শাপলা – ঢেপ- ঢেপের খৈ-শালুক

সাবিহা সুলতানা
আষাঢ়ের আগমনীতে মাঠ-ঘাট নির্মল-নিঘূর জল আবাহনীর গান গায়। শুরু হয় বর্ষা। বর্ষায় পানিতে ডুবে থাকা ফসলী জমি ও হাওড়-বাওড়ে দেখা যায় প্রকৃতি আর জলের উল্লাস নৃত্য। লক লক করে পানির নীচে ও উপরিভাগে জন্ম নেয় নানা জাতের উদ্ভিদ। এর মধ্যে পানির উপরিভাগে যা উপর থেকেই চাক্ষুস হয় এমন জলজ উদ্ভিদের মধ্যে আছে পদ্ম, শাপলা, বিভিন্ন জাতের ঘাস, কচুরিপানাসহ নানা উদ্ভিদ। এর মধ্যে শাক-সবজির আকালী বর্ষায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিল প্রধান এলাকায় শাপলা অন্যতম সবজি।
বর্ষার শুরুতেই ধানী জমি-হাওড়-বাওড়-বিলে শাপলা ও শাপলা জাতীয় জলজ উদ্ভিদ মাথা উচু করে দাড়ায়। মাটির নীচে থাকা শাপলা গাছের কন্দ থেকে বের হয়ে আসা শাপলা, বিস্তীর্ন এলাকা জুওে, পানির উপরিভাগে- ফুটে থাকে।
শাপলা ভাজি :
পানির নীচে মাটি থেকে পানির উপরিভাগ, এর মধ্যবর্তী অংশটুকু ডাটার মতো কেটে রসুন তেলে দিয়ে সেখানে ভেঁজে খাওয়া হয়। এছাড়া শাপলা মাছে তরকারি হিসেবে ও ব্যবহৃত হয়। সারা বর্ষা জুড়ে বিলের শাপলা তুলে গ্রাম বাংলার মানুষ রসনায় তৃপ্ত হয়।
শাপলা ভাজি রান্নার পদ্ধতি :
১। শাপলা (আবরন ছাড়িয়ে ছোট ছোট করে কেটে নিতে হবে) – পাঁচটি
২। রসুন কুচি – ২ কোয়া
৩। তেল – ২ চা চামচ
৪। লবন – পরিমান মত
চুলার আগুনে হাড়ি চড়িয়ে তেল দিতে হবে। তেল গরম হলে রসুন দিয়ে দিতে হবে। রসুন লাল হয়ে গেলে, কাটা শাপলা দিয়ে দিতে হবে। লবন দিয়ে ঢেকে ৫ মিনিট রেখে নেড়ে দিতে হবে। আরো ৫ মিনিট আচে রেখে নামিয়ে নিতে হবে।
হয়ে গেলো শাপলা ভাজি।

ঢেপ :
আষাঢ়-শ্রাবণ পেরিয়ে ভাদ্রে এসে অবশিষ্ট শাপলার ফুল ফুটে ঝড়ে গিয়ে সেখানে একটি ফল হয়। এই শাপলা ফলকে ঢেপ বলে। গ্রামে কৈশোরে ঢেপ একটি উৎকৃষ্ট ফল বা খাদ্য। ঢেপের চামড়া ছিড়ে, কোয়া কোয়া অংশে খাওয়া যায়। ঢেপ সাধারণত শুধু বিচির সমাহার।
এই ঢেপ পেকে ফেটে গেলে সেই বিচিগুলো সংগ্রহ করে শুকিয়ে খৈ ভাজা হয়। এক সময় ঢেপের খৈ ছিলো কিংবদন্তিতুল্য।

ঢেপের খৈ ভাজার পদ্ধতি :
১। চুলায় ঢালাই লোহার কড়াই গরম করতে হবে। (এছারা কড়াইতে বালি দিয়েও করা যায়)
২। গরম কড়াইতে অনবরত নাড়তে হবে।
বিচি গুলো ফুটে ফুটে সাদা হয়ে যাবে।

শালুক :
এবার শালুক। বর্ষায় গ্রামের কিশোর বয়সীরা নৌকা নিয়ে বিলের পানিতে শালুক তুলে। শাপলা গাছে শালুক হয় না। শালুকের গাছগুলো আলাদা। শালুক গাছের পাতা আকৃতিতে ছোট এবং খুবই বাহারী আকারের। প্রথমে বাহারী পাতা খুঁজে বের করা হয়। সেই পাতার ট্রেইল ধরে পানির নীচে নিঃস্বাস নিয়ে গাছের গোড়া খুঁজে বের করা হয়। কাঁদা মাটির নীচে গোড়া থেকে কন্দ বা শালুকটা তুলে আবার ভুস করে পানির উপরে উঠে আসতে হয়। গাছ শুদ্ধ শালুক উপরে তুলে শালুক থেকে পাতাও ডাটি গুলো হাতে মোচর দিয়ে ছিড়ে ফেলে দেয়া হয়। পাওয়া গেলো আস্ত একটা শালুক। এভাবে শালুকে হাড়ি বোঝাই করে তবেই বাড়ি ফিরে কিশোরদল। যার নিঃশ্বাস যত বড় সে তত বেশি শালুক সংগ্রহ করতে পারে।
শলুক সাধারণত পানিতে সিদ্ধ করে উপরের চামড়া ছাড়িয়ে খাওয়া হয়।
এছাড়া কাচা শালুক চামরা ছাড়িয়ে , জুলুপ দিয়ে মুড়ালি তৈরি হয়।

শলুক এর মুড়ালি তৈরির পদ্ধতি :
গোল গোল অথবা লম্বা লম্বা আকারে কেটে রোধে শুকাতে হবে।
হাড়িতে গুড় গরম করে সেখানে শুকানো শালুক গুলো দিয়ে নাড়তে হবে। লাল হয়ে গেলে নামিয়ে নিতে হবে।
এবার গরম থাকতেই, যে যেমন চাই আকার দিয়ে ঠান্ডা হতে দিতে হবে।
হয়ে গেলো জুলুপ শালুক।

লেখক : খাদ্য বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষক।

রাতের অন্ধকারে বলিস্ট দেহ খুঁজে ফেরে অতৃপ্ত লিলিথ

প্রাচীন রাব্বাদের ব্যাখ্যা অনুসারে অ্যাডামের প্রথম স্ত্রী ইভ নয়, অন্য কেউ! উপকথা অনুসারে তার নাম লিলিথ। লিলিথ এক রহস্যময় মানবী তার পাখা ছিল । সে ও অ্যাডাম একই মাটি থেকে সৃষ্টি হয়েছিল বিধায় যৌন মিলনে লিলিথ চেয়েছিল সম-অধিকার। আর সেই বিবাদের কারণেই স্বর্গ ত্যাগ করে লিলিথ। স্বর্গ থেকে বিতাড়িত লিলিথ এখন একা, অতৃপ্ত। রাতের আঁধারে অবিবাহিত ঘুমন্ত ছেলেদের সাথে মিলিত হয়ে যাচ্ছে লিলিথ, শতাব্দীর পর শতাব্দী। অতৃপ্ত লিলিথ নিজের যৌন ক্ষুধা মিটিয়ে যাচ্ছে এভাবেই।
লিলিথ উপাখ্যানের উৎপত্তি হয়েছিল যিশু খ্রিস্টের জন্মের তিন হাজার বছর আগে। প্রাচীন সুমেরীয় রূপকথায়, তাকে বলা হত ‘অন্ধকারের নারী’ বা ডাইনী। লিলিথের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীর একটি খোদাই করা সিরীয় লিপিতে, যেখানে লেখা ছিল, ‘হে অন্ধকারের উড়ন্ত অশুভ আত্মা, দূর হয়ে যা এই মুহূর্তে, হে লিলিথ!’ লিলিথ নামটি একই সাথে বিতর্ক, রহস্যময়তা, আধিপত্যের ইতিহাস, শোষক ও শোষিত শ্রেণির আদিরূপে মিলেমিশে রয়েছে।
এক অর্থে লিলিথই আমাদের আদি-মাতা। যদিও আধিপত্যবাদের করাল হস্তপেক্ষে চিরকালের জন্য সেই ইতিহাস আজ লুপ্তপ্রায়। লিলিথ শব্দের প্রচলিত অর্থ রাত্রি।
লিলিথের অস্তিত্ব নিয়ে চালু রয়েছে একাধিক উপাখ্যান-
ধর্মগ্রন্থ অনুসারে বলা যায়, ইসলাম ও খ্রিস্ট ধর্মে যদিও আদম-হাওয়া কিংবা এডাম-ঈভের কথা বলা হয়েছে কিন্তু এই দুটি ধর্মেরই আদিরূপ হল ইহুদী ধর্ম। সেই ইহুদী ধর্মের ধর্মগ্রন্থ ‘বুক অব জেনেসিসে’ বলা হচ্ছে প্রথম মানবী ইভেরও আগে আরেক নারীর অস্তিত্বের কথা যিনি আদমের মতোই মাটির তৈরি। আদমের পাঁজরের হাড় থেকে প্রস্তুত নয়। নর ও নারীকে একই সাথে সৃষ্টি করার কথা উল্লেখ আছে ইহুদি ধর্মগ্রন্থে।
লিলিথ চরিত্রটি উপাখ্যানে পরিণত হওয়ার পেছনে মূলত যে ঘটনাটি প্রচলিত সেটি পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যবাদী মানসিকতার প্রাথমিক নিদর্শন। বলা হচ্ছে, আদম ও লিলিথের মধ্যে দ্বন্ধের শুরু সঙ্গমের মধ্য দিয়ে। নর-নারীর সম্পর্কের সর্বোৎকৃষ্ট রূপ ভালোবাসা আর সেই ভালোবাসার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশের মধ্য দিয়ে প্রজন্মের উত্তরাধিকার সৃষ্টির পথ তৈরি হয়। কিন্তু নর ও নারীর ভালোবাসাবাসির মধুরতম পর্যায়েও পৃথিবীর প্রথম পুরুষ এগিয়ে থাকতে চান নারীর চাইতে। তিনি সর্বদাই আরোহনে ইচ্ছুক এবং এজন্য তিনি বল প্রয়োগেও পিছ-পা হন না। সৃষ্টির শুরুতেই কেন তার এমন ধারণা হল যে, তিনিই ঝঁনলবপঃ, নারী ঙনলবপঃরাব অথবা তিনি অপঃরাব, নারী চধংংরাব, তা বলা মুশকিল। লিলিথের যুক্তি হল তারা দুজনই যেহেতু একই মৃত্তিকাজাত সৃষ্টি কাজেই আদমের আধিপত্য তিনি মেনে নিতে পারেন না। ফলস্বরূপ লিলিথকে পেতে হয়েছে অবাধ্যতার জন্য বহুমুখী শাস্তি। অনন্তকালের জন্য। সম্ভবত একারণেই পরবর্তী সময়ে ধর্মে নারীর শয্যাগমনের বিষয়টি তিরস্কারের মাধ্যমে প্রায় আইনীরূপ দেয়া হয়েছে। যেমন-
১. যখন কোন স্ত্রীকে তার স্বামী শয্যায় আহ্বান করে এবং সে তা অস্বীকার করে এবং তার জন্য যদি স্বামীটি অসন্তুষ্ট অবস্থায় রাত কাটায়- তাহলে সেই স্ত্রীকে ফেরেশতাগণ যেন প্রভাত পর্যন্ত অভিশাপ দেয়। (তিরমিজি হাদিস)
২. …স্ত্রীগণের মধ্যে যাদের অবাধ্যতার আশঙ্কা কর, তাদের সদুপদেশ দাও, তারপর তাদের শয্যা বর্জন কর এবং তাদের প্রহার কর। (সুরা নিসা : ৩৪ আয়াত)
সৃষ্টির শুরুতেই নারীর ভাগ্যে রচিত হয়েছে অপবাদের ইতিবৃত্ত, ঘৃণা আর কলঙ্ক দিয়ে। তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে সন্তান ও সম্পদের অধিকার থেকে। জন্মের আদি থেকে নারীই ¯্রষ্টা। তবুও তাকে শিশু পালনের জন্য প্রয়োজনীয় মাতৃত্বের বোধ ছাড়া অধিক কোনো অধিকার প্রদান করা হয়নি।
যদি ভাবা হয়, লিলিথ কেন মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল তার নিয়তি, তাহলে পূর্বপাঠে দেখা যাবে লিলিথ সর্বদাই নিঃসঙ্গ। আদমকে শুরু থেকেই এড়ফ বা ¯্রষ্টা সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি এড়ফ-এর আজ্ঞাবহ অনুচর বা ফেরেশতাগণও লিলিথের অবাধ্যতায় তাকে হত্যার হুমকি দেয়। লিলিথ কি তবে বিদ্রোহ করেছিল স্বয়ং ¯্রষ্টার বিরুদ্ধেও? সব তথ্যাদি মিলিয়ে একথা ভাবা বোধ হয় অসঙ্গত নয় যে, লিলিথ কেবলই সৃষ্টির প্রথম নারী নন। তিনিই প্রথম সৃষ্টি। কেননা, নারীই তো সৃষ্টির আধার। ¯্রষ্টার অনুরূপ পার্থিব সংস্করণ। নরই বরং সৃষ্টির সহায়করূপে আর্বিভূত হয়েছে। অথচ সৃষ্টিকর্তার প্রতিরূপকে পরবর্তী সময়ে এতখানি অবনমিত করা হল যে, নারীর কাছে পুরুষকে স্রষ্টার সমতুল্যই করে ফেলা হল প্রায় (আমি যদি সেজদা করিতে হুকুম করিতাম তবে নিশ্চয়ই সকল নারীকে হুকুম করিতাম তাহারা যেন তাহাদের স্বামীকে সেজদা করে)- আবু দাউদ
আজকের বিশ্বে সমাজতাত্ত্বিক বা মনস্তত্ত্ববিদেরা জেন্ডার বৈষম্যের জন্য প্রধানত দায়ী করছেন পুরুষসৃষ্ট সমাজ পারিপার্শ্বকে। অথচ সৃষ্টির আদিতে যখন ধর্ম-সমাজ বা রাষ্ট্রের প্রতিবন্ধকতার সীমানা প্রাচীরগুলো সৃষ্টি হয়নি তখনই তো জেন্ডার বৈষম্য বা আধিপত্যবাদের রাজনীতি শুরু হয়ে গেছে। ঘৃণা-অবজ্ঞা-অপবাদ-বিতাড়নের চক্রে শৃঙ্খলাবদ্ধ নারী চিরকাল। তাই সৃষ্টির আদিতে যৌনজীবন যাপনে আনুগত্যের কোনোরকম শর্তস্থাপন ছাড়াই, বিবাহবন্ধন নামক উদ্বন্ধন রজ্জু আবিষ্কৃত হবার আগেই, অবাধ্যতার ফলস্বরূপ লিলিথের ভাগ্যে জুটেছিল পুরুষ-ধরা কামুক নারীর অপবাদ। শিশু হত্যা ও ভক্ষণকারী এবং কামুক-নারীর জন্য এই দুই অপবাদই যথেষ্ট তার ভাবমূর্তি ধুলোয় মিশিয়ে দেবার জন্য। লিলিথের ঘটনার সঙ্গে যদিও ইসলাম ধর্মে উল্লেখিত শয়তান বা ইবলিশের ঘটনার সাযুজ্য পাওয়া যায় তবু সেখানেও বৈষম্যের দেখা মেলে খুব সহজেই। শয়তান ছিল আগুনের সৃষ্টি। কাজেই মানুষের সাথে সৃষ্টির শুরুতেই বিষয়টি ছিল অসম লড়াই। তাছাড়া শয়তান যখন মানুষকে সেজদা করতে অস্বীকৃতি জানায় তখন শয়তানকে অবাধ্যতার শাস্তিস্বরূপ তাকে অভিশপ্ত আত্মারূপে ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তুু লিলিথের মতো সে কি বয়ে বেড়িয়েছে চিরস্থায়ী অপবাদ? তাকে তো বরং মানুষকে বিপথগামী করবার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। এখানেও শয়তান নররূপে আবির্ভূত বলেই ¯্রষ্টার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে মানব সমাজে পরিপূর্ণভাবে তার ক্ষমতা কায়েমে নিয়োজিত।
বিপরীতে লিলিথ নিজেকে শ্রেষ্ঠ নয়, কেবল সমতার দাবিতেই ধিকৃত, অভিযুক্ত, বিতাড়িত হতে হতে খোদ ধর্ম গ্রন্থের ইতিহাস থেকেই ক্রমে বিলুপ্ত; যদিও তথ্য উপাত্ত বলে লিলিথই আসলে নারীর পূর্বসূরী, আদি-মাতা। আর নারীর জন্য ডাইনী আখ্যায়িত হওয়াটা রীতিমত ঐতিহাসিক ব্যাপার। মজার বিষয় হল, ‘ডাইনি’ শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘উইচ’ (ডরঃপয) এসেছে গ্রীক ‘উইক্কা’ থেকে যার অর্থ বুদ্ধিমান নারী। এইসব বুদ্ধিমান নারীদের বিদ্যাবুদ্ধির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে এক জোট হয়ে পুরুষতন্ত্রের ধারকেরা একের পর এক ফাঁসি দিয়েছে তাদের।
যুক্তরাজ্যের ইতিহাসে বিভিন্ন পর্যায়ে ডাইনীদের বিভিন্ন উপকথা জানা যায়। একটা সময় ছিল যখন যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন স্থানে ডাইনিদের বেশ রমরমা অবস্থা ছিল। সাধারণ মানুষের মাঝেও ডাইনিদের প্রতি এক ধরনের বিশ্বাস কাজ করত। বিশেষত রোগ মুক্তি ও জাদু টোনার কাজে তৎকালীন মানুষ ডাইনিদের শরণাপন্ন হত। কিন্তু মধ্যযুগ পরবর্তী সময়ে গোটা যুক্তরাজ্য থেকেই ধীরে ধীরে ডাইনিদের নিষিদ্ধ করা শুরু হয়। আর এই নিষিদ্ধের খেসারত দিতে হয়েছে কয়েক হাজার ডাইনিকে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। ফাঁসি, আগুনে পুড়িয়ে কিংবা অন্যান্য মধ্যযুগীয় বর্বর কায়দায় অনেক নারীকেই হত্যা করা হয়। ডাইনি বিদ্যার জন্য। এমনো হয়েছে, অনেক সাধারণ নারীকেও সে সময় আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। কোনো কিছু যাচাই না করেই। নারীর শৃঙ্খলিত হবার ইতিহাস তো আজকের নয়। কয়েক হাজার বছরের।
লিলিথের গল্পের পরের অংশে দেখা যায় এডামের মনোবাঞ্ছা পরিপূর্ণ না হওয়াতে সে লিলিথের উপর বলপ্রয়োগ করে। লিলিথ শুরু থেকেই আত্মসচেতন, এটা প্রতিভাত। এডামের কর্তৃত্ব অস্বীকৃতি জানিয়ে লিলিথ আদমকে ছেড়ে পৃথিবীতে চলে আসে। আদম ইশ্বরের কাছে অভিযোগ জানালে লিলিথের কাছে ফেরেশতারা ঈশ্বরের বাণী বহন করে নিয়ে আসে। লিলিথ তখন এক অদ্ভুত কথা বলে যা এই একুশ শতকের অধিকার সচেতন নারীর ভাষ্য বলেই প্রতীয়মান হয়। লিলিথ বলে, আমি জানি, ঈশ্বর আমাকে কেবলি শিশুর প্রতি দুর্বল করবার জন্য সৃষ্টি করেছেন। তাও শুধু শিশুপুত্রের জন্য আটদিন আর কন্যা শিশুর ক্ষেত্রে বারোদিন পর্যন্ত আমার অধিকার বলবৎযোগ্য।
কী বিস্ময়! আজকের আধুনিকতম আদালতেও সাধারণ বিবেচনায় মাকে খুব সহজে সন্তানের কাস্টডি বা হেফাজত দেয়া হয় না। অথচ মাতৃত্বের জয়গানে মুখর জনসমাজ তথা পুরো বিশ্ব। লিলিথ ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে হুমকি দেয়া হয় প্রতিদিন তার একশত সন্তানকে মেরে ফেলার। মনের দুর্বলতাকে ব্ল্যাকমেইল করার অপপ্রয়াস ব্যর্থ হয়। লিলিথ জয় করে নেয় সকল প্রকার দুর্বলতা বা নতি স্বীকারকে। কোনো কিছুর বিনিময়েই সে স্বাধীনতাকে বিসর্জন দেয়নি। যদিও বলছি লিলিথই আমাদের আদিমাতা। কিন্তু বিদ্রোহের এই প্রেক্ষাপটকে মাথায় রাখলে আজ পর্যন্ত কি লিলিথের প্রকৃত উত্তরসূরীর দেখা মিলেছে?
আর তাইতো শুরু হয়ে যায় অপবাদ আর অপপ্রচারের বন্যা। লিলিথ কামুক, লিলিথ শিশু ভক্ষণকারী ডাইনি। সে এক অশুভ আত্মার অধিকারী, রাতজাগা প্যাঁচার রূপে সে ঘুরে বেড়ায়। ব্যাবিলনীয় তালমুদে (শাবাত ৫) এ বলা আছে, কোনো যুবক পুরুষের জন্য রাতের বেলায় ঘরে একা একা ঘুমানো নিষিদ্ধ, কারণ লিলিথ তাকে ছলে বলে গ্রাস করবে। বলা হত, লিলিথ নাকি একলা পুরুষের বীর্যে নিজেকে গর্ভবতী করে আরো শয়তানের জন্ম দেবে।
এ ধরনের কল্পকাহিনীর পর এলো একটু যুক্তিসঙ্গতভাবে লিলিথের গল্পকে ব্যাখ্যার চেষ্টা। ইহুদীদের ‘দ্যা বুক অব জেনেসিসে’ বর্ণিত অনেক জটিলতাকে সাধারণ মানুষের বোধগম্য করার চেষ্টা দেখা যায় মিদ্রাশ সাহিত্য। জেনেসিসের মিদ্রাশ সংস্করণে (জেনেসিস রাব্বাহ) লিলিথকে রূপ দেয়া হয়েছিল অশুভ আত্মা থেকে একটা গ্রহণযোগ্য চরিত্রে। এখানে দাবি করা হয়, ইভেরও আগে আদমের প্রথম স্ত্রী ছিল লিলিথ। জেনেসিসে বর্ণিত দুইটি সৃষ্টিতত্ত্বের উপর ভিত্তি করে এই ব্যাখ্যা দেয়া হয়। জেনেসিস : ১-এ বলা আছে নারী এবং পুরুষ উভয়ই একই সময়ে তৈরি, কিন্তু জেনেসিস : ২-এ বলা আছে, ইভের আগে তৈরি হয় আদম। জেনেসিসের মিদ্রাশ সংস্করণে বলা হয়, আদি সৃষ্টির এই দুই গল্প আসলে ভিন্ন। প্রথম গল্পে আদমের স্ত্রীকে একই সময়ে মাটি দিয়ে তৈরি করা হয় সমানভাবে। কিন্তু কোনো একটা কারণে তাদের সেই বিয়ে টেকেনি। কাজেই সৃষ্টিকর্তা আদমের জন্য আবার তৈরি করলেন দ্বিতীয় স্ত্রী ইভকে।
অর্থাৎ সৃষ্টির শুরুতেই পুরুষের তথাকথিত ‘সহজাত’ বহুগামিতা ও বহুবিবাহ অনুমোদিত।
আধুনিক সময়ে লিলিথ নারী স্বাধীনতার শক্তিশালি প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ব্রুুকলিনে জন্মগ্রহণকারী ম্যানহাটান কলেজের তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক জুডিথ প্লাস্কোর (১৯৪৭) ধর্মতত্ত্বের নারীবাদী ব্যাখ্যা ও দর্শন বিশেষত ঞযব পড়সসরহম ড়ভ ষরষষরঃয গ্রন্থের সারসংক্ষেপ লিলিথ সম্পর্কে নতুন করে ভাববার অবকাশ দেয়। এখানে জুডিথ লিলিথকে দেখিয়েছেন ইভের গোপন সঙ্গী হিসেবে। যার বুদ্ধিতেই ইভ নিষেধাজ্ঞার প্রাচীর ডিঙিয়ে জ্ঞানফল আহরণে প্রবৃত্ত হয়। ইভকে প্ররোচনা দানকারী সাপটি আসলে ছদ্মবেশি লিলিথ। দুর্মূখেরা অবশ্য তাদের এই গোপন সম্পর্ককে ষবংনরধহরংস-এর প্রারম্ভ বলতে পিছপা হন না। কিন্তু যত যাই হোক না কেন, এ ব্যাপারে দ্বিধার অবকাশ নেই যে, জ্ঞানফল আহরণকারী ব্যক্তিটি নারীই বটে। নামই যখন জ্ঞানফল, কেন তা নিন্দার্থে- তা বোধগম্য নয়। পৃথিবীর হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, সাফল্য-সংগ্রামের জীবনের চাইতে স্বর্গের ইন্দ্রিয় নির্ভর অলস জীবন যাপনই পুরুষের কাম্য হয়তো। বেগম রোকেয়া বিষয়টিকে মাথায় রেখে পুরুষতন্ত্রকে শরবিদ্ধ করেছেন এভাবে-
‘রমণী প্রতিভার আদি অধিশ্বরী। ইহা সর্ব্ববাদিসম্মত যে নারীই প্রথমে জ্ঞানফল চয়ন ও ভক্ষণ করিয়াছেন। পরে পুরুষ তাঁহার (উচ্ছিষ্ট!)প্রদত্ত ফলপ্রাপ্ত হইয়াছেন।’(রোকেয়া রচনাবলী/ পৃ:২০৬)
বর্তমান পৃথিবীর দিকে তাকালে লিলিথের অশুভত্বের অপবাদ-আবিষ্ট নির্বাসিত জীবনের প্রতিফলন দেখতে পাই বিশ্বব্যাপী স্বাধীনতাকামী নারীদের ভেতর। লিলিথের মতো আত্মমর্যদাকামী নারীদের একইভাবে সমাজ-বিচ্ছিন্ন করে ফেলার অপপ্রয়াস অব্যাহতভাবে বিদ্যমান। আজো শত-সহ¯্র বছর পরেও দেশে-দেশে নারী তার আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে ব্যাপৃত। আজো সন্তান ও সম্পদের অধিকারের মতো মৌলিক বিষয়গুলোতে সাম্য প্রতিষ্ঠা পায়নি। সবচেয়ে বড় কথা, নারীর সম্মান অথবা অসম্মান এখনো তার কর্মপরিসর বা ব্যক্তিত্বের প্রভাব সঞ্চারণের উপর নির্ভর করে না। আজো সমাজ-পরিপার্শ্বের ক্ষুদ্র গন্ডিতে তুচ্ছাতিতুচ্ছ প্রপঞ্চে ঘুরপাক খাচ্ছে নারীর অবয়ব। স্বেচ্ছা নির্বাসিত মোহমুক্ত লিলিথের আত্মমর্যাদাবোধ তাই আজকের দ্বিধা বিভক্ত, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যহীন নারীবাদী ভাবনার যোগ্য আদর্শিক প্রতিমুর্তি হয়ে উঠতে পারে। তাই ‘লিলিথ’ বিষয়টিতে আরও অধিক গবেষণা, যথার্থ অনুসন্ধান ও পুনঃপাঠ হওয়া জরুরী।

