জয়দেব রোয়াজা
আর্ট কলেজে পড়তে চট্টগ্রাম শহরে এসেছিলাম ১৯৯১ সালে, এর পর প্রেম-বিয়ে-দুই সন্তান, কিভাবে যেন থিতু হয়ে আছি প্রায় তিরিশটি বছর! আমার বেশির ভাগ বন্ধু যখন কোনো ছুটিতে দেশ-বিদেশে ঘুরতে যায়, কিংবা চমৎকার কোনো পর্যটন স্পটে যায়, তখন আমি ছুটি ঝিরি জঙ্গলে! ছেলে-মেয়েদের শিখাই কিভাবে ঝিরির পিছল পাথওে হাঁটতে হয়, কোন বুনো ফল খাওয়া যায়, কোন জংলী গাছের পাতা গায়ে লাগলে চুলকায়, শরীরে জোঁক ধরলে কিভাবে ছাড়াতে হয়, ছোটছোট পাথর উল্টিয়ে কিভাবে তাঁর নিচে লুকিয়ে থাকা চিংড়ি,কাঁকড়া ধরতে হয়, আরো কত কি!
আসলে আমারদের গ্রামের পাশে চঞ্চল গতিতে বয়ে চলা “হাজাতৈসা” ঝিরি এখনো আমার বেঁচে থাকার উৎস! মনে আছে গ্রামে তখন টিউবওয়েল ছিলোনা, এই ঝিরিটাই ছিলো একমাত্র জলের উৎস, সাথে মাছেরও! কিছু স্মৃতি এখনো বেশ স্পষ্ট, মা প্রতিদিন স্নানের সময় ঝটপট কিছু মাছ ধরতো, উনি যখন লুইটি আস্তে আস্তে ঠেলে নিয়ে আসতেন আমার দায়িত্ব ছিল বিপরীত দিক থেকে লাফঝাফ দিয়ে চঞ্চল ছোট মাছগুলোকে তাড়িয়ে নিয়ে আসা! এতে দ্রুত মাছ পাওয়া যেত সত্য কিন্তু আমি বাবার সাথে মাছ ধরতে যাওয়াটা বেশি উপভোগ করতাম, বাবা মাছ ধরতে বের হতো সপ্তায় মাত্র একদিন। সাতসকালে গরম গরম ভাত খেয়ে আমাকে সাথে নিয়ে উনি ঝিরিতে যেতেন, সাথে থাকতো বড়শি। এছাড়া মাছ রাখার পাত্র ছাড়াও আরো অনেক জিনিসপত্র আমাকে বইতে হতো, বিস্কিট, বাগান থেকে কিছু ফল, পলিথিনে মোড়ানো গল্পের বই, মশা তাড়ানোর জন্য পুরানো কাপড় দিয়ে বানানো লম্বা মোটা দড়ি, যার মাথাটা আগুনে পোড়ালে অনেক্ষন ধোঁয়া তৈরী করে। বাঁশের চোঙ্গায় “চুওয়াক” (ঘরে বানানো মদ), এবং আমার সব চেয়ে প্রিয় জিনিস কাঁচের বোতলে স্প্রাইট! হ্যা শুধু মাত্র বাবার সাথে ঝিরিতে মাছ ধরতে গেলেই স্প্রাইট খেতে পেতাম ! আসলে মাছ ধরার চাইতে বাবা সময়টাকে উপভোগ করতে যেতেন, ফলে একটা সময় দেখলাম বাবা মাছ ধরেছে দুইটা আর আমি পাথর উল্টিয়ে কুড়িটা ! এই ভাবেই আমার ঝর্ণায় মাছ ধরার হাতেখড়ি।
বাবা প্রায়ই বড়শি ফেলে গল্পের বই এ মগ্ন থাকতেন, ফলে সময় জ্ঞান ভুলে যেতেন, এদিকে খিদায় আমার অবস্থা কাহিল! ফলে আমি ঝিরির পাশেই আগুন জ্বালিয়ে কিছু মাছ, কাঁকড়া, চিংড়ি পুড়িয়ে খাওয়া শুরু করতাম, ব্যাপারটা বাবারও বেশ পছন্দ হতো ! বকা দেয়ার পরিবর্তে উনি বেশ উৎসাহ দিতেন! এমন কয়েকবার হয়েছে মাছ ঝিড়িতেই খেয়ে