দেশে থেকে যাওয়া মৃৎশিল্পীদের সংখ্যা যদি একত্র করে দেখার সুযোগ থাকত, তাহলে বাংলাদেশে মৃৎশিল্পের বর্তমান অবস্থাকে রীতিমতো 'রমরমা'ই বলা যেত। আবার একথাও সত্য যে, ক্রেতা সাধারণের চাহিদা ও রুচিতে কিছু পরিবর্তন, জীবনযাপনের ধরন-ধারণ বদলে যাওয়া ইত্যাদি কারণে অতীতের অনেক উন্নত শিল্পমান সম্পন্ন মৃৎসামগ্রী যেমন এখন আর তৈরি হয় না, তেমনি একই কারণে অনেক নিম্নমানের মৃৎ পণ্যেও বাজার ছয়লাব হয়ে গেছে। তবু আশার কথা এই, আমাদের ঐতিহ্যবাহী লোক ও কারুশিল্পের উৎকৃষ্ট নিদর্শনগুলোর সঙ্গে ক্রেতা সাধারণকে পরিচয় করিয়ে দিতে গত শতকের আশির দশক থেকেই কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান (নকশা কেন্দ্র বিসিক, বাংলা একাডেমি, সোনারগাঁর লোকশিল্প সংগ্রহশালা এবং পরবর্তীকালে জাতীয় জাদুঘর ও ক্রাফ্ট কাউন্সিল) নিয়মিতভাবে মেলার আয়োজন ও শ্রেষ্ঠ কারুশিল্পী পুরস্কার প্রদান করে যাচ্ছে। আর একটি আশাপ্রদ ঘটনা এই যে, ওইসব মেলায় দূর-দূরান্ত থেকে বয়ে আনা লোকশিল্প ও কারুসামগ্রী যথেষ্ট উচ্চমূল্যে খুব দ্রুত বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। ঢাকার বড় বড় বুটিকগুলোতেও আজকাল সেই সব পণ্যই ক্রেতাদের বেশি আকৃষ্ট করছে, যেগুলোর আকৃতি এবং অলঙ্করণ আধুনিক হওয়া সত্ত্বেও আমাদের লোক ঐতিহ্যের কিছু বৈশিষ্ট্যকে মিশিয়ে নিতে পেরেছে (ঠিক যেমনটি ব্যান্ড সঙ্গীতের বেলাতেও লক্ষ করা গেছে)। এ ধরনের নবউদ্ভাবিত শিল্প-সামগ্রী ও কারুপণ্যের একটি বড় অংশই মৃৎশিল্প, যা আমাদের ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পের সেই আদি প্রসিদ্ধ কেন্দ্রগুলো থেকেই তৈরি হয়ে আসছে। এখানে যে বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষণীয় তা হচ্ছে- অতীতকাল থেকে যে অঞ্চলটি যে ধরনের তৈজস বা শিল্প সামগ্রী তৈরি করে খ্যাতি পেয়েছিল আজ শত শত বছর পর কলাকৌশলে, গড়ন ও অলঙ্করণে নানা রকম পরিবর্তন আসার পরও ওইসব কেন্দ্রই খ্যাতির শীর্ষে অবস্থান করছে। যেমন জেমস ফওন্স নর্টন ওয়াইজ (ঔধসবং ঋধহিং ঘড়ৎঃড়হ ডরংব) তার ১৮৮৩ সালে প্রকাশিত গ্রন্থ ‘ঘড়ঃবং ড়হ জবপবং, ঈধংঃবং ধহফ ঞৎধফবং ড়ভ ঊধংঃবৎহ ইবহমধষদ-এ লিখেছেন, 'গোটা পূর্ববঙ্গে ঢাকার রায়েরবাজারের কুমারদের কাজ প্রসিদ্ধ।... মাটির কাজের জন্য ত্রিপুরার বিজয়পুরও (বর্তমানে কুমিল্লার বিজয়পুর) প্রসিদ্ধ। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আজ প্রায় ১৩০ বছর পরও এ দেশে মরণচাঁদ পাল কিম্বা সুভাষ পালের মতো অতুলনীয় মৃৎশিল্পীদের ঠিকানা সেই রায়েরবাজারই (যদিও তাদের একজন পরলোকগত এবং একজন দেশত্যাগী। আর রায়েরবাজার অঞ্চলে এখন একটি কি দুটি মাত্র পরিবার মৃৎশিল্পে যুক্ত)। মৃৎশিল্পের প্রাচীন কেন্দ্র বিজয়পুরের আধুনিক মৃৎপাত্রের খ্যাতিও এখন দেশের সীমানা পেরিয়ে সুদূর ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত। ইংল্যান্ডে ভারতীয় পণ্যের প্রদর্শনী উপলক্ষে ১৮৮৮ সালে ত্রৈলক্যনাথ মুখোপাধ্যায় 'অৎঃ সধহঁভধপঃঁৎবং ড়ভ ওহফরধ' নামক যে গ্রন্থটি রচনা করেন, তাতে চিত্রিত মৃৎপাত্রের মধ্যে উৎকৃষ্ট হিসেবে বিবেচনা করে যে মৃৎপাত্রকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন তা হচ্ছে রাজশাহীর শখের হাঁড়ি। খুবই আশ্চর্যের বিষয়, আজ শতাধিক বছর পরও হাঁড়ি চিত্রণে শ্রেষ্ঠ শিল্পী ওই রাজশাহীরই সুশান্ত পাল। ২০০০ সালে বৃহদাকার মৃৎপাত্র 'মটকা' বা 'জালা' তৈরি করে যিনি শ্রেষ্ঠ কারুশিল্পী পদক লাভ করেছিলেন (জহর পাল) তিনি সেই স্মরণাতীতকাল থেকে জালা নির্মাণে প্রসিদ্ধ গ্রাম কার্ত্তিকপুরেরই সন্তান। এই কার্ত্তিকপুরকেই ফরিদপুরী রীতির লক্ষ্মীসরা নির্মাণের আদিকেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করে ১৯৮৪ সালে তোফায়েল আহমেদ এই গ্রামের হেরেম্ব পালকে শ্রেষ্ঠ সরাশিল্পী হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। সেই হেরেম্ব পালেরই পুত্র বিমল পাল এখনও কালে-ভদ্রে যে দু-একটি সরা আঁকেন তার তুলনা গোটা বাংলা অঞ্চলেই নেই। ঢাকার নবাবগঞ্জ-বান্দুরা অঞ্চলের জয়পাড়া নিকটবর্তী পালপাড়ার রঙবিলাসী পাল গত দু-তিন যুগ ধরে খুবই পাতলা, হালকা এবং নিখুঁত আকৃতির যে মৃৎপাত্রগুলো তৈরি করছেন তা নিঃসন্দেহে জয়পাড়ার মৃৎশিল্পের অতীত সুনামকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম। রঙবিলাসী পালের আঁকা সরাগুলো একদিকে যেমন সারা বাংলার একমাত্র চালচিত্র সমৃদ্ধ লক্ষ্মীসরা (ইদানীং অবশ্যই এই সরার অনুকরণে অন্য অঞ্চলেও কিছু নিম্নমানের সরাও হচ্ছে), তেমনি এই সরায় রঙ-রেখার চমৎকার প্রয়োগ দেখে দীনেশ চন্দ্র সেন এবং গুরুসদয় দত্তের সঙ্গে সহমত পোষণ করে স্বীকার করতেই হয় যে, আজও বাংলার রমণীরা চিত্রাঙ্কন দক্ষতায় পুরুষ শিল্পীদের সমতুল্য, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে আরও উত্তম। মৃৎপাত্র নির্মাণ এবং চিত্রণ- এই দুটো কাজেই নারী ও পুরুষরা সমানভাবে অংশগ্রহণ করেন কালিয়াকৈর, আশুলিয়া, ধামরাই, মানিকগঞ্জ, বিক্রমপুর, নবাবগঞ্জ, রাজবাড়ী, ভাঙ্গা, কার্ত্তিকপুর, সিড্ডা, গৈলা, স্বরূপকাঠি, চাউলাকাঠি ইত্যাদি অঞ্চলে। এসব অঞ্চলের চিত্রিত মৃৎপাত্রগুলো হচ্ছে লক্ষ্মীসরা, মনসাঘট, নাগঘট, লক্ষ্মীঘট, মঙ্গলঘট, এয়োসরা প্রভৃতি। এ ছাড়া নানা ধরনের চিত্রিত পুতুলগুলোতেও নারী মৃৎশিল্পীদের আঁকা-গড়ার দক্ষতা প্রকাশ পায় (বিশেষ করে রাজবাড়ী, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, মির্জাপুর, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চলে)। তবে ময়মনসিংহ অঞ্চলের টেপা পুতুলগুলোতে অঙ্কন দক্ষতার বিশেষ পরিচয় ধরা না পড়লেও দেহের গড়নের অন্তর্নিহিত জ্যামিতিকে অনুসরণ করে রূপের সংক্ষেপিত উপস্থাপনায় দৈনন্দিন জীবনের নানা কর্মকান্ডভিত্তিক দেহভঙ্গিগুলোকে (শিশু লালন-পালন, মসলা পেষা, চুল বাঁধা ইত্যাদি) কেবল আঙুলে টিপে অতিদ্রুত নিমার্ণ করে ফেলার মাধ্যে যে মুন্সিয়ানা ও রসবোধের পরিচয় পাওয়া যায়, তা এক কথায় অতুলনীয় বা বিস্ময়কর। একসময় ধারণা করা হয়েছিল, এ ধরনের টেপা পুতুল ক্রমেই লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এ ধারণাটিই সম্ভবত আংশিক সত্য, কেননা বেশকিছু বিষয়বস্তু তথা ভঙ্গি ও আয়োজন এখন আর টেপা পুতুলে দেখতে পাওয়া যায় না। হাতের কাজের মানকেও আর ততটা উৎকৃষ্ট বলা যায় না। তবু আশার কথা এই যে, আজও ঈদ, মহররম, দুর্গাপূজা আর পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে ময়মনসিংহ ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলগুলোতে ছোট-বড় যেসব মেলাগুলো হয় তাতে সাধারণ মানুষের জন্য প্লাস্টিকের পুতুলের তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যক টেপা পুতুলই দেখতে পাওয়া যায়। ক্রেতারাও কিন্তু ছাঁচে তৈরি প্লাস্টিকের পুতুলের মতো একচেহারার পুতুল থেকে যে কোনো একটি পুতুল তুলে নিয়েই সন্তুষ্ট হন না; বরং টেপা পুতুলগুলো প্রতিটি আলাদা আলাদাভাবে হাতে তৈরি হওয়ার কারণে প্রত্যেকটির মধ্যে যে কিঞ্চিৎ স্বাতন্ত্র্য তৈরি হয় তা ভালোভাবে পরখ করে, পছন্দমাফিক (বেশ কয়েকটি) বাছাই করে নেন। অনেক ক্ষেত্রে দক্ষ হাতের কাজ আকৃতিতে ছোট হলেও রসিক ক্রেতারা তা বেশি মূল্যে ক্রয় করতেও দ্বিধা বোধ করেন না। এই রসিক ক্রেতারাই আমজনতার লোকশিল্পকে এত রসালো ও হৃদয়গ্রাহী করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় অনুপ্রেরণার জোগান দিচ্ছেন। বাংলাদেশের মৃৎশিল্পের বহুকিছু নিয়ে আমরা যেমন এখনও আশাবাদী, তেমনি কিছু কিছু দিক এতটাই উদ্বেগজনক যে, ঠিক এই মুহূর্তে পর্যাপ্ত উদ্যোগ নেওয়া না হলে হাজার বছরে গড়ে ওঠা আমাদের মহামূল্যবান ঐতিহ্যের অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান চিরদিনের মতো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এই আশঙ্কার তালিকায় এ মুহূর্তে 'এসওএস' পর্যায়ে রয়েছে রাজশাহীর শখের হাঁড়ি, যা উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ ঐতিহ্য পোড়ামাটির ফলকচিত্রের মতোই করুন পরিণতি লাভ করবে। শখের হাঁড়ির ঐতিহ্যটি বিরাট অঞ্চলজুড়ে বিস্তার লাভ করেছিল। নওগাঁ, রাজশাহী এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে গড়ে ওঠা এ ঐতিহ্য যে খুবই প্রাচীন তার প্রমাণ আমরা নানাভাবে পেয়েছি। শখের হাঁড়ি শুধু লোক ঐতিহ্যই নয়, এ হচ্ছে সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্যর প্রতীক। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিনির্ভর লোকসমাজে লক্ষ্মী এবং সরস্বতীর যে জনপ্রিয়তা একসময় হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ সব সম্প্রদায়েই বিরাজ করত, তা এই হাঁড়ির জমিনের রঙ (একটি সাদা এবং অন্যটি হলুদ) এবং উৎকীর্ণ মটিফগুলো (মাছ, হাঁস, পদ্মফুল, চিরুনি, সিঁদুরের কৌটা, ধানের মঞ্জরি ইত্যাদি) অনুশীলন করলে নিশ্চিত হওয়া যায়। গত শতকের আশির দশকেও ওইসব অঞ্চলে অসংখ্য কুম্ভকার এই হাঁড়ি নির্মাণ ও চিত্রণের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। নব্বই দশকের শেষভাগ পর্যন্ত চাঁপাইনবাবগঞ্জের বারোঘরিয়া থেকে আমার ঘনিষ্ঠজনেরা শখের হাঁড়ি এনে দিতেন। শখের হাঁড়িকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ক্রেতারা বলতেন রঙ্গের পাতিল বা শিকার হাঁড়ি; আর নক্সাবহুল ছোট খেলনা-হাঁড়িগুলোকে বলতেন চুকাই। সম্প্রতি ক্ষেত্র অনুশীলন করে বিস্মিত হলাম এই তথ্য পেয়ে যে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে গড়ে ওঠা সেই শখের হাঁড়ি বা শিকার হাঁড়ির ঐতিহ্যটির শতভাগ পৃষ্ঠপোষক ছিল বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ। ৮-১০ বছর আগেও এই হাঁড়ি প্রচুর পরিমাণে তৈরি হতো মূলত ঈদের জামাত এবং ঈদ উপলক্ষে জমে ওঠা মেলাগুলোকে উদ্দেশ্য করে। ঈদের নামাজ শেষে মুসল্লিরা ঘরে ফিরতেন রঙিন শিকায় ঝুলানো, শখের হাঁড়ি হাতে নিয়ে। তা ছাড়া মেয়ের বিয়েতে উপঢৌকন বহন করতে কিংবা বিবাহিত মেয়েকে দেখতে যাওয়ার কালে মিষ্টি বা যে কোনো শৌখিন দ্রব্যে পরিপূর্ণ একটি শিকায় ঝোলানো শখের হাঁড়ি বহন করা ছিল পিতার জন্য অপরিহার্য কর্তব্য। সেই চাঁপাইনবাবগঞ্জ আজ সম্পূর্ণভাবেই শখের হাঁড়ি শূন্য। লেখক : নিসার হোসেন, চিত্রশিল্পী এবং অধ্যাপক, চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

মেলা : বৈশাখ-জৈষ্ঠ-আষাঢ়

ইমরান উজ-জামান

মেলা সেই অনুসঙ্গ যাতে একত্রিত হয় ধনী-গরীব, কালো-ধলো, নম-শুদ্র, আশ্রাফ-আত্রাফ, হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, ছোট-বড় আর জাত-অজাত।