(সংকলিত)

ঝিরিতে মাছ ধরা

জয়দেব রোয়াজা


আর্ট কলেজে পড়তে চট্টগ্রাম শহরে এসেছিলাম ১৯৯১ সালে, এর পর প্রেম-বিয়ে-দুই সন্তান, কিভাবে যেন থিতু হয়ে আছি প্রায় তিরিশটি বছর! আমার বেশির ভাগ বন্ধু যখন কোনো ছুটিতে দেশ-বিদেশে ঘুরতে যায়, কিংবা চমৎকার কোনো পর্যটন স্পটে যায়, তখন আমি ছুটি ঝিরি জঙ্গলে! ছেলে-মেয়েদের শিখাই কিভাবে ঝিরির পিছল পাথওে হাঁটতে হয়, কোন বুনো ফল খাওয়া যায়, কোন জংলী গাছের পাতা গায়ে লাগলে চুলকায়, শরীরে জোঁক ধরলে কিভাবে ছাড়াতে হয়, ছোটছোট পাথর উল্টিয়ে কিভাবে তাঁর নিচে লুকিয়ে থাকা চিংড়ি,কাঁকড়া ধরতে হয়, আরো কত কি!
আসলে আমারদের গ্রামের পাশে চঞ্চল গতিতে বয়ে চলা “হাজাতৈসা” ঝিরি এখনো আমার বেঁচে থাকার উৎস! মনে আছে গ্রামে তখন টিউবওয়েল ছিলোনা, এই ঝিরিটাই ছিলো একমাত্র জলের উৎস, সাথে মাছেরও! কিছু স্মৃতি এখনো বেশ স্পষ্ট, মা প্রতিদিন স্নানের সময় ঝটপট কিছু মাছ ধরতো, উনি যখন লুইটি আস্তে আস্তে ঠেলে নিয়ে আসতেন আমার দায়িত্ব ছিল বিপরীত দিক থেকে লাফঝাফ দিয়ে চঞ্চল ছোট মাছগুলোকে তাড়িয়ে নিয়ে আসা! এতে দ্রুত মাছ পাওয়া যেত সত্য কিন্তু আমি বাবার সাথে মাছ ধরতে যাওয়াটা বেশি উপভোগ করতাম, বাবা মাছ ধরতে বের হতো সপ্তায় মাত্র একদিন। সাতসকালে গরম গরম ভাত খেয়ে আমাকে সাথে নিয়ে উনি ঝিরিতে যেতেন, সাথে থাকতো বড়শি। এছাড়া মাছ রাখার পাত্র ছাড়াও আরো অনেক জিনিসপত্র আমাকে বইতে হতো, বিস্কিট, বাগান থেকে কিছু ফল, পলিথিনে মোড়ানো গল্পের বই, মশা তাড়ানোর জন্য পুরানো কাপড় দিয়ে বানানো লম্বা মোটা দড়ি, যার মাথাটা আগুনে পোড়ালে অনেক্ষন ধোঁয়া তৈরী করে। বাঁশের চোঙ্গায় “চুওয়াক” (ঘরে বানানো মদ), এবং আমার সব চেয়ে প্রিয় জিনিস কাঁচের বোতলে স্প্রাইট! হ্যা শুধু মাত্র বাবার সাথে ঝিরিতে মাছ ধরতে গেলেই স্প্রাইট খেতে পেতাম ! আসলে মাছ ধরার চাইতে বাবা সময়টাকে উপভোগ করতে যেতেন, ফলে একটা সময় দেখলাম বাবা মাছ ধরেছে দুইটা আর আমি পাথর উল্টিয়ে কুড়িটা ! এই ভাবেই আমার ঝর্ণায় মাছ ধরার হাতেখড়ি।
বাবা প্রায়ই বড়শি ফেলে গল্পের বই এ মগ্ন থাকতেন, ফলে সময় জ্ঞান ভুলে যেতেন, এদিকে খিদায় আমার অবস্থা কাহিল! ফলে আমি ঝিরির পাশেই আগুন জ্বালিয়ে কিছু মাছ, কাঁকড়া, চিংড়ি পুড়িয়ে খাওয়া শুরু করতাম, ব্যাপারটা বাবারও বেশ পছন্দ হতো ! বকা দেয়ার পরিবর্তে উনি বেশ উৎসাহ দিতেন! এমন কয়েকবার হয়েছে মাছ ঝিড়িতেই খেয়ে শেষ! বাড়িতে তুলে এনেছি কিছু ঢেকিশাক, মাশরুম! মাকে বুঝ দেয়ার জন্য। মূলত আমার রান্না বান্নার হাতে খড়ি এই ঝিরিতে মাছ ধরতে গিয়েই! এর পর শৈশব পেরিয়ে এলো কিশোরকাল, বাবা এর মধ্যে গ্রামের সবাইকে নিয়ে সমবায় পুকুর খনন করে মাছ চাষ শুরু করেছেন, আর আমি তৈরী করলাম তিন বন্ধুর একটা গ্যাং! ধনিত্রিপুরা, চুক্কত্রিপুরা আর আমি। স্কুল বন্ধের দিন আমরা ঘরে খাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছি, গামছায় বেঁধে কিছু চাল, নুন, শিশিতে তেল নিয়ে বের হতাম একেকটা ঝিরিতে, বাঁশের চোঙ্গাতে রান্না হতো মাছ, আর কলাপাতায় ভাত, কলাপাতায় ভাত রান্না অনেকের কাছে কঠিন মনে হতে পারে, তাই লিখে দিচ্ছি, যখন ঝিরিতে মাছ ধরতে নামি তখন থেকেই গামছায় বাঁধা চাল পানিতে ভিজিয়ে রাখি, এর পর মাছ ধরা শেষ হলে মাটিতে একটা গর্ত করে ভিজানো চালগুলো বেশি করে কলাপাতা দিয়ে মুড়িয়ে গর্তে রেখে হালকা পাথর ও মাটি চাপা দিতে হবে, এরপর ঠিক তার উপরে আগুন জ্বালিয়ে বাঁশের চোঙ্গায় মাছ রান্না করতে হবে, সেই উত্তাপে ভাত সেদ্ধ!
একবার হঠাৎ এক ঘটনা ঘটলো যা আমাদের মাছ ধরার পদ্ধতি পাল্টে দিলো! বাবার তিন ব্যাটারি টর্চ পানিতে পরে নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো, ফলে বাবা নুতুন টর্চ কিনেছে, কারণ ঘরে টর্চ ছাড়া অচল! কেরোসিন তেলের খরচ কমানোর জন্য সন্ধ্যায় আমাদের পড়াশুনা শেষ করতে হতো, এরপর আলো জ্বালানো হতোনা, জরুরি প্রয়োজনে টর্চ জ্বালানো হতো। পুরানো টর্চটি খুলে রোদে দিয়ে দিয়ে ব্যাটারি লাগিয়ে দেখলাম দিব্যি জ্বলে! ফলে আমি একটা টর্চের মালিক হলাম। তিন বন্ধু মিলে বাজার থেকে নুতুন ব্যাটারি ও কিনে আনলাম। একবার রাতে উঠানে কাবাডি খেলতে গিয়ে ঘামে একাকার, সিদ্ধান্ত নিলাম তিন বন্ধু মিলে রাতেই ঝিরিতে গিয়ে স্নান করবো, যেহেতু এখন আমাদের পার্সোনাল টর্চ রয়েছে। ঝিরির ঘাটে গিয়ে টর্চের আলোয় দেখি প্রচুর মাছ, কাঁকড়া, চিংড়ি গিজগিজ করছে! খালি হাতেই ধরে ফেললাম প্রায় আধা কেজির মতন। এখন এতো রাতে মাছ খাবো কিভাবে? সাথে আছে শুধু একটা পানি খাওয়ার জগ, চুপিচুপি আবার বাড়ি থেকে ছোট্ট একটি পাতিল আর লবণ মরিচ তেল নিয়ে ঝিরির একটু ভিতরে গেলাম, সেখানে এলাকার সবচেয়ে বড় অশ্বথগাছ, গাছের নিচে বেশ পরিষ্কার। আগুন জ্বালিয়ে শুরু হলো মাছ রান্না, শিককাবাব! এর মধ্যে আমরা তিন বন্ধুর প্রত্যেকের পার্সোনাল টর্চলাইট হয়েছে, কয়েকটা হাঁড়িপাতিল স্থায়ীভাবে গাছে লুকিয়ে রাখতাম, বছর খানেক প্রায় নিয়মিত এই অভিযান চললো। কোন কোন দিন মাছ ধরতে ইচ্ছে হতোনা, সেই দিন গাছে উঠে গল্প করতাম, নিশাচর অনেক প্রাণীকে তখন পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পেয়েছি। এর মধ্যে হঠাৎ এক ঘটনা ঘটলো, দুপুর বেলায় ঝিরিতে একা স্নান করতে গিয়েছিলো গ্রামের এক কিশোরী, আমাদের সেই বড় গাছের নিচে গিয়েই সে কিসের যেন অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেলো, আর ভয়ে সেইখানেই মূর্ছা গেলো! কিছুক্ষন পর এক কাকিমাও স্নান করতে গিয়ে ওকে দেখে, বাড়িতে আনার পর মেয়েটার প্রচন্ড জ্বর। গ্রামের বৈধ্য দেখে বললো, গাছের গোড়ায় পূজা দিতে হবে, গ্রামে এমনিতেই প্রচলিত এই গাছের মধ্যে বহুবছর আগে দুষ্ট এক ভুত ছিলো, বর্তমান বৈদ্যের গুরু আর এক দাদু সেই ভুতকে শূকর বলি দিয়ে তাড়িয়েছিলো।
যাই হোক বৈদ্য সাতটি মুরগি নিয়ে গাছের গোড়ায় উপস্থিত, উপস্থিত গ্রামের অনেকের সাথে আমরাও। মন্ত্র পড়তে পড়তে বৈদ্যও চোখ গেলো আমাদের লুকিয়ে রাখা দুটো কালো ময়লা পাতিলের দিকে, উনি সবাইকে বললেন সাতটি মুরগির মধ্যে একটি জ্যান্তছেড়ে দিতে হবে! সচরাচর পূজার পরে দেবতার জন্য শুধু মাথা আর নাড়ি-ভুঁড়ি রেখে আসা হতো, বাকিটা গ্রামে এনে সবাই মিলে রান্না করে খাওয়া হতো। বৈদ্য জানালো এই দেবতা নিজে রান্না করে খায়, একটা জ্যান্ত প্রাণী না দিলে অসুখ ভালো হবেনা! দেখলাম বেশ বড় মুরগিটা ছেড়ে দেয়া হয়েছে! আমাদেও তিন বন্ধুর একটা গোপন দৃষ্টি বিনিময় হয়ে গেলো! সন্ধ্যায় টর্চ নিয়ে যখন গাছের নিচে গেলাম, যেইটা অনুমান করেছি সেইটাই ঠিক, মুরগিটা পেয়ে গেলাম! মাছের পরিবর্তে মুরগি খাওয়া হলো সেদিন। তবে সুবিধা অসুবিধা দুইটাই হয়েছে এটাতে, প্রায় প্রতি মাসেই একটা দুটা পূজা হতে লাগলো, আমরাও মুরগি পাচ্ছি, কিন্তু প্রাইভেসি থাকছেনা, গ্রামের লোকজন রাতে স্নান করতে আসলে গাছের উপর দূর থেকে টর্চ মারে, মাছের পরিবর্তে আমরাও মুরগির স্বাদ পেয়ে গেছি, পূজা-তুজা না থাকলে আমরাই নিজেদের ঘরের মুরগি চুরি করে নিয়ে আসি! এর মধ্যে আমার ছোট ভায়ের জ্বর, বাবা দেখে ম্যালেরিয়ার ওষুধ খাওয়ার জন্য দিয়ে গেলেন, কিন্তু ছোট ভাই জিব্বায় ওষধ দিয়ে দেখে প্রচন্ড তিতা, ওষুধ না খেয়ে সে লুকিয়ে রেখেছিলো! জ্বও বেড়ে সে প্রলাপ বকতে লাগলো। এর মধ্যে মা বৈধ্যেও কাছে গিয়ে জানলো সেই বড় গাছের দেবতার উদ্দেশ্যে একটা ছাগল বলি দিতে হবে! আর একটা ছাগলের বাচ্চা জ্যান্ত ছেড়ে দিতে হবে! শুনে বাবা খুব রেগে গেলো, বলে রাখি বাবা ভুত প্রেত অপদেবতার বিশ্বাস করতেন না, তিনি সরকারি অফিসে সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসাবে ম্যালেরিয়া রোগের বিশেষ ট্রেনিং প্রাপ্ত ছিলেন। বাবার সন্দেহ হওয়াতে ছোট ভায়ের বালিশের কভারের ভিতরে খুঁজে পেলেন ওষুধ, তিনি তাৎক্ষণিক ইনজেকশন না দিলে তখন যে কি হতো ভাবলেই শিউরে উঠি! এর মধ্যে ছোট ভায়ের অসুখ ছাড়ার পরও বাবার সাথে বৈদ্যেও একটা স্নায়ুযুদ্ধ চলতেই লাগলো গাছে পূজা দেয়া না দেয়া নিয়ে। বাবা আবার আমাদের গ্রামের মন্দিরের সভাপতি, তিনি মীটিংএ সিদ্ধান্ত নিলেন, সেই গাছটি কেটে তার তক্তা দিয়ে মন্দিরের উন্নয়নের কাজ করবেন। এভাবেই গাছটির জীবনও শেষ হলো আর আমাদের আস্তানাও। এখনো ঝিরিতে গেলে আফসোস হয় , হয়তো আমাদের হাড়ি-পাতিল লুকিয়ে রাখার কারণেই গাছটার জীবন দিতে হলো।
ঝিরির একটু বড় সাইজের মাছ ধরা খুব কঠিন কাজ। বিশেষ করে আমাদের ককবরক ভাষায় যাকে “আসুদ” মাছ বলি। ওরা গভীর পানিতে বড় বড় গর্তে থাকে। সেগুলোকে ধরার একমাত্র উপায় গর্তেও মুখে জাল আটকিয়ে একটা একটা লম্বা বাঁশসহ পানিতে ডুব দিয়ে গর্তে অনবরত গুতা দিয়ে বের করা। সেই সময় পানিতে বেশিক্ষন ডুবে থাকার রেকর্ড আমার বেশ ভালোই ছিলো, ফলে একবার ছোট কাকা আমাকে তাদের দলে নিলো! উনাদের সাথে গেলাম বাড়ি থেকে প্রায় দুই মাইল দূরের গোমতী ঝিরিতে, ডিসেম্বর মাস কনকনে ঠান্ডা পানি, দুই-তিনটে ডুব দিয়েই আমি কাহিল! আমি কিছুতেই আর পানিতে নামতে চাইছিলামনা, ছোট কাকা বললেন তুমি একটা ডুব দাও, ঠান্ডা কমানোর ব্যবস্থা আমি করছি। নামলাম আবার পানিতে একটা ডুবে পেলাম মাত্র দুটো মাছ নিয়ে যখন ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে তীরেউঠলাম, দেখি ছোট কাকা আমার জন্য একটা বিড়ি জ্বালিয়ে রেখেছে! বললো টান দাও, শীত লাগবে না! এর আগে ছোটোকাকার ভয়ে বিড়ি-সিগারেট খেতে ঝোপ ঝাড়ে লুকাতাম। বিড়ির সাথে বাঁশের চোঙ্গায় এক পেগ ঘওে বানানো মদও দিলো আমাকে! মুহূর্তেই শরীরচাঙ্গা! আমার মনে আছে, সেদিন প্রায় ছয় কেজির মতন মাছ পেয়েছিলাম যার অর্ধেকের বেশি আমি একাই ধরেছিলাম! এইটা দারুন এক অভিজ্ঞতা বটে, এখনো আমি বন্ধুদেও সাথে মাছ ধরতে ঝিরি-জঙ্গলে গেলে শরীর গরম রাখার কিছু উপকরণ সাথে রাখি!