শেষ! বাড়িতে তুলে এনেছি কিছু ঢেকিশাক, মাশরুম! মাকে বুঝ দেয়ার জন্য। মূলত আমার রান্না বান্নার হাতে খড়ি এই ঝিরিতে মাছ ধরতে গিয়েই! এর পর শৈশব পেরিয়ে এলো কিশোরকাল, বাবা এর মধ্যে গ্রামের সবাইকে নিয়ে সমবায় পুকুর খনন করে মাছ চাষ শুরু করেছেন, আর আমি তৈরী করলাম তিন বন্ধুর একটা গ্যাং! ধনিত্রিপুরা, চুক্কত্রিপুরা আর আমি। স্কুল বন্ধের দিন আমরা ঘরে খাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছি, গামছায় বেঁধে কিছু চাল, নুন, শিশিতে তেল নিয়ে বের হতাম একেকটা ঝিরিতে, বাঁশের চোঙ্গাতে রান্না হতো মাছ, আর কলাপাতায় ভাত, কলাপাতায় ভাত রান্না অনেকের কাছে কঠিন মনে হতে পারে, তাই লিখে দিচ্ছি, যখন ঝিরিতে মাছ ধরতে নামি তখন থেকেই গামছায় বাঁধা চাল পানিতে ভিজিয়ে রাখি, এর পর মাছ ধরা শেষ হলে মাটিতে একটা গর্ত করে ভিজানো চালগুলো বেশি করে কলাপাতা দিয়ে মুড়িয়ে গর্তে রেখে হালকা পাথর ও মাটি চাপা দিতে হবে, এরপর ঠিক তার উপরে আগুন জ্বালিয়ে বাঁশের চোঙ্গায় মাছ রান্না করতে হবে, সেই উত্তাপে ভাত সেদ্ধ!
একবার হঠাৎ এক ঘটনা ঘটলো যা আমাদের মাছ ধরার পদ্ধতি পাল্টে দিলো! বাবার তিন ব্যাটারি টর্চ পানিতে পরে নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো, ফলে বাবা নুতুন টর্চ কিনেছে, কারণ ঘরে টর্চ ছাড়া অচল! কেরোসিন তেলের খরচ কমানোর জন্য সন্ধ্যায় আমাদের পড়াশুনা শেষ করতে হতো, এরপর আলো জ্বালানো হতোনা, জরুরি প্রয়োজনে টর্চ জ্বালানো হতো। পুরানো টর্চটি খুলে রোদে দিয়ে দিয়ে ব্যাটারি লাগিয়ে দেখলাম দিব্যি জ্বলে! ফলে আমি একটা টর্চের মালিক হলাম। তিন বন্ধু মিলে বাজার থেকে নুতুন ব্যাটারি ও কিনে আনলাম। একবার রাতে উঠানে কাবাডি খেলতে গিয়ে ঘামে একাকার, সিদ্ধান্ত নিলাম তিন বন্ধু মিলে রাতেই ঝিরিতে গিয়ে স্নান করবো, যেহেতু এখন আমাদের পার্সোনাল টর্চ রয়েছে। ঝিরির ঘাটে গিয়ে টর্চের আলোয় দেখি প্রচুর মাছ, কাঁকড়া, চিংড়ি গিজগিজ করছে! খালি হাতেই ধরে ফেললাম প্রায় আধা কেজির মতন। এখন এতো রাতে মাছ খাবো কিভাবে? সাথে আছে শুধু একটা পানি খাওয়ার জগ, চুপিচুপি আবার বাড়ি থেকে ছোট্ট একটি পাতিল আর লবণ মরিচ তেল নিয়ে ঝিরির একটু ভিতরে গেলাম, সেখানে এলাকার সবচেয়ে বড় অশ্বথগাছ, গাছের নিচে বেশ পরিষ্কার। আগুন জ্বালিয়ে শুরু হলো মাছ রান্না, শিককাবাব! এর মধ্যে আমরা তিন বন্ধুর প্রত্যেকের পার্সোনাল টর্চলাইট হয়েছে, কয়েকটা