বাংলাদেশে বর্ষবরণের মূল আয়োজন মূলত ঢাকার রমনা পাকের বটমূলকে ঘিরে। ছায়ানট রমনা পার্কে পহেলা বৈশাখ বর্ষবরণ উৎসব পালনের আয়োজন করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এসো হে বৈশাখ……এসো , এসো….গানের মাধ্যমে তারা স্বাগত জানায় নতুন বছরকে। ১৯৭২ সালের পর থেকে রমনা বটমূলে বর্ষবরণ জাতীয় উৎসবের স্বীকৃতি পায়। ১৯৮০ সালে বৈশাখী মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে এক ধাপ বাড়তি ছোঁয়া পায় বাংলা নববর্ষ বরণের অনুষ্ঠান। ১৯৮৯ সালে এই শোভাযাত্রার প্রচলন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থীরা। পহেলা বৈশাখের দিন সকাল গড়িয়ে যখন রমনা টি.এস.সি শাহবাগে মানুষের উপচে পরা ভিড় থাকে, তখন শুরু হয় মঙ্গলশোভা যাত্রা। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে শোভাযাত্রা বের হয়ে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। এখানে পশু পাখির মুখাকৃতির ছবিসহ গ্রামীণ ঐতিহ্যের নানা অনুসঙ্গকে ফুটিয়ে তোলা হয় নানা রং বেরং-এর মুখোশ ও আলপনার মাধ্যমে। ছেলে বুড়ো সবাই মেতে ওঠে বর্ষবরণের মঙ্গলশোভা যাত্রার আনন্দে। তবে প্রতি বছর মঙ্গল শোভাযাত্রায় একটি থিম শ্লোগান রাখা হয়, যা সমাজের সমসাময়িক সময়কে ধরে, কবি-সাহিত্যিকদের কবিতার পক্তি ব্যবহার করা হয়।
বৈশাখ মেলার মাস। বাংলা একাডেমির এক হিসাবে কেবল বৈশাখ মাসেই সারা বাংলাদেশে মেলা বসে ২শ ৪৫টি। আর দেশের বিভিন্ন স্থানে শুধু বৈশাখকে উপলক্ষ করে বসা মেলার সংখ্যা ১শ ৮০টি। অন্যান্যগুলো বার্ষিক ওরস ও ¯œান মেলা। আর আছে কালিপূজা উপলক্ষে মেলা। তবে প্রকৃতপক্ষে এই মেলার সংখ্যা দাড়াবে ৫শ’র বেশি। স্মরনকালে প্রবর্তিত হলেও বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুঠির শিল্প কর্পোরেশন আয়োজিত মেলা এখন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত। এছাড়া প্রতি জেলা শহরেই বৈশাখি মেলা বসে, অনেক জায়গায় আবার চৈত্র সংক্রান্তি থেকেই শুরু হয় মেলা ।
বাঙালি জীবনের অসাম্প্রদায়িক, সার্বজনীন একটি উৎসব হল পহেলা বৈশাখ, বর্ষবরণের দিন, শুভ নববর্ষ। রমনার বটমূল থেকে পুরো ঢাকা হয়ে প্রতিটি বিভাগীয় শহর, জেলা শহর, উপজেলা, ইউনিয়ন, গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে ঘটা করে নববর্ষ পালনের সংস্কৃতি। শুধু গ্রাম নয় শহর উপশহর রাজধানীর ঢাকারও বিভিন্ন অলিগলিতে বসে বৈশাখি মেলা। পান্তা- ইলিশ, বাঁশি, ঢাক-ঢোলের বাজনায় আর মঙ্গল শোভাযাত্রায় পূর্নতা পায় বাঙালির এ উৎসব মুখরতা।
হিন্দু সৌর পঞ্জিকামতে, আগে থেকেই পালিত হয়ে আসছে বাংলায় বারোমাস। কিন্তু গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় দেখা যায়, এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় এই সৌর বছর গণনা শুরু হত। ভারত বর্ষে মোঘল সা¤্রাজ্য শুরুর পর থেকে আরবী বছর হিজরী পঞ্জিকা অনুযায়ী তারা কৃষিপণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরী সাল চাঁদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় কৃষি ফলনের সাথে এর কোন মিল পাওয়া যেত না। যার কারনে স¤্রাট আকবর এর সুষ্ঠু সমাধানের জন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ আমীর ফতেহউল্লাহ সিরাজীর উপর নতুন বাংলা সনের প্রবর্তনের দায়িত্ব দেন। ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ ই মার্চ বা ১১ ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গননা পদ্ধতিকে কার্যকর ধরা হয় স¤্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহনের তারিখ ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর থেকে। প্রথমে এর নাম ফসলি সন বলা হলেও পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিতি পায়।
সেই অর্থে জৈষ্ঠ্য মাসে মেলা খুবই কম। কারন এই মাসকে মধু মাস বলা হয়, ঘরে ঘরে থাকে মধু ফলের উদযাপন। আম-কাঠাল সহযোগে ঘরে ঘরে নতুন জামাই সমাদরের ধুম পরে। মেলা এই মাসে মূলত ঘরে ঘরে।
একসময় শুধু গ্রাম গঞ্জে মেলা বসলেও এখন এর পরিধি ছড়িয়েছে সর্বত্র। তবে গ্রাম আর শহুরে মেলায় পার্থক্য বেশ। স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য কারুপণ্য, লোকশিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাত সামগ্রী, সকল প্রকার হস্ত শিল্পজাত ও মৃৎশিল্পজাত সামগ্রী উপস্থিত করার রেওয়াজ রয়েছে। এছাড়া শিশু-কিশোরদের খেলনা, মহিলাদের সাজ-সজ্জার সামগ্রী। থাকে সাপের খেলা, বাঁশ-বেতের তৈজষ, মাটির খেলনা-হাড়ি-পাতিল আর নানা জাতের খেলার সামগ্রী, নারকেল মুড়ি-মুড়কিসহ হাজারো পদ থাকে মেলায়। মেলা উপলক্ষে বসে নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা, কুস্তির আসর। যাত্রা, পালাগান, কবিগান, জারিগান, গম্ভীরাগান, গাজীর গানসহ বিভিন্ন ধরনের লোকসংগীত, বাউল-মারফতি-মুর্শিদি-ভাটিয়ালী। থাকে আঞ্চলিক গান পরিবেশনের আয়োজন। লাইলী-মজনু, ইউসুফ-জুলেখা, রাধা-কৃষ্ণ প্রভৃতি আখ্যানও উপস্থাপিত হয়। চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, নাটক, পুতুল নাচ, নাগরদোলা, সার্কাস বৈশাখী মেলার বিশেষ আকর্ষণ। এছাড়া শিশু-কিশোরদের আকর্ষণের জন্য থাকে বায়োস্কোপ। শহরাঞ্চলে নগর সংস্কৃতির আমেজে এখনও বৈশাখী মেলা বসে এবং এই মেলা বাঙালীদের কাছে এক আনাবিল আনন্দের মেলায় পরিণত হয়। বৈশাখী মেলা বাঙালীর আনন্দঘন লোকায়ত সংস্কৃতির ধারক।
বিখ্যাত সব বৈশাখি মেলার মধ্যে-নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, সাভার, রংপুরের পায়রাবন্দ, দিনাজপুরের ফুলছুড়ি ঘাট এলাকা, মহাস্থানগড়, কুমিল্লার লাঙ্গলকোট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মহেশপুর, খুলনার সাতগাছি, ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল অঞ্চল, সিলেটের জাফলং, মণিপুর, বরিশালের ব্যাসকাঠি-বাটনাতলা, গোপলগঞ্জ, মাদারীপুর, টুঙ্গিপারা, মুজিবনগরের বৈশাখি মেলা অন্যতম।
চট্টগ্রামে লালদীঘীর ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় জব্বারের বলি খেলা। পার্বত্য এলাকার উপজাতি অধ্যুষিত এলাকায় বিভিন্ন জাতি বিভিন্ন ভাবে বছরের শুরুটা পালন করে। যেমন চাকমা’রা বিজু, মারমা’রা সাংরাইং, ত্রিপুরা’রা বৈসু, তঞ্চঙ্গাদের বিষু। সব মিলিয়ে এক সঙ্গে বলা হয় বৈসাবি। রাঙামাটিতে বৈসাবিকে উপলক্ষ করে মেলার হাট বসে। র‌্যালি, জলকেলি, বলি খেলা আরো কত কি। বৈশাবির প্রধান আকর্ষন পানি খেলা। নৌকার মধ্যে বোঝাই পানি থাকে। নৌকার দুই পাশে ছেলে এবং মেয়ের দল দাড়িয়ে পানি ছোড়াছুড়ি করে। এই খেলাকে জলকেলি বলে।
তবে রাঙামাটির জেলেপাড়ায় বসে ভিন্ন রকমের আয়োজন। নতুন এবং পুরনো জেলে পাড়া মিলে দুই গ্রাম জেলে। হিন্দু অধ্যুসিত দুই গ্রামে বৈশাখ মাসের প্রথম দিন পাঁচন উৎসব হয়। বাঙালির নববর্ষের আদলে এই পাঁচন উৎসব। সকাল থেকেই পাড়ার বৌ-ঁিঝ’রা ঘাটে ভীর করে বড় হাঁড়ি বা গামলা নিয়ে। যার মধ্যে থাকে হরেক প্রকারের সবজি যা লেকের পানিতে পরিষ্কার করতে নিয়ে আসেন তারা। আর অন্য হাতে থাকে ছোট মাটির হাঁড়ি যার মধ্যে থাকে ফুল। এই ফুল স্থলে ফেলা যাবে না। তাহলে অনিষ্ঠ হবে। ফেলতে হবে পানিতে। পুজার ফুল পানিতে ভাসিয়ে দিয়ে, গোসল করে পবিত্র হয়ে তার পরে পাঁচনের কাঁটা সবজি গুলো ধুয়ে নিয়ে বাড়ী ফিরেন পাঁচন রান্নায় বসেন। রান্নার পদে থকে ১০৮ টি সবজি। ছোট ছোট মেহমানরা মহানন্দে বাড়ি বাড়ি ঘুরে পাঁচন খাচ্ছেন। পাঁচন খাওয়া শেষ হলে খই,মুড়ি-মুড়কি পলিথিনে নিয়ে তারা বাড়ি ছারছে। প্রত্যেকের হাতে একটি করে পলিথিনের পুটলি। পুটলিতে বাড়ি বাড়ি থেকে জমানো এইসব মুড়ি-মুড়কি। আর ঘরে ঘরে চলছে দেবতাকে তুষ্ট করার নানা আয়োজন। নিতাই মালির ঘরে বসেছে কীর্তনের আসর। মধুবালা দেবী মন্দিরা হাতে তান ধরেছেন। আর প্রিয়বালা ১৬ রকমের ফল ঝরো করেছেন দেবতার সামনে। প্রত্যেক ঘরের দরজায় সুতায় বেধে টানিয়ে দেয়া হয়েছে কিছু ফুল। প্রায় সবই বনফুল। তাদের পুঁজার বেদি কিন্তু খুবই সাধারন। কোন বাড়িতে একটা খুটির মাথায় কাঠের চারকোনাকৃতি ছোট ঘরে ফুল দিয়ে। কোথাও খুটির উপরে ড্রাম রেখে তার ভেতরে। কোথাও আবার শুধুই ঘরের সামনের খালি জায়গায় মাটিতে লেপে আল্পনা একে সেখানে প্লেটে পাঁচন আর পাশে ফুল রেখে চলে দেবতাকে তুষ্ট করার কাজ। সারা গ্রাম জুরে শিশু -কিশোরদের মেলা যেন এক। পাঁচনের মেলা।
প্রাচীন বর্ষবরণের রীতির সাথে অঙ্গাঅঙ্গি ভাবেই জড়িত হালখাতা। চাষাবাদ বাবদ চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করে দিত দেনাদাররা। পহেলা বৈশাখ ভূমির মালিকরা তাদের প্রজা সাধারণের জন্য মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়নের ব্যবস্থা রাখতেন। যা পরবর্তিতে ব্যবসায়িক পরিমন্ডলে ছড়িয়ে পড়ে। দোকানীরা সারা বছরের বাকীর খাতা সমাপ্ত করার জন্য পহেলা বৈশাখের দিনে নতুন সাজে বসে দোকানে। গ্রাহকদের মিষ্টিমুখ করিয়ে শুরু করেন নতুন বছরের ব্যবসার সূচনা। এ উৎসব গুলো সামাজিক রীতির অংশ হিসেবে পরিণত হয়েছে প্রতিটি বাঙালির ঘরে। এখনো গ্রাম গঞ্জে নববর্ষে হালখাতার হিড়িক পড়ে বাজার, বন্দর ও গঞ্জে। তবে ঢাকার তাঁতীবাজারে এখনো মহা ধুমধামে হালখাতা অনুষ্ঠান হয়।
বার ভূঁঈয়া প্রধান ঈশা খাঁর সোনারগাঁয় বৈশাখ উপলক্ষ্যে এক ব্যতিক্রমী মেলা বসে। যা বউমেলা নামে পরিচিত। জয়রামপুর গ্রামে প্রায় ১০০ বছর ধরে পয়লা বৈশাখে শুরু হওয়া এই মেলা পাঁচ দিনব্যাপী চলে। প্রাচীন একটি বটবৃক্ষের নিচে এই মেলা বসে, যদিও সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সিদ্ধেশ্বরী দেবীর পুঁজো হিসেবে এখানে সমবেত হয়। বিশেষ করে কুমারী, নববধূ, এমনকি জননীরা পর্যন্ত তাঁদের মনস্কামনা পূরণের আশায় এই মেলায় এসে পূজা-অর্চনা করেন। সন্দেশ-মিষ্টি-ধান দূর্বার সঙ্গে মৌসুমী ফলমূল নিবেদন করে ভক্তকূল। বটবৃক্ষের তলে পাঁঠাবলির রেওয়াজও রয়েছে। বদলে যাচ্ছে পুরনো অর্চনার পালা।এখন কপোত-কপোতী শান্তির বার্তা পেতে চায় দেবীর কাছ থেকে। কাঙ্খিত মানুষের আশায় কাঙ্খিত মানসীরা প্রার্থনা করে। হয়ত সফল হয়েই তারা ঘরে ফিরে। বউমেলা ছাড়াও সোনারগাঁ থানার পেরাব গ্রামের পাশে আরেকটি মেলায় আয়োজন করা হয় যার নাম ঘোড়ামেলা। লোকমূখে প্রচলিত জামিনী সাধক নামের এক ব্যক্তি ঘোড়ায় করে এসে নববর্ষের এই দিনে সকলকে প্রসাদ বিতরণ করতেন। জামিনী সাধক মারা গেলে ঐ স্থানে তার স্মৃতি স্তম্ব নির্মান করা হয়। প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে তার স্মৃতি স্তম্বে¢ সনাতন ধর্মাবলম্বীরা একটি করে মাটির ঘোড়া রাখে এবং এখানে মেলার আয়োজন করা হয়। এই হলো ঘোড়ামেলা। বৈশাখে সারা দেশ ভাসে মেলায়।