অষ্টমশ্রেণীতে পড়ার সময় ঝিরির মাছ বিক্রি করে আমরা তিন বন্ধু প্রথম ফুটবল কিনি, সেই স্মৃতি এখনো মনে পরে। প্রায় বছর খানেক আবদার করেও বাবার কাছে ফুটবল কিনার টাকা পাইনি, জাম্বুরা ফল দিয়ে খেলতে আর ভালো লাগতোনা। একদিন ঝিরির ঘাটে হাড়ি-পাতিল ধুইতে গিয়ে দেখলাম বাসি ভাত তরকারি খেতে ছোট ছোট চিংড়ি মাছ রীতিমতো হামলে পড়ছে! মাথায় নুতুন আইডিয়া আসলো পরের দিন সকালে স্কুল ফাঁকি দিলাম, আমার দুই বন্ধুর অবশ্য স্কুলে যাওয়ার ঝামেলা নেই, তারা ক্লাস ফাইভ এর পর আর পড়াশুনা করেনি, আসলে পড়ার সুযোগ পায়নি। তিন বন্ধু মিলে পুরানো মশারির কাপড় দিয়ে চালুনির মতন তিনটা জিনিস বানালাম, আর সাত ফুটের মতন লম্বা বাঁশের তিন ফুটের মতন চার ফালি করে চিরে সেই চালুনির সাথে শক্ত কওে বেঁধে দিলাম। ঠিক মাঝখানে টোপ হিসাবে কিছু বাসি ভাত, তুষ আর উইপোকা দিয়ে একটা মন্ডের মতন জিনিস হালকা আগুনে পুড়ে বেঁধে দিলাম। এবার ঝিরিতে গিয়ে পরীক্ষার পালা, যেখানে জল শান্ত ঠিক সেখানে চালুনি-ফাঁদ বসিয়ে দেখতে লাগলাম কি হয়। যেহেতু ঝিরির জল স্বচ্ছ ফলে সব দেখতে পাচ্ছিলাম। দুই মিনিটেই দেখলাম যে সব চিংড়ি মাছ আগে ধরতে গেলেই চিপা গর্তে লুকাতো তারা বেরিয়ে চালুনির মাঝখানে ভিড় জমাতে লাগলো! প্রায় তিরিশটির মতন দেখার পর আস্তেকওে বাঁশের মাথাটা ধওে চালুনিটা তুললাম। সেই দিন মাছ রাখার কোনো পাত্র নিয়ে যাইনি তাই জংলী পাতায় মুড়িয়ে বাড়িতে আনলাম, বাড়িতে এসেও দেখি চিংড়ি মাছগুলো জ্যান্ত! লাফাচ্ছে! তিন বন্ধু মিলে আলোচনা হলো আমরা যদি পানিসহ মাছগুলো রাখি তাহলে গ্রাম থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরের বাজার পর্যন্তমাছ জীবিত থাকবে। পরের দিন আরো তিনটি চালুনিসহ হাজাতৈসাঝিরির গভীওে গিয়ে মাছ ধরা শুরু করলাম মাত্র দুই ঘন্টার মধ্যেই চার কেজি চিংড়ি মাছ! উত্তেজনায় সেদিন দুপুরের ভাত খাওয়া হয়নি কারোর, কোনো রকমে কাপড় চেন্স করেই মাছ নিয়ে বাজারের দিকে হাঁটা শুরু করলাম আমরা, অর্ধেক পথেই ছোট্ট এক চায়ের দোকানে বিক্রি হলো এক কেজি, ৩০টাকায়, দোকানদার পরামর্শ দিলো এমন চিংড়ি মাছ বাজারে সহজে উঠেনা, বিশেষ কওে জ্যান্ত চিংড়ি, তোমরা কেজি পঞ্চাশ করে বলবে। বাজারে পৌঁছা মাত্রই এক মাছ ব্যবসায়ী সব মাছ কিনে নিলো পঞ্চাশ টাকা দরেই! সেদিন সত্যি সত্যি একটা আসল ফুটবল কিনেছিলাম একশ কুড়িটাকায়, আর তিন বন্ধু খেলাম গরম গরম জিলাপির সাথে পরোটা, এরপরও হাতে ছিল পঁচিশ টাকা, নিজেদেও সেইদিন সবচেয়ে সুখী মনে হয়েছিল। তবে মাছ ধরার এই কৌশল বর্ষাকালে কাজে দেয়নি, কারণ বর্ষায় ঝিরিতে মাছের খাবারের অভাব হয়না, আবার এক এক ঝিরিতে মাছের চরিত্র এক এক রকম, যেসব ঝিরিতে মানুষের পদচারণা কম, মাছগুলো একটু বোকা কিসিমের হয়, আবার যেসব ঝিরিতে প্রতিদিনই মানুষ মাছ ধরে, সেখানকার মাছগুলো সাংঘাতিক চঞ্চল চালাক হয় সহজে ধরা যায় না।
আর্ট কলেজে প্রথম বর্ষ খুব উত্তেজনায় কাটলো, বাড়িতে নিয়মিত যাওয়া হয়নি। আমার গ্রামের দুই বন্ধুর একজন ইতিমধ্যেই বিয়ে করেছেন, আমাদেও মাছ ধরাও বন্ধ। কিন্তু দ্বিতীয় বর্ষে আমার আর শহওে মন টিকেনা। বাড়িতে আসার পর আমার দুই বন্ধুর সাথে দেখা করতে গেলাম, মনে হলো আমাদের আগের মতন বন্ধুত্ব নেই! প্রস্তাব দিলাম চল গুমটি ঝিরিতে মাছ ধরতে যাই! ইা এইটাতে তারা আর অমত করেনি, ইতিমধ্যে তারা মাছ ধরার অনেক পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে, সেইটা আমাকে দেখানোর জন্য তারা উন্মুখ! চুক্কদা জানালো খুব ভোরে রওয়ানা দিতে হবে, কিন্তু এত ভোওে জানা ছিলোনা। ভোর চারটার দিকে ওরা আমাকে জাগিয়ে হাঁটা শুরু করলো। সাথে জাল ছাড়াও হাঁড়ি-পাতিল তেল-নুন চাল, ইদানিং তারা এইভাবেই মাছ ধরতে যায়। সকালে যে মাছ ধরবো সেইটা রান্না-বান্না কনে সকালের নাস্তা হবে এর পর যা ধরবো তা বাড়িতে নিয়ে আসা হবে। যাওয়ার পথেই আমরা খুঁজতে লাগলাম উইপোকার বাসা, পিঁপড়ার বাসা, নাম নাজানা এক ধরণের ছোট ছোট সাদা ফুল। গুমটি ঝিরিতে পৌঁছে একটা গভীর ডংগড় বা গভীর কুয়ার মতন পেলাম এউইপোকার ডিম, পিঁপড়ের ডিম, ও কুচি সাদা ফুলের মিশ্রণ ছিটিয়ে দিলো ধনিদা, আর চুক্কদা ঘাপটি মেরে থাকলো হাতে ছুড়া জাল নিয়ে একেবারে ঝিরির কিনারে, প্রথমে কয়েকটা এরপর একঝাঁক আসুদ মাছ খেতে লাগলো মিশ্রণ, ঠিক সেই মুহুর্ত্তে ছোঁড়া হলো জাল! এক কোপেই সাতটি মাছ ধরা পড়লো! আগে আমরা কনকনে ঠান্ডা পানিতে ডুবে লম্বা বাঁশ দিয়ে গর্তে গুতা মেরে মাছ বের করতাম ভাবলেই বোকা বোকা মনে হলো। যাই হোক এইভাবে তিন স্থানে তিন বার জাল ফেলার পর সকালে খাওয়ার উপযোগী মাছ হয়ে গেলো। দুই বন্ধু ভোরেই ভাত রান্না করে কলাপাতায় মুড়িয়ে এনেছিলো, ওরা মাছ কুটার সময় আমি কিছু ঢেঁকিশাক তুলে আনলাম, সিদ্ধশাক, কয়েকটা পোড়া মাছ দিয়ে মরিচ ভর্ত্তা, আর গরম ঝোলের টাটকা ঝিরির মাছ, অমৃতের মতোই স্বাদ, আমাদের সকালের নাস্তা। সেদিন আমরা প্রায় ছয় কেজির মতন মাছ পেয়েছি, বুদ্ধি খাটিয়ে হালকা পরিশ্রমে! তবে এরপর একটা সমস্যা, সেই সময় পাহাড়ে টেলিফোন কিংবা মোবাইলের নেটওয়ার্ক ছিলোনা, আমি দুই দিনের ছুটিতে বাড়িতে আসলাম কিন্তু বন্ধুরা তাদের পূর্বনির্ধারিত কোনো কাজে ব্যস্ত, ফলে আমার সুযোগ গুলো বৃথা যেতো। এ সমস্যারও দারুন আধুনিক একটা সমাধান করেছিলাম! চট্টগ্রাম বেতারে তখন নিয়মিত পাহাড়ের তিনটি আদিবাসীদের চাকমা, মারমা, ও ত্রিপুরা ভাষায় একঘন্টার আঞ্চলিক ভাষায় অনুষ্ঠান “পাহাড়িকা” প্রচার হতো। খাগড়াছড়ির বিশিষ্ট লেখক, গবেষক, একুশে পদকে ভূষিত শ্রীপ্রভাংশু ত্রিপুরা তখন এই অনুষ্ঠানে মুখ্য প্রযোজক ছিলেন। তিনি আমাকে সপ্তাহে দুই দিন ককবরক ভাষায় সংবাদ পাঠকের কাজ দিয়ে ছিলেন প্রথম বর্ষ থেকেই। এই দিকে চুক্কদা নিয়মিত এই অনুষ্ঠানের শ্রোতা, বিভিন্ন সংবাদ শেষে আবহাওয়া খবরেই আমি জানিয়ে দিতাম পরের সপ্তায় আমি বাড়িতে আসবো কিনা! যেমন, বঙ্গোপসাগওে গভীর একটি নিম্নচাপ তৈরী হয়েছে, সমুদ্রবন্দর সমূহকে চার নম্বর সতর্ক সংকেত দেখতে বলা হয়েছে, এর প্রভাবে এই স্থানে ঝড়ো বাতাসের সাথে বজ্রবৃষ্টি হবে, “আমার পক্ষে বাড়িতে আসা সম্ভব হবেনা!” অথবা, “তবু আমি বাড়িতে আসবো”! আমার রেডিও বার্তা শুনে তারা সেই ভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রাখতো! অর্থাৎ সেই দিন তারা অন্য কারো কাছে দিন মুজুরী করতে যেতো না!
আর্ট কলেজের চতুর্থ বর্ষে কি এক সামান্য কারণে ইয়ার ড্রপ দিলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম আমাদের গ্রামের প্রিয় সেই “হাজাতৈসা” ঝিরিতে আউটডোর পেইন্টিং করবো। সকালে মা টিফিন ক্যারিয়ারে ভাত-তরকারি রান্না করে দিতো। ক্যানভাস, ইজেল, রং নিয়ে সারা দিন চলতো শিল্প সাধনা। একদিন প্রিয় দুই বন্ধু ধনিদা ও চুক্কদাকে আমন্ত্রণ জানালাম আমি কি করি দেখার জন্য। ঝিরির হুবহু সুন্দর ছবি দেখে তারা মুগ্ধ! জীবনে প্রথম তাদের কাছ থেকে শ্রদ্ধাও প্রশংসা পেলাম, কারণ গ্রামীণ প্রতিটি কাজে শারিরীক সামর্থ্যে আমি পিছিয়ে থাকতাম। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত হলো পরের দিন শৈশবের মতন ঝিরিতে মাছ শিকার করে রান্না-বান্না হবে! আমি বললাম আমিতো ছবি আঁকার কাজে ব্যস্ত থাকবো, ওরা বললো কোনো সমস্যা নেই, তারাও সকালের আধাবেলা অন্য কাজে ব্যস্ত থাকবে, মাছ ধরার ফাঁদ আজকেই পেতে রাখা হবে। ধনিদা গেলেন কিছু জংলী কলার গাছ কেটে আনতে, আর চুক্কদা গ্রামে গেলেন কিছু “গড়া” বা পচানো ভাত থেকে তৈরি চুওয়াক। সাধারণত গ্রামের প্রতিটি ঘরে ভাত পচিয়ে বাস্পায়িত করে মদ বানানো হয়, বাস্পায়িত হওয়ার অবশিষ্টাংশ কে ককবরক ভাষায় গড়া বলা হয়। ছবি আঁকতে আঁকতেই দেখলাম ধনিদা কলা গাছগুলো দুই ভাগ করে মাঝখানের অংশটি ফেলে আবার জোড়া দিয়ে শক্ত করে বাঁধলেন, ফলে একটা বড় পাইপের মতন তৈরী হলো একদিকের অংশ বুনোলতা পাতা ঢুকিয়ে বন্ধক রেদিলেন, অপরদিকে ছোটছোট বাঁশের কঞ্চি এমন ভাবে গাঁথলেন মাছ ঢুকতে পারবে কিন্তু বের হতে পারবেনা ! এদিকে চুক্কদা পুরানো কাপড় দিয়ে বাঁধা ছোটছোট গড়ার পুটলি নিয়ে এসে প্রতিটি কলাগাছের ফাঁপা অংশে ঢুকিয়ে গভীর পানিতে চুবিয়ে পাথরচাপা দিয়ে রাখলেন। শুরুতে আমার সন্দেহ ছিল এই ভাবে মাছ পাবো, কিন্তু পরের দিন আসলেই মাছের ভুরি ভোজ হয়েছিল ! মানুষ নিত্য-নুতুন বুদ্ধি বেরকরতে পাওে কিন্তু মাছের পারেনা , এই কারণেই ঝিরির অনেক প্রজাতির মাছ আজ বিলুপ্ত।
তবে এইসব ঘটনা এখন অতীত, আমাদেও গ্রামের সেই হাজাতৈসা ঝিরির আর সেই আগের জৌলস রূপ তেজ নেই। ভিবিন্ন প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে, নব্বইয়ের দশকে পাহাড়ি সব ঝিরি থেকে পাথর তুলে বানানো হয়েছে পাকা রাস্তা, আগে বাজাওে যেতে লাগতো এক-দুই ঘন্টা, এখন টেক্সী চড়ে ১০মিনিট ওলাগেনা। জঙ্গলে বড়গাছ প্রায় নেই, ঝিরির দুই পাশে লাগানো হয়ে ছেদামি সেগুন গাছ, ফলে বর্ষা শেষ হলেই প্রায় পানি শূন্য হচ্ছে ঝিরি।
আমিও এখন নুতন নুতন ঝিরির খোঁজে ঘুরি, নুতন-নুতন বন্ধুর সন্ধান করি, যারা আমার মতোই ঝিরি-ঝর্ণায় ঘুরতে ভালোবাসে, ভালোবাসে এই পাহাড়ি প্রকৃতি। গত কয়েক বছর যার সাথে ঘুরতে যাই সে হলো কংচাইদাদা, ফেসবুকেইপরিচয়, তিনি চাকুরীজিবি আর আমি গৃহস্বামী দুজনের সময় মিলানো খুব মুশকিল, তবু যখনই সুযোগ পাই বেরিয়ে পড়ি। কংচাই দাদার সাথে মজার এক স্মৃতি লিখে শেষ করছি এই লিখা, একবার উনার গ্রামের দিকের এক ঝিরিতে গেলাম, যেখানে চমৎকার সুন্দও একটি ঝর্ণা রয়েছে। যথারীতি যাওয়ার পথেই খালি হাতে বেশ কিছু মাছ ধরলাম আমরা, আর কিছু বুনো শাক। ঝর্ণার কাছাকাছি গিয়ে আগুন জ্বালিয়ে ভাত আর শাক রান্না করলাম, মাছগুলো কুটে একটা পাতার উপর রেখে স্নান করতে গেলাম।
পরিকল্পনা ছিল স্নান শেষে গরম গরম মাছ রান্না করে খাবো। ঘন্টা খানেক স্নান শেষে এসে দেখি অর্ধেকের বেশি মাছ উধাও! এতো নির্জন স্থানে কোনো চোর আসবে? হঠাৎ দেখলাম অদূরে সুন্দর এক বুনো পাখি আমাদের ধরা মাছ খাচ্ছে! না আফসোস কিংবা দুঃখ হয়নি আমাদের, নিজ হাতে ধরা মাছ দিয়ে একটি পাখিকে আপ্যায়ন করতে পেরেছি এই সৌভাগ্য কয়জনেরইবা হয়!
আর আমার সেই শৈশবের দুইবন্ধু, তারা এখনো পাহাড় থেকে পাহাড়ে জুম চাষ করে, চুক্কত্রিপুরার এখন নাতিও আছে, তবে ধনিত্রিপুরা কি এক কারণে বিয়ে করেনি, ভিবিন্ন জনের বাড়িতে কামলা খাটে, যেখানে রাত সেখানেই কাত। তবে এখনো প্রতি ডিসেম্বরের শেষের দিকে শহর ছেড়ে আমি বাড়িতে বেশ কিছু দিনের জন্য যাই, ওদের খুঁজে বেরিয়ে পড়ি অভিযানে!!
লেখক : চিত্রশিল্পী, পরিভ্রাজক
হাপংপাড়া, খাগড়াছড়ি , বাংলাদেশ।