হাঁড়িপাতিল স্থায়ীভাবে গাছে লুকিয়ে রাখতাম, বছর খানেক প্রায় নিয়মিত এই অভিযান চললো। কোন কোন দিন মাছ ধরতে ইচ্ছে হতোনা, সেই দিন গাছে উঠে গল্প করতাম, নিশাচর অনেক প্রাণীকে তখন পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পেয়েছি। এর মধ্যে হঠাৎ এক ঘটনা ঘটলো, দুপুর বেলায় ঝিরিতে একা স্নান করতে গিয়েছিলো গ্রামের এক কিশোরী, আমাদের সেই বড় গাছের নিচে গিয়েই সে কিসের যেন অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেলো, আর ভয়ে সেইখানেই মূর্ছা গেলো! কিছুক্ষন পর এক কাকিমাও স্নান করতে গিয়ে ওকে দেখে, বাড়িতে আনার পর মেয়েটার প্রচন্ড জ্বর। গ্রামের বৈধ্য দেখে বললো, গাছের গোড়ায় পূজা দিতে হবে, গ্রামে এমনিতেই প্রচলিত এই গাছের মধ্যে বহুবছর আগে দুষ্ট এক ভুত ছিলো, বর্তমান বৈদ্যের গুরু আর এক দাদু সেই ভুতকে শূকর বলি দিয়ে তাড়িয়েছিলো।
যাই হোক বৈদ্য সাতটি মুরগি নিয়ে গাছের গোড়ায় উপস্থিত, উপস্থিত গ্রামের অনেকের সাথে আমরাও। মন্ত্র পড়তে পড়তে বৈদ্যও চোখ গেলো আমাদের লুকিয়ে রাখা দুটো কালো ময়লা পাতিলের দিকে, উনি সবাইকে বললেন সাতটি মুরগির মধ্যে একটি জ্যান্তছেড়ে দিতে হবে! সচরাচর পূজার পরে দেবতার জন্য শুধু মাথা আর নাড়ি-ভুঁড়ি রেখে আসা হতো, বাকিটা গ্রামে এনে সবাই মিলে রান্না করে খাওয়া হতো। বৈদ্য জানালো এই দেবতা নিজে রান্না করে খায়, একটা জ্যান্ত প্রাণী না দিলে অসুখ ভালো হবেনা! দেখলাম বেশ বড় মুরগিটা ছেড়ে দেয়া হয়েছে! আমাদেও তিন বন্ধুর একটা গোপন দৃষ্টি বিনিময় হয়ে গেলো! সন্ধ্যায় টর্চ নিয়ে যখন গাছের নিচে গেলাম, যেইটা অনুমান করেছি সেইটাই ঠিক, মুরগিটা পেয়ে গেলাম! মাছের পরিবর্তে মুরগি খাওয়া হলো সেদিন। তবে সুবিধা অসুবিধা দুইটাই হয়েছে এটাতে, প্রায় প্রতি মাসেই একটা দুটা পূজা হতে লাগলো, আমরাও মুরগি পাচ্ছি, কিন্তু প্রাইভেসি থাকছেনা, গ্রামের লোকজন রাতে স্নান করতে আসলে গাছের উপর দূর থেকে টর্চ মারে, মাছের পরিবর্তে আমরাও মুরগির স্বাদ পেয়ে গেছি, পূজা-তুজা না থাকলে আমরাই নিজেদের ঘরের মুরগি চুরি করে নিয়ে আসি! এর মধ্যে আমার ছোট ভায়ের জ্বর, বাবা দেখে ম্যালেরিয়ার ওষুধ খাওয়ার জন্য দিয়ে গেলেন, কিন্তু ছোট ভাই জিব্বায় ওষধ দিয়ে দেখে প্রচন্ড তিতা, ওষুধ না খেয়ে সে লুকিয়ে রেখেছিলো! জ্বও বেড়ে সে প্রলাপ বকতে লাগলো। এর মধ্যে মা বৈধ্যেও কাছে গিয়ে জানলো