ঝড় এলো, এলো ঝড়
আম পর, আম পর।
কাঁচা আম, পাঁকা আম
টক টক মিষ্টি

বৈশাখ নিয়ে আছে এমন অনেক ছড়া। সারা দেশের গ্রামে গঞ্জে মেলার মধ্য দিয়ে যে উৎসবের সূচনা হয়। জৈষ্ঠ মাসের ফলের ম ম গন্ধ্যে সেই উৎসব পূর্ণতা পায়। বাড়ি বাড়ি জামাই বরন আর জামাই সমাদরের ধুম চলে। প্রতিটি ঘর এক একটি মেলায় পরিনত হয়।
দেশব্যাপী নাম ধরে বলার উল্লেখ্য করার মতো আছে অনেক বিখ্যাত মেলা।
মাতাই পুখির/ চৈত্র সংক্রান্তির মেলা- দেবতা পুকুর, নুনছড়ির, খাগড়াছড়ি।
বৈশাখী মেলা – বলীখেলা- লালদিঘি মাঠ, চট্টগ্রাম।
বৈশাখী মেলা – বলীখেলা -সাতকানিয়ার, চট্টগ্রাম।
বৈশাখী মেলা – বলীখেলা-তৈলারদ্বীপ, আনোয়ারা, চট্টগ্রাম।
বৈশাখী মেলা – ডিসি সাহেবের বলীখেলা- ডিসি মাঠ কক্সবাজার।
বৈশাখী মেলা – রাণী’র প্রাসাধ, কালী মন্দির, ময়নামতি, বুড়িচং ,কুমিল্লা। বৈশাখ থেকে আরম্ভ হয়ে মাস ব্যাপী মেলা।
বৈশাখী মেলা -লালমাই-ময়নামতি পাহাড়ের চূড়া, কুমিল্লা।
বৈশাখী মেলা/গডিয়া – কালিতারা বাজার, নোয়াখালী।
কুমারটেক (পালপাড়া), ঘোড়াশাল, পলাশ, নরসিংদী।
টেঙ্গরপাড়া, চরসিন্দুর ও পারুলিয়া কুমার পল্লী ,বরাব, জিনারদী, নরসিংদী।
গাজী, কালু মেলা – নিজসরাইল, সরাইল , ব্রাহ্মণবাড়িয়া ।
চড়ক পূজা ও বৈশাখী মেলা – হালির হাওর, জামালগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ।
চড়ক পূজা ও বৈশাখী মেলা -ছয়হারা খোজারগাও, ফেনারবাঁক, সুনামগঞ্জ ।
বৈশাখ মেলা/জামাইমেলা – বাছিরন নেছা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ, রসুলপুর, টাঙ্গাইল। ১১, ১২ ও ১৩ বৈশাখ।
বৈশাখী মেলা – পাউলদিয়া বটতলা, সিরাজদিখান, মুন্সীগঞ্জ। ১বৈশাখ।
বৈশাখী মেলা পঞ্চবটির অশ্বথমূলে, নামার বাজার, সাভার। ১ বৈশাখ।
চড়ক মেলা – বেলতলা, কাপাসিয়া- সংক্রান্তি।
সংক্রান্তি -বৈশাখী তিনদিন – সিংজুরী, রাধাকান্তপুর, পেঁচারকান্দা-বালিয়াখোড়া, পয়লা উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠ, নালী বাজার , ঘিওর, মানিকগঞ্জ।
বৈশাখী মেলা-মাইলাঘী, তরা কালীগঙ্গা নদীর পাড়, পঞ্চ রাস্তা এলাকা, পুখুরিয়া স্বপ্নের মোড়, মানিকগঞ্জ।
পাগলা গাছের মেলা, হামছাদী ,বৈদ্যোরবাজার, সোনারগাঁ, নারায়ণগঞ্জ। ৩১ বৈশাখ থেকে মাস।
চড়ক মেলা -ঠাকুরবাড়ি, কালিয়া, নড়াইল, ৩০ চৈত্র।
চড়কপূজার মেলা – শুড়িরডাঙ্গা সিদ্ধাশ্রম ও মহাশ্মশান, সুন্দলী, অভয়নগর, যশোর। ২৯ চৈত্র খেজুর ভাঙা, ৩০ চৈত্র। চড়কপূজা, পহেলা বৈশাখ বৈশাখী মেলা।
সতিমান ঠাকুরের মন্দির ও মেলা – বোচাগঞ্জের, দিনাজপুর
চৈত্র সংক্রান্তির মেলা-জম্বুলেশ্বর মন্ডবের মেলা শিবমন্দির-সাঁওতাল পাড়া,চন্ডিপুর, বিরামপুর মির্জাপুর, দিনাজপুর । সংক্রান্তি
বৈশাখী মেলা/গোপিনাথপুর মেলা/ঘোড়ার হাট – আক্কেলপুর, উপলক্ষে জয়পুরহাট –
বৈশাখী মেলা – নিমাইদীঘি, নন্দীগ্রাম/কাহালু, বগুড়া – চৈত্র সংক্রান্তি থেকে তিনদিন।
বৈশাখী মেলা – শিবগঞ্জ, মহাস্থানগড়, বগুড়া – একদিন এক রাত।
বৈশাখী মেলা – উত্তর শিহিপাশা, আগৈলঝাড়া, বরিশাল – সারা মাস।
বৈশাখী মেলা – দুরমুট, মেলান্দহ, জামালপুর – বৈশাখের প্রথম দিন থেকে মাস ব্যাপী।
জামাই মেলা/চৈত্রমেলা – গোপালপুর বাজার, ঘোড়াধাপ, জামালপুর। মাসব্যাপী
বৈশাখী মেলা – পোড়াবাড়ীয়া, নারান্দি,পাকুন্দিয়া, কিশোরগঞ্জ। মাস ব্যাপী।
ফকির মেলা-মৌতলা, শ্যামনগর, সাতক্ষীরা। সংক্রান্তি ও বৈশাখ।

চারন কবিদের গানে বঙ্গবন্ধু

রঞ্জনা বিশ্বাস


বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সবচেয়ে বেশি রচিত হয়েছে ১৯৯৬ এরপর, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার মধ্য দিয়ে। প্রায় সাড়ে চার হাজারের বেশি গ্রন্থ রচিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে। এর বেশির ভাগই ঐতিহাসিকের গভীর দৃষ্টিভঙ্গীতে রচিত নয়। যে দু একজন সত্যনিষ্ঠ ‘নিরপেক্ষ’ ইতিহাসের কথা ভেবেছেন তারাও জনজীবনকে উপেক্ষা করেছেন। আলোচনায় এনেছেন যুক্তিতর্ক আর ‘বঙ্গবন্ধু’কে মহান করে দেখাবার প্রচেষ্টা। বর্তমানে আওয়ামী গণরাজনীতির চাপে নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকের আরাধ্য বিষয়বস্তু একেবারই সংকুচিত হয়ে গেছে, কখনও কখনও উপেক্ষিত হয়েছে। ফলে ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে উঠেছেন একটি বিশেষ দলের নেতা। সামগ্রীকতাকে পরিহার করে সংকীর্ণ গোষ্ঠীচেতনায় সংকুচিত করে ফেলার এই প্রবনতার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে এক একটি আকবরনামা। অথচ বাংলাদেশে ‘বঙ্গবন্ধু’ বাঙালি জাতীয় ঐক্যের প্রতীক রূপে প্রতিভাত হন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের ‘গণরাজনীতির চাপে তিনিও হয়ে উঠছেন বিশেষ দলের প্রতীক। এ থেকে মুক্তির উপায় কী? মুক্তির উপায় জনজীবনের সঙ্গে ঐতিহাসিকের সামাজিক কমিটমেন্ট রক্ষা করা। আমরা যাদের ‘জন’ বলি এরা কারা? এদের সঙ্গে কেন্দ্রিয় শাসকদের সম্পর্ক কতটুকু? মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে এদের সম্পর্ক কেমন ছিল ? এই সব প্রশ্নের উত্তর কি আমাদের পাঠ্যবইয়ের চিন্তা ও রচনার সাহায্যে পাওয়া সম্ভব ? পাওয়া সম্ভব নয়, কেননাÑ সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক চেতনা ও তাদের সমাজচেতনার মুখ্য উপাদান এসব রচনায় উপস্থিত নয়। আর তাই ‘উচ্চবর্গের দৃষ্টিভঙ্গীর বাহন ইতিহাসবিদ্যার সাধ্য নেই যে জাতীয়তাবাদের এই গুরুত্বপূর্ণ দিকটাকে স্বীকার করে কিংবা ব্যাখ্যা করে।’১ অথচ বঙ্গবন্ধু জনসাধারনের ঐক্যের প্রতীক আকাক্সক্ষার ফল, যার মধ্য দিয়ে জনসমাজ স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহন করার চেষ্টায় রত হয়েছিল এবং জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে তারা ছিনিয়ে এনেছিল বিজয়। কিন্তু উচ্চবর্গ তাকে আত্মসাৎ করার চেষ্টা করেছে, তাকে চালিয়ে দিচ্ছে বিশেষ একটি গোষ্ঠীর মহানায়ক হিসেবে। তাই এই জাতীয় ইতিহাস হয়ে উঠছে একপেশে ভাবনায় পূর্ণ, নিরানন্দময়, অগভীর , অপ্রশস্ত আর চাটুকারিতায় পূর্ণ কীর্তিগাথা।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এটুকু বলেই সব শেষ হয়ে যায় না যে, ৭ই মার্চের ভাষণ বাঙালিদের বিজয়ের যথাযথ কাল নির্দেশক অবস্থানকে খুঁজে বের করার জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ কিংবা শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের সংকট ও উত্তরণ পন্থার অভিনবত্ব শাশ্বতরূপে চিত্রিত করার চেষ্টাই হবে ঐতিহাসিকের কাজ। কিন্তু এতে করে যে বিষয়টি আড়ালে থেকে যায় তা হলো জনগণের সঙ্গে ‘নায়ক’ মানুষটির পরিবর্তনের মুহূর্তটিকে চিহ্নিত করা, স্থীর করা। আবার সেই মুহূর্তটাও তো কোনো স্থীর সময় নয় বরং নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহের ভিতর দিয়ে অবিরাম পরিবর্তন। এই প্রবাহ যতটা না উপর থেকে নিচের দিকে ধাবমান ছিল তার চেয়ে বেশি নিচ থেকে উপরের দিকে উৎসারিত হয়েছিল ফোয়ারার মত। সেই প্রবাহকে অস্বীকার করা হয় প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাস চর্চায়। এখানে ঐতিহাসিকের দায়িত্ব কেবল নায়কের দিক থেকে ঘটনা সমুহকে বর্ণনা করা। অথচ তার একটি বিশেষ সামাজিক দায়িত্বও ছিল। জনজীবনের সঙ্গে নায়কের অবস্থানের যে স্বাভাবিক ও চিরন্তন ‘ঐক্য’ ও ‘সমগ্রভাবনা’ আছে তার অভেদতত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব সব সময়ই এড়িয়ে গেছেন তারা। কেন এড়িয়ে গেছেন ? কারণ Ñ জনজীবনে রাজনৈতিক নায়কের ইতিহাস কিভাবে প্রতিভাত হয়েছিল তার সন্ধান পাওয়ার চেষ্টা তারা করেননি। আবার মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক রচিত ইতিহাসেও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। যায়নি কারণ, ‘ নি¤œবর্গের রাজনীতির চরিত্র নির্ধারিত হচ্ছে নি¤œবর্গের নিজস্ব চেতনার রূপরেখানুসারে। সেই চেতনা গড়ে উঠেছে অধীনতার অভিজ্ঞতা থেকে।’২
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের জনযোদ্ধাগণ যুদ্ধ করেছেন ১১টা সেক্টরের অধীনে। যাদের অধীনে তারা যুদ্ধ করেছেন তারা প্রায় সকলেই সামরিক কর্মকর্তা, তাদের চেয়ে শিক্ষিত, সামরিক বিষয়ে প্রশিক্ষিত অতএব যুদ্ধের প্রসাশনিক বিন্যাসানুযায়ি ক্ষমতাটা চলে যায় উচ্চবর্গেরই হাতে। ফলে পরবর্তী ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধের কীর্তিগাথা ও চেতনার সাক্ষ্য প্রমাণ সংরক্ষিত হয়েছে উচ্চবর্গের দিক থেকে তাদের অধীনে এবং তাদেরকে ঘিরে। বলা বাহুল্য যে, স্বাধীনতার পরে ক্ষমতার কেন্দ্রেও তারাই ছিলেন। এমতাবস্থায় নি¤œবর্গের জনজীবন স্বাভাবিক ভাবেই ইতিহাসে উপেক্ষিত হয়েছে। তাই বলে কি নি¤œবর্গের উপস্থিতি একেবারেই অস্বীকার করা সম্ভব? সম্ভব নয়। ‘ একমাত্র একটি মুহূর্তেই শাসককুলের মানসপটে নি¤œবর্গ আবির্ভূত হয় স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের অধীকারি হয়ে। সেই মুহুর্তটি হল বিদ্রোহের মুহূর্ত।’৩ তাই সাবল্টার্ন স্টাডিজের গবেষনায় সবচেয়ে বড় অংশ জুড়ে রয়েছে বিদ্রোহের ইতিহাস, বিশেষত কৃষক বিদ্রোহ। এখানে নি¤œবর্গের চিন্তার স্বরূপটি কেমন ছিল তার কিছুটা হদিস পাওয়া যায়। আর তাই সাবল্টার্ন স্টাডিজের ঐতিহাসিক গণ বিদ্রোহের ইতিহাসগুলির মধ্যে নি¤œবর্গের চেতনার সন্ধান করেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া জনযোদ্ধারাও তো এক বিশেষ চেতনার বশবর্তী হয়ে যুদ্ধে নেমেছিলেন। সেই চেতনার পরিচয়টি পাবার জন্য আমরা কতটা এগিয়ে এসেছি? উচ্চবর্গের হাতে রচিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ভিতরে কোনো সাবল্টার্ন স্টাডিজের ঐতিহাসিকও ‘নি¤œবর্গের অবস্থান’ সনাক্ত করার জন্য আগ্রহী হননি। অথচ ইতিহাসের কর্মকান্ডের মধ্যে নি¤œবর্গের একটি স্বতন্ত্র ভূমিকা রয়েছে। সাবল্টার্ন স্টাডিজের ঐতিহাসিকের কাজ যদি হয় প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাসের সমালোচনা করা৪ তাহলেও আমাদের দেশে সেই অর্থে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নি¤œবর্গের ঐতিহাসিকের ভূমিকা চোখে পড়ে না। তবে সাবলটার্ন স্টাডিজের ঐতিহাসিকের কাজ যেখানে প্রচলিত ইতিহাসের মধ্যে নি¤œবর্গের অবস্থান সনাক্ত করা ও ব্যাখ্যা করা সেখানে ‘জনইতিহাসের ’ স জ্ঞা সে রকম নয়। আমরা জানি , বিশ্বাস করি, জনজীবনের মধ্যেই ইতিহাসের ঘটনা রয়ে গেছে। তাদের চেতনায় উপস্থিত ঐতিহাসিক ঘটনা, বিপ্লবী নায়কের চরিত্র ও তাদের প্রেষণা সমুহ তাদের ধর্মবিশ্বাস, সমাজ সংস্কৃতি, জীবনাচার, অলৌকিকতার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে লোকগান, লোকছড়া, কবিতায় রূপ নিয়েছে। রূপ নিয়েছে মিথ বা জনশ্রুতিতে। সেই সব উপাদানগুলি সংরক্ষণ করা গেলে তার ভেতরে নি¤œবর্গের যে ইতিহাস চেতনা কাজ করেছে তার স্বরূপ উদঘাটন করা সম্ভব হবে। আর তাই আমরা এই সব উপাদানগুলোকে প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসের ছকে ফেলে নি¤œবর্গের চেতনার সন্ধান পেতে চাই।