তঞ্চঙ্গ্যা রূপকথা তেন্দেরার পচ্ছন

বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা


আরাকান দেশের পাহাড়ি বসতির জালিম্বর একজন আঙু বা সমাজপতি। সে ছিলো এক বিশাল তালুকের অধিকারী। জালিম্বর একদল লোক নিয়ে রোয়াঙ্গ বা আরাকান থেকে যখন আনকে বা পশ্চিম দেশ চট্টগ্রামে আসে তখনো চট্টগ্রাম অঞ্চলে মোগলদের প্রভাব ছিল। তাই দলবল নিয়ে সে নাক্ষ্যংছড়ি ও রামু হয়ে উত্তর দিকে সরে ক্রমে ক্রমে পার্বত্য চট্টগ্রামের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। তখন সংরক্ষিত বনাঞ্চল বলে কোন সরকারী বনাঞ্চল ছিল না, বিস্তীর্ণ অঞ্চল ছিল মুক্ত বনাঞ্চল। জালিম্বর আঙুর তার দলবল নিয়ে বিস্তীর্ণ বনাঞ্চলের একটি সুবিধাজনক স্থানে বসতি স্থাপন করে। সেখানেই তাঁর দলবল নিয়ে বাস করতে থাকে। জালিম্বর-আঙু স্বগোত্রীয় এক সুন্দরী কন্যাকে বাদীমুই কে বিয়ে করেন। তার অনুসারীদের নিয়ে বিয়েতে খুব আনন্দ ফুর্তি করে। সাত বছর পর জালিম্বরের স্ত্রী একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেয়। জালিম্বর এবং তাঁর স্ত্রী বাদীমুই ছেলেটিকে কিভাবে আদর করবে তা নিয়ে দুইজনের মধ্যে ঝগড়া হতো প্রায়ই। তাঁরা অতি আদরের ছেলেটির নাম রাখল চিজিগুলা। কিন্তু পাড়ার লোকেরা কেউ কেউ আদর করে কিংবা বিদ্রুপ করে ডাকে গুলা। চিজি বাদ দিয়ে শুধু গুলা। তাঁরা অতি আদর যতœ নিয়ে ছেলেটিকে বড় করতে লাগল।
কিশোর বয়সে চিজিগুলার জন্য বৌ আনতে শখ জাগল জালিম্বর আঙুর। পাড়ার সবচাইতে সুন্দরী ফুলরেণুকে চিজিগুলার জন্য বৌ ঠিক করা হল। ফুলরেণু বয়সে গুলার চেয়ে কয়েক বছরের বড় এবং পূর্ণ যুবতী না হলেও তার বিয়ের সাধ হয়েছে। বাগল্যার সঙ্গে ফুলরেনুর আইপাই বা মন দেয়া নেয়া, ঘনিষ্টতার কথা কারোর অজানা ছিল না পাহাড়ে। ফুলরেণু এ বিয়েতে কোন মতেই রাজি নয়। তার অভিযোগ হচ্ছে গুলা তার চেয়ে বয়সে ছোট, এখনো কিশোর এবং গুলা ভাল করে কথা বলতে পারে না, তার জিহ্বায় আড়ষ্টতার দোষ আছে। ফুলরেণুর বাবা মা আঙুর একমাত্র সন্তান বিবেচনা করে গুলার সঙ্গে মেয়ে ফুলরেণুর বিয়ের কথা পাকা করে ফেলেছে। বিয়ে যে দিন হবে, তার আগের রাতে ফুলরেণু বাগল্যার সঙ্গে পালিয়ে গেলো। সকাল হতে না হতেই ঐ খবর জালিম্বর কানে আসে। রাগে, ক্ষোভে, দুঃখে দিগবিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে একজন বিশ্বাসী লোক পাঠিয়ে দিল ভিনগ্রামের তাঁর মামাত ভাই নাগর্য্যার কাছে। লোকটি গিয়ে নাগর্য্যাকে বলল, জালিম্বর তাঁর ছেলে চিজিগুলোকে বর সাজিয়ে নিয়ে আসছে, সে যেন তার মেয়ে মুগুলিকে কনে সাজিয়ে রাখে। চিজিগুলা আর মুগুলির আজই বিয়ে হবে। সব ব্যবস্থা যেন নাগর্য্যা করে রাখে। নাগর্য্যা আর তার স্ত্রী খবরটি পেয়ে বিস্মিত হলেও বরঞ্চ খুশি হল। তার মেয়ে মুগুলির বয়স চিজিগুলার চেয়ে দু বছরের বড়। এমনিতে আত্মীয় আর জালিম্বর হচ্ছে আঙু বা দলপতি, কাজেই নাগর্য্যা আর তার স্ত্রী জালিম্বরের কথায় বেরাজী হল না। মুহূর্তের মধ্যেই লোকজন দিয়ে বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলল নাগর্য্যা মহা ধুমধাম সহকারে না হলেও সে দিন ঠিক ঠিক চিজিগুলা আর মুগুলির বিয়ে হয়ে গেল। পাড়া প্রতিবেশীরা এসে ভুরি ভোজন করে চিজিগুলা আর মুগুলিকে আশীবাদ করল।
জালিম্বর আঙু জুম চাষ করলেও তার কিছু ধান্যজমি আছে। গরু, ছাগল, মহিষ, শূকর, হাঁস-মুরগি গৃহপালিত পশু-পাখি তাঁর অঢেল আছে। তাঁর পারিবারিক অবস্থা সচ্ছল। একেবারে ধনী বলা না গেলেও দরিদ্র নয় জালিম্বর আঙু।
মুগুলির সঙ্গে বিয়ে হলেও চিজিগুলা ফুলরেণুকে ভুলতে পারেনি। তার কথা মাঝে মাঝে মুগুলিকে শোনায়। উভয়ের মধ্যে মাঝে মাঝে এ ব্যাপারে কথা কাটাকাটি ও ঝগড়াঝাটি হয়। চিজিগুলা আর মুগুলির বিয়ের তিন বছর পর জালিম্বরের স্ত্রী মারা যায়। এর চার বছর পর জালিম্বরও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। চিজিগুলা আর মুগুলির জোড়া তালি দিয়ে কোন রকমে সংসার চালিয়ে যাচ্ছে। পাড়ার লোকেরা তাদের শেষাংশ উচ্চারণ করে ডাকে। যেমন – চিজিগুলাকে শুধু গুলি। উভয়ের কথা বলতেই শুধু গুলা-গুলি উচ্চারণ করে হাসে আর ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে। গুলা-গুলির সংসারে বিয়ের দীর্ঘ ছয় বৎসরেও কোন সন্তান সন্ততি হয়নি। জালিম্বর আঙু স্বপ্নে দর্শন দিয়ে গুলাকে বলে, চিজিগুলা তোমরা বড় একা হয়ে গেছ, আমি আসছি। আমি তোমার ঘরে আসছি। কিছুদিনের মধ্যে গুলা বুঝতে পারল গুলি গর্ভধারণ করেছে। সে তার স্বপ্নের কথা গুলিকে বলে ফেলল। তাদের বিশ্বাসমতে গুলার পিতা জালিম্বর পুনর্জন্ম গ্রহণ করেছে। এতে তারা খুশি হল। ঠিক দশ মাস দশদিন পর মুগুলি একটি পুত্র সন্তান প্রসব করল। তাদের আনন্দ এখন দেখে কে!
সন্তানটি বড় হতে থাকে। যখন হাঁটতে পারে, কথা বলতে পারে, পাড়া মাতিয়ে রাখে ছেলেটি। তার বাবা-মাকে সে বাবা-মা ডাকে না। বাবাকে ডাকে গুলা আর মাকে ডাকে গুলি। অন্যান্য ছেলেদের চেয়ে আলাদা এবং ভিন্ন প্রকৃতির হয়েছে ছেলেটা। তার কথা-বার্তা, চাল-চলন, আচরণে চাতুর্য প্রকাশ পেতে থাকে। পাড়ার লোকেরা তাকে তেন্দেরা নামে ডাকতে থাকল। একদিন গুলা এবং গুলিও ছেলেটিকে তেন্দেরা নামেই ডাকতে থাকে। একদিন গুলা জঙ্গল থেকে একটি কচ্ছপ ধরে নিয়ে এল ঘরে। ডিমওয়ালা কচ্ছপ। কচ্ছপ কেটে রান্না করা হলে তেন্দেরা বলল যে, সে ডিমগুলোই খাবে, ডিম বাদে কিছুই খাবে না। গুলা এবং গুলিও এতে খুশি। একটি মাত্র ছেলে, সে না খেলে খাবে কে? কিন্তু কচ্ছপের সেই হলদে রঙ্গের ডিমগুলো খাওয়া শেষ করে তার বাবা-মাকে বলতে লাগল, ইস! তোমরা কী খাচ্ছ? আমাকে একটুও দিলে না। আমিও কচ্ছপের মাংস খাব। কচ্ছপের মাংস পেট ভরে খেল ডিমগুলো খাওয়ার পর। খেয়ে বলতে লাগল, ইস এটা ডিমের চেয়ে সুস্বাদু। সে মুরগি বা মোরগের গিলা, কলিজা খায় না, শুধু খায় মাথা, ঠ্যাং ইত্যাদি। গুলাগুলি এই ডানপিটে ছেলে তেন্দেরার কান্ডে অবাক হলো।
বয়স বার, তের হতে না হতেই তেন্দেরার দেহে, মনে যৌবন এসে গেল। সে পাড়ার তরুণীদের পিছে পিছে ঘুরে বেড়ায়। পাড়ার ছেলেরা তাকে চোখে চোখে রাখে, সাবধান করে। গুলা-গুলি ছেলের এই আচরণ দেখে মর্মাহত হয় এবং তার জন্য বৌ আনার সিন্ধান্ত নেয়। পাড়ায় অনেক তরুণী তাকে পছন্দ করলেও তেন্দেরা বিয়েতে রাজি হয় না। তাই একদিন তারা তেন্দেরাকে ঘর থেকে নামিয়ে দেয়। তাকে বলে দেয় যে, সঙ্গে বৌ না নিয়ে আসলে ঘরে উঠতে পারবে না।
তেন্দেরা কোন কথা না বলে বেড়িয়ে পড়ল শূণ্য হাতে। পকেটে টাকা পয়সা নেই, কোন যুবতীর মন পেতে হলে নূন্যতম পক্ষে সুগন্ধি তৈল, আয়না, চিরুনি দিতে হয় একথা তেন্দেরার জানা আছে কিন্তু সে এগুলো পাবে কোথায়?
টাকা পয়সা থাকলে বাজার থেকে সে কিনে নিতে পারত। কিভাবে টাকা পাওয়া যায় একথা ভাবতে ভাবতে তেন্দেরা এক স্থানে গিয়ে দেখে একজন চাষী হাল চাষ করছে।
এক জোড়া মহিষের হাল। সে মিষ্টি কথা বলে চাষীর সঙ্গে সখ্যতা করে। সুযোগ মতো বলল, দাদা তুমি বিশ্রাম কর, আমি তোমার বদলে হাল চালাই। লোকটি তাতে রাজি হল এবং তেন্দেরা হাল চষতে লাগল।
বেশ খানিকক্ষণ চষার পর তেন্দেরা লোকটিকে বলল, দাদা মশা-মাছি মহিষ দুটোর গায়ে বসে বড় উৎপাত করে। এতে মহিষগুলো বিরক্ত হয়, লাঙ্গল টানতে চায় না।
বরঞ্চ মহিষ দুটোর গায়ে কাদা লেপে দিলে মশা-মাছি গায়ে বসে উৎপাত করবে না। মহিষ দুটো আরাম করে হাঁটবে, লাঙ্গল টানবে। দাদা, আমি তাই করি, কী বল?
লোকটি আপত্তি করল না। তেন্দেরা মহিষ দুটোর গায়ে ভালভাবে কাদা লেপে দিল। সূর্যের তাপে কাদা শুকালে মহিষ দুটোর কালো রং সাদা হয়ে গেল এবং দুটো সম্পূর্ণ নতুন মহিষ বলে মনে হতে লাগল।
তেন্দেরা একটু পর লোকটিকে বলল, দাদা আমার পানির তৃঞ্চা পেয়েছে, তোমার ঘরে গেলে কি পানি খেতে পারব? লোকটি বলল, “সে কি কথা? পানি কেন পাবে না?
যাও ঐ যে টিলার ওপর ঘর, ওখানে গিয়ে আমার স্ত্রীকে বললে পানি দেবে। তেন্দেরা সন্দেহের ভান করে বলল, দাদা যদি পানি না দেয়, তখন আমি তোমাকে বলব, দিচ্ছে না তাহলে তুমি তাকে দাও, দাও বলবে তো?” লোকটি স্বাচ্ছন্দে রাজি হল।
তেন্দেরা ধীর পায়ে টিলার ওপর লোকটির ঘরে গিয়ে তার স্ত্রীকে বিনয় সহকারে কুশল জিজ্ঞেস করে, খুশি করল। তারপর বলল, বৌদি দেখ, দাদা মানে তোমার স্বামী একটু আগে আমার কাছ থেকে এক জোড়া হালের মহিষ কিনেছে ঐ দেখ সাদা মহিষগুলি। তোমার নিকট থেকে মহিষ দুটোর দাম দু’শো টাকা নেয়ার জন্য দাদা পাঠিয়েছে, তুমি আমাকে দু’শো টাকা দাও। তখন স্ত্রী লোকটি উত্তরে বলল, কি যাতা বলছ, আন্দাজে কেন টাকা দেব? তেন্দেরা বলল, তাহলে আমি তোমার স্বামীকে জিজ্ঞেস করছি, দেখ সে কি বলে। তেন্দেরা ডাক দিয়ে লোকটিকে বলল, দাদা কথামত তোমার স্ত্রী দিচ্ছে না। এই কথা শুনে লোকটি রাগত স্বরে জোরে জোরে বলল, আরে দাও, দাও। অগত্যা স্ত্রী লোকটি বাক্স থেকে তাড়াতাড়ি বের করে দুশো টাকা দিয়ে দিল। তেন্দেরা টাকা পাওয়া মাত্রই সেখান থেকে চম্পট দিল দূরে অনেক দূরে।
হাঁটতে হাঁটতে সাত গাঙ সাত পাড়া পার হয়ে এক বাজার থেকে সুগন্ধি তেলের বোতল, আয়না, চিরুনি এবং অন্যান্য প্রসাধনী সামগ্রী কিনে থলে ভর্তি করে নিল।
একদিন সাঁঝের বেলা শামুকছড়ি পাড়ে এক পাড়ায় এসে পৌঁছাল তেন্দেরা। পাড়ার এক প্রৌঢ়া ও একজন তরুণী। মা ও মেয়ে। মা মেয়েটিকে নদী থেকে পানি আনতে বলছে, কিন্তু মেয়েটি সাঁঝের বেলায় একা পানি আনার জন্য যেতে ভয় পাচ্ছে।
তেন্দেরা তরুণীকে দেখে পছন্দ করল। প্রৌঢ়া মহিলাকে মাসী সম্বোধন করে কুশল জিজ্ঞাসা করল।
প্রৌঢ়া মহিলা বিস্মিত হয়ে তেন্দেরাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কে গো! আমাকে কেন মাসী ডাকছ, আমার তো এ জম্মে কোন বোন ছিলো না। তুমি কোথেকে এলে?
তেন্দেরা বিনীতভাবে বলল, আমি তোমাকে আমার মায়ের মতই দেখছি। আমার মায়ের চেহারা ঠিক তোমার মত। আমি তোমাকে মাসি বলে ডাকব।
মাসী আমাকে কলসিটা দাও, আমি পানি এনে দিচ্ছি। মা ও মেয়ে উভয়ে খুশি হল। তরুণীটি কলসিটি তেন্দেরার হাতে দেওয়ার সময় তেন্দেরা তার থলেটি তরুণীর হাতে দিয়ে বলল, বোন এই থলেতে যা আছে সব তোমার জন্য এনেছি, তুমি রেখে দাও।
তেন্দেরা কলসিটি ভরে পানি নিয়ে উঠানে পৌঁছার আগে থেকে প্রৌঢ়া বকবক করছিল। তেন্দেরার কানে গেল প্রৌঢ়ার কথা গুলো, কোথা থেকে কে আসল এই সাঁঝের বেলা।
তাকে রাত্রে থাকতে দেব কিভাবে? তেন্দেরা মনে মনে ভাবল তাহলে তাকে কি এখানে থাকতে দেবে না? সে ফন্দি আঁটতে লাগল কিভাবে এই ঘরে থাকা যায়?
পানির কলসি ঘরে তুলে দিয়ে মহিলাকে জিজ্ঞেস করল, মাসীমা কী কী কাজ আমাকে দাও আমি করে ফেলি। আমাকে অন্য ঘর খুঁজতে হবে থাকার জন্য। মহিলা বুঝল তেন্দেরার এখানে থাকার ইচ্ছা নেই, অথচ কাজ করে দিতে বলছে।
তখন তেন্দেরাকে জিজ্ঞস করল, তুমি কোথা থেকে আসছ? কে তুমি? তেন্দেরা জবাব দিল সে আঙু জালিম্বরের নাতি। তখন মাহিলার মনে আগের কথা স্মরণ হল, ভাবতে লাগল সে।
জালিম্বর আঙু তার ছেলে চিজিগুলার জন্য তাকে বৌ ঠিক করেছিল। কিন্তু যে দিন বিয়ে হবে তার আগের রাতে বাগল্যার সঙ্গে সে পালিয়ে এই গ্রামে চলে আসে। ছয়/ সাত বছর সুখে ঘর করে একমাত্র কন্যা কুকলিকমালা জম্ম গ্রহণ করে এবং তার জম্মের এক বছর পর বাগল্যা মারা যায়।
প্রৌঢ়া ফুলরেণু তেন্দেরার বাপের নাম জিজ্ঞেস করতেই তেন্দেরা জবাব দিল, তার বাপের নাম গুলা। এবার ফুলরেণু বলল, তুমি চিজিগুলার ছেলে তাহলে?
তেন্দেরা বলল, হ্যাঁ।
এবার ফুলরেনু বলে,এই সাঁঝের বেলা আর কোথায় যাবে, এখানেই থাক। এর আগে কোনদিন কোন ছেলে বা পুরুষকে আমাদের ঘরে থাকতে দেয়নি, আমার মেয়ে কুকলিকমালা। এই বলে, মেয়ে কুকলিকমালাকে তেন্দেরাসহ তিনজনের ভাত রাঁধতে বলল ফুলরেণু। কুকলিকমালা ইতোমধ্যে তেন্দেরার দেওয়া থলে থেকে সুগন্ধি তেল মাথায় দিয়ে আয়না দেখে চুল আঁচড়িয়ে মনের মত সেজেছে।
সে কোন কথা না বলে ভাত রাঁধতে শুরু করে। তেন্দেরার আগমনে সে খুশি হয়েছে!
একদিন দুদিন থেকেও তেন্দেরা চলে যাওয়ার নাম করে না। মা আর মেয়েও উচ্চবাচ্য করেনা। তবে চলাফেরা দেখে বোঝা যায় সে কুকলিকমালাকে অনুসরন করছে।
তেন্দেরা ফন্দি আঁটে কিভাবে কুকলিকমালাকে বৌ করে ঘরে নিয়ে যাবে। ফুলরেণু মাঝে মাঝে ভাবে, চিজিগুলা ভালভাবে কথা বলতে পারে না। জিব্বায় যেমন জড়তা আছে তেমনি জড়বুদ্ধি সম্পন্ন। তার ছেলে তেন্দেরার বুদ্ধিইবা কত হবে, আর এই তেন্দেরা তার মেয়ে কুকলিকমালার জামাই হবে কিভাবে? একে বুদ্ধি করে তারাতে হবে।
ফুলরেণু একদিন রাত্রে তেন্দেরাকে বলল, তুমি দেখছি এখানে থেকে চলে যাবার নামও করছ না, এভাবে থাকলে লোকে বদনাম করবে। তুমি আমার জন্য তিনটা জিনিস নিয়ে আস, যদি নিয়ে আসতে পার তবে এখানে থাকতে পারবে এবং আমার মেয়ে তোমাকে পছন্দ করলে তার সাথে বিয়ে দেব।
আর যদি তিন দিনের মধ্যে এ জিনিস গুলি আনতে না পার তবে এখান থেকে চলে যাবে বুঝলে? কি জিনিস জানতে চায় তেন্দেরা।
ফুলরেনু বলে, এক – বোঁটাহীন ফল। দুই – যে ফলের বিচি বাইরে। এবং তিন- যে জিনিস এক বাটি খেলেও সেই বাটি পূর্ণ থাকে।
এই তিন দ্রব্যের নাম শুনে তেন্দেরা বোকা বনে গেল। সে এমন জিনিসের কথা কখনো শুনেনি। সে হতাশ হয়ে গেল। তাকে তারানোর জন্যই এই ফন্দি করা হয়েছে, সে বুঝতে পারলো।
তেন্দেরা ম্লান মুখে কুকলিকমালাকে বলল যে, সে এখান থেকে চলে যাচ্ছে। কুকলিকমালা তেন্দেরাকে পছন্দ করে ফেলেছে তাই তেন্দেরাকে এই তিনটি দ্রব্য কী কী এবং কোথায় পাওয়া যায় তার বিষদ বলে দিলো, আমাদের ঘরের পাশে যে ছড়া তার নাম শামুকছড়ি। এই ছড়ার উজানে যেতে যেতে ডানে একটা ছড়া দেখবে তার নাম তামছড়ি। সেই ছড়ার দু’ধারে অনেক ফল গাছ। ওগুলো তাম গাছ। দেখবে গাছে তাম বা কাজু বাদাম ধরে আছে গাছে। ফলগুলোর বাইরে বিচি। তাম পাড়ার সময় দেখবে ছড়াতে অনেক শামুক। সেই শামুক কুড়িয়ে নিয়ে আসবে।
তেন্দেরা তার কথামত গিয়ে দেখে সত্যই গাছে তাম ফল ঝুলতেছে। সে পাকা তাম ফল এক থলে নিয়ে আসার সময় এক থলে শামুকও কুড়িয়ে নিল ছড়া থেকে।
ঠিক দুপুরের সময় কুকলিকমালার মুরগিটা কক-কক-কতাক, কক-কক-কতাক ডাকতে ডাকতে ঘরের বেড়ায় টাঙ্গানো খোপ থেকে নেমে গেল। তেন্দেরা সেখানে পৌঁছলে কুকলিকমালা তাকে ঐ খোপ থেকে মুরগির পাড়া ডিম নিয়ে আসতে বললো, তেন্দেরা ঠিক ডিমটা নিয়ে এল।
কুকলিকমালার কথামতো তেন্দেরা ফুলরেণুকে তিনটা জিনিস বুঝিয়ে দিলো। ডিম হচ্ছে বোঁটাহীন ফল। তামের বিচি ফলের বাইরে। ফলের নিচে ঝুলে থাকে। আর শামুক একবাটি খেলেও তার খোলসগুলো পড়ে থাকে কাজেই একবাটি খেলেও এক বাটিই অবশিষ্ট থাকে।