সেই বড় গাছের দেবতার উদ্দেশ্যে একটা ছাগল বলি দিতে হবে! আর একটা ছাগলের বাচ্চা জ্যান্ত ছেড়ে দিতে হবে! শুনে বাবা খুব রেগে গেলো, বলে রাখি বাবা ভুত প্রেত অপদেবতার বিশ্বাস করতেন না, তিনি সরকারি অফিসে সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসাবে ম্যালেরিয়া রোগের বিশেষ ট্রেনিং প্রাপ্ত ছিলেন। বাবার সন্দেহ হওয়াতে ছোট ভায়ের বালিশের কভারের ভিতরে খুঁজে পেলেন ওষুধ, তিনি তাৎক্ষণিক ইনজেকশন না দিলে তখন যে কি হতো ভাবলেই শিউরে উঠি! এর মধ্যে ছোট ভায়ের অসুখ ছাড়ার পরও বাবার সাথে বৈদ্যেও একটা স্নায়ুযুদ্ধ চলতেই লাগলো গাছে পূজা দেয়া না দেয়া নিয়ে। বাবা আবার আমাদের গ্রামের মন্দিরের সভাপতি, তিনি মীটিংএ সিদ্ধান্ত নিলেন, সেই গাছটি কেটে তার তক্তা দিয়ে মন্দিরের উন্নয়নের কাজ করবেন। এভাবেই গাছটির জীবনও শেষ হলো আর আমাদের আস্তানাও। এখনো ঝিরিতে গেলে আফসোস হয় , হয়তো আমাদের হাড়ি-পাতিল লুকিয়ে রাখার কারণেই গাছটার জীবন দিতে হলো।
ঝিরির একটু বড় সাইজের মাছ ধরা খুব কঠিন কাজ। বিশেষ করে আমাদের ককবরক ভাষায় যাকে “আসুদ” মাছ বলি। ওরা গভীর পানিতে বড় বড় গর্তে থাকে। সেগুলোকে ধরার একমাত্র উপায় গর্তেও মুখে জাল আটকিয়ে একটা একটা লম্বা বাঁশসহ পানিতে ডুব দিয়ে গর্তে অনবরত গুতা দিয়ে বের করা। সেই সময় পানিতে বেশিক্ষন ডুবে থাকার রেকর্ড আমার বেশ ভালোই ছিলো, ফলে একবার ছোট কাকা আমাকে তাদের দলে নিলো! উনাদের সাথে গেলাম বাড়ি থেকে প্রায় দুই মাইল দূরের গোমতী ঝিরিতে, ডিসেম্বর মাস কনকনে ঠান্ডা পানি, দুই-তিনটে ডুব দিয়েই আমি কাহিল! আমি কিছুতেই আর পানিতে নামতে চাইছিলামনা, ছোট কাকা বললেন তুমি একটা ডুব দাও, ঠান্ডা কমানোর ব্যবস্থা আমি করছি। নামলাম আবার পানিতে একটা ডুবে পেলাম মাত্র দুটো মাছ নিয়ে যখন ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে তীরেউঠলাম, দেখি ছোট কাকা আমার জন্য একটা বিড়ি জ্বালিয়ে রেখেছে! বললো টান দাও, শীত লাগবে না! এর আগে ছোটোকাকার ভয়ে বিড়ি-সিগারেট খেতে ঝোপ ঝাড়ে লুকাতাম। বিড়ির সাথে বাঁশের চোঙ্গায় এক পেগ ঘওে বানানো মদও দিলো আমাকে! মুহূর্তেই শরীরচাঙ্গা! আমার মনে আছে, সেদিন প্রায় ছয় কেজির মতন মাছ পেয়েছিলাম যার অর্ধেকের বেশি আমি একাই ধরেছিলাম! এইটা দারুন এক অভিজ্ঞতা বটে, এখনো আমি বন্ধুদেও সাথে মাছ ধরতে ঝিরি-জঙ্গলে গেলে শরীর গরম রাখার কিছু উপকরণ সাথে রাখি!