জনজীবনের মধ্যে ইতিহাসের কোন অংশগুলি কিভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে এবং তাদের ভাবনাকে উজ্জীবিত করেছে তার সন্ধান পেতে আমরা দ্বারস্থ হই লোকগান, লোকছড়া, লোক কবিতা প্রভৃতির কাছে। এই সব উপাদান লোকসংস্কৃতির অংশ বলে গবেষকগণ মনে করতেই পারেন জনইতিহাসও লোকসংষ্কৃতির অংশ। কিন্তু আমরা জনজীবনের সঙ্গে সম্পর্কহীন প্রচলিত ইতিহাসের বিপরীত অবস্থাকেই জনইতিহাস বলতে চাই। রাজ-রাজড়াদের বাইরে যে বিশাল জনতা, যারা যোদ্ধা, ভূক্তভোগী তারাও তো ইতিহাসের অংশ, যারা নিজেদের মধ্যে ইতিহাসের ঘটনা সমূহ বা মূলসূত্রটুকু সযতেœ আত্মস্থ করেন নিজেদের সুখ-দুঃখ-ব্যথা বেদনার সংমিশ্রণে। এই পাঠ কখনই প্রচলিত ইতিহাসবিদের বিবেচ্য নয় বলে তা জনগণের কাছে উম্মোচিত হয় না।
নি¤œবর্গের ইতিহাসবিদগণ নি¤œবর্গের চেতনা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখেছেন যে, তাদের চেতনা স্বতন্ত্র হয়েও পরাধীন, বহুধাবিভক্ত। ফলে তারা কখনওই গোটা সমাজের হয়ে কথা বলতে পারে না। তাই তাদের ইতিহাস চেতনা অসম্পূর্ণ, আংশিক। একারণে ভারতবর্ষের সকল নি¤œবর্গের বিদ্রোহ অসফল হয়েছে। কিন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী নি¤œবর্গের চেতনায় এক ধরনের বিশেষত্ব আছে। আর সেটা হল সমগ্র পূর্ববঙ্গের শোষিত মানুষের সংগঠিত স্বতস্ফুর্ত আন্দোলনের সচেতনতা। এই দিক থেকে ’৭১ এ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীগণ নি¤œবর্গ নন, তারা জনগণ (ঢ়বড়ঢ়ষব)।
‘জনে’র সঙ্গায় বলা হয়েছে Ñ লোক, (নর ও নারী) লোকসমুহ, শ্রমজীবী মজুর পামর ইত্যাদি। ‘জনে’র ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে কলিম খান ও রবী চক্রবর্তী তাদের বঙ্গীয় শব্দার্থ কোষে বলেন, ‘জন হচ্ছে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী আত্মবিক্রয় জীবী জন বা মজুর। যতদিন সে যৌথ সমাজব্যবস্থার অধীন ছিল – ততদিন ছিল Ñগণ” গণের সঙ্গায় মেধাতিথি বলেনÑ ‘যাহারা মিলিত ভাবে এক কার্য দ্বারা জীবীকার্জন করে তাদেরই গণ বলা হয়।’৫ গণের লোকেরা ব্যাক্তিস্বাতন্ত্র দাবী করে না। গোষ্ঠীর চেতনা দ¦ারা তারা পরিচালিত হয়। অন্য দিকে ‘জন’ এর লোকেরা প্রত্যেকেই ব্যাক্তি স্বাতন্ত্রবাদী। এই দু শ্রেণিকে একত্রে বলা হয় জনগণ। মুক্তিযুদ্ধের সময় শোষকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের যে অংশ রাজনৈতিক চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে জনযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল এখানে তারাই মুলত ‘জন’ নামে পরিচিত হবে। আর এই জনগণের ভেতরকার ইতিহাস চেতনাকেই আমরা বলছি জনইতিহাস। এই জনইতিহাসের উপাত্ত পাওয়া যাবে জনগনের স্মৃতিতে সংরক্ষিত লোককবিতায়, লোকছড়ায় ও গানে। সন্দেহ নাই যে সেই সব উপাদানের ভিত্তিতে একটি পূর্ণাঙ্গ এবং বিশুদ্ধ ইতিহাস রচনা সম্ভব নয় কিন্তু আমরা এতে করে একটা বিশেষ সত্যের মুখোমুখি হতে পারব। রবীন্দ্রনাথ এ প্রসঙ্গে বলেন- ‘ঐতিহাসিকের ঘটনার জনশ্রুতি বহুতর লোকের মন হইতে প্রতিফলিত হইয়া আসে এবং সেই ঘটনার বিবরনে সাময়িক লোকের মনের ছাপ পড়িয়া যায় তাহা হইতে ঘটনার বিশুদ্ধ সত্যতা আমরা না পাইতেও পারি কিন্তু তৎসাময়িক অনেক লোকের মনে তাহা কিরূপ প্রতিভাত হইয়াছিল সেটা পাওয়া যাইতে পারে। অতীত সময়ের অবস্থা কেবল ঘটনার দ্বারা নির্ণয় হয় না। লোকের কাছে তাহা কিরূপ ঠেকিয়াছিল সে ও একটা প্রধান দ্রষ্টব্য বিষয়। অতএব ঐতিহাসিক ঘটনার জনশ্রুতিতে বাস্তব ঘটনার সহিত মনব মন মিশ্রিত হইয়া যে পদার্থ উদ্ভুত হয় তাহাই ঐতিহাসিক সত্য। সেই সত্যের বিবরনই মানবের নিকট চিরন্তন কৌতুকাবহ এবং শিক্ষার বিষয়’।৬ আমরা এই সত্যের বিবরণকেই জনইতিহাসের বিষয় বস্তু রূপে উপস্থাপন করতে চাই। তাই লোকসংস্কৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে এখানে যে আলোচনা তা একপ্রকার জনইতিহাস।
আর একথা একান্তভাবেই স্বীকার্য যে বাঙালির লোকসংস্কৃতিই শেষ পর্যন্ত তাকে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলো, যুদ্ধে যাওয়ার প্রেরণা যুগিয়েছিল। আর সেই ইতিহাসের যে ভিত্তি রচিত হয়েছিল এদেশের জনজীবনে, জনমানসে রবীন্দ্রনাথ একেই বলতে চেয়েছেন জনপ্রবাহের ভিতরকার ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধে বিদ্রোহী কৃষক শ্রমিক, মুটে, মজুর, কুলি, কামার, কুমার, জেলে, মাঝির যে চেতনার পরিচয় পাওয়া যায় তাতে উপস্থিত ধর্মভাব, অলৌকিকতা, দৈবশক্তিতে আস্থা ইত্যাদির ভেতর মোড়ানো যে রাজনৈতিক চেতনা, যে ইতিহাস চেতনা তাকে উচ্চবর্গের চেতনার ছকে ফেরে আত্মস্থ করার চেষ্টাও ঠিক জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের শর্ত নয়। এরকম চেষ্টার ফলে নি¤œবর্গের নিজস্ব ইতিহাস চেতনা ও কীর্তি হারিয়ে যেতে বাধ্য। নি¤œবর্গের ইতিহাস রচয়িতাগণ জাতীয়তাবাদী ও মার্কসবাদী ইতিহাসের ভেতর নি¤œবর্গের যে স¦তন্ত্র ঐতিহাসিক ভূমিকা উপেক্ষিত হয়েছে তা প্রমাণ করার উদ্দেশ্যেই নি¤œবর্গের ইতিহাস রচনার কথা বলেন। কিন্তু ইতিহাসে নি¤œবর্গের মানুষের চেতনা ও উচ্চবর্গের মানুষের চেতনা স্বতন্ত্র ভাবে প্রবাহিত হয়ে কোথায় কিভাবে মিলিত হয়েছে এবং বিদ্রোহের জন্ম দিয়েছে তার সম্মিলিত কর্মসূচি নিয়ে ইতিহাস লেখার চেষ্টাই হতে পারে বিকল্প ইতিহাস রচনার পদ্ধতি।
ইতিহাস শব্দটি এতটাই প্রাতিষ্ঠানিক অর্থে ব্যবহৃত হয় যেÑ শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে বেশির ভাগ সময় আমাদের মনে কেবলই অতীতের রাজ-রাজড়াদের কাহিনি ভিড় করে। আমাদের মন তখন ঝিমিয়ে পড়ে আর আমরা ক্লান্ত বোধ করি। এর কারণ আমাদের প্রচলিত ইতিহাস চর্চার শুরু হয়েছিল ইংরেজ শাসন ব্যবস্থা থেকে যেখানে ইতিহাস বিষয়টির সামগ্রীক ব্যাখ্যান অনুপস্থিত। ‘জয় যখন বিজিত দেশের ক্ষমতা কায়েম করার আকাক্সক্ষায় পরিণত হয়, বিজেতাকে ইতিহাস চেতনা ব্যবহার করতে হয় প্রভুসংস্কৃতির একটি উপাদান হিসেবে।’৭ ফলে সেই সব ইতিহাসে ইংরেজ শাসকদের শাসন ব্যবস্থার প্রয়োজনকেই কোনো না কোনো ভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং পরবর্তী কালে এই ধারাবাহিকতায়ই রচিত হয়েছে ভারতবর্ষের ইতিহাস। এই সব ইতিহাসে ঘটনার বর্ণনা আছে, সন-তারিখ উল্লেখ আছে, আছে রাজনৈতিক মতবাদ, সভা, সেমিনার, ভাষণের সংকলন কিন্তু প্রাণ নেই। আর একারণেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আক্ষেপ করে বলেনÑ‘ আজও ভারত বর্ষের একখানি পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচিত হয়নি।’ হয়নি, কারণÑ‘ তা জনপ্রবাহের দিক’ থেকে রচিত হয়নি। এই একই অভিযোগ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রসঙ্গেও উত্থাপন করা যায়।
জাতীয় জীবনে সাধারণ মানুষের ভেতর বা ‘জনপ্রবাহে’র ভেতর ইতিহাস বোধ কিভাবে দানা বেধেছিল, কিভাবে তা জাতীয় ঐক্যে পরিণত হয়েছিল তার হদিস আমরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কতটুকু পাই ? আমাদের পাঠ্যপুস্তকের ইতিহাসে কেবল জাতীয়তাবাদী ঐক্যের কল্পনা কাজ করেছে কিন্তু জনযুদ্ধের সামনে দাঁড়িয়ে সেই ইতিহাস চেতনা যতটুকু বস্তুনিষ্ঠ হয়েছে ততটুক কি সত্যনিষ্ঠ হয়েছে ? কেন সত্যনিষ্ঠ হয়ে উঠছে না ? এর কারণও রবীন্দ্রনাথ বলেছেনÑ‘ জনসমাজের সহিত শিক্ষিত সমাজের নানা প্রকারেই বিচ্ছেদ ঘটাতে জাতির ঐক্যবোধ সত্য হইয়া উঠিতেছে না।’৮ স্যার যদুনাথ সরকার বলেন,‘ … মানব সঙ্ঘের চিত্তের ভাব ও উদ্যম কোন পথে চলিয়াছিল, জাতীয় জীবনে পূর্ব্বপুরুষদের মনোবৃত্তি ও সভ্যতার প্রভাব কতদূর গিয়া দাঁড়ায়, মহাপুরুষ জননেতারা কিরূপে দেশমধ্যে বিপ্লবের সমান পরিবর্তন সংঘটিত করেন, নতুনকে ঝড়ের মত আনিয়া দিয়া প্রতিষ্ঠিত করিয়া দিয়া জাতিকে নবীন পথে প্রচলিত করেন, সেই সব মনস্তÍত্ত্বের কথা কাব্যের তুলিতে ইতিহাসে প্রকাশ করিতে পারিলে তবে সে ইতিহাসগ্রন্থ প্রকৃত ফলবান হইবে, অমর হইয়া থাকিবে Ñ নচেৎ নহে।’৯ তা হলে কী দাঁড়াচ্ছে ? আমাদের ইতিহাসে কি ‘জনপ্রবাহ’ ‘জনসমাজ’ কিংবা ‘মানব-সঙ্ঘ’ যাই বলি না কেন তাদের ‘চিত্তের ভাব বা উদ্যম’ ধরা পরেছে ? পরেনি কারণ তাদের সঙ্গে শিক্ষিত সমাজের ঐতিহাসিকদের দূরত্ব রয়েছে ফলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে জনযুদ্ধ সব সময়ই উপেক্ষিত হয়েছে। এই বক্তব্যে একটা কথা পরিস্কার যে আমরা এখানে দুটি শ্রেণির সন্ধান পাচ্ছি। একটা শ্রেণি ‘জনসমাজ’ আর অপরটি হচ্ছে জনসমাজ বহির্ভূত অপর সমাজ যারা জনসমাজের সঙ্গে সম্পর্ককে স্বীকার করে না, তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ। সাবল্টার্ন স্টাডিজে এদের একটি নি¤œবর্গ অন্যটি উচ্চবর্গ। নি¤œবর্গের ইতিহাস গবেষক রণজিৎ গুহ উচ্চবর্গ বলতে ইংরেজ শাসিত ভারত বর্ষে যারা প্রভুশক্তির অধিকারী ছিলেন তাদেরই বুঝিয়েছেন। এই প্রভুগোষ্ঠীকে তিনি আবার দুই ভাগে ভাগ করেছেনÑ বিদেশি ও দেশি। এদের মধ্যেও দুটি ভাগ ছিলÑ সরকারি ও বেসরকারি। এদের মধ্যে সরকারি ভাবে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের অভারতীয় কর্মচারী ও ভৃত্য সকলে, বেসরকারি অর্থে বিদেশি শিল্পপতি, বণিক, অর্থব্যবসায়ী, খনির মালিক, জমিদার, নীলকুঠি চা-বাগান কফিক্ষেত বা ওই জাতীয় যে সব সম্পত্তি প্লানটেশন প্রণালীতে চাষ করা হয় তার মালিক ও কর্মচারী, খ্রিষ্টান মিশনারি, যাজক, পরিব্রাজক ইত্যাদি। আর দেশি প্রভুগোষ্ঠীরা আঞ্চলিক বা স্থানীয় প্রতিনিধিদের স্বার্থ ও দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী কাজ করে। এরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাবে উচু শ্রেণির এবং এই সঙ্গা অনুযায়ী যারা উচ্চবর্গের মধ্যে পড়ল তাদেরকে সমগ্র জনসংখ্যা থেকে বাদ দিলে যারা থাকে তাদেরকেই রণজিৎ গুহ নি¤œবর্গ বলে চিহ্নিত করেছেন। আমরাও যদি সাবল্টার্নের এই সঙ্গা অনুসরন করি তাহলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে আশ্রয় করে যে জনসমাজকে আবর্তিত হতে দেখব তারা সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারী, কিছু জনপ্রতিনিধি, সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণি যারা মুসলিম লীগের সমর্থক এবং যুদ্ধের সময় শাসকগোষ্ঠীর চিন্তার সমর্থনকারী সম্প্রদায়। এরাই এখানে উচ্চবর্গ। অন্যদিকে এদের বিপরীতে যারা এদের নির্যাতন, শাসন ও শোষণের শিকার, সাধারণ মানুষ, তারাই নি¤œবর্গভুক্ত। এই যে শেষোক্ত শোষিত সমাজ এদের সঙ্গে শাসকগোষ্ঠীর এবং উচ্চবর্গের সম্পর্ক কী ? এই সম্পর্কের কি কোনো সমতা আছে ? সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাবে এরা বৈষম্যের শিকার । এদের চেতনার গড়নও তাই উচ্চবর্গের চেতনার গড়ন থেকে আলাদা। ফলে উচ্চবর্গের অন্তর্গত ইতিহাস চেতনার মধ্যে নি¤œবর্গের মানুষের চেতনার বাস্তবতা উপেক্ষিত হবে এটাই স্বাভাবিক। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যারা ইতিহাস রচনা করেছেন তারা কি এই আদর্শিক দন্দ্ব ও তার পরিনামের কথা মাথায় রেখেছেন ? কেন রাখেননি ? এটাই তো ঐতিহাসিকের কাজ, গবেষকের দায়িত্ব। গবেষক সাংবাদিক মোস্তফা হোসেইন জানানÑ‘ মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর প্রশাসন চলে যায় পাকিস্তানি ভাবাদর্শের কর্মকর্তাদের হাতে। স্বাধীনতা লাভের পরপর রাজনৈতিক সরকারকে ব্য¯ত থাকতে হয় নাগরিক অস্তিত্ব রক্ষায়, এককোটি মানুষের পুনর্বাসন, যোগাযোগসহ অবকাঠামোগত উন্নয়নে। প্রশাসনিক ব্যবস্থা রক্ষায় পাকিস্তানি বংশবদদের ওপর নির্ভর করতে হয় সরকারকে। যারা একাত্তরে পাকিস্তানি সামরিক সরকারকে সহযোগিতা করেছে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সুযোগ থাকার পরও , তারা যুদ্ধ পরবর্তীকালে সাদা কাগজে মুচলেকা দিয়ে নিজ নিজ অবস্থানে বহাল থেকেছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাদের আনুগত্য তাই প্রশ্নবিদ্ধই থেকে যায়।’১০ এ তো গেল উচ্চবর্গের ভাবাদর্শগত দিক। অন্যদিকে সামাজিক ভাবে যদি বিবেচনা করা হয় তা হলে দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী জনযোদ্ধাদের অবস্থান একেবারেই প্রান্তিক পর্যায়ে। অর্থনৈতিকভাবে এবং চিন্তাগত দিক থেকে তাদের অবস্থান ছিল একেবারেই প্রান্তে যেখানে উচ্চবর্গের ইতিহাস রচয়িতার দৃষ্টি কখনওই পড়েনি।।
এদিকে মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধের যে প্রশাসনিক কাঠামো আমরা দেখি সেখানে বাংলাদেশ তথা পূর্বপাকিস্তানকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছে। এই সেক্টরের অধিপতিরা সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে আদর্শিক ভাবে নি¤œবর্গেরই মানুষ ছিলেন। শাসক শোষকের বিপরীতেই ছিল তাদের অবস্থান। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আদর্শিকভাবে এই সামগ্রীক জনগোষ্ঠীর মধ্যেও উচ্চবর্গ ও নি¤œবর্গের ধারনা তৈরি হয়ে যায়। ফলে জনযোদ্ধাদের কেউ বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত হতে পারেননি। তারা সবাই সামরিক ব্যক্তি। জনযোদ্ধারা এখানে উপেক্ষিত। আবার মুক্তিযুদ্ধ শেষে যারা ইতিহাস রচনা করেছেন তারাও যুদ্ধের প্রশাসনিক অবকাঠামোগত দিক থেকেই একে বর্ণনা করেছেন। ফলে ্সামরিক কর্মকর্তা, বিডিআর, পুলিশবাহিনির ভূমিকা ও দলিলপত্র সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের নজর যতটা তিক্ষè ছিল ততটা সাধারন যোদ্ধাদের দিকে ছিল না। ফলে সে সব ইতিহাসে উপেক্ষিত হয়েছে জনযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা। তা ছাড়া এ যাবৎকালে যারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চা করেছেন তাদের একটা বড় অংশই সামরিক কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও বিভিন্ন পেশাজীবীর মানুষ। এদের রচনায় ব্যক্তিগত চিন্তার প্রতিফলন যতটা দেখা যায় ততটা নি¤œবর্গের পরিপ্রেক্ষিতের গভীরতা দেখা যায় না। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে যে উদ্যোগ তা নি¤œবর্গের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট নয়। ঔপনিবেশিক আমলের প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মনীতি ও আদর্শ ভেঙ্গে এদেশে এখনও কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে পারেনি। ফলে একাডেমিক ভাবে রচিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেও নি¤œবর্গের রাজনৈতিক চেতনা ও ইতিহাস চেতনা এক বিশেষ কায়দায় উপেক্ষিত হয়। অথচ ‘ রবীন্দ্রনাথ, অক্ষয়কুমার, যদুনাথÑ এরা সবাই চেয়েছিলেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠিত ও চর্চিত বিষয়গুলির ভিত্তি থাকুক জনজীবনে। ইতিহাস গবেষণার বিষয়টি এর ব্যতিক্রম নয়। জাতীয়তাবাদী চিন্তায় ইতিহাস অনুশীলন ইতিহাসের জনজীবনেরই অংশ।’১১ অথচ সেখানেও জনজীবনের দেখা মেলে না। রবীন্দ্রনাথ এ কথাও বলেন যে, বঃযহড়ষড়মুর বই পড়ে যদি দেখা যায় যে ‘আমাদের ঘরের পাশে যে হাড়ি- ডোম -কৈবর্ত-বাগদী রহিয়াছে তাহার সম্পূর্ণ পরিচয় পাইবার জন্য আমাদের লেশমাত্র ঔৎসুক্য জন্মে না তখনই বুঝিতে পারি, পুঁথি সমন্ধে আমাদের কতবড় একটা কুসংস্কার জন্মিয়া গেছে।…’১২ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ক্ষেত্রেও এই কুসংস্কার তৈরি হয়েছে সেই সব ঐতিহাসিকদের কারণে যারা শাসনদ-কে আশ্রয় করে ইতিহাস চর্চা করছেন। এরা শাসকের সুবিধাভোগী লোক। এদের দৃষ্টিতে জনযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী নি¤œবর্গের মানুষের যে নিজস্ব ইতিহস জ্ঞান আছে, যে সমাজ ভাবনা আছে, রাষ্ট্রভাবনা আছে তা উপেক্ষিত থেকে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের জাতীয়তাবাদী চেতনায় যে ঐক্যের সুর বেজেছিল তা পাঠ্যপুস্তকের ইতিহাসের এক তারে গ্রন্থিত হতে পারেনি। ফলে রবীন্দ্রনাথ যে তার সময়ে ‘ইতিহাস উৎসাহ’ জেগে উঠতে দেখেছিলেন তার প্রভাব এখানে লক্ষ করা যায় না।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সবচেয়ে বেশি রচিত হয়েছে ১৯৯৬ এরপর, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার মধ্য দিয়ে। প্রায় সাড়ে চার হাজারের বেশি গ্রন্থ রচিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে। এর বেশির ভাগই ঐতিহাসিকের গভীর দৃষ্টিভঙ্গীতে রচিত নয়। যে দু একজন সত্যনিষ্ঠ ‘নিরপেক্ষ’ ইতিহাসের কথা ভেবেছেন তারাও জনজীবনকে উপেক্ষা করেছেন। আলোচনায় এনেছেন যুক্তিতর্ক আর ‘বঙ্গবন্ধু’কে মহান করে দেখাবার প্রচেষ্টা। বর্তমানে আওয়ামী গণরাজনীতির চাপে নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকের আরাধ্য বিষয়বস্তু একেবারই সংকুচিত হয়ে গেছে, কখনও কখনও উপেক্ষিত হয়েছে। ফলে ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে উঠেছেন একটি বিশেষ দলের নেতা। সামগ্রীকতাকে পরিহার করে সংকীর্ণ গোষ্ঠীচেতনায় সংকুচিত করে ফেলার এই প্রবনতার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে এক একটি আকবরনামা। অথচ বাংলাদেশে ‘বঙ্গবন্ধু’ বাঙালি জাতীয় ঐক্যের পতীক রূপে প্রতিভাত হন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের ‘গণরাজনীতির চাপে তিনিও হয়ে উঠছেন বিশেষ দলের প্রতীক। এ থেকে মুক্তির উপায় কী ? মুক্তির উপায় জনজীবনের সঙ্গে ঐতিহাসিকের সামাজিক কমিটমেন্ট রক্ষা করা। আমরা যাদের ‘জন’ বলি এরা কারা ? এদের সঙ্গে কেন্দ্রিয় শাসকদের সম্পর্ক কতটুকু ?মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে এদের সম্পর্ক কেমন ছিল ? এই সব প্রশ্নের উত্তর কি আমাদের পাঠ্যবইয়ের চিন্তা ও রচনার সাহায্যে পাওয়া সম্ভব ? পাওয়া সম্ভব নয়, কেননাÑ সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক চেতনা ও তাদের সমাজচেতনার মুখ্য উপাদান এসব রচনায় উপস্থিত নয়। আর তাই ‘ উচ্চবর্গের দৃষ্টিভঙ্গীর বাহন ইতিহাস বিদ্যার সাধ্য নেই যে জাতীয়তাবাদের এই গুরুত্বপূর্ণ দিকটাকে স্বীকার করে কিংবা ব্যাখ্যা করে।’১৩ অথচ বঙ্গবন্ধু জনসাধারনের ঐক্যের প্রতীক আকাক্সক্ষার ফল, যার মধ্য দিয়ে জনসমাজ স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহন করার চেষ্টায় রত হয়েছিল এবং জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে তারা ছিনিয়ে এনেছিল বিজয়। কিন্তু উচ্চবর্গ তাকে আত্মসাৎ করার চেষ্টা করেছে, তাকে চালিয়ে দিচ্ছে বিশেষ একটি গোষ্ঠীর মহানায়ক হিসেবে। তাই এই জাতীয় ইতিহাস হয়ে উঠছে একপেশে ভাবনায় পূর্ণ, নিরানন্দময়, অগভীর, অপ্রশস্ত আর চাটুকারিতায় পূর্ণ কীর্তিগাথা।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এটুকু বলেই সব শেষ হয়ে যায় না যে, ৭ই মার্চের ভাষণ বাঙালিদের বিজয়ের যথাযথ কাল নির্দেশক অবস্থানকে খুঁজে বের করার জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ কিংবা শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের সংকট ও উত্তরণ পন্থার অভিনবত্ব শাশ্বতরূপে চিত্রিত করার চেষ্টাই হবে ঐতিহাসিকের কাজ। কিন্তু এতে করে যে বিষয়টি আড়ালে থেকে যায় তা হলো জনগণের সঙ্গে ‘নায়ক’ মানুষটির পরিবর্তনের মুহূর্তটিকে চিহ্নিত করা, স্থীর করা। আবার সেই মুহূর্তটাও তো কোনো স্থীর সময় নয় বরং নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহের ভিতর দিয়ে অবিরাম পরিবর্তন। এই প্রবাহ যতটা না উপর থেকে নিচের দিকে ধাবমান ছিল তার চেয়ে বেশি নিচ থেকে উপরের দিকে উৎসারিত হয়েছিল ফোয়ারার মত। সেই প্রবাহকে অস্বীকার করা হয় প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাস চর্চায়। এখানে ঐতিহাসিকের দায়িত্ব কেবল নায়কের দিক থেকে ঘটনা সমুহকে বর্ণনা করা। অথচ তার একটি বিশেষ সামাজিক দায়িত্বও ছিল। জনজীবনের সঙ্গে নায়কের অবস্থানের যে স্বাভাবিক ও চিরন্তন ‘ঐক্য’ ও ‘সমগ্রভাবনা’ আছে তার অভেদতত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব সব সময়ই এড়িয়ে গেছেন তারা। কেন এড়িয়ে গেছেন ? কারণ Ñ জনজীবনে রাজনৈতিক নায়কের ইতিহাস কিভাবে প্রতিভাত হয়েছিল তার সন্ধান পাওয়ার চেষ্টা তারা করেননি। আবার মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক রচিত ইতিহাসেও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। যায়নি কারণ, ‘ নি¤œবর্গের রাজনীতির চরিত্র নির্ধারিত হচ্ছে নি¤œবর্গের নিজস্ব চেতনার রূপরেখানুসারে। সেই চেতনা গড়ে উঠেছে অধীনতার অভিজ্ঞতা থেকে।’১৪