ফুলরেণু খুব খুশি হল। কিন্তু তা স্বত্বেও চিজিগুলার ছেলে তেন্দেরার কাছে মেয়ে দিতে রাজি নয় ফুলরেণু। কুকলিকমালা জানে তার মা ফুলরেণু তার বাবা বাগল্যার সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করেছিল, কাজেই তার মা যদি পালিয়ে গিয়ে তার প্রেমিককে বিয়ে করতে পারে, সে কেন তেন্দেরার সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করতে পারবে না। এক রাত্রে সত্যি সত্যি তেন্দেরার হাত ধরে পালিয়ে গেল কুকলিকমালা। তেন্দেরা কুকলিকমালাকে নিয়ে সোজা ঘরে ফিরে এল। গুলা-গুলি ছেলে আর ছেলের বৌ দেখে মহা খুশি। কিছুদিন পর গুলা তেন্দেরাকে নিয়ে পাড়ালিয়াদের সঙ্গে কাট্টনে গেল। নৌকার কাট্টন। তারা এক মাসের খোরাকি নিয়ে দেড় দিনের হাঁটা পথের গভীর বনে চলে গেল। ঘরে রইল গুলি আর তেন্দেরার নববধূ কুকলিকমালা। একমাসের প্রায় শেষ, কিন্তু নৌকার কাজ এখনো অনেক বাকি এদিকে খোরাকিও প্রায় শেষ হয়ে আসছে। তাই তেন্দেরা বাড়ি ফিরল খোরাকি নিয়ে যাবার জন্য। বাড়ি ফিরে দেখল তার মা খুব অসুস্থ। কুকলিকমালা কী করবে দিশেহারা হয়ে আছে। তেন্দেরা বৈদ্য এনে তার অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা করাল। কিন্তু কয়েকদিন পর তার মা গুলি মারা গেল। তেন্দেরা তার বাবা গুলাকে খবর দিতে পারল না তার মা শ্রাদ্ধ সম্পন্ন করল।
এদিকে খোরাকি নিয়ে না গেলে তার বাবা উপোসে মরবে, আর খোরাকি নিয়ে কাট্টনে তার বাবার কাছে গেলেও ঘরে কুকলিকমালা একা থাকতে পারবে না। তাই একদিন সে ফুলরেণুকে তেন্দেরার নিজেদের ঘরে আনতে গেল। তেন্দেরা বুঝেছিলো- ফুলরেণু তাদের ঘরে কোনদিন যাবে না। তাই ফুলরেণুর কাছে পৌঁছামাত্র হাউ মাউ করে কেঁদে বলল, আমরা বাপবেটা নৌকার কাট্টনে গিয়েছিলাম- সেখানে নৌকার কাজ অর্ধেক করে বাবা গুলা মারা গেছে আর সেদিন মা গুলিও মারা গেল। এখন নৌকাটার কাজ সম্পন্ন করে নিয়ে আসতে হবে। তাই আমি কাট্টনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ঘরে কুকলিকমালা একা থাকবে কিভাবে?
আপনি আমাদের বাড়িতে চলে আসেন। তেন্দেরার কথা ফুলরেণু ভেবে দেখল। অমনি সে একা থাকা পছন্দ করেনা – এখন তার মেয়ের সঙ্গে তাদের ওখানে থাকলে খারাপ কিছু নয়, তাই তেন্দেরার কথায় সে সহজেই রাজি হয়ে গেল।
ঘরের জিনিসপত্র যতটুকু পারে তেন্দেরা নিয়ে নিল। ফুলরেণুও তার কাপড় চোপড় ব্যবহার্য দ্রব্যাদি যা পারল সঙ্গে নিয়ে তেন্দেরার ঘরে এসে পৌঁছল।
দুদিন পর তেন্দেরা কিছু দিনের খোরাকি নিয়ে কাট্টনে তার বাবা গুলার কাছে চলে গেল। সে তার মা গুলির মৃত্যুর কথা তার বাবা গুলার কাছে গোপন রাখল। সে বরঞ্চ বলল যে, তার মা গুলি ভয়ানক অভিমান করে আছে। এত দীর্ঘ সময় যে কোনদিন প্রবাসে কাটায়নি। এবার দীর্ঘদিন ঘরবাড়ি ছেড়ে প্রবাসে চলে এসেছে গুলা।
দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকার স্বাভাবিকভাবে স্ত্রীর প্রতি দিওয়ানা হয়ে আছে। ছেলের কথা শুনে মনে মনে খুব আফসোস করল। মনে মনে ভাবল এতদিন প্রবাসে থাকা কী ঠিক হল ? তেন্দেরা আবার বলল, তুমি ঘরে গেলে মা কামরাতেই পড়ে থাকবে দেখো। গুলা মনে মনে ঠিক করল তাতে কী আছে যায়, ঘরে গিয়ে সোজা কামরার ভিতরে গুলিকে জড়িয়ে ধরলে সব অভিমান ভেঙ্গে যাবে গুলির। গিয়েই জড়িয়ে ধরবে মনে মনে ঠিক করল গুলা।
কয়েকদিন পরিশ্রম করে বাপ-বেটা অসস্পূর্ণ নৌকাটি সম্পূর্ণ করে বাড়ির দিকে রওনা দিল। দেড় দিন নদীর পথে নৌকাটি ভাসিয়ে এনে একদিন সন্ধ্যায় বাজার ঘাটে ভিড়াল তারা। তেন্দেরা তার পিতাকে বলল, তুমি নৌকাটি বাজারে বিক্রি কর আর আমি আমাদের কুড়াল, দা এবং অন্যান্য সরঞ্জামাদি ঘরে নিয়ে যাই। মাকে তুমি এসেছ বলে সংবাদ দিব-তাকে তোমার কথা বুঝিয়ে বলব। এই কথা বলে সে ঘরে এল আর গুলা নৌকাটি বিক্রির জন্য বাজারে থেকে গেল।
ঘরে এসে তেন্দেরা ফুলরেণুকে বলল, আমরা নৌকাটা নিয়ে এসেছি, আমি একা পারিনা বলে আমার এক মামাও সঙ্গে এসেছে। তাকে নৌকা বিক্রির জন্য বাজারে পাঠিয়েছি। সে নৌকা বিক্রি করে রূপার টাকা নিয়ে ঘরে আসবে। সে হয়ত ফিরতে রাত হবে। তোমার খওয়া-দাওয়া করে ঘুমাতে পার ,আমি আমার মামার জন্য জেগে থাকব। গ্রামে সন্ধ্যা হতে না হতেই লোকজন খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়ে।
তেন্দেরার কথামতে তারা সাঁঝের আঁধার হতে না হতে খাওয়া দাওয়া শেষ করল। তেন্দেরা যতদিন কাট্টনে ছিল, ততদিন ফুলরেণু আর তার মেয়ে কুকলিকমালা ঘরের বারান্দাতে ঘুমাত।
আজ তেন্দেরা ঘরে আসাতে কুকলিকমালা আর তেন্দেরা ঘরের পিছনের কক্ষ অজলেঙে ঘুমাবে। তেন্দেরা গুলরেণুকে বলল, আমার মামা এলে খাওয়া দাওয়া, করে এখানে থাকবে। সে বারান্দাতে ঘুমাবে, কাজেই তুমি ভিতরের কামরাতে ঘুমাও।
ফুলরেণু ঘরের ভিতরে বিছানা করে শুয়ে পড়ল। কুকলিকমালা তাদের জন্য অজলেঙে বিছানা প্রস্তুত করে তেন্দেরার কথিত মামার জন্য বারান্দাতে বসে অপেক্ষা করতে লাগল।
গুলা বাজারে নৌকাটি বিক্রি করে রাত হলে রূপার টাকা নিয়ে খুশি মনে ফিরে এল। গুলার মনে আছে, তেন্দেরা বলেছে গুলি তার প্রতি অভিমান করে আছে। গুলা ঘরে ফিরে তেন্দেরা আর কুকলিকমালাকে দেখল কিন্তু গুলিকে দেখলনা। গুলি নিশ্চয়ই অভিমান করে ভিতরে শুয়ে আছে মনে করে গুলা সোজা ভিতরে চলে গেল। তখন সেখানে অন্ধকার। গুলা হাতড়িয়ে ধরতে পেল কে একজন শুয়ে আছে। সে গুলি মনে করে জড়িয়ে ধরল ফুলরেণুকে । ফুলরেণু ঘুম থেকে জেগে হতভম্ব হয়ে হাত-পা ছুঁড়তে লাগল।
গুলা ততোধিক জোরে চেপে ধরল ফুলরেণুকে। ফুলরেণু ভূত ভূত বলে চিৎকার করলে গুলা বলতে লাগল-না-না আমি ভূত নই। ফুলরেণু ভয়ে গুলাকে জোরে জড়িয়ে ধরল।
তাদের এই হৈ চৈ কালে তেন্দেরা আর কুকলিকমালা বাতি নিয়ে সেখানে হাজির হল। বাতির আলোতে ফুলরেণু দেখল গুলাকে আর গুলা দেখল ফুলরেণুকে উভয়েই হতভম্ব। লজ্জায় তাদের মুখ লাল হয়ে গেল।
তাদের এ অবস্থা দেখে তেন্দেরা বলল, তোমরা এভাবে জড়াজড়ি করেছ একথা লোকে জানতে পারলে। কলঙ্কের একশেষ হবে। তার চেয়ে উভয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়া ভাল।
গুলা আর ফুলরেণু কিছুই বলতে পারল না। তাদের স্মরণ হল কৈশরেই তো তাদের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। তখন হয় নি এখন শেষ বয়সে হলে ক্ষতি কী?

লেখক : সাহিত্যিক।

টেপা পুতুল বিষয়ক বই

সাবিহা সুলতানা


সাহিত্য বা শিল্পের দোষ-গুণের আলোচনা হলো সমালোচনা। সহজ করে বললে, সমালোচনা হলো কোন কিছুর দোষ এবং গুণ/ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দিক উভয় আলোচনা করা। যেহেতু লোক উপাদান নিয়ে দীর্ঘদিন নাড়াচাড়া করছি, এমন একটি বই নিয়ে সমালোচনা করতে আনন্দই পাচ্ছি। লেখক হয়তো মনক্ষুন্ন হবেন তবুও প্রথমেই বলে রাখি বইটি অসম্পূর্ণ। কেনো অসম্পূর্ণ তা আলোচনাতেই পরিস্ফুটিত হবে।
প্রথমত : ‘পুতুল:বাংলার প্রাণ প্রতিমা’ বইটির নাম বিষয়বস্তুর সাথে যুক্তিযুক্ত হয়েছে। মো. আফজালুর রহিমের করা প্রচ্ছদ অসাধারণ হয়েছে। বইটি আবহমান মৃৎশিল্পীদের উৎসর্গ করা হয়েছে- যেখানে মৃৎশিল্পীদের প্রতি লেখকের ভালেবাসার প্রকাশ ঘটেছে। এটা লেখক ও শিল্পীকে আরো কাছে টানবে। বইয়ের বাঁধাই,কভার পেজ,কাগজের মান উন্নত,বইয়ের ছাপার অক্ষর একটু বড় হওয়াতে পড়ার সুবিধা হয়েছে। সহজ ও ঝড়ঝড়ে ভাষার ব্যবহার,রঙ্গিন ছবি সব মিলিয়ে বইটি লোভনীয়।
লেখক অন্যদের মতো ঋড়ষশষড়ৎবকে লোকসংস্কৃতি নয়, বহুভাষাবিদ আচার্য্য ড. মুহম্মদ শহীদুল্লার ভূক্তি টেনে ঋড়ষশষড়ৎবকে লোকবিজ্ঞান বলে অবিহিত করার বিষয়টা ভালো লেগেছে। আরো ভালো লেগেছে বইটিতে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন থেকে শুরু করে পরবর্তীতে যারা কাজ করেছেন তাদের ধারাবাহিক নাম দেওয়ার বিষয়টা।
তবে বইটিতে অসংখ্য অসঙ্গতি ও তথ্য ভুল রয়েছে। লেখক যে সব জায়গাতে না গিয়েই কাজটি সম্পন্ন করেছেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় বইটির পরতে পরতে। যেমন, একটা চ্যাপটার আছে ‘জরিপ ব্যাখ্যা’-
ময়মনসিংহ-এখানে কতগুলো পরিবার বর্তমানে মাটি নিয়ে কাজ করছে তার সুস্পষ্ট নির্দেশনা নাই।
কিশোরগঞ্জ-এখানেও মৃৎশিল্পীর পরিবারের সংখ্যা স্পষ্ট না। আবার এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন ৩০টি পরিবার বর্তমানে কাজ করছেন কিন্তু সেখান থেকে কিছুই সংগ্রহ করতে পারেন নি। যা কিনা বাস্তবসম্মত নয়।
নেত্রকোনা- লেখক নিজেই বলছেন,- ‘ আমতলা বাজারে ১০০ বছরের পুরানো মেলা বসে। এমন কিছু নাই যা এই মেলায় পাওয়া যায় না।’ অথচ প্রাথমিক অবস্থায় এই এলাকা থেকে তিনি কিছুই সংগ্রহ করতে পারেন নাই, যা বাস্তবসম্মত নয়।
জামালপুর- মৃৎশিল্পীর পরিবারের সংখ্যাই উল্লেখ নাই।
টাঙ্গাইল- শোভা রানী পালের উঠোনে পৌছে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে রাজশাহীর সুবোধ কুমার পালের। এভাবে অসম্পূর্ণ রয়ে গেলো টাঙ্গাইলের ব্যাখ্যা।
জরিপ শেষে তার একটি ছক চিত্র দিলে, বিষয়টার বিস্তারিত রূপ একনজরে দেখা যেতো।
যদিও টেপা পুতুল বিষয়ক বই,তার পরও কতগুলো পরিবার এখনও চাকা ঘুরিয়ে কাজ করে থাকেন ,তার সংখ্যা উল্লেখ থাকলে অনুসন্ধিৎসু পাঠক আরো বেশি লাভবান হত।
মাটি প্রস্তুতের যে আঁকা চিত্র দেওয়া হলো তার পরিবর্তে মৃৎশিল্পীর মাটি প্রস্তুতের স্থির চিত্র দেওয়া হলে , শিল্পীর বাস্তব রূপ অনুধাবন সহজ হতো।
জেলা মাটি খড়ি রঙ ক্রয়(১বছরে) বিক্রয়(১বছরে)
ময়মনসিংহ ৪০,০০০ ৫,০০০ ২,০০০ ৪৭,০০০ ১,০০,০০০
কিশোরগঞ্জ ৩৫০ ৩,০০০ ——- ৩,৩৫০ ১,৭০,০০০
নেত্রকোনা ৫,০০০ ২০,০০০ ১০,০০০ ৩৫,০০০ ৭৫,০০০
জামালপুর ২,৪০০ ৪,০০০ ৪,০০০ ১০,৪০০ ৪০,৪০০
টাঙ্গাইল ২২,২০০ ১৯,২০০ ——– ৩১,৪০০ ১,১২,৮০০
শেরপুর ১২,০০০ ৩৫,০০০ ——– ৩৭,০০০ ১,০২,০০০
উপরোল্লেখিত ছকে রঙ প্রসঙ্গ বাদই দিলাম,মাটি আর খড়ির আর্থিক যে তারতম্য তা বাস্তবসম্মত নয়। একই বিষয় লক্ষ্যনীয় ক্রয়-বিক্রয়ে ক্ষেত্রেও।
একজন গবেষক বইটি পড়ে পরবর্তী কার্যক্রম শুরু করতে পারবেন না,কারণ তথ্য অসম্পূর্ণ।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের মতো আমরাও চাই, এদেশের মৃৎশিল্পীদের কাজ দেখে বিদেশীরা হতবাক হয়ে যাবে। কিন্তু তারজন্যে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এদেশের মানুষের সিনথেটিক পণ্য ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। এর সাথে দেশীয় কাঁচামালে তৈরি পণ্য ব্যবহারে উদ্ভুদ্ধ করতে হবে। দেশের স্বার্থে প্রয়োজনে বল প্রয়োগ করতে হবে।
বইয়ের শেষের দিকে লেখক সামিনা নাফিজের সঙ্গে তোলা মৃৎশিল্পীদের স্থির চিত্র প্রদর্শণ করলে বিষয়টি হৃদয়গ্রাহী, যুক্তিযুক্ত এবং আরো বেশি আকর্ষণীয় হতো।
সব শেষে শিল্পাচার্যের দেখানো পথে এমন একটি বিষয়ে কাজ করার জন্য লেখক সাধুবাদ পেতেই পারেন।
লেখক : শিক্ষক ও লোকসংস্কৃতির ছাত্র।