অষ্টমশ্রেণীতে পড়ার সময় ঝিরির মাছ বিক্রি করে আমরা তিন বন্ধু প্রথম ফুটবল কিনি, সেই স্মৃতি এখনো মনে পরে। প্রায় বছর খানেক আবদার করেও বাবার কাছে ফুটবল কিনার টাকা পাইনি, জাম্বুরা ফল দিয়ে খেলতে আর ভালো লাগতোনা। একদিন ঝিরির ঘাটে হাড়ি-পাতিল ধুইতে গিয়ে দেখলাম বাসি ভাত তরকারি খেতে ছোট ছোট চিংড়ি মাছ রীতিমতো হামলে পড়ছে! মাথায় নুতুন আইডিয়া আসলো পরের দিন সকালে স্কুল ফাঁকি দিলাম, আমার দুই বন্ধুর অবশ্য স্কুলে যাওয়ার ঝামেলা নেই, তারা ক্লাস ফাইভ এর পর আর পড়াশুনা করেনি, আসলে পড়ার সুযোগ পায়নি। তিন বন্ধু মিলে পুরানো মশারির কাপড় দিয়ে চালুনির মতন তিনটা জিনিস বানালাম, আর সাত ফুটের মতন লম্বা বাঁশের তিন ফুটের মতন চার ফালি করে চিরে সেই চালুনির সাথে শক্ত কওে বেঁধে দিলাম। ঠিক মাঝখানে টোপ হিসাবে কিছু বাসি ভাত, তুষ আর উইপোকা দিয়ে একটা মন্ডের মতন জিনিস হালকা আগুনে পুড়ে বেঁধে দিলাম। এবার ঝিরিতে গিয়ে পরীক্ষার পালা, যেখানে জল শান্ত ঠিক সেখানে চালুনি-ফাঁদ বসিয়ে দেখতে লাগলাম কি হয়। যেহেতু ঝিরির জল স্বচ্ছ ফলে সব দেখতে পাচ্ছিলাম। দুই মিনিটেই দেখলাম যে সব চিংড়ি মাছ আগে ধরতে গেলেই চিপা গর্তে লুকাতো তারা বেরিয়ে চালুনির মাঝখানে ভিড় জমাতে লাগলো! প্রায় তিরিশটির মতন দেখার পর আস্তেকওে বাঁশের মাথাটা ধওে চালুনিটা তুললাম। সেই দিন মাছ রাখার কোনো পাত্র নিয়ে যাইনি তাই জংলী পাতায় মুড়িয়ে বাড়িতে আনলাম, বাড়িতে এসেও দেখি চিংড়ি মাছগুলো জ্যান্ত! লাফাচ্ছে! তিন বন্ধু মিলে আলোচনা হলো আমরা যদি পানিসহ মাছগুলো রাখি তাহলে গ্রাম থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরের বাজার পর্যন্তমাছ জীবিত থাকবে। পরের দিন আরো তিনটি চালুনিসহ হাজাতৈসাঝিরির গভীওে গিয়ে মাছ ধরা শুরু করলাম মাত্র দুই ঘন্টার মধ্যেই চার কেজি চিংড়ি মাছ! উত্তেজনায় সেদিন দুপুরের ভাত খাওয়া হয়নি কারোর, কোনো রকমে কাপড় চেন্স করেই মাছ নিয়ে বাজারের দিকে হাঁটা শুরু করলাম আমরা, অর্ধেক পথেই ছোট্ট এক চায়ের দোকানে বিক্রি হলো এক কেজি, ৩০টাকায়, দোকানদার পরামর্শ দিলো এমন চিংড়ি মাছ বাজারে সহজে উঠেনা, বিশেষ কওে জ্যান্ত চিংড়ি, তোমরা কেজি পঞ্চাশ করে বলবে। বাজারে পৌঁছা মাত্রই এক মাছ ব্যবসায়ী সব মাছ কিনে নিলো পঞ্চাশ টাকা দরেই! সেদিন সত্যি সত্যি একটা আসল ফুটবল কিনেছিলাম একশ কুড়িটাকায়, আর তিন বন্ধু খেলাম গরম গরম জিলাপির সাথে পরোটা, এরপরও হাতে ছিল পঁচিশ টাকা, নিজেদেও সেইদিন সবচেয়ে সুখী মনে হয়েছিল। তবে মাছ ধরার এই কৌশল বর্ষাকালে কাজে দেয়নি, কারণ বর্ষায় ঝিরিতে মাছের খাবারের অভাব হয়না, আবার এক এক ঝিরিতে মাছের চরিত্র এক এক রকম, যেসব ঝিরিতে মানুষের পদচারণা কম, মাছগুলো একটু বোকা কিসিমের হয়, আবার যেসব ঝিরিতে প্রতিদিনই মানুষ মাছ ধরে, সেখানকার মাছগুলো সাংঘাতিক চঞ্চল চালাক হয় সহজে ধরা যায় না।
