টেপা পুতুল বিষয়ক বই

সাবিহা সুলতানা


সাহিত্য বা শিল্পের দোষ-গুণের আলোচনা হলো সমালোচনা। সহজ করে বললে, সমালোচনা হলো কোন কিছুর দোষ এবং গুণ/ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দিক উভয় আলোচনা করা। যেহেতু লোক উপাদান নিয়ে দীর্ঘদিন নাড়াচাড়া করছি, এমন একটি বই নিয়ে সমালোচনা করতে আনন্দই পাচ্ছি। লেখক হয়তো মনক্ষুন্ন হবেন তবুও প্রথমেই বলে রাখি বইটি অসম্পূর্ণ। কেনো অসম্পূর্ণ তা আলোচনাতেই পরিস্ফুটিত হবে।
প্রথমত : ‘পুতুল:বাংলার প্রাণ প্রতিমা’ বইটির নাম বিষয়বস্তুর সাথে যুক্তিযুক্ত হয়েছে। মো. আফজালুর রহিমের করা প্রচ্ছদ অসাধারণ হয়েছে। বইটি আবহমান মৃৎশিল্পীদের উৎসর্গ করা হয়েছে- যেখানে মৃৎশিল্পীদের প্রতি লেখকের ভালেবাসার প্রকাশ ঘটেছে। এটা লেখক ও শিল্পীকে আরো কাছে টানবে। বইয়ের বাঁধাই,কভার পেজ,কাগজের মান উন্নত,বইয়ের ছাপার অক্ষর একটু বড় হওয়াতে পড়ার সুবিধা হয়েছে। সহজ ও ঝড়ঝড়ে ভাষার ব্যবহার,রঙ্গিন ছবি সব মিলিয়ে বইটি লোভনীয়।
লেখক অন্যদের মতো ঋড়ষশষড়ৎবকে লোকসংস্কৃতি নয়, বহুভাষাবিদ আচার্য্য ড. মুহম্মদ শহীদুল্লার ভূক্তি টেনে ঋড়ষশষড়ৎবকে লোকবিজ্ঞান বলে অবিহিত করার বিষয়টা ভালো লেগেছে। আরো ভালো লেগেছে বইটিতে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন থেকে শুরু করে পরবর্তীতে যারা কাজ করেছেন তাদের ধারাবাহিক নাম দেওয়ার বিষয়টা।
তবে বইটিতে অসংখ্য অসঙ্গতি ও তথ্য ভুল রয়েছে। লেখক যে সব জায়গাতে না গিয়েই কাজটি সম্পন্ন করেছেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় বইটির পরতে পরতে। যেমন, একটা চ্যাপটার আছে ‘জরিপ ব্যাখ্যা’-
ময়মনসিংহ-এখানে কতগুলো পরিবার বর্তমানে মাটি নিয়ে কাজ করছে তার সুস্পষ্ট নির্দেশনা নাই।
কিশোরগঞ্জ-এখানেও মৃৎশিল্পীর পরিবারের সংখ্যা স্পষ্ট না। আবার এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন ৩০টি পরিবার বর্তমানে কাজ করছেন কিন্তু সেখান থেকে কিছুই সংগ্রহ করতে পারেন নি। যা কিনা বাস্তবসম্মত নয়।
নেত্রকোনা- লেখক নিজেই বলছেন,- ‘ আমতলা বাজারে ১০০ বছরের পুরানো মেলা বসে। এমন কিছু নাই যা এই মেলায় পাওয়া যায় না।’ অথচ প্রাথমিক অবস্থায় এই এলাকা থেকে তিনি কিছুই সংগ্রহ করতে পারেন নাই, যা বাস্তবসম্মত নয়।
জামালপুর- মৃৎশিল্পীর পরিবারের সংখ্যাই উল্লেখ নাই।
টাঙ্গাইল- শোভা রানী পালের উঠোনে পৌছে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে রাজশাহীর সুবোধ কুমার পালের। এভাবে অসম্পূর্ণ রয়ে গেলো টাঙ্গাইলের ব্যাখ্যা।
জরিপ শেষে তার একটি ছক চিত্র দিলে, বিষয়টার বিস্তারিত রূপ একনজরে দেখা যেতো।
যদিও টেপা পুতুল বিষয়ক বই,তার পরও কতগুলো পরিবার এখনও চাকা ঘুরিয়ে কাজ করে থাকেন ,তার সংখ্যা উল্লেখ থাকলে অনুসন্ধিৎসু পাঠক আরো বেশি লাভবান হত।
মাটি প্রস্তুতের যে আঁকা চিত্র দেওয়া হলো তার পরিবর্তে মৃৎশিল্পীর মাটি প্রস্তুতের স্থির চিত্র দেওয়া হলে , শিল্পীর বাস্তব রূপ অনুধাবন সহজ হতো।
জেলা মাটি খড়ি রঙ ক্রয়(১বছরে) বিক্রয়(১বছরে)
ময়মনসিংহ ৪০,০০০ ৫,০০০ ২,০০০ ৪৭,০০০ ১,০০,০০০
কিশোরগঞ্জ ৩৫০ ৩,০০০ ——- ৩,৩৫০ ১,৭০,০০০
নেত্রকোনা ৫,০০০ ২০,০০০ ১০,০০০ ৩৫,০০০ ৭৫,০০০
জামালপুর ২,৪০০ ৪,০০০ ৪,০০০ ১০,৪০০ ৪০,৪০০
টাঙ্গাইল ২২,২০০ ১৯,২০০ ——– ৩১,৪০০ ১,১২,৮০০
শেরপুর ১২,০০০ ৩৫,০০০ ——– ৩৭,০০০ ১,০২,০০০
উপরোল্লেখিত ছকে রঙ প্রসঙ্গ বাদই দিলাম,মাটি আর খড়ির আর্থিক যে তারতম্য তা বাস্তবসম্মত নয়। একই বিষয় লক্ষ্যনীয় ক্রয়-বিক্রয়ে ক্ষেত্রেও।
একজন গবেষক বইটি পড়ে পরবর্তী কার্যক্রম শুরু করতে পারবেন না,কারণ তথ্য অসম্পূর্ণ।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের মতো আমরাও চাই, এদেশের মৃৎশিল্পীদের কাজ দেখে বিদেশীরা হতবাক হয়ে যাবে। কিন্তু তারজন্যে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এদেশের মানুষের সিনথেটিক পণ্য ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। এর সাথে দেশীয় কাঁচামালে তৈরি পণ্য ব্যবহারে উদ্ভুদ্ধ করতে হবে। দেশের স্বার্থে প্রয়োজনে বল প্রয়োগ করতে হবে।
বইয়ের শেষের দিকে লেখক সামিনা নাফিজের সঙ্গে তোলা মৃৎশিল্পীদের স্থির চিত্র প্রদর্শণ করলে বিষয়টি হৃদয়গ্রাহী, যুক্তিযুক্ত এবং আরো বেশি আকর্ষণীয় হতো।
সব শেষে শিল্পাচার্যের দেখানো পথে এমন একটি বিষয়ে কাজ করার জন্য লেখক সাধুবাদ পেতেই পারেন।
লেখক : শিক্ষক ও লোকসংস্কৃতির ছাত্র।