মোহাম্মদ সাইদুর : ফোকলোর সাধকের প্রতিকৃতি

সাইমন জাকারিয়া
বাংলাদেশের ফোকলোর চর্চার ইতিহাসে মোহাম্মদ সাইদুর একজন সাধক-সংগ্রাহক হিসেবে অনন্য ভূমিকা রেখে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন পর্যন্ত অধিকাংশ মনীষী বাংলার ফোকলোর বলতে যেখানে শুধু গ্রামীণ সংগীতের ধারা তথা বাউলগান, মুশির্দি-মারফতি গান, মেয়েলিগীত ইত্যাদি এবং তার অন্তর্গত জ্ঞান, সাধনা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের বিশ্লেষণের ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। অবশ্য, এ কথাও বলে রাখা ভালো যে রবীন্দ্রনাথের আগ্রহের সঙ্গে বাংলার ছড়া, রূপকথা, নাট্যপালার পরিবেশনা, লোকশিল্প ও গ্রামীণ জীবনের নানা বিষয় যুক্ত ছিল; দীনেশচন্দ্র সেন ও চন্দ্রকুমার দে থেকে ক্ষিতিশচন্দ্র মৌলিক প্রমুখের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল আখ্যান-গীতির ধারা, তাঁদের ভাষায় ‘গীতিকা’, ‘পল্লীগাথা’ বা ‘পালাগান’; অন্যদিকে কবি জসীমউদ্দীনের মূল আগ্রহ ছিল গ্রামীণ সংগীত ও নাট্যপালার দিকে, গুরুসদয় দত্তের আগ্রহের বিষয় ছিল ‘পটুয়াসঙ্গীত’, বাংলার লোকনৃত্য ইত্যাদি এবং এমনকি উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কালের লোকজ্ঞান গবেষকদের মধ্যে শক্তিনাথ ঝা, সুধীর চক্রবর্তী, আবুল আহসান চৌধুরী প্রমুখ খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বদের প্রধান আগ্রহের স্থানে রয়েছে বাউল-সাধকদের জীবন ও সংগীত।
এই বিচারে মোহাম্মদ সাইদুর ছিলেন একেবারেই ব্যতিক্রম। তিনি জন্ম সূত্রে লোকজ্ঞানের প্রাণবন্ত ভুবনের অকৃত্রিম এক উত্তরাধিকারী হিসেবে অনেকটা স্বপ্রণোদিতভাবেই বাংলাদেশের বৈচিত্র্যময় ফোকলোর চর্চায় ব্রতী হন। একদিকে তিনি গ্রথিত করেছেন-বাংলাদেশের মৌখিক সংস্কৃতির কিচ্ছা, পালা, নাট্য, গীতি, কথা, পুথি, কাব্য, আখ্যান, ধাঁধা, প্রবাদ ইত্যাদি গ্রামীণ সাহিত্যের অমূল্য ভাণ্ডার। অন্যদিকে বস্তুগত সংস্কৃতির কাব্যিক আধার সূচিশিল্প, নকশীকাঁথা, শখের হাড়ি, টেপা পুতুল, কাঠের পুতুল, লোক অংলকার, কাগজ কাটা শিল্প, নকশী শিকা, কুটির শিল্পের প্রাচীন ঐতিহ্য বস্ত্রশিল্প ইত্যাদি; বাংলাদেশের কৃত্যমূলক ফোকলোর মুহররম, বেড়া ভাসান ইত্যাদি। এদেশের স্থানীয় লোকক্রীড়া, পেশাজীবী সম্প্রদায়ের পরিচয়, ব্যাঙ বিয়ে ও পুতুলের বিয়ে। এছাড়া, বাংলাদেশের মেলা ও উৎসবের প্রথম পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়নের ব্যাপারে নিঃসন্দেহে তিনিই পথিকৃৎ। এক্ষেত্রে, ইতিহাসের আলোকে বাংলার ফোকলোর গবেষণার ক্ষেত্রে মোহাম্মদ সাইদুরের ফোকলোর সংগ্রহের দুইটি বিশেষত্বের কথা উল্লেখ করা যায়-
১. তিনি বাংলাদেশের সামগ্রিক ফোকলোর চর্চার সংগ্রহের ব্যাপারে একনিষ্ঠ ছিলেন, এক্ষেত্রে খুব সম্ভবত তাঁর আগ্রহ ছিল বাংলাদেশের ফোকলোর চর্চার একটি সামগ্রিক ইতিহাস প্রণয়ন,
২. মোহাম্মদ সাইদুরের ফোকলোর সংগ্রহের পদ্ধতি আধুনিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক, কেননা তিনি তাঁর সংগ্রহের প্রায় সকল ক্ষেত্রে সংগ্রহ সম্পর্কিত সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বস্তগত সামগ্রিক তথাদি প্রদান করেছেন, যার ওপর ভিত্তি করে মোহাম্মদ সাইদুর সংগৃহীত ফোকলোর উপাদানের একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস রচনা করা সম্ভব। এছাড়া, ব্যক্তিগতভাবে তাঁর এলাকায় জনসংস্কৃতি সমীক্ষণে গিয়ে প্রত্যক্ষ করেছি যে মোহাম্মদ সাইদুর তাঁর ফোকলোর সংগ্রহের মাধ্যমে আরেকটি খুবই গুরুত্বপূণ কাজ সম্পন্ন করেছেন, যার প্রভাব আজো তাঁর জন্মস্থান বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে রয়ে গেছে। কেননা, তিনি যেসব শিল্প ও সাধকদের কাছ থেকে সরাসরি গান, কিচ্ছা, পুথি ইত্যাদি সংগ্রহ করেছিলেন, তাঁরা মোহাম্মদ সাইদুরের সংগ্রহ পদ্ধতিতে এতোটাই আবিষ্ট হয়েছিলেন যে এখনো উক্ত অঞ্চলের মানুষ তাঁদের নিজের ঐতিহ্য রক্ষা ও চর্চার ব্যাপারে অত্যন্ত সক্রিয় রয়েছেন।
একথা বলতে দ্বিধা নেই, বাংলাদেশের অন্তত তিনটি জাদুঘর তথা- বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মোহাম্মদ সাইদুরের সংগ্রহে অনেকটাই সমৃদ্ধ হয়েছে। এর বাইরে বাংলা একাডেমীর লোকঐতিহ্য সংগ্রহশালা খুব সম্ভবত মোহাম্মদ সাইদুরের সংগ্রহের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছিল, বর্তমানে যার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর!
এবারের এই কৃর্তিমান ফোকলোরবিদ মোহাম্মদ সাইদুরের ব্যক্তিগত ও কর্মজীবনের অন্যান্য পরিচয় দেওয়া যাক। তিনি ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জ জেলার চরবগাতিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা কুতুবদ্দিন আহমদ ছিলেন একজন পুথি পাঠক ও লোকগীতি গায়ক। তিনি ১৯৫৬ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে একটি জারিগানের দল নিয়ে মওলানা ভাসানীর ডাকে ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনে যোগ দেন। কর্মজীবনের শুরুতেই মোহাম্মদ সাইদুর দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। নিজ জেলার সংবাদ পরিবেশনের সময় তিনি চন্দ্রকুমার দে’র মতো নিজ অঞ্চলের লোকসংস্কৃতির পরিচয় প্রদান করতে শুরু করেন। এরপর ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বাংলা একাডেমীর সংগ্রাহক হিসেবে কাজ শুরু করেন। চাকরিরত অবস্থায় ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এস.এস.সি. পাস করেন। বাংলা একাডেমীর চাকরি জীবনে তিনি অঞ্চলের বাইরে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে গিয়ে গান, কবিতা, কাহিনী, কিচ্ছা, নাট্যপালা, পুথি ও লোকজীবনের অন্যান্য উপাদান সংগ্রহের সুযোগ গ্রহণ করে। একই সঙ্গে বাংলা একাডেমী থেকে তাঁর সংগ্রহ ও সংকলনের ওপর ভিত্তি করে প্রকাশিত হতে থাকে বেশ কিছু গ্রন্থ, যেমন- জামদানি এবং বাংলা একাডেমী ফোকলোর সংকলন-এর তিনটি খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত “পালাগান”, “বেড়াভাসান”, “মুহররম অনুষ্ঠান”। এছাড়া, দেশে-বিদেশের পত্র-পত্রিকায় তাঁর শতাধিক প্রবন্ধ, নিবন্ধ, প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা একাডেমীতে এবং ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে শিল্পকলা একাডেমীতে তাঁর সংগৃহীত নিদর্শন প্রদর্শিত হয়েছে। ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপেল আর্ট গ্যালারিতে তাঁর সংগৃহীত লোকশিল্প নিদর্শনের প্রদর্শনী হয়। বাংলা একাডেমী থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে যোগ দেন, সেখানে তিনি আমৃত্যু কর্মরত অবস্থায় ছিলেন। একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মীর প্রতি শ্রদ্ধায় ও কৃতজ্ঞতায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মোহাম্মদ সাইদুরের তিরোধানের মাত্র এক মাসের মাথায় ২০-৩০ এপ্রিল ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে “মোহাম্মদ সাইদুর স্মরণ”-এর অংশ হিসেবে তাঁর সংগৃহীত “লোকঐতিহ্য প্রদর্শনী : কাঁথা” শীর্ষক শিল্পকর্ম প্রদর্শন করে।
বিভিন্ন জাদুঘর ও প্রতিষ্ঠানে অকাতরে নিজের সংগ্রহ বিলিয়ে দিয়েও মোহাম্মদ সাইদুর বোধ করে শেষ পর্যন্ত এদেশের শিল্পকর্মের যথার্থ সম্মান প্রদর্শন প্রত্যক্ষ করতে পারেননি, অথবা নিজের সংগ্রহের যথার্থ প্রদর্শনী কোথাও দেখে খুশী হতে পারেননি। তাই তিনি এক পর্যায়ে নিজের বাড়িতেই প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন এদেশীয় লোকশিল্পের একটি পূর্ণাঙ্গ ও ব্যতিক্রমী সংগ্রহশালা। সেই লক্ষ্যে বিশ্ববিখ্যাত ফোকলোরবিদ ও আমেরিকার ফোকলোর গবেষক হেনরি গ্লাসিকে দিয়ে নিজের বাড়িতে উদ্বোধন করান একটি ‘লোকশিল্প সংগ্রহশালা’। কিন্তু বিধি বাম, ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের ৪ মার্চ মোহাম্মদ সাইদুর আকস্মিকভাবে প্রাণ হারান। সম্প্রতি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তৎপরতায় বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের তত্ত্বাবধানে স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান পুনঃসংস্কারের কার্যক্রম চলছে। আমাদের বিশ্বাস, মোহাম্মদ সাইদুরের নামে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের ফোকলোরের বিকাশ ও বিস্তারে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।
লেখক : লোক গবেষক।