আর্ট কলেজে প্রথম বর্ষ খুব উত্তেজনায় কাটলো, বাড়িতে নিয়মিত যাওয়া হয়নি। আমার গ্রামের দুই বন্ধুর একজন ইতিমধ্যেই বিয়ে করেছেন, আমাদেও মাছ ধরাও বন্ধ। কিন্তু দ্বিতীয় বর্ষে আমার আর শহওে মন টিকেনা। বাড়িতে আসার পর আমার দুই বন্ধুর সাথে দেখা করতে গেলাম, মনে হলো আমাদের আগের মতন বন্ধুত্ব নেই! প্রস্তাব দিলাম চল গুমটি ঝিরিতে মাছ ধরতে যাই! ইা এইটাতে তারা আর অমত করেনি, ইতিমধ্যে তারা মাছ ধরার অনেক পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে, সেইটা আমাকে দেখানোর জন্য তারা উন্মুখ! চুক্কদা জানালো খুব ভোরে রওয়ানা দিতে হবে, কিন্তু এত ভোওে জানা ছিলোনা। ভোর চারটার দিকে ওরা আমাকে জাগিয়ে হাঁটা শুরু করলো। সাথে জাল ছাড়াও হাঁড়ি-পাতিল তেল-নুন চাল, ইদানিং তারা এইভাবেই মাছ ধরতে যায়। সকালে যে মাছ ধরবো সেইটা রান্না-বান্না কনে সকালের নাস্তা হবে এর পর যা ধরবো তা বাড়িতে নিয়ে আসা হবে। যাওয়ার পথেই আমরা খুঁজতে লাগলাম উইপোকার বাসা, পিঁপড়ার বাসা, নাম নাজানা এক ধরণের ছোট ছোট সাদা ফুল। গুমটি ঝিরিতে পৌঁছে একটা গভীর ডংগড় বা গভীর কুয়ার মতন পেলাম এউইপোকার ডিম, পিঁপড়ের ডিম, ও কুচি সাদা ফুলের মিশ্রণ ছিটিয়ে দিলো ধনিদা, আর চুক্কদা ঘাপটি মেরে থাকলো হাতে ছুড়া জাল নিয়ে একেবারে ঝিরির কিনারে, প্রথমে কয়েকটা এরপর একঝাঁক আসুদ মাছ খেতে লাগলো মিশ্রণ, ঠিক সেই মুহুর্ত্তে ছোঁড়া হলো জাল! এক কোপেই সাতটি মাছ ধরা পড়লো! আগে আমরা কনকনে ঠান্ডা পানিতে ডুবে লম্বা বাঁশ দিয়ে গর্তে গুতা মেরে মাছ বের করতাম ভাবলেই বোকা বোকা মনে হলো। যাই হোক এইভাবে তিন স্থানে তিন বার জাল ফেলার পর সকালে খাওয়ার উপযোগী মাছ হয়ে গেলো। দুই বন্ধু ভোরেই ভাত রান্না করে কলাপাতায় মুড়িয়ে এনেছিলো, ওরা মাছ কুটার সময় আমি কিছু ঢেঁকিশাক তুলে আনলাম, সিদ্ধশাক, কয়েকটা পোড়া মাছ দিয়ে মরিচ ভর্ত্তা, আর গরম ঝোলের টাটকা ঝিরির মাছ, অমৃতের মতোই স্বাদ, আমাদের সকালের নাস্তা। সেদিন আমরা প্রায় ছয় কেজির মতন মাছ পেয়েছি, বুদ্ধি খাটিয়ে হালকা পরিশ্রমে! তবে এরপর একটা সমস্যা, সেই সময় পাহাড়ে টেলিফোন কিংবা মোবাইলের নেটওয়ার্ক ছিলোনা, আমি দুই দিনের ছুটিতে বাড়িতে আসলাম কিন্তু বন্ধুরা তাদের পূর্বনির্ধারিত কোনো কাজে ব্যস্ত, ফলে আমার সুযোগ গুলো বৃথা যেতো। এ সমস্যারও দারুন