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের জনযোদ্ধাগণ যুদ্ধ করেছেন ১১টা সেক্টরের অধীনে। যাদের অধীনে তারা যুদ্ধ করেছেন তারা প্রায় সকলেই সামরিক কর্মকর্তা, তাদের চেয়ে শিক্ষিত, সামরিক বিষয়ে প্রশিক্ষিত অতএব যুদ্ধের প্রসাশনিক বিন্যাসানুযায়ি ক্ষমতাটা চলে যায় উচ্চবর্গেরই হাতে। ফলে পরবর্তী ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধের কীর্তিগাথা ও চেতনার সাক্ষ্য প্রমাণ সংরক্ষিত হয়েছে উচ্চবর্গের দিক থেকে তাদের অধীনে এবং তাদেরকে ঘিরে। বলা বাহুল্য যে, স্বাধীনতার পরে ক্ষমতার কেন্দ্রেও তারাই ছিলেন। এমতাবস্থায় নি¤œবর্গের জনজীবন স্বাভাবিক ভাবেই ইতিহাসে উপেক্ষিত হয়েছে। তাই বলে কি নি¤œবর্গের উপস্থিতি একেবারেই অস্বীকার করা সম্ভব ? সম্ভব নয়। ‘ একমাত্র একটি মুহূর্তেই শাসককুলের মানসপটে নি¤œবর্গ আবির্ভূত হয় স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের অধীকারি হয়ে। সেই মুহুর্তটি হল বিদ্রোহের মুহূর্ত।’১৫ তাই সাবল্টার্ন স্টাডিজের গবেষনায় সবচেয়ে বড় অংশ জুড়ে রয়েছে বিদ্রোহের ইতিহাস, বিশেষত কৃষক বিদ্রোহ। এখানে নি¤œবর্গের চিন্তার স্বরূপটি কেমন ছিল তার কিছুটা হদিস পাওয়া যায়। আর তাই সাবল্টার্ন স্টাডিজের ঐতিহাসিক গণ বিদ্রোহের ইতিহাসগুলির মধ্যে নি¤œবর্গের চেতনার সন্ধান করেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া জনযোদ্ধারাও তো এক বিশেষ চেতনার বশবর্তী হয়ে যুদ্ধে নেমেছিলেন। সেই চেতনার পরিচয়টি পাবার জন্য আমরা কতটা এগিয়ে এসেছি ? উচ্চবর্গের হাতে রচিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ভিতরে কোনো সাবল্টার্ন স্টাডিজের ঐতিহাসিকও ‘নি¤œবর্গের অবস্থান’ সনাক্ত করার জন্য আগ্রহী হননি। অথচ ইতিহাসের কর্মকান্ডের মধ্যে নি¤œবর্গের একটি স্বতন্ত্র ভূমিকা রয়েছে। সাবল্টার্ন স্টাডিজের ঐতিহাসিকের কাজ যদি হয় প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাসের সমালোচনা করা১৬ তাহলেও আমাদের দেশে সেই অর্থে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নি¤œবর্গের ঐতিহাসিকের ভূমিকা চোখে পড়ে না। তবে সাবলটার্ন স্টাডিজের ঐতিহাসিকের কাজ যেখানে প্রচলিত ইতিহাসের মধ্যে নি¤œবর্গের অবস্থান সনাক্ত করা ও ব্যাখ্যা করা সেখানে ‘জনইতিহাসের ’ সঙ্গা সে রকম নয়। আমরা জানি, বিশ্বাস করি, জনজীবনের মধ্যেই ইতিহাসের ঘটনা রয়ে গেছে। তাদের চেতনায় উপস্থিত ঐতিহাসিক ঘটনা, বিপ্লবী নায়কের চরিত্র ও তাদের প্রেষণা সমুহ তাদের ধর্মবিশ্বাস, সমাজ সংস্কৃতি, জীবনাচার, অলৌকিততার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে লোকগান, লোকছড়া, কবিতায় রূপ নিয়েছে। রূপ নিয়েছে মিথ বা জনশ্রুতিতে। সেই সব উপাদানগুলি সংরক্ষণ করা গেলে তার ভেতরে নি¤œবর্গের যে ইতিহাস চেতনা কাজ করেছে তার স্বরূপ উদঘাটন করা সম্ভব হবে। আর তাই আমরা এই সব উপাদানগুলোকে প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসের ছকে ফেলে নি¤œবর্গের চেতনার সন্ধান পেতে চাই।

জনজীবনের মধ্যে ইতিহাসের কোন অংশগুলি কিভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে এবং তাদের ভাবনাকে উজ্জীবিত করেছে তার সন্ধান পেতে আমরা দ্বারস্থ হই লোকগান, লোকছড়া, লোক কবিতা প্রভৃতির কাছে। এই সব উপাদান লোকসংস্কৃতির অংশ বলে গবেষকগণ মনে করতেই পারেন জনইতিহাসও লোকসংষ্কৃতির অংশ। কিন্তু আমরা জনজীবনের সঙ্গে সম্পর্কহীন প্রচলিত ইতিহাসের বিপরীত অবস্থাকেই জনইতিহাস বলতেচাই। রাজ-রাজড়াদের বাইরে যে বিশাল জনতা, যারা যোদ্ধা, ভূক্তভোগী তারাও তো ইতিহাসের অংশ, যারা নিজেদের মধ্যে ইতিহাসের ঘটনা সমুহ বা মূলসূত্রটুকু সযতেœ আত্মস্থ করেন নিজেদের সুখ-দুঃখ-ব্যথা বেদনার সংমিশ্রণে। এই পাঠ কখনই প্রচলিত ইতিহাসবিদের বিবেচ্য নয় বলে তা জনগণের কাছে উম্মোচিত হয় না।
নি¤œবর্গের ইতিহাসবিদগণ নি¤œবর্গের চেতনা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখেছেন যে, তাদের চেতনা স্বতন্ত্র হয়েও পরাধীন, বহুধাবিভক্ত। ফলে তারা কখনওই গোটা সমাজের হয়ে কথা বলতে পারে না। তাই তাদের ইতিহাস চেতনা অসম্পূর্ণ, আংশিক। একারণে ভারতবর্ষের সকল নি¤œবর্গের বিদ্রোহ অসফল হয়েছে। কিন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী নি¤œবর্গের চেতনায় এক ধরনের বিশেষত্ব আছে। আর সেটা হল সমগ্র পূর্ববঙ্গের শোষিত মানুষের সংগঠিত স্বতস্ফুর্ত আন্দোলনের সচেতনতা। এই দিক থেকে ’৭১ এ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীগণ নি¤œবর্গ নন, তারা জনগণ (ঢ়বড়ঢ়ষব)।
আর এই জনগণের ভেতরকার ইতিহাস চেতনাকেই আমরা বলছি জনইতিহাস। এই জনইতিহাসের উপাত্ত পাওয়া যাবে জনগনের স্মৃতিতে সংরক্ষিত লোককবিতায়, লোকছড়ায় ও গানে। সন্দেহ নাই যে সেই সব উপাদানের ভিত্তিতে একটি পূর্ণাঙ্গ এবং বিশুদ্ধ ইতিহাস রচনা সম্ভব নয় কিন্তু আমরা এতে করে একটা বিশেষ সত্যের মুখোমুখি হতে পারব। রবীন্দ্রনাথ এ প্রসঙ্গে বলেন-‘ ঐতিহাসিকের ঘটনার জনশ্রুতি বহুতর লোকের মন হইতে প্রতিফলিত হইয়া আসে এবং সেই ঘটনার বিবরনে সাময়িক লোকের মনের ছাপ পড়িয়া যায় তাহা হইতে ঘটনার বিশুদ্ধ সত্যতা আমরা না পাইতেও পারি কিন্তু তৎসাময়িক অনেক লোকের মনে তাহা কিরূপ প্রতিভাত হইয়াছিল সেটা পাওয়া যাইতে পারে। অতীত সময়ের অবস্থা কেবল ঘটনার দ্বারা নির্ণয় হয় না। লোকের কাছে তাহা কিরূপ ঠেকিয়াছিল সে ও একটা প্রধান দ্রষ্টব্য বিষয়। অতএব ঐতিহাসিক ঘটনার জনশ্রুতিতে বাস্তব ঘটনার সহিত মনব মন মিশ্রিত হইয়া যে পদার্থ উদ্ভুত হয় তাহাই ঐতিহাসিক সত্য। সেই সত্যের বিবরনই মানবের নিকট চিরন্তন কৌতুকাবহ এবং শিক্ষার বিষয়’।১৭ আমরা এই সত্যের বিবরণকেই জনইতিহাসের বিষয় বস্তু রূপে পেতে চাই।
১৯৪৭ সালের পরে বাংলাদেশে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে এবং বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামে অগ্রগামী ছিলেন এদেশের নি¤œবর্গের মানুষÑ ¤িœধ্যবিত্ত কৃষক,শ্রমিক, দিনমজুর। এমন কি এদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির সঙ্গে এদেরই সম্পর্ক ছিল গভীর। এক গবেষণায় দেখা গেছেন ১৯৬৯ এর আগে পূর্ব পাকিস্তানে কৃষিজীবীর সংখ্যা ছিল ৭৬.৯৬%।১৩ আবার দেশের বর্গাচাষী, কৃষিমজুর এবং শিল্পশ্রমিক (যাদের মোট পরিমান প্রায় ৬০ শতাংশ) ছিলেন মোট শ্রম শক্তির সংখ্যা গরিষ্ঠ অংশ।১৮ বাঙালিরা ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানি শাসন শোষনের বিরুদ্ধে ২৮১ বার ধর্মঘটের ডাক দেয়। এই আন্দোলনগুলির মধ্যে শিল্প ও অন্যান্য শ্রমিকদের ডাকা ধর্মঘটের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১০৫ ও ৪২।১৯ এদিকে ছাত্রদের ডাকা ধর্মঘটের সংখ্যা ছিল ১০৬। বলাই বাহুল্য যে এই ছাত্রদের বড় অংশই ছিল গ্রামের কৃষকের সন্তান। একটি সাধারণ সমীক্ষায় দেখা গেছে বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারীদের ৬০ শতাংশ ছিলেন গ্রামের অধিবাসী। সমীক্ষায় দেখা যায় যে, ৮৩ শতাংশের পারিবারিক আয়ের উৎস ছিল আংশিক অথবা পুরোপুরি কৃষি নির্ভর।২০ তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, গ্রামীন কৃষি সমাজই ছিল বাংলার অর্থনীতির প্রাণ। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে এবং উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটিশরা ভারতের জমিসংক্রান্ত নীতি নির্ধারণের কাজে নিজেদের ব্যস্ত রেখেছে।২১ তারা মুঘল আমলের কৃষিব্যবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন সাধন না করে তাদের আদলেই নিজেদের সুবিধা মাফিক জমিদারী প্রথা বহাল রেখে নীতি নির্ধারণ করে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হলে বাঙালিরা মনে করে যে, এখন তাদের সরকার হয়তো ভূমি সংস্কার ও কৃষি উন্নয়নে গুরুত্ব দেবে। কিন্তু ১৯৫১ সালে পাকিস্তান পার্লামেন্টে যে ভূমি সংস্কার বিল পাশ করা হয় তাতে জোতদারদের স¦ার্থ সংরক্ষিত হয়।২২ শাসকদের অসম ভূমি ব্যবস্থাপনা, জমির মালিক ও বর্গা চাষীদের মধ্যে ফসলেরর বন্টন প্রক্রিয়ায় আসমতা, ফসল ফলানোর ওপর নানারকম নিষেধাজ্ঞা জারি, কৃষকের কাছ থেকে বেশি করে ভূমি রাজস্ব আদায়, কর্ডন আইনের মাধ্যমে কৃষিদিনমজুরকে প্রতারনাসহ নানা রকম নিপীড়ন চলতে থাকে। এমতাবস্থায় বাঙলার গ্রামীন সমাজে অস্তিত্বের সংকট দেখা দেয়। খাদ্যাভাবে অনাহার অর্ধাহারে দিন কাটাতে শুরু করে মানুষ। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে বাড়তে থাকে অস্থিরতা। বিক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে গ্রামীন সমাজের মধ্যে। ১৯৫৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন-‘ গু য়ঁবংঃরড়হ রং যিড়ংব সড়হবু বি ধৎব ংঢ়বহফরহম হড়?ি ঞযরং সড়হবু নবষড়হমং ঃড় ঃযব ঢ়ড়ড়ৎ ভধৎসবৎ ড়ভ ঃযরং পড়ঁহঃৎুৃ’২৩ এই বিষয়টিও ততদিনে গ্রামীন কৃষক সমাজের কাছে পরিস্কার হয়ে গেছে। তাই
লোককবি মফিজ উদ্দিন বলেন-
দুইশ বছর গোলামির পর পেয়েচিলাম পাকিস্তান
কেউ হয়েছি নেস্তইনাবুদ কেউ হতেছে অপমান ॥
আজাদী পাইলো চাষী কাগজে আর কলমে
দুনিয়াতে বদনাম তোদের মরিবে এই শরমে ॥
চপ কাটরেট লুচি মাখন কর্তারা খায় দিনরাত
চাষীর ভাগ্যে জুটে নারে পোড়া মরিচ পান্তা ভাত ॥
তোদের ক্ষেতে জন্মে উঠে সোনার দানা সেরা পাট
তোরাই আজ পথের কাঙাল খালি তোদের তোদের হাত ॥
আন্য কলাই যব মুসুরি জন্মে তোদের ক্ষেতে
ছেলে মেয়ে নিয়ে আজ মরিস তোরা ভাতে ॥২৪
যেহেতু পূর্ব পাকিস্তানের বেশির ভাগ মানুষ ছিল কৃষির ওপর নির্ভরশীল তাই পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর সকল ধরনের বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হতেন সরাসরি এই সম্প্রদায়ের মানুষ। আর তাই ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট তাদের ইশতেহারের কারণে কৃষককূলের আস্তাভাজন হয়েছিল। তারা ২১ দফারমধ্যে কৃষকের মুক্তির বিষয়টি উপস্থাপন করতে সক্ষম হন। আর একারণে লোক কবি দেওয়ান ফরিদ উদ্দিন তার কবিতায় বলেন-
‘ মন্ত্রি সভা গঠন করে, ২১ দফা ওয়াদারে
পালন করো একে একে, নইলে হবে পরমাদ ॥
আমাদের এই মিনতি হক-আতা- ভাসানীর প্রতি
নিজ হাতে খুইদো গো নূরুল আমিনের খাদ ॥’২৫