সাঈদুর

বাংলাদেশের নকশী শিকা

মোহাম্মদ সাইদুর

প্রাক কথন
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী লোকায়ত কারু ও চারু শিল্প পর্যায়ে বিশেষ বিশেষ কয়েকটি কারু কৃতির প্রতি দেশী-বিদেশী পন্ডিত ও গবেষকদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হলেও এখন পর্যন্ত বাংলার অসংখ্য ঐতিহ্যবাহী কারুকৃতি, পন্ডিত গবেষক ও শিল্প রসিকদের দৃষ্টির আড়ালেই রয়ে গেছে অথবা গবেষকরা এর প্রতি তেমন কোন গুরুত্বই আরোপ করেননি। ঐতিহ্যবাহী এমনি সব শিল্প সামগ্রির আমার নাম করতে পারি-বাংলার হাঁড়ি-কলসী ও সরার বিচিত্র গড়ন, – রূপ এবং আকৃতিগত শিল্প, লাক্ষা-শিল্প, কড়ির কারুকাজ,- কড়ি শিল্প, মাছের কাঁটা, পুঁতির বিচিত্রধর্মী কারু কাজ – পুঁতি শিল্প, ঝিনুক শিল্প, কাগজ কাটা শিল্প, ও আঁশের কারু-কাজ, পাখির পালক বা পাখনার কারুকাজ, ছাচ-শিল্প, নকশী পিঠার ছাঁচ শিল্প, শিংজাত শিল্প, চামড়াজাত শিল্প, রন্ধন শিল্প, গিঁট ও বুনটের কারুকাজ, পাখির খাঁচা ও পাখি ধরার বিভিন্ন শ্রেণীর ফাঁদ, দৈহিক সাজ-সজ্জা, গৃহ সজ্জা, উৎসবের পোষাক-আশাক, বাংলার মেয়েদের কেশবিন্যাস, দেশীয় কৃষি যন্ত্রপাতি, লৌকিক যানবাহন, শন ও বাঁশের কারুকাজ, পশমের কাজ, বাঙালির পোষাক শিল্প, বাঁশ বেতের বিচিত্র আকৃতিগত পাত্র শিল্প, প্রসাধন শিল্প, লক্ষীর ঝাঁপি ও ‘শিকা শিল্পের’ নাম করা যায়। এসব শিল্প সামগ্রিতে একদিকে যেমন রয়েছে বাঙালির হাজার হাজার বছরের ধ্যান ধারনা ও শিল্প ভাবনার ছাপ, অপরদিকে প্রতিটি শিল্পেই রয়েছে বাঙালির হাজার বছরের শিল্প রুচির স্বাতন্ত্র মহিমার উজ্জ্বল প্রজ্ঞাপন। এখানে সামগ্রিক শিল্প পর্যায় থেকে আজ আমাদের আলোচ্য বাঙালির রমণীয় শিল্প বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ‘শিকা শিল্প’।
শিকার উদ্ভব ও বিকাশ
বাংলাদেশে আজ আমরা শিকা হিসেবে যে শিল্পটি দেখছি এর উৎস ও উদ্ভবকাল সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব নয়-কারণ প্রাক কথনেই বলা হয়েছে যে শিকা শিল্পটি নিয়ে আজ পর্যন্ত তেমন কোন আলোচনা ও গবেষণা হয়নি-যার ফলে এর উদ্ভবের কাল নিয়ে আমাদেরই চিন্তা-ভাবনা করতে হচ্ছে। এ বিষয়ে আমাদের যতদূর ধারণা -মানব সভ্যতার আদি যাত্রা পর্বেই এর উদ্ভব হয়েছিলো। কারণ অরণ্যচারী মানব তাদের সারাদিনের আহরিত খাদ্যবস্তু-ব্যবহারের পর উদ্বৃত্ত অংশ সংরক্ষণের জন্যে হয়তো লতা-পাতায় বেঁধে কোন বৃক্ষের শাখায় ঝুলিয়ে রাখতেন। এ থেকে একদিকে সংরক্ষিত খাদ্যাংশ জন্তু জানোয়ার, বন্য পাখি ও কীট পতঙ্গের হাত থেকে রেহাই পেতো, তেমনি অপর দিকে বাইরের মানব মানবীও তা সহজে গ্রহণ করতে সমর্থ হতো না। এমনি করেই বন্য লতা-পাতা দিয়ে আদিম মানবের মধ্যে বিভিন্ন খাদ্য ও ব্যবহার্য সামগ্রী সংরক্ষণের ঝুলানো পদ্ধতি থেকেই মানব সভ্যতার প্রথম স্তরেই হয়তো শিকা জাতীয় সামগ্রীর উদ্ভব হয়েছিল পরবর্তী পর্যায়ে মানুষের ক্রম বিবর্তন ও বিকাশে এ শিকাই পর্যায়ক্রমে উন্নত শিকায় বিকশিত হয়েছে বলে আমরা একটি প্রাথমিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি।
শিকা তৈরির উপকরণ
আজ আমরা গৃহে ব্যবহারগত যে শিকা শিল্পের সংগে পরিচিত অর্থ্যাৎ নকশী শিকা তৈরিতে যেসব উপাদান – উপকরণ ব্যবহার করা হয় -তার একমাত্র প্রধান উপকরণ পাট। এর উপযোগী উপকরণ হিসেবে থাকে পুরাতন শাড়ির পাড় থেকে তোলা বিভিন্ন রঙের সুতা, বাঁশের ফলি-কঞ্চি, সুতলী, কড়ি, পোড়ামাটির গুটি, আস্ত সুপারী, কাচের মার্বেল, বড়ই বীচি, খেজুর বীচি, হাঁস-কবুতর ও ময়ুরের পালক, রঙিন কাগজের টুকরো, ন্যাকড়া,শন, ঝিনুক কড়ি, সরিষা শঙ্খ, হাতের চুরি, বেত-এসব দ্রব্যাদিই সাধারণত শিকা শিল্পের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে।
তৈরি পদ্ধতি
নকশী শিকা বাংলাদেশে সর্বত্রই প্রতিটি গ্রাম এলাকার গ্রামীণ মহিলারাই তৈরি করে থাকেন। এ তৈরি পদ্ধতিটির কৌশল পারিবারিক ঐতিহ্য সূত্রে মেয়েরা কিশোরী বয়সেই দাদী-নানী ও মা-খালাদেও কাছ থেকে শিখেন। শিকাটি তৈরির আগে – যে পাত্রের জন্য শিকা তার আকৃতি অনুযায়ী প্রথমে কাঁচামাল – অথ্যাৎ উৎকৃষ্টমানের সাদা-পাট, পুরানো কাপড়ের পাড়ের সুতা, পুরাতন রঙ্গিন শাড়ির পাড়, সুই, বেত, বাঁশের কঞ্চি ইত্যাদি যোগাড়ের পালা। সব যোগাড় হয়ে গেলে এবার তৈরির পালা। প্রথমে একগুচ্ছ পাটকে বাঁ হাতে নিয়ে পাটের গুচ্ছটির ঠিক মাঝামাঝি অংশ রঙ্গিন সুতার ঘন প্যাঁচ দিয়ে দিয়ে দুই ইঞ্চিরমত জায়গা ভরাট করার পর, ভরাট অংশটি বাঁকিয়ে একটি চিমটার উপরের আকৃতি দেয়া হয়। এবার সেই চিমটাকৃতি অংশে আলাদা সুতার দড়ি লাগিয়ে ঘরের আকৃতি দেয়া হয়। এবার সেই চিমটাকৃতি অংশে আলাদা সুতার দড়ি লাগিয়ে ঘরের খুঁটি বা আড়ের বাঁশে ঝুলিয়ে নিয়ে এক এক করে প্রয়োজনীয় আকৃতি অনুযায়ী বিভিন্ন ডাল বা শাখায় বুনট করা হয়। এ শাখা বা বুনট প্রক্রিয়াটি একটি হয় চুলের বিনুনীর মত, আবার অন্যটি হয় প্যাঁচ দেয়া পাকানো দড়ির মত। এমনি করে একের পর এক শাখা প্রশাখা ও শিল্পীর দক্ষতা অনুযায়ী গিঁট ও নকশায় শিকাটি সমাপ্ত করা হয়। বুনটের বেলায় অনেক ক্ষেত্রে একটি শিকায় একজন শিল্পীই নয় দু’তিন জন শিল্পীও একত্রে বুনট করে থাকেন। বুনটের সময় শিল্পীর প্রধান কৃতি হচ্ছে বিভিন্ন শ্রেণীর গিঁট, বুনট ও পাকের মধ্যে। শিকার গিঁটের ও অসংখ্য নাম এবং নকশা রয়েছে যেমন- টেহা গিড়, কড়ি গিড়, ফুল কলি গিড়, বুবি গিড়, কদম ফুলি গিড়, এমনি অসংখ্য নকশানুযায়ী নাম। এমনি বুনটেরও নাম রয়েছে যেমন- বেনীবাইন, দরি বাইন, তিন প্যাঁচি বেনী, চার প্যাঁচি বেনী, পাঁচ প্যাঁচি বেনী ইত্যাদি।
শিকা একটি গৃহগত শিল্প
সাধারণত খাবার দ্রব্যাদি ও অন্যান্য গৃহজাত সামগ্রী সংগ্রহ ও সংরক্ষণের অধার হিসেবেই শিকার প্রয়োজন হলেও বাঙালী রমনীর মন মানসিকতায় সাদা-মাটা এ বস্তুটিই গৃহ সজ্জায়ও রুচির দ্যোতনায় প্রকাশ পেয়েছে। এই মানসিকতা ও রুচির দ্যোতনার দিকটি উদঘাটন করতে হলে আমাদের যেতে হবে আবহমান বাঙলা, বাঙালি ও বাঙলার বিচিত্র প্রকৃতি, রূপ, রস ও বিস্তৃত পরিবেশের কাছে। যে বিস্তৃত পরিবেশে – উঁচু টিলার উপর ঘর, চারদিকে ঢালু চাল, প্রশস্থ আঙ্গিনা, ঘন আম-জাম, তাল-তমাল, ঝোঁপ-ঝাড়, ছায়া ঘেরা যে গৃহ , এ গৃহকে অবলম্বন করেই পুরুষাণুক্রমিক ছিল বাঙালির আকর্ষণ।
এ আকর্ষণ থেকেই এ গৃহকে অবলম্বন করেই ছিল বাঙালির ধ্যান-ধারণা সামগ্রিক চিন্তা ও কর্ম যার ফলে এখানেই সঞ্চিত করেছিল বাঙালি নারী-পুরুষ তাদের কামনা-বাসনা ও কল্পনার সামগ্রী। এসব সামগ্রিতেই আত্মপ্রকাশ করেছিল বাঙালি রমনীয় কল্পনা, বিশ্বাস, আচার, সংস্কার ও সামগ্রিক রূপ-রস। বাঙালির বিস্তৃত পরিবেশ ছেড়ে সেখানেই শিল্প এসে ঘরের আঙ্গিনায় পা মিলিয়েছিল আর সেখানেই জন্ম হয়েছিল চলতি শিল্পের প্রাণ প্রতিষ্ঠা। শিল্প এখানে যে রূপ ও রস নিয়ে প্রাত্যহিক জীবনের নিত্য ব্যবহারের প্রতিটি জিনিসের মধ্যে প্রবিষ্ট হয়েছিল তারই ফসল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল- লোকায়ত গৃহশিল্প। আমাদের আলোচ্য শিকা শিল্পটি ও এর ব্যত্যয় নয়। যার ফলে আমার এ শিল্পটিকে একান্তই গৃহগত ও মেয়েলী শিল্প হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। বার বার গৃহগত শিল্প বলছি এ জন্যই যে-শিকা শুধু বুনটের পারি পাট্যেই নয়-এর আর একটি ব্যবহারগত দিক রয়েছে-যা দিয়ে বাঙালি রমনী তার স্বপ্নের ও কামনা বাসনার আবাস এ গৃহটিকে সাধ্যানুযায়ী শৈল্পিকরূপে সাজিয়ে নিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে শিকা গৃহসজ্জার উপকরণ শিল্প হিসেবেই চিহ্নিত হতে পারে। এ বিষয়ে অনেকেই হয়তো শিকা দিয়ে গৃহ সজ্জা দেখেছেন- তবে এ ক্ষেত্রে আমি আমার দুটি বাস্তব অভিজ্ঞতার প্রসংগ এখানে টেনে আনছি।
দুটি অভিজ্ঞতার কথা
প্রথম অভিজ্ঞতা : খ্রিস্টাব্দ ১৯৮৪ সাল। বাংলা একাডেমীর হয়ে গ্রাম সমীক্ষা করতে গিয়েছিলাম-বর্তমান নড়াইল জেলার কালিয়া থানার কালাবাড়িয়া গ্রামে। সমীক্ষার এক পর্যায়ে সে গ্রামেরই বিশিষ্ট ধনী-মানিব্যাক্তি মাহমুদ সাহেবদের বাড়ির ছনে ছাউয়া আট চালা ঘরটির ভেতরে যাই। মাহমুদ সাহেবের বৃদ্ধ মা সে ঘরে নিকানো উঠোনে মাদুর পেতে বসতে দিলেন। আমি বসে ঘরের ভেতরের চারপাশ দেখতে লাগলাম, – ঘরের দক্ষিণ অংশে মোটা কাঠের পাইল – এ মোটা দড়ির বুনটের শিকায় বড় বড় মাটির মটকা থরে থরে ঝুলানো। প্রত্যেকটি শিকার বিন্যাস একই প্রকার। নিচে বড় মাটির মটকা পরেরটি একটু ছোট এবং পরেরটি আরো ছোট এভাবে ক্রমান্বয়ে এক সারিতে সাজানো -সাতটি শিকায় কমপক্ষে পঁয়ত্রিশটি মটকা সাজানো। এগুলোতে বিভিন্ন জাতের বীজ ধান রাখা আছে। উত্তর দিকের পাইলে-একটি বাঁশের টানায় ঝুলানো আছে পঞ্চাশটি শিকা। এতে ছোট বড় আকৃতির প্রায় শতাধিক কলসী থরে থরে সাজানো রয়েছে। এসব কলসীগুলো কোন কোনটিতে বিভিন্ন পদের চাল, ডাল রাখা। পশ্চিম দিকের দরজার একপাশ থেকে ঘরের কোন অবধি অপর একটি বাঁশের পাইলে-বিচিত্র ধরনের বিশটি শিকায় কমপক্ষে কয়েক ডজন চিনামাটির প্লেট, ঘটি, বাটি রয়েছে। দরজার অপরদিকে রয়েছে বিভিন্ন প্রকার শিশি, বোতল, বৈয়াম ঝুলানো পঁচিশটি, বিচিত্র ধরনের নকশাযুক্ত শিকা। ঘরের দক্ষিণ অংশের মাঝামাঝি বিছানাপত্র রাখার জন্যে পাটের তৈরি-রঙ্গিন ঝালরযুক্ত একটি বড় ফুল চাং।
এখানেই শেষ নয়, ঘরের মধ্যের পালা যা তাদের আঞ্চলিক শব্দে “মধুপালা” নামে প্রচলিত তার পাশে ঝুলানো আছে কড়ি ও রঙ্গিনসুতার নকশায় সাজানো একটি লক্ষী শিকা। আজ শিকা বিষয়ক আলোচনা করতে গিয়ে সাধারণ শিকা ও হাঁড়ি পাতিল দিয়ে সাঝানো এ ঘরটি যেন আমার চোখে মাটির বিচিত্র হাঁড়ি-পাতিল ও শিকার একটি পূর্ণাঙ্গ মিউজিয়ার রূপে ফুটে উঠছে।
শুধু কালাবাড়িয়ার মাহমুদ সাহেবের বাড়িই নয়, ছোঠ বেলায় আমার দাদীর ঘরেও এমনি শিকা ঝুলিয়ে রাখতে দেখেছি। সে সময় আমার মাকেও দেখতম তুচ্ছ একটি শিশি বোতল ঝুলিয়ে রাখার জন্য কত আন্তরিক দরদ দিয়ে বিভিন্ন আকার আকৃতির শিশি বোতলের শিকা তৈরি করছে। এখনো আমার মনে আছে মা ও দাদীর সেই সংগ্রহ ভান্ডার থেকে প্রায় সত্তুরটির মদত বিভিন্ন ধরনের শিকা শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সাহেবের বাসায় এনে জমা করেছিলাম।
আবার কালাবাড়িয়ার মাহমুদ সাহেবের কথায় ফিরে আসি। এই কিছুদিন পূর্বে খোঁজ নিয়ে জেনেছি মাহমুদ সাহেবের সেই ঘরটি আর নেই। সে ভিটেতেই এখন একটি ইমারত শোভা পাচ্ছে। ইমারতে তো আর মাটির হাঁড়ি-পাতিল বা পাটের শিকা রাখার কথা নয়। শুনেছি সেখানে এখন বিদ্যুৎও চলে গেছে, সুতরাং খাদ্য সামগ্রী রাখার জন্যে একটি ফ্রীজও হয়তো সে ঘরে ঠাঁই করে নিয়েছে।
দ্বিতীয় অভিজ্ঞতাটি আমার দেখা নয়-শোনা। তখন আমি গ্রামের বাড়ি নিচু ক্লাসে পড়ি। একদিন দেখলাম পাশের বাড়ির উঠতি এক ধনি ব্যক্তির বাড়িতে ইট আসছে-অর্থ্যাৎ ছনের ঘরটি ভেঙে সেখানে দালান করা হবে। কিন্তু এতে বাদ সাজছেন ঐ ধনী ব্যক্তির স্ত্রী। তিনি কোন মতেই তার ভিটার ঘর ভাংতে দেবেন না। কারণ একেতো পূর্ব পুরুষের ঘর, ঘরে বোঝাই কয় পুরুষের জমানো শিকা-কলসী। এখন দালান হলে তিনি তার এ সাধের শিকাগুলো টানাবেন কোথায়? আর হাঁড়ি-কলসিগুলোই বা রাখবেন কোথায়? এ নিয়ে দীর্ঘ দিন তাদের স্বামী-স্ত্রীর বচ্সা। শেষ পর্যন্ত সে ব্যক্তি চার পাশে ইঁটের দেয়াল গেঁথে উপরে টিন সেড দিয়ে উভয়কূল রক্ষা করলেন।
নকশী শিকার ব্যবহারগত শ্রেণি
বাংলাদেশে অসংখ্য শ্রেণীর শিকার প্রচলন রয়েছে। এর মাধ্যে আবার আছে ব্যবহারগত শ্রেণি যেমন :
পাতিল রাখার শিকা, কলসী রাখার শিকা, কাঁথা/বালিশ রাখার শিকা, বই/পত্র রাখার শিকা, আয়না-কাঁকই রাখার শিকা, নকশী হাড়ির শিকা, বৈয়াম রাখার শিকা, বাসনপত্র রাখার শিকা, শিশি/বেতাল রাখার শিকা, মাটির ঝাড় রাখার শিকা, পাখা রাখার শিকা, আলনা শিকা, খিলাই রাখার শিকা, ঘরের শোভা বর্ধনের ঝাড় শিকা, ধামা রাখার শিকা, দোলনা শিকা, বিছানাপত্র রাখার শিকা, বাঁক শিকা, ঝালড় শিকা, দেয়ালী শিকা, হিংলা শিকা ব্যবহারগত শ্রেণীর এ নামগুলোই বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য।
নকশী শিকার নকশার আঞ্চলিক নাম
নকশার নাম ব্যবহার সংগ্রহীত অঞ্চল
১। চাদরের বেড় বড় পাত্র ও বাসনপত্র রাখার শিকা ময়মনসিংহ
২। উল্টা বেড়ী একত্রে গ্লাস/বাসন রাখার শিকা
৩। সরফুশ বেতের ধান/চাল রাখার পাত্র
৪। ফুলমালা বাসন/পত্র রাখার
৫। লাটিম শিকা বড় থেকে ছোট পাত্র রাখারব্রাহ্মণবাড়িয়া
৬। ফুলঝুড়ি ময়মনসিংহ
৭। আওলা আংটি
৮। আংটি বেড়
৯। পাতা শিকা বড় বাটি/ঘটি রাখার ব্রহ্মণবাড়িয়া
১০। ইচাঁর ঠ্যাং বৈয়াম রাখার
১১। বেলকী বাইন শিশি/বোতল রাখার শিকা ময়মনসিংহ
১২। মাছের কাঁটা ঘটি/বাটি রাখার
১৩। চমক পাটি কলসী/পাতিল রাখার
১৪। চিলের চোখ হাঁড়ি/পাতিল রাখার
১৫। জয়ফুল মালা বৈয়াম/বাটি
১৬। ঝালর বেড় বাসন/পত্র রাখার
১৭। রসুন দানা বড়পাত্র ও পাতিল
১৮। বুবি শিকা
১৯। আনারসি
২০। কটির ঘর
২১। বড়ই ফুল
২২। মাকড়ের ঘর কিশোরগঞ্জ
২৩। ছিহল বেড়
২৪। ঝিংগা বেড়ি
২৫। বলদের চোখ
২৬। হরু ফুল
২৭। বেঁট ফুল
২৮। কাঁকই বেড়
২৯। কাউয়্যার ঠ্যাং
৩০। মারুয়া গিঁট্যা
৩১। কাঁঠালী নরসিংদী
৩২। গান্জা
৩৩। জোথ্
৩৪। ফুলটুংগী
৩৫। খিলাইটুংগী
৩৬। খিলাইদানী
৩৭। ময়ুর পেখম
৩৮। পাংখা দানী ঢাকা
৩৯। ফুল মাচাং
৪০। জালি বাইন
৪১। বান্দর লড়ি
৪২। কাঞ্চন সুন্দরী
৪৩। উড়ি ফুল
৪৪। চিলা বাঁছা
৪৫। বেতা বাইন
৪৬। ঝুপরী টানা
৪৭। হাঁপ বেড়ি
৪৮। কেঞ্চিবেড়ি
৪৯। উল্টা বেড়ি
৫০। চাইর গুচা ফুলপুর, ময়মনসিংহ
৫১। গরুর দানহা
৫২। ডালিম ফুল
৫৩। লারের শিকা
৫৪। জাওলা বেড়ি
৫৫। তলি ছাড়া
৫৬। বাজু শিকা
৫৭। বলাকতলী
৫৮। জিলাপির প্যাঁচ
৫৯। ঝাঁপড়ি
৬০। আলহা দানহা
৬১। চিলা বাঁহা
৬২। লাউয়ের আলী ব্রহ্মণবাড়িয়া
৬৩। ঘাষড়ি ছিকা
৬৪। বলাক বেড়ি
৬৫। কদম ফুলি
৬৬। কঞ্চন বেড়ি কিশোরগঞ্জ
৬৭। জোড় বেড়ি
৬৮। মাকড়শী
৬৯। পাংখা বেড়ী
৭০। ফুল ঝাড়
৭১। মাদারফুলি
৭২। বালুক ঝাঁপা
৭৩। সাতেশ্বরী
৭৪। কানফুলি
৭৫। কাউয়্যা কাঠি
৭৬। আঠ ঘড়ি
৭৭। গোলক বেড় শিবপুর, নরসিংদী
৭৮। কড়ি দানা
৭৯। আম ঝুপি
৮০। পঞ্চমুখী কোটালীপাড়া
৮১। ত্রিমুখী গোপালগঞ্জ
৮২। সপ্তমুখী
৮৩। চান্দা
৮৪। বুচকা
৮৫। বাঁওটি
৮৬। কাঠি শিকা
৮৭। বেলফুলি
৮৮। ধান্দাবেড়ী
৮৯। নাহা দড়ি
৯০। মুখ বেড়
৯১। ফুল চাং
৯২। এক চোখা গুলি
৯৩। তিন চোখা গুলি
৯৪। সাত চোখা গুলি
৯৫। নয় চোখা গুলি
৯৬। পল বেড়
৯৭। ডাউক ফান্দ
৯৮। ডালিম শিকা
৯৯। কইতর ছতি
১০০। বাঁউক ঝোল
১০১। লক্ষী ঝাড়
১০২। মাগুন্দা বেড় ইত্যাদি

সত্তর দশকের চমক
বাংলাদেশে নকশী শিকা সাধারণত নিজেদের প্রযোজন ও ব্যবহার এবং খাদ্য সামগ্রী ও গৃহগত বস্তু সামগ্রী নিরাপদে রাখার আধার হিসেবেই আবহমানকাল থেকে এর ব্যবহার চলে আসছে। কিন্তু খুব সম্ভবত ষাটের দশকে এর কিছু শিকা’র শিল্প কৌশলে আকৃষ্ট হয়ে কিছু বিদেশী-বিদেশিনী পর্যটক বাঙালির একান্ত নিজস্ব এ শিল্পটিকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিয়ে যান। সে থেকে দেখা যায় আমাদের শিকা শিল্পটির বিদেশে একটি বিশেষ আবেদন, রয়েছে। সে আবেদন সৌখিনতা থেকে হোক বা প্রয়োজনের তাগিদেই হোক এ দেশ থেকে বিদেশে ব্যবসায়িক ভিত্তিতে বিভিন্ন প্রকার শিকা রপ্তানী হতে থাকে। যত দূর সম্ভব এ রপ্তানী প্রক্রিয়ায় সত্তুরের দশক একটি সমাজ উন্নয়ন সংস্থা করিতাস প্রথমে এগিয়ে আসেন, এদের পর পরই কারিকা, কুমুদিনী, ব্র্যাক, শৈঁতুলী নামের কয়েকটি সংস্থা শিকা রপ্তানী শুরু করে। কিন্তু শিকা রপ্তানীর এ হুজুগ এক দশকের বেশী স্থায়ীত্ব লাভ করেনি। নব্বইয়ের দশক থেকেই বলতে গেলে এ রপ্তানী ও তৈরির খাত শতাংশের পাঁচের কোটায় নেমে আসে। এটি কাদের এবং কি কারণে হয়েছে তা এখনো অজ্ঞাত।
যাক সে কথা। কারণ বাঙলার এ শিল্পটি রপ্তানীর জন্যে উৎকর্ষতা লাভ করেনি এর মূল লক্ষ্য ছিল বাঙালির নিজস্ব শিল্পরস বোধ বা নিজের ঘরের শোভা বর্ধন করবে এবং দানের মাধ্যমে আপনাজনদের কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনাই ছিল যার প্রধান লক্ষ্য। সে ক্ষেত্রে এ রপ্তানী প্রক্রিয়াটি আমাদের জন্য সুফল নয় বরং কুফলই বয়ে নিয়ে আসছিল।
জন জীবনে শিকা’র প্রভাব
যে কোন শিল্প সামগ্রী জন জীবনে মিশে গেলে সাধারণ মানুষ একে নানা ক্ষেত্রে ব্যবহার করে থাকেন। আমাদের শিকা শিল্পটিও জনজীবনের সঙ্গে যে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে তার প্রমাণ পাই আমাদের কয়েকটি প্রাচীন রোক সংগীতে এই শিকা’র অনুপ্রবেশ থেকে। এখানে ক’টি প্রাচীন লোক সংগীতের ছত্র উদ্ধৃত করা হলো –
বাঘাই শিন্নীর গান
-ছিক্কা লড়ে ছিক্কা লড়ে
ঝপ ঝপাইয়া টেহা পড়ে
একটি টেহা পাইলাম রে
বাইন্যা বাড়ি গেলামরে .. . . .।।

বাইদ্যানীর গান
আমার বাড়ি যাইও বন্ধু
এই না বরা বর।
পূব দোয়াইরা বাড়িরে বন্ধু
উত্তর দোয়ারিয়া ঘর। ।
আমার বাড়ি গেলেরে বন্ধু
খাইতে দিবাম শরবীকলা
গামছা বান্ধা দৈ।
আরো দিবাম শিক্যায় তোলা
বিন্নী ধানের খৈ . . . ।।

উল্টা বাউলের গীত
হা-হা-একি আচানক কারবার
তালগাছে লোলের পনা
বগা ধইরা খায়,
ইন্দুরে যে বিলাই মারলো
এর কি হইলো উপায়. . . . ।।

এখানে উল্টা বাউলের গীতে “উন্দুরে বিলাই মারলো”
এর অর্থ-শিকা’র নিচে বিড়াল বসা ছিল উপর দিকে ইঁদুরে শিকা কেটে দেয়ায়-শিকা’র তৈজস পত্রের চাপে পরে বিড়াল মারা যায়। আমাদের লোক সাহিত্য-লোক সংগীতের পরতে পরতে শিকা সম্পর্কে এমনি উল্লেখ আছে।