আধুনিক একটা সমাধান করেছিলাম! চট্টগ্রাম বেতারে তখন নিয়মিত পাহাড়ের তিনটি আদিবাসীদের চাকমা, মারমা, ও ত্রিপুরা ভাষায় একঘন্টার আঞ্চলিক ভাষায় অনুষ্ঠান “পাহাড়িকা” প্রচার হতো। খাগড়াছড়ির বিশিষ্ট লেখক, গবেষক, একুশে পদকে ভূষিত শ্রীপ্রভাংশু ত্রিপুরা তখন এই অনুষ্ঠানে মুখ্য প্রযোজক ছিলেন। তিনি আমাকে সপ্তাহে দুই দিন ককবরক ভাষায় সংবাদ পাঠকের কাজ দিয়ে ছিলেন প্রথম বর্ষ থেকেই। এই দিকে চুক্কদা নিয়মিত এই অনুষ্ঠানের শ্রোতা, বিভিন্ন সংবাদ শেষে আবহাওয়া খবরেই আমি জানিয়ে দিতাম পরের সপ্তায় আমি বাড়িতে আসবো কিনা! যেমন, বঙ্গোপসাগওে গভীর একটি নিম্নচাপ তৈরী হয়েছে, সমুদ্রবন্দর সমূহকে চার নম্বর সতর্ক সংকেত দেখতে বলা হয়েছে, এর প্রভাবে এই স্থানে ঝড়ো বাতাসের সাথে বজ্রবৃষ্টি হবে, “আমার পক্ষে বাড়িতে আসা সম্ভব হবেনা!” অথবা, “তবু আমি বাড়িতে আসবো”! আমার রেডিও বার্তা শুনে তারা সেই ভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রাখতো! অর্থাৎ সেই দিন তারা অন্য কারো কাছে দিন মুজুরী করতে যেতো না!
আর্ট কলেজের চতুর্থ বর্ষে কি এক সামান্য কারণে ইয়ার ড্রপ দিলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম আমাদের গ্রামের প্রিয় সেই “হাজাতৈসা” ঝিরিতে আউটডোর পেইন্টিং করবো। সকালে মা টিফিন ক্যারিয়ারে ভাত-তরকারি রান্না করে দিতো। ক্যানভাস, ইজেল, রং নিয়ে সারা দিন চলতো শিল্প সাধনা। একদিন প্রিয় দুই বন্ধু ধনিদা ও চুক্কদাকে আমন্ত্রণ জানালাম আমি কি করি দেখার জন্য। ঝিরির হুবহু সুন্দর ছবি দেখে তারা মুগ্ধ! জীবনে প্রথম তাদের কাছ থেকে শ্রদ্ধাও প্রশংসা পেলাম, কারণ গ্রামীণ প্রতিটি কাজে শারিরীক সামর্থ্যে আমি পিছিয়ে থাকতাম। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত হলো পরের দিন শৈশবের মতন ঝিরিতে মাছ শিকার করে রান্না-বান্না হবে! আমি বললাম আমিতো ছবি আঁকার কাজে ব্যস্ত থাকবো, ওরা বললো কোনো সমস্যা নেই, তারাও সকালের আধাবেলা অন্য কাজে ব্যস্ত থাকবে, মাছ ধরার ফাঁদ আজকেই পেতে রাখা হবে। ধনিদা গেলেন কিছু জংলী কলার গাছ কেটে আনতে, আর চুক্কদা গ্রামে গেলেন কিছু “গড়া” বা পচানো ভাত থেকে তৈরি চুওয়াক। সাধারণত গ্রামের প্রতিটি ঘরে ভাত পচিয়ে বাস্পায়িত করে মদ বানানো হয়, বাস্পায়িত হওয়ার অবশিষ্টাংশ কে ককবরক ভাষায় গড়া বলা হয়। ছবি আঁকতে আঁকতেই দেখলাম ধনিদা কলা গাছগুলো দুই ভাগ করে মাঝখানের অংশটি ফেলে আবার জোড়া দিয়ে শক্ত করে বাঁধলেন, ফলে একটা বড় পাইপের মতন তৈরী হলো একদিকের অংশ বুনোলতা পাতা ঢুকিয়ে বন্ধক রেদিলেন, অপরদিকে ছোটছোট বাঁশের কঞ্চি এমন ভাবে গাঁথলেন মাছ ঢুকতে পারবে কিন্তু বের হতে পারবেনা ! এদিকে চুক্কদা পুরানো কাপড় দিয়ে বাঁধা ছোটছোট গড়ার পুটলি নিয়ে এসে প্রতিটি কলাগাছের ফাঁপা অংশে ঢুকিয়ে গভীর পানিতে চুবিয়ে পাথরচাপা দিয়ে রাখলেন। শুরুতে আমার সন্দেহ ছিল এই ভাবে মাছ পাবো, কিন্তু পরের দিন আসলেই মাছের ভুরি ভোজ হয়েছিল ! মানুষ নিত্য-নুতুন বুদ্ধি বেরকরতে পাওে কিন্তু মাছের পারেনা , এই কারণেই ঝিরির অনেক প্রজাতির মাছ আজ বিলুপ্ত।
তবে এইসব ঘটনা এখন অতীত, আমাদেও গ্রামের সেই হাজাতৈসা ঝিরির আর সেই আগের জৌলস রূপ তেজ নেই। ভিবিন্ন প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে, নব্বইয়ের দশকে পাহাড়ি সব ঝিরি থেকে পাথর তুলে বানানো হয়েছে পাকা রাস্তা, আগে বাজাওে যেতে লাগতো এক-দুই ঘন্টা, এখন টেক্সী চড়ে ১০মিনিট ওলাগেনা। জঙ্গলে বড়গাছ প্রায় নেই, ঝিরির দুই পাশে লাগানো হয়ে ছেদামি সেগুন গাছ, ফলে বর্ষা শেষ হলেই প্রায় পানি শূন্য হচ্ছে ঝিরি।
আমিও এখন নুতন নুতন ঝিরির খোঁজে ঘুরি, নুতন-নুতন বন্ধুর সন্ধান করি, যারা আমার মতোই ঝিরি-ঝর্ণায় ঘুরতে ভালোবাসে, ভালোবাসে এই পাহাড়ি প্রকৃতি। গত কয়েক বছর যার সাথে ঘুরতে যাই সে হলো কংচাইদাদা, ফেসবুকেইপরিচয়, তিনি চাকুরীজিবি আর আমি গৃহস্বামী দুজনের সময় মিলানো খুব মুশকিল, তবু যখনই সুযোগ পাই বেরিয়ে পড়ি। কংচাই দাদার সাথে মজার এক স্মৃতি লিখে শেষ করছি এই লিখা, একবার উনার গ্রামের দিকের এক ঝিরিতে গেলাম, যেখানে চমৎকার সুন্দও একটি ঝর্ণা রয়েছে। যথারীতি যাওয়ার পথেই খালি হাতে বেশ কিছু মাছ ধরলাম আমরা, আর কিছু বুনো শাক। ঝর্ণার কাছাকাছি গিয়ে আগুন জ্বালিয়ে ভাত আর শাক রান্না করলাম, মাছগুলো কুটে একটা পাতার উপর রেখে স্নান করতে গেলাম।
পরিকল্পনা ছিল স্নান শেষে গরম গরম মাছ রান্না করে খাবো। ঘন্টা খানেক স্নান শেষে এসে দেখি অর্ধেকের বেশি মাছ উধাও! এতো নির্জন স্থানে কোনো চোর আসবে? হঠাৎ দেখলাম অদূরে সুন্দর এক বুনো পাখি আমাদের ধরা মাছ খাচ্ছে! না আফসোস কিংবা দুঃখ হয়নি আমাদের, নিজ হাতে ধরা মাছ দিয়ে একটি পাখিকে আপ্যায়ন করতে পেরেছি এই সৌভাগ্য কয়জনেরইবা হয়!
আর আমার সেই শৈশবের দুইবন্ধু, তারা এখনো পাহাড় থেকে পাহাড়ে জুম চাষ করে, চুক্কত্রিপুরার এখন নাতিও আছে, তবে ধনিত্রিপুরা কি এক কারণে বিয়ে করেনি, ভিবিন্ন জনের বাড়িতে কামলা খাটে, যেখানে রাত সেখানেই কাত। তবে এখনো প্রতি ডিসেম্বরের শেষের দিকে শহর ছেড়ে আমি বাড়িতে বেশ কিছু দিনের জন্য যাই, ওদের খুঁজে বেরিয়ে পড়ি অভিযানে!!
লেখক : চিত্রশিল্পী, পরিভ্রাজক
হাপংপাড়া, খাগড়াছড়ি , বাংলাদেশ।