কৃষকের একচেটিয়া সমর্থনের ফলে পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। কিন্তু শেষপর্যন্ত বেনিয়া শাসকদল তাদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেয়। বাঙালির ওপর নির্যাতন নিপীড়নের মাত্রা বাড়তে থাকে। শরীরের তল্লাশী থেকে শুরু করে স্থাবর- অফস্থাবর সম্পত্তি দখল, কৃষকদের ওপর নির্বিচারে পুলিশি গুলিবর্ষণ ইত্যাদি ছিল নিত্যকার ঘটনা।২৬ ১৯৬৯ সালে ৪ জানুয়ারি দৈনিক সংবাদের শিরোনাম-‘ খুলনার পল্লীতে ধান কাটা লইয়া হাঙ্গামায় পুলিশের গুলীবর্ষণে ১২ জন ব্যক্তি আহত।’ অপর শিরোনাম- ‘হাতিরদিয়ায় পুলিশের গুলীর প্রতিবাদে কৃষকদের সংঘবদ্ধ হওয়ার আহ্বান।’ ৯ জানুয়ারির একটি শিরোনাম- ‘ কুষ্টিয়ার আখচাষীরাও সরকারী পীড়নের শিকারে পরিণত হইয়াছে’। ১০ জানুয়ারির একটি শিরোনাম-‘ দিনাজপুর রাজশাহীর লক্ষ লক্ষ আধিয়া চাষী জোতদারদের সামন্তবাদী শোষণে মধ্যযুগীয় ভূমিদাসে পরিণত।’ এর সঙ্গে পাল্লাদিয়ে চলছিল নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল বৃদ্ধির উর্দ্ধোগতি, খাদ্য সংকট যা নিয়ন্ত্রণ ও নিরসনের জন্য সরকারে কোনো বাস্তব উদ্যোগই ছিল না। ১৯৬৯ এর ১৪ জানুয়ারি দৈনিক সংবাদের একটি শিরোনাম-‘ পাবনায় খাদ্য সংকট চূড়ান্ত: চাষীরা জমি বিক্রি করিতেছে।’ ৬ মার্চের শিরোনাম ‘ মাদারীপুর মহকুমায় চরম খাদ্যাভাব: শতকরা ৯০জন লোক অনাহারে দিন কাটাইতেছে।’ ২২ মার্চ একই পত্রিকার শিরোনাম ছিল- ক্ষুধার জ্বালায় মানুষ হন্যে হইয়া ফিরিতেছে: পাবনায় চাউলের মণ ৬০ টাকা। ১৩ ডিসেম্বরের ভয়াবহ শিরোনাম-‘ মাগুরা মহকুমায় আত্মহত্যার হিড়িক: অভাব অনটনই কারণ বলিয়া ধারণা।’ সংবাদপত্রের এই শিরোনাম থেকেই পাকিস্তানি শাসকদের নির্যাতন নিপীড়ন ও অত্যাচারের প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা করা যায়। পূর্ব বাংলার কৃষকদের দুর্দশা আরও চরম আকার ধারণ করছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে। কিন্তু তাতে পশ্চিমা পাকিস্তানি শাসকদের কোনও রকম সহমর্মিতা প্রকাশ পেত না। সংবাদ পত্রে এইসব দুর্যোগের খবর প্রচার পেলেও কর্তৃপক্ষ সে বিষয়ে একেবারেই উদাসীন থাকত। এর ওপর চাষীদের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থাও ছিল ভঙ্গুর। কলেরা বসন্তে হাজার হাজার লোক মারা গেলেও প্রশাসন ছিল এ বিষয়েও নিস্পৃহ। এতে পূর্ব বাংলার কৃষক সমাজ মুসলিম লীগের শাসন ব্যবস্থার প্রতি হতাশ হয়ে পড়ে এবং বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার দাবীতে তারা স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে অংশগ্রহণ করে। ফলে ৭০ এর নির্বচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্রাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী নির্বচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চ লাইট পরিচালনা করে। শুরু হয় বাঙালিদের মুক্তির সংগ্রাম। গবেষনায় দেখা গেছে- ‘প্রায় চার-পঞ্চমাংশ মুক্তিযোদ্ধাই ছিলেন কৃষক পরিবারের সন্তান।’২৭ পশ্চিম পাকিস্তানিদের শাসন শোষন ও অত্যাচারে নিঃস্ব কৃষকেরা ভাগ্যের কাছে নতি স্বীকার না করে, ভবিতব্যের কাছে আত্ম সমার্পন না করে তারা এক এক জন যোদ্ধা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। কেননা পাকিস্তান আমলের কৃষিজ সমাজের অর্থনৈতিক সংকটই তাদের সামগ্রীকভাবে অস্তিত্বের সংকট তৈরি করে যার ফলে তারা বাধ্য হয়েছিল মরণকে তুচ্ছ করে মুক্তির সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই জনমানুষের উপস্থিতি আমরা লক্ষ করি না। তবু তারা নিজেদের মতো করেই ইতিহাসের বয়ান করে নিজেদের ভাষায়। সেখানে তারা তাদের কথা বলে, তাদের নেতার কথা বলে। আর সেটাই হচ্ছে জনইতিহাস, লোক সংস্কৃতির ভেতরকার নির্যাস। এর মধ্যে স্বার্থন্বেষণের চেষ্টা নেই, খ্যাতির মোহ নেই, প্রাপ্তির আকাক্সক্ষা নেই। তাই লোকসংস্কৃতির মধ্যে লুকিয়ে থাকা এই ইতিহাস যদি ছড়িয়ে পড়ে জাতীয় জীবনে, বৃহত্তর সমাজে তাহলে আমরা একটি সামগ্রীক ইতিহাসের ধারণা লাভ করতে সক্ষম হব। নইলে যে ইতিহাসে জনজীবন উপেক্ষিত হয় তার কাছ থেকে আমাদের কিছুই শেখার থাকবে না। আমাদের চেতনার মধ্যে ঐক্যের বন্ধন স্থাপিত হবে না। আমাদের মধ্যে বাঙালি হিসেবে গর্ববোধ করার প্রত্যয় প্রতিষ্ঠিত হবে না। আর তা না হলে আমাদের চিন্তা ভাবনা ক্রমেই অসংহত হয়ে পড়বে, সেই ফাঁকগলে ঢুকে পরবে সাম্প্রদায়িকতার নানা ভেদজ্ঞান।
তথ্যসূত্র:
১. দীপেশ চক্রবর্তী, ইতিহাসের জনজীবন ও অন্যান্য প্রবন্ধ, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা: লি:, ৩য় মুদ্রণ, পৃ: ২৯।
২. পার্থ চট্টপাধ্যায়. ভ’মিকা: নি¤œবর্গের ইতিহাস চর্চার ইতিহাস, নি¤œবর্গের ইতিহাস, প্রাগুক্ত, পৃ: ১২।
৩. প্রাগুক্ত, পৃ: ১২।
৪. প্রাাগুক্ত, পৃ: ১৩।
৫. রবি চক্রবর্তী ও কলিমখান,বঙ্গীয় শব্দার্থ কোষ,ভাষাবিন্যাস, কলকাতা, প্রথমখন্ড, পুনর্মদ্রণ ১৪১৭, পৃ ২৫৮।
৬. ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়,২২ শ্রাবণ,১৩৬২,পৃ:১১৭-১১৮।
৭. রণজিৎ গুহ, নি¤œবর্গের ইতিহাস, নি¤œবর্গের ইতিহাস, সম্পাদনা: গৌতম ভদ্র ও পার্থ চট্টোপাধ্যায়, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা:লি:, ষষ্ঠ মুদ্রণ, পৃ: ২৩।
৮. দীপেশ চক্রবর্তী, প্রাগুক্ত, ৩য় মুদ্রণ, পৃ: ৩৩।
৯. যদুনাথ সরকার, যদুনাথ সরকার রচনা সম্ভার, সম্পাদক: নিখিলিশ গুহ ও রাজনারায়ণ পাল, এম সি সরকার এ- প্রাইভেট লি:, ২য় সংস্করণ২০১২, পৃ:২১।
১০. মোস্তফা হোসেইন, উপেক্ষিত জনযুদ্ধ, বাংলা ট্রিবিউন, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৬।
১১. দীপেশ চক্রবর্তী, প্রাগুক্ত, পৃ: ৩২।
১২. প্রাগুক্ত, পৃ: ৩০।
১৩. প্রাগুক্ত, পৃ: ২৯।
১৪. পার্থ চট্টপাধ্যায়. ভ’মিকা: নি¤œবর্গের ইতিহাস চর্চার ইতিহাস, নি¤œবর্গের ইতিহাস, প্রাগুক্ত,পৃ: ১২।
১৫. প্রাগুক্ত, পৃ: ১২।
১৬. প্রাাগুক্ত, পৃ: ১৩।
১৭. রবি চক্রবর্তী ও কলিমখান,বঙ্গীয় শব্দার্থ কোষ,ভাষাবিন্যাস, কলকাতা, প্রথমখন্ড, পুনর্মদ্রণ ১৪১৭, পৃ ২৫৮।
১৮. ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়,২২ শ্রাবণ,১৩৬২,পৃ:১১৭-১১৮।
১৯. মহিউদ্দিন আলমগীর এবং লড উইক জে. বি বারলেজ, (১৯৭৪); বাংরাদেশ: ন্যাশনাল ইনকামএন্ডএক্সপেন্ডিচার ১৯৪৯-১৯৬৯-৭১, বিআইডিএস, পৃ: ১৭৫-৭৬। উদ্ধৃত, আতিউর রহমান, মুক্তিযুদ্ধ জনযুদ্ধ আর্থ- সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০০৩, পৃ:৪৪।
২০. আতিউর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ:৫০।
২১. প্রাগুক্ত, পৃ:৫১।
২২. প্রাগুক্ত, পৃ: ৫৩।
২৩. গৌতম ভদ্র, মুঘলযুগে কৃষি অর্থনীতি ও কৃখশ বিদ্রোহ, সুবর্ণরেখা, ৫ম সংস্করণ, কলকাতা, ১৪২০, পৃ:২।
২৪. আতিউর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ: ৫৫।
২৫. প্রাগুক্ত,পৃ: ৫৭।
২৬. মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান, বাংলাদেশের ভাট-কবি ও কবিতা, অনিন্দ্য প্রকাশ, ঢাকা- ২০১২,পৃ :২২২, রঞ্জনা বিশ্বাস, লোকসংস্কৃতিতে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ,রোদেরা প্রকাশনী ,ঢাকা, ২০১৭,পৃ:১০৩।
২৭. মুহম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান, প্রাগুক্ত, পৃ: ১৯৬। রঞ্জনা বিশ্বাস, প্রাগুক্ত,পৃ: ৯৪।

বাংলার ধান – বাংলার ব্রত

বিধান বিশ্বাস
পৃথিবীর খাদ্যশষ্য হিসেবে মানুষ যা যা গ্রহণ করে ধান তার মধ্যে বহুল ব্যবহৃত। অর্ধেকের অনেক বেশী লোক খাদ্য হিসেবে ধান তথা চাল ব্যবহার করে। এশিয়ার পূর্ব দেশ গুলো ধান উৎপাদনে অগ্রণী। তার মধ্যে সমগ্র বাংলার প্রথম শষ্যই হলো ধান। বাংলার ধান উৎপাদনের কথা প্রাচীন ও মধ্য যুগের সাহিত্যে উল্লেখ করা হয়েছে।
বাঙালির যা কিছু সংস্কৃতি (Culture) তা সবই প্রায় এই ধান কেন্দ্রিক সভ্যতায় গড়ে উঠেছে। সারা বছরের মাত্র চার মাস বাকী থাকে আর আট মাস জুড়ে ধানের চাষ নিয়েই বাংলার কৃষক ব্যস্ত থাকে। এখন অবশ্য সেই চার মাসেও বোরো বা খরার ধান চাষে ভীষণ ভাবে জড়িত হয়েছে কৃষককুল। কেননা জলের জোগান থাকলে মাঘ ফাল্গুনে রোয়া ধান চৈত্র বৈশাখে উঠে যায় নিরুপদ্রপে। এই প্রথাটি নতুন, এতে করে অনেক প্রচলিত নিয়ম-কানুন, মেলা মহোৎসবের আমূল পরিবর্তণ ঘটে গেছে। তবুও আজ বাঙালির জীবনে যাকিছু অনুষ্ঠান তা নির্ভর ক’রে থাকে ধান সহযোগে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে। অর্থনীতির অনেকটাই ধান উৎপাদন কেন্দ্রিক।
সারা বাংলার ধান চাষকে কেন্দ্র করে বেশকিছু লোক উৎসব পালিত হয়। এই উৎসবের শুরুটা হয় জ্যৈষ্ঠ মাসের রোহিনীর দিন থেকে। এটি পশ্চিম সীমান্ত বাংলার উৎসব। ওই দিন প্রথম বীজতলায় বীজধান ছড়িয়ে পরীক্ষা করা হয় কতদিনে কেমন চারা তৈরী হয়। এগুলো দেখে মূল ধান বোনার কাজ শুরু হয়। বিশেষ নিয়মে তৈরী তালগাছের ডেগোর বাতায় নতুন তৈরী ডোলা, তাতে বীজধান ভরে নিয়ে যাওয়া হয়, তার আগে ডোলার গায়ে পিটুলির গোলার ছোপ দেয়া হয়। ঘরের যেখানে ডোলা রাখা হয় সেখানেও আলপনা দেওয়া হয় মেঝে লেপে। ধূপ দীপ জ্বালিয়ে রাখা হয়। তারপর প্রকাশকারী শুদ্ধ বস্ত্র বা নতুন বস্ত্র পরে ডোলা নিয়ে মাঠে যায়। যাবার সময় সে পিছন ফিরে তাকাবে না। প্রথম বীজ বোনার পর যতদিন ধানের চারা না গজাবে অর্থাৎ বের না হবে, ততদিন আর কোন বীজতলা বা বপনকার্য হবে না। প্রকৃতির খেয়ালকে এভাবেই পরখ করে চাষিরা।
বাঙালির কাছে ধান যে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ তা তার অচরণ আর আচার দেখলে বোঝা যায়। বোঝা যায় আদর করে ধানের নামকরণ দেখে। কোন শষ্যকে যে এতো নামে ডাকা হয় তা বাংলার ধান ছাড়া আর কিছুতে আছে কিনা সন্দেহ। আর কোন শষ্য থেকে এত রকমের উপকরণ হতে পারে তাও অজানা।

“… যেহেতু ধান লক্ষী, গৃহস্থের কল্যাণকারী তাই তাকে নিয়ে প্রকৃতি বিজ্ঞান সম্মত প্রবাদ-প্রবচণের অন্ত নেই। এর পাশাপাশি চলতো লোকায়ত জীবন থেকে উদ্ভুত ছড়া-গান-লোককথা, ব্রত, আলপনা ও ধান মাড়াইয়ের শেষে করাইতে তোলার পর উৎসব।…” -(ভূমিকা- বাংলার ধান ও ধান সংস্কৃতি, সম্পাদক- লীলা চাকী)।
এরকম ব্যপকত্ব আর কোন খাদ্য-শষ্য নিয়ে আছে কি? ধান থেকে উৎপাদিত আতপ চাল, তা গুড়ি ক’রে জলে গুলে ভূমিপরে হাতের আঙ্গুলের সাহায্যে যে চিত্র রচনা করা হয় তা আলপনা। শিলাচিত্রের পর বোধ হয় চিত্র রচনার এটি দ্বিতীয় প্রথা। কেননা মাঝামাঝি আর কোন চিত্রের হদিস পাওয়া যায়নি। আর গুহাচিত্রের ক্ষেত্রে যেমন রেখা ভিত্তিক ছবি আলপনাও তাই।
কৃষি যেমন মানুষের অত্যাশ্চর্য্য আবিস্কার, শিকার জীবন ছেড়ে কৃষি জীবনে প্রবেশের পরই সভ্যতার উন্মেষ ঘটে। কৃষি শষ্য ধান থেকে চাল হয়ে আলপনার আবির্ভাব তাও কম আশ্চর্যের নয়। সেই আলপনা ব্রত বা ধান সংক্রান্ত আচারের সঙ্গী হয়ে যেন জন্মদাত্রীর ঋণ পরিশোধ করছে। যেন গায়ে গায়ে শোধ। আচারের এ রীতিও অভিনব। জ্যৈষ্ঠের বীজ বপণ থেকে অগ্রহায়ণের গোলাজাত করা অবধি নানা অনুষ্ঠান চলতে থাকে। আলপনার এই বিস্ময়কর জগত থেকে শুধুমাত্র ধান কেন্দ্রিক ব্রত, পালা, আচারের নমুনা তুলে ধরা হ’ল। এগুলো সমগ্র বাংলার আচরিত রীতি নীতি থেকে নেওয়া। সব জায়গাতেই রকম ফেরে অনুষ্ঠান গুলো হয়ে থাকে।

ব্রত পার্বণের ভ‚মন্ডলে সারা বছরে প্রধান একটি বিষয় হল চাষ-বাস সংক্রান্ত আচার আর তার আলপনা । বাংলার কৃষির মূল শস্য হল ধান, তাই তাকে জড়িয়ে বেশ কিছু ব্রত পার্বণের সার্থক উপস্থাপনা ঘটে । এখানে দেখা যাবে বীজ ধান সংগ্রহ থেকে চাষের শেষ পর্যায়ে ধান কেটে গোলায় তোলা পর্যন্ত পর্বে পর্বে আলপনার সমাহার । আলপনাও দেওয়া হয় গুড়ি জলে গুলে পিটুলি তৈরি করে ।
১.
চাষির ঘরে বীজধান থাকে মাটির কলসিতে । ঘরের কোণে মাটির বেদির ওপর রাখা হয় কলসি। বেদির চারধার দিয়ে আলপনা দেওয়া হয়, আবার কলসির গায়েও চালের গুড়িতে ন্যাকড়া ডুবিয়ে ছোপ ছোপ করে আলপনা দেওয়া হয় । বীজধানের ভান্ডে লক্ষী বসত, সারা বছর তাকে যতনে রাখতে হয়। কোথাও কোথাও প্রতি বৃহস্পতিবার কলসির চারধারে গোল করে আলপনা দেওয়ার চল আছে। কলসির গায়ে ছোটো থেকে বড়ো করে গোল দাগ দেওয়া হয়, তাতে চালের গোলা গড়িয়ে পড়ে এক অন্য মাত্রা যোগ হয় আলপনায়। এই আলপনাটি সংগ্রহ করা হয়েছে নদিয়ার বগুলা থেকে।
২.
পুণ্যপুকুর হল গ্রামজীবনের জল-স¤পদের আশ্রয় । এটি মূলত পানীয় জলের প্রতীক। পুকুর শুকিয়ে গেলে জীবন অচল হয়। চাষের কাজে ব্যাঘাত ঘটে। খরা যাতে না হয় সেই কারণে বৈশাখ মাস জুড়ে গ্রামে চাষি পরিবারের মেয়ে-বউরা বৃষ্টির কামনায় পুণ্যিপুকুর ব্রত পালন করে। সেই উপলক্ষ্যে নানা সাংকেতিক চিহ্ন দিয়ে আলপনা আঁকা হয়। পুকুর কেটে তার চারধারে আলপনা দেওয়া হয়। এই আলপনাটিতে পুকুরের চারধারে বাঁধানো ঘাট, আর মাঝে আঁকা পদ্মবন। এই আলপনাটি সংগ্রহ করা হয়েছে নদিয়া জেলার শিমুলতলার বাসন্তী দেবীর কাছ থেকে।
৩.
ধানগাছের গর্ভাবস্থায় সাধ দেওয়া হয়। ধানের সুস্থতা কামনায় ওষুধপালা করা হয় নলপুতা (নলপুতা হল নানারকম ঔষধি গাছ কচুপাতায় মুড়ে নলখাগাড়ার মাথায় বেঁধে ধানের খেতে পুঁতে দেওয়া হয়) সংক্রান্তিতে অর্থাৎ আশ্বিন সংক্রান্তিতে । কোথাও এটি গারসি নামেও পরিচিত। এই ঔষধি গাছের আলপনাটি নদিয়া জেলার নিরঞ্জনপুর থেকে সংগ্রহ করা।
৪.
কোজাগরী পূর্ণিমাতে চাষির বাড়িতে ঘটা করে ল²ীপুজো হয়, ওই দিন তার বাড়িতে পুজোর আয়োজন তো থাকেই তার সঙ্গে সারা ঘরদোর লক্ষীর আসন আর উঠোন জুড়ে চলতে থাকে আলপনার ঢেউ। কত রকম লতাপাতা আর ফুলের ঠাটে ভরিয়ে দেওয়া হয়। এর মধ্যে লক্ষীর চরণ ও ধানছড়া গৃহস্থ আঁকবেই। এটি সবচেয়ে শুভচিহ্ন লক্ষীর আগমন ঘোষণায়। বাংলার প্রায় সব অঞ্চলেই এই ঠাটটি প্রচলিত। এখানে তারই নমুনা।
৫.
খেতের ফসল পেকে উঠলে তাকে কেটে ঘরে আনা মানে লক্ষী আনা। চাষি কার্তিক মাসে নির্দিষ্ট দিনে শুদ্ধ কাপড় পরে ধূপ-দীপ-কাস্তে-বস্ত্রখন্ড বা নতুন গামছা নিয়ে মাঠে যায়। জমির এক কোণে ধূপ-দীপ জ্বেলে ধানগাছের গায়ে সিঁদুরের ফোটা দিয়ে প্রণাম করে। পরে কাস্তে দিয়ে আড়াই মুঠ ধান কেটে কাপড়ে বা গামছায় জড়িয়ে মাথায় করে বাড়ি নিয়ে আসে। একে বলে মুঠ আনা। চাষি বাড়িতে এলে গৃহিনী তার পা ধুইয়ে দেন। এই সময় গোরুর গাড়িতে আলপনা দেওয়া হয়। যেহেতু এই গাড়ি বোঝাই হয়েই ধান আসবে বাড়িতে। এই আলপনা সদর থেকে বাড়ির ভিতরে যেখানে ধানের মুঠটি রাখা হবে সেখানে পর্যন্ত দিতে হয়। এই আলপনা দেওয়া হয় বীরভ‚ম জেলার পালশবনি গ্রামে ও অন্যান্য জায়গায়।
৬.
খেতের ধান কেটে এনে কিছুদিন রাখা হয় খামারে। খামার লক্ষীর স্থান। চাষি খামারে উঠলেই আগে প্রণাম করে। যতদিন ধান খামারে থাকে ততদিন চাষিবউ রোজ না হলেও প্রতি বৃহস্পতিবার খামারের সামনে আলপনা দেবেই। নানারকম আলপনা, তাতে পদ্মফুল ও লক্ষীর শ্রীপদ-চিহ্ন একটি বিশেষ বিষয়। আর সব হয় সাংকেতিক চিহ্নের মতো। পশ্চিম মেদিনীপুরের সরডিহা গ্রামে এই আলপনা দেখা যায়। অবশ্য ঝড়খন্ডের মাহাতো স¤প্রদায়ের মধ্যেও এই আলপনা দেখা যায় ।
৭.
খেতের ধান খামারের মলন বা মাড়াই করার আগে খামারপুজো করা হয়। তাতে খামারকাজের সরঞ্জাম এঁকে পুজো করা হয়। মেহীখুটি, তাতে বাধা আড়াই মুঠ ধানের গুছি, গোরু বাঁধার দাওনদড়ি, গোরু, ধামাকুলো ইত্যাদির পাশে আর মলনের ধার বরাবর রেখা আঁকা হয়। এই আলপনাটি সংগ্রহ করা হয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার শিলদা থেকে।
৮.
শষ্যপাত্র: কুটি – কোলা – ডোলা। প্রথমটি কাঁচা মাটির, দ্বিতীয়টি পোড়া মাটির বড় কলসীর আকারে, তৃতীয়টি বাঁশের বাতার মিহি বুননে তৈরী। এতে চাল রাখা হয়। বেশী পরিমান চাল তৈরী করে বা সংগ্রহ করে এগুলিতে সংরক্ষিত করা হয়। কোন কোন সময়ে সম্বৎসরের খাদ্য শষ্যও সংরক্ষিত থাকে। এগুলির গায়ে গোলা নেতা দিয়ে ছোপ ছোপ করে অথবা নানা রকম আলপনা দেওয়া হয়। কুটি বা কোলার ঢাকনা হিসেবে সরা ব্যবহার করা হয়। সরাতেও আলপনা দেওয়া হয়। উপমহাদেশে মেহেরগড়ে আবিস্কৃত সরা আনুমানিক ৭০০০ বছর আগেকার, তার উপর মনক্রম রঙে শিলাচিত্র ঢঙে ছবি আঁকা হয়েছে। এভাবেই হয়তো একদিন শরতের লক্ষী চিত্রর আবির্ভাব ঘটেছে। এ তথ্য হাওড়ার বাগমান বাসিন্দা সূর্যেন্দু শেখর বিশ্বাসের লেখাতে পাওয়া।
৯.
ধান থেকে চাল আর চালকে প্রথম ব্যবহারের দিন হয় নবান্ন অনুষ্ঠান। নবান্ন না করে চাষি নতুন ধানের ভাত খাবে না। অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম দিন তাই নবান্নের দিন। অবশ্য অন্যান্য দিনেও নবান্ন হতে পারে, তবে তিথি মেনে করতে হয়। গৃহস্থ ধানের প্রথম ভাগ ঢেকিতে কুটে চাল বের করে সেই চাল গুড়ি করে পায়েস করে লক্ষীর আসনের সামনে দেয়, আবার গুড়ি দিয়ে আলপনাও দেয়। বাড়ির সদর দরজা থেকে লক্ষীর আসন পর্যন্ত আলপনা দেওয়া হয়। নবান্নের প্রসাদ যেখানে রাখা হয় সেখানে আগে আলপনা দেওয়া হয়, তার ওপরে বসার আসন ও নৈবেদ্যর থালা রাখা হয়। এই নিয়ম মালদহ ও দক্ষিণ দিনাজপুরে দেখেছি। সঙ্গের আলপনাটি তারই নমুনা।
১০.
বার লক্ষী বা উঠান লক্ষী ব্রত। ১লা মাঘ এই অনুষ্ঠান হয়। সকালে উঠান গোবর গোলা দিয়ে লেপে তার উপর এলা মাটি দিয়ে পোচ দেয়া হয় যাতে আলপনা সুন্দর করে দেওয়া যায়। লেপা শুকালে ব্রতী স্নান করে শুদ্ধ কাপড়ে বড় গোল ক’রে আলপনা দেয়, পাশদিয়ে কৃষি সরঞ্জাম আর ব্যবহারিক দ্রব্যর আলপনা দেয়। গোলের মাঝখানে ধামা ভরে ধান এনে ফেলে দেওয়া হয়। দূর থেকে লক্ষীর পা এঁকে দেয় ধানের দিকে মুখ করে। এই লক্ষীর পা দেওয়ার পদ্ধতি অভিনব- হাতের মুঠোর নিচের দিক পিটুলি গোলায় চুবিয়ে ছাপ দেয়া হয়, শেষে আঙ্গুলের সাহায্যে ফোটা দিয়ে পায়ের পাতার আঙ্গুলের ছাপ একটু দেওয়া হয়। এই রকম উদ্ভাবনী ক্ষমতার ধারক কিন্তু মেয়েরাই।
১১.
ধানের গোলা হল লক্ষীগোলা। সংবৎসরের ধান জমা থাকে গোলায়। চাষির বড় ভরসা। যে যত সম্পন্ন চাষি তার তত বড়ো গোলা। আলপনায় গোলা আঁকার পদ্ধতিটি খুব চমৎকার। বিন্দু দিয়ে শুরু করে গোলের আকৃতি ক্রমশ বাড়তে থাকে। তারপর সামনে মইয়ের মতো একটা সিঁড়ি করে। বড়ো গোলা বাঝোতে বড়ো সিঁড়িটির পাশে দুটি ছোটো সিঁড়ি আঁকা হয়; তার ওপরে দুটি গোল গোলা আঁকে। এই আলপনা দেখতে ফুলগাছের মতো। যেন গাছের ডগায় ফুটন্ত ফুল। সারা বছর গোলার সামনে ন্যাতা লেপে আলপনা দেওয়া হয়। তাতে ধানের শিষের চিহ্ন থাকবেই। নদিয়ার নিরঞ্জনপুর থেকে সংগ্রহ করা এই আলপনা।
১২.
লক্ষীব্রতের চালি বা অন্যান্য জায়গায় আলপনাতে প্যাঁচা আঁকা হয়। প্রধান ক্ষেত্র হল ধানের গোলা। নদিয়া, বর্ধমান, বীরভ‚ম জেলার ধানের গোলার গায়ে মাটি লেপে চৌকোনা ক্ষেত্র লেপা হয়। লক্ষীপূজোর সময় তার ওপরে আলপনা আঁকা হয়। তাতে বিশেষ করে প্যাঁচা থাকে। একেক ক্ষেত্রে অঙ্কনক্ষমতা বিশেষে প্যাঁচার গড়ন আলাদা হয়। ডানা উঁচু উড়ন্ত প্যাঁচা শুভচিহ্ন, তাই আলপনায় সেটিই বেশি চোখে পড়ে। লক্ষীর আসনের প্যাঁচা স্থির, উড়ন্ত নয়।
১৩.
কৃষিজীবনের সমাপ্তি-উৎসব হল পৌষপার্বণ। এই সময় গ্রামের প্রতিটি ঘরে ধামা ভরে যায় চালের গুড়িতে। সেই গুড়ি থেকে পিঠে পুলি পায়েস তো হয়ই, আলপনার জন্য রাখা হয় গুড়ি। বাড়ির উঠোন জুড়ে দেওয়া হয় আলপনা। এই আলপনায় আঁকা হয় কৃষির সরঞ্জাম। চাষবাসের যত সরঞ্জাম আছে- লাঙল, নিড়ানি, জোয়াল, কাচি- সবই আঁকা হয়। পৌষপার্বণ হয় পৌষ মাসের সংক্রান্তির দিন। পরদিন বাউনি অর্থাৎ যাত্রাল²ীর পুজো। এইদিন উঠোনের মাঝখানে চাষের যাবতীয় সরঞ্জাম জড়ো করে রেখে তার চারধারে আলপনা দেওয়া হয় ও পুজো করা হয়। এই আলপনাটি নদিয়া জেলার আনন্দনগর থেকে সংগৃহীত ।

লেখক :
বিধান বিশ^াস, লোক গবেষক।
বি.দ্র. : লেখাটি ইতোপূর্বে ভারতের পশ্চিম বাংলায় লীনা চাকী সম্পাদিত ‘বাংলার ধান ও ধান সংস্কৃতি’ ও হৃদয় পত্রিকাসহ ‘প্রবাহ’তে নানা আকারে ছাপা হয়েছে। লেখাটি এখন প্রকাশ পেলো বর্ধিতাকারে।