উপসংহার
এ আলোচনার উপসংহার টানতে গিয়ে ‘শিকা’ সম্পর্কে আমি আশা ও নিরাশা দুটোই পোষণ করছি। আশা পোষণ করছি এক্ষেত্রেই যে যতদিন গ্রাম বাংলা এবং বাঙলার রমনীকূল থাকবে ততদিন ‘শিকা’ ও থাকবে। কিন্তু শিকার যে বৈচিত্রময় নকশা যেভাবে হারিয়ে যাচ্ছে তাকে রোধ করা সম্ভব নয়। কাজেই অচিরেই শিকা নয় – বরং শিকার বৈচিত্রময় নকশাগুলো জাতীয় পর্যায়ে সংরক্ষণের আবেদন জানাচ্ছি।

নিসার হোসেন এদেশের লোকসমাজের ওপর নির্ভর করে তাদের রুচি ও চাহিদামাফিক শিল্প সামগ্রী নির্মাণের যে ঐতিহ্যগুলো সহ¯্র বছর আগেই গড়ে উঠেছে এবং আজও যে সৃজন প্রক্রিয়াগুলো পরম্পরার মধ্য দিয়ে চর্চিত হয়ে চলেছে তাদের মধ্যে মৃৎশিল্পই সর্বপ্রাচীন এবং তা মানের দিক থেকেও সর্বশ্রেষ্ঠদেরই পর্যায়ভুক্ত। আমাদের ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পের এই মূল্যায়ন শুধু গবেষকদের বা পন্ডিতদেরই নয়; সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এবং শ্রেষ্ঠ মূল্যায়নকারী যে আমজনতা (যাদের পৃষ্ঠপোষকতায় চরম প্রতিকূলতার মধ্যেও এ ঐতিহ্যটি অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী শিল্পের তুলনায় মাথা যথেষ্ঠ উঁচু করেই টিকে আছে), এ তাদেরই মূল্যায়ন। মৃৎশিল্পীদের মধ্যে যারা মূর্তি নির্মাণে দক্ষ বা ভাস্কর্যধর্মী কাজে পারদর্শী তারা সাধারণ মানুষের কাছে 'গুণরাজ' নামে পরিচিত। এর কারণ সম্ভবত এই যে, এ ধরনের কাজে নৃত্যকলা, চিত্রকলা, স্থাপত্যকলা, অলঙ্কার নির্মাণকলাসহ অন্য কলাজ্ঞানও প্রয়োগ করতে হয়। যে কোনো শিল্প সামগ্রী নির্মাণের ক্ষমতা অবশ্যই একটি গুণবিশেষ; কিন্তু সকল গুণের শ্রেষ্ঠ গুণটি যে কুম্ভকার সম্প্রদায়ের একচ্ছত্র দখলে চলে গেছে সেই বিষয়টি আমরা আমজনতা প্রদত্ত এই 'গুণরাজ' উপাধিটির মাধ্যমেই নিশ্চিত হতে পেরেছি। তবে মূর্তি বা ভাস্কর্য নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় গুণটুকু রপ্ত করার ইতিহাস সম্ভবত এতটা প্রাচীন নয়, যতটা প্রাচীন তাদের হাঁড়ি-কুড়ি-ঘট-কলসি নির্মাণের ইতিহাস। কেননা প্রাচীনকাল থেকেই এই উপমহাদেশের মৃৎশিল্পীরা কুম্ভকার নামেই পরিচিত, যার অর্থ ঘট বা কলসি নির্মাতা। কুম্ভকাররাও বিশ্বাস করেন, “শিবের বিয়েতে যখন ঘটের প্রয়োজন হলো, তখন শিব তার রুদ্রাক্ষের মালা থেকে একটি রুদ্রাক্ষ নিয়ে তাই দিয়ে মানুষ তৈরি করলেন, ঘট তৈরি করে দেওয়ার জন্য...”। সেই ঘট বা কুম্ভ নির্মাতাই কুম্ভকার। অর্থাৎ কুম্ভকারই প্রথম মানুষ বা প্রথম মানুষই কুম্ভকার। সুতরাং এরা মৃণ¥য় মূর্তি নির্মাণের কাজে নিশ্চয়ই যুক্ত হয়েছেন এরও অনেক পরে, কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে। ধারণা করা হয় যে, পাথর বা কাঠ দিয়ে দীর্ঘস্থায়ী মূর্তি নির্মাণের যে প্রাচীন ধারাটি এ অঞ্চলে বহমান ছিল, তা মূর্তি উপাসনাবিরোধী শক্তির দ্বারা আক্রান্ত হতে শুরু করলে ক্ষণস্থায়ী উপাদান দিয়ে দ্রুত মূর্তি নির্মাণ এবং নির্ধারিত আচার শেষে তা দ্রুত বিলুপ্ত (বিসর্জন) করে ফেলার রীতি যখন চালু হলো, তখন কাঁচা মাটিকেই এ ধরনের মূর্তি নির্মাণের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত বলে বিবেচনা করা হলো। আর সেই সুযোগে এই বাংলার সূত্রধর আর ভাস্করদের পেছনে ফেলে মাটি নিয়ে যাদের কারবার, সেই কুম্ভকাররাই শ্রেষ্ঠ শিল্পীর মর্যাদাপূর্ণ আসনটি দখল করে নিল। পশ্চিমবাংলার বেশিরভাগ অঞ্চলে এ আসনটি এখনও সূত্রধর এবং ভাস্করদের দখলেই রয়ে গেছে। বাংলাদেশের কুম্ভকাররা তাদের সহজাত শৈল্পিক প্রতিভার জোরে হাল আমলে স্বর্ণকারদের পেশাটিও কব্জা করে নিচ্ছেন। সব রকম কলাকৌশলকে রপ্ত করে নেওয়ার এই সহজাত ক্ষমতাটি রয়েছে বলেই প্রবল প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়েও বহু কুম্ভকার পরিবার নতুন যুগের চাহিদার সঙ্গে বনিবনা করে নিয়ে আজও মৃৎশিল্পকে আঁকড়ে ধরে যথেষ্ট সচ্ছলভাবেই জীবনযাপন করছেন। গত শতকের আশির দশকের প্রথমভাগে নক্সাকেন্দ্র বিসিকের উদ্যোগে যে জরিপ চালানো হয় (যা বই আকারে 'বাংলার কারুপল্লী' নামে ১৯৮৫ সালে মুদ্রিত হয়েছে), তাতে বাংলাদেশের প্রায় ৭০-৭৫ শতাংশ লোকশিল্পী ও কারুশিল্পী পরিবারকে তালিকাভুক্ত করা সম্ভব হয়েছিল বলে মনে করা হয়। সেই জরিপে মৃৎশিল্পীদের ৬৮০টি গ্রাম, পল্লী বা পাড়াকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছিল, যেখানে ১৫ হাজারেরও বেশি পরিবার সম্পূর্ণভাবে এই পেশার ওপর নির্ভর করেই জীবিকা নির্বাহ করছে। যদিও এই সংখ্যা ১৮৭২ সালের জরিপ থেকে পাওয়া সংখ্যার তুলনায় অনেক কম (১৮৭২-এর জরিপে পাওয়া সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৫-৪০ হাজার পরিবার; ২ লাখ ৮১ হাজার ৭৫৮ জন সদস্য)। সুতরাং উল্লিখিত পরিসংখ্যান দুটোর তুলনা করলে কুম্ভকারদের সার্বিক পরিস্থিতির ক্রমাবনতির একটা চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী শিল্পধারার সঙ্গে তুলনা করলে ওই ১৫ হাজার পরিবারের সংখ্যাটিকেও যথেষ্ট সন্তোষজনক সংখ্যা বলেই বিবেচনা করতে হয়। মৃৎশিল্পীদের ক্রমাগত সংখ্য া হ্রাসের কারণটি কিন্তু কেবল মৃৎশিল্পের চাহিদা কমে যাওয়ার সঙ্গেই যুক্ত নয়। তার চেয়ে অনেক বড় কারণ, যা কখনোই আলোচিত হয় না, তা হচ্ছে- যুগ যুগ ধরে হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার মৃৎশিল্পীর দেশত্যাগ। সেই ১৯৪৭-এর দেশভাগ, '৫২ সালের মুলাদি রায়ট, '৬৫-এর পাক-ভারত যুদ্ধ, '৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যা ইত্যাদি বিভিন্ন সময়ে অশুভ শক্তির উত্থানে ভীত হয়ে হিন্দু সম্প্রদায় ক্রমাগত দেশত্যাগ করে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা ইত্যাদি অঞ্চলে স্থায়ীভাবে চলে যাওয়ার কারণেও মৃৎশিল্পীদের সংখ্যা কমতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন কুম্ভকার পল্লীগুলোতে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, সেখানকার প্রায় অর্ধেক মৃৎশিল্পী আমাদের দেশ থেকে অভিবাসিত। এখানে বিশেষ একটি মৃৎ সামগ্রী নিয়ে আমার সমীক্ষা লব্ধ ধারণার কথা জানাচ্ছি- লক্ষ্মী পূজায় লক্ষ্মীসরা নামে পরিচিত যে মৃৎ সামগ্রীটি নির্মাণ করা হয় তার ক্রেতা প্রায় সম্পূর্ণভাবেই ফরিদপুর, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, ঢাকা এবং বিক্রমপুরের মানুষ। এর বাইরে কিছু ক্রেতার বসবাস বরিশাল, যশোর, টাঙ্গাইল, নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জ (তুলনামূলকভাবে খুবই অল্প); উল্লিখিত অঞ্চলগুলোয় যত সংখ্যক লক্ষ্মীসরা উৎপাদিত হয় তা মিলিতভাবে ৭০-৮০ হাজারের বেশি নয়। অথচ পশ্চিমবঙ্গে শুধু নদিয়ার তাহেরপুর গ্রামেই চিত্রিত সরার উৎপাদন সংখ্যা ১ লাখ ২০ হাজার! মনে রাখতে হবে, পশ্চিমবঙ্গেও এই সরা ক্রয় করেন কেবল পূর্ববঙ্গের উল্লিখিত অঞ্চল সমূহ থেকে অভিবাসিত হয়ে যাওয়া পরিবারগুলো এবং একটি পরিবার প্রতি বছর লক্ষ্মী পূজায় কেবল মাত্র একটি সরাই ক্রয় করে থাকে। তাহেরপুর ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের পানিহাটি, দত্তপুকুর, উল্টোডাঙ্গা, হাবরা সহ আরও অনেক অঞ্চলেই লক্ষ্মীসরা নির্মাণ করা হয়। সুতরাং দেশত্যাগ করে চলে যাওয়া এবং দেশে থেকে যাওয়া মৃৎশিল্পীদের সংখ্যা যদি একত্র করে দেখার সুযোগ থাকত, তাহলে বাংলাদেশে মৃৎশিল্পের বর্তমান অবস্থাকে রীতিমতো 'রমরমা'ই বলা যেত। আবার একথাও সত্য যে, ক্রেতা সাধারণের চাহিদা ও রুচিতে কিছু পরিবর্তন, জীবনযাপনের ধরন-ধারণ বদলে যাওয়া ইত্যাদি কারণে অতীতের অনেক উন্নত শিল্পমান সম্পন্ন মৃৎসামগ্রী যেমন এখন আর তৈরি হয় না, তেমনি একই কারণে অনেক নিম্নমানের মৃৎ পণ্যেও বাজার ছয়লাব হয়ে গেছে। তবু আশার কথা এই, আমাদের ঐতিহ্যবাহী লোক ও কারুশিল্পের উৎকৃষ্ট নিদর্শনগুলোর সঙ্গে ক্রেতা সাধারণকে পরিচয় করিয়ে দিতে গত শতকের আশির দশক থেকেই কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান (নকশা কেন্দ্র বিসিক, বাংলা একাডেমি, সোনারগাঁর লোকশিল্প সংগ্রহশালা এবং পরবর্তীকালে জাতীয় জাদুঘর ও ক্রাফ্ট কাউন্সিল) নিয়মিতভাবে মেলার আয়োজন ও শ্রেষ্ঠ কারুশিল্পী পুরস্কার প্রদান করে যাচ্ছে। আর একটি আশাপ্রদ ঘটনা এই যে, ওইসব মেলায় দূর-দূরান্ত থেকে বয়ে আনা লোকশিল্প ও কারুসামগ্রী যথেষ্ট উচ্চমূল্যে খুব দ্রুত বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। ঢাকার বড় বড় বুটিকগুলোতেও আজকাল সেই সব পণ্যই ক্রেতাদের বেশি আকৃষ্ট করছে, যেগুলোর আকৃতি এবং অলঙ্করণ আধুনিক হওয়া সত্ত্বেও আমাদের লোক ঐতিহ্যের কিছু বৈশিষ্ট্যকে মিশিয়ে নিতে পেরেছে (ঠিক যেমনটি ব্যান্ড সঙ্গীতের বেলাতেও লক্ষ করা গেছে)। এ ধরনের নবউদ্ভাবিত শিল্প-সামগ্রী ও কারুপণ্যের একটি বড় অংশই মৃৎশিল্প, যা আমাদের ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পের সেই আদি প্রসিদ্ধ কেন্দ্রগুলো থেকেই তৈরি হয়ে আসছে। এখানে যে বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষণীয় তা হচ্ছে- অতীতকাল থেকে যে অঞ্চলটি যে ধরনের তৈজস বা শিল্প সামগ্রী তৈরি করে খ্যাতি পেয়েছিল আজ শত শত বছর পর কলাকৌশলে, গড়ন ও অলঙ্করণে নানা রকম পরিবর্তন আসার পরও ওইসব কেন্দ্রই খ্যাতির শীর্ষে অবস্থান করছে। যেমন জেমস ফওন্স নর্টন ওয়াইজ (ঔধসবং ঋধহিং ঘড়ৎঃড়হ ডরংব) তার ১৮৮৩ সালে প্রকাশিত গ্রন্থ ‘ঘড়ঃবং ড়হ জবপবং, ঈধংঃবং ধহফ ঞৎধফবং ড়ভ ঊধংঃবৎহ ইবহমধষদ-এ লিখেছেন, 'গোটা পূর্ববঙ্গে ঢাকার রায়েরবাজারের কুমারদের কাজ প্রসিদ্ধ।... মাটির কাজের জন্য ত্রিপুরার বিজয়পুরও (বর্তমানে কুমিল্লার বিজয়পুর) প্রসিদ্ধ। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আজ প্রায় ১৩০ বছর পরও এ দেশে মরণচাঁদ পাল কিম্বা সুভাষ পালের মতো অতুলনীয় মৃৎশিল্পীদের ঠিকানা সেই রায়েরবাজারই (যদিও তাদের একজন পরলোকগত এবং একজন দেশত্যাগী। আর রায়েরবাজার অঞ্চলে এখন একটি কি দুটি মাত্র পরিবার মৃৎশিল্পে যুক্ত)। মৃৎশিল্পের প্রাচীন কেন্দ্র বিজয়পুরের আধুনিক মৃৎপাত্রের খ্যাতিও এখন দেশের সীমানা পেরিয়ে সুদূর ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত। ইংল্যান্ডে ভারতীয় পণ্যের প্রদর্শনী উপলক্ষে ১৮৮৮ সালে ত্রৈলক্যনাথ মুখোপাধ্যায় 'অৎঃ সধহঁভধপঃঁৎবং ড়ভ ওহফরধ' নামক যে গ্রন্থটি রচনা করেন, তাতে চিত্রিত মৃৎপাত্রের মধ্যে উৎকৃষ্ট হিসেবে বিবেচনা করে যে মৃৎপাত্রকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন তা হচ্ছে রাজশাহীর শখের হাঁড়ি। খুবই আশ্চর্যের বিষয়, আজ শতাধিক বছর পরও হাঁড়ি চিত্রণে শ্রেষ্ঠ শিল্পী ওই রাজশাহীরই সুশান্ত পাল। ২০০০ সালে বৃহদাকার মৃৎপাত্র 'মটকা' বা 'জালা' তৈরি করে যিনি শ্রেষ্ঠ কারুশিল্পী পদক লাভ করেছিলেন (জহর পাল) তিনি সেই স্মরণাতীতকাল থেকে জালা নির্মাণে প্রসিদ্ধ গ্রাম কার্ত্তিকপুরেরই সন্তান। এই কার্ত্তিকপুরকেই ফরিদপুরী রীতির লক্ষ্মীসরা নির্মাণের আদিকেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করে ১৯৮৪ সালে তোফায়েল আহমেদ এই গ্রামের হেরেম্ব পালকে শ্রেষ্ঠ সরাশিল্পী হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। সেই হেরেম্ব পালেরই পুত্র বিমল পাল এখনও কালে-ভদ্রে যে দু-একটি সরা আঁকেন তার তুলনা গোটা বাংলা অঞ্চলেই নেই। ঢাকার নবাবগঞ্জ-বান্দুরা অঞ্চলের জয়পাড়া নিকটবর্তী পালপাড়ার রঙবিলাসী পাল গত দু-তিন যুগ ধরে খুবই পাতলা, হালকা এবং নিখুঁত আকৃতির যে মৃৎপাত্রগুলো তৈরি করছেন তা নিঃসন্দেহে জয়পাড়ার মৃৎশিল্পের অতীত সুনামকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম। রঙবিলাসী পালের আঁকা সরাগুলো একদিকে যেমন সারা বাংলার একমাত্র চালচিত্র সমৃদ্ধ লক্ষ্মীসরা (ইদানীং অবশ্যই এই সরার অনুকরণে অন্য অঞ্চলেও কিছু নিম্নমানের সরাও হচ্ছে), তেমনি এই সরায় রঙ-রেখার চমৎকার প্রয়োগ দেখে দীনেশ চন্দ্র সেন এবং গুরুসদয় দত্তের সঙ্গে সহমত পোষণ করে স্বীকার করতেই হয় যে, আজও বাংলার রমণীরা চিত্রাঙ্কন দক্ষতায় পুরুষ শিল্পীদের সমতুল্য, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে আরও উত্তম। মৃৎপাত্র নির্মাণ এবং চিত্রণ- এই দুটো কাজেই নারী ও পুরুষরা সমানভাবে অংশগ্রহণ করেন কালিয়াকৈর, আশুলিয়া, ধামরাই, মানিকগঞ্জ, বিক্রমপুর, নবাবগঞ্জ, রাজবাড়ী, ভাঙ্গা, কার্ত্তিকপুর, সিড্ডা, গৈলা, স্বরূপকাঠি, চাউলাকাঠি ইত্যাদি অঞ্চলে। এসব অঞ্চলের চিত্রিত মৃৎপাত্রগুলো হচ্ছে লক্ষ্মীসরা, মনসাঘট, নাগঘট, লক্ষ্মীঘট, মঙ্গলঘট, এয়োসরা প্রভৃতি। এ ছাড়া নানা ধরনের চিত্রিত পুতুলগুলোতেও নারী মৃৎশিল্পীদের আঁকা-গড়ার দক্ষতা প্রকাশ পায় (বিশেষ করে রাজবাড়ী, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, মির্জাপুর, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চলে)। তবে ময়মনসিংহ অঞ্চলের টেপা পুতুলগুলোতে অঙ্কন দক্ষতার বিশেষ পরিচয় ধরা না পড়লেও দেহের গড়নের অন্তর্নিহিত জ্যামিতিকে অনুসরণ করে রূপের সংক্ষেপিত উপস্থাপনায় দৈনন্দিন জীবনের নানা কর্মকান্ডভিত্তিক দেহভঙ্গিগুলোকে (শিশু লালন-পালন, মসলা পেষা, চুল বাঁধা ইত্যাদি) কেবল আঙুলে টিপে অতিদ্রুত নিমার্ণ করে ফেলার মাধ্যে যে মুন্সিয়ানা ও রসবোধের পরিচয় পাওয়া যায়, তা এক কথায় অতুলনীয় বা বিস্ময়কর। একসময় ধারণা করা হয়েছিল, এ ধরনের টেপা পুতুল ক্রমেই লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এ ধারণাটিই সম্ভবত আংশিক সত্য, কেননা বেশকিছু বিষয়বস্তু তথা ভঙ্গি ও আয়োজন এখন আর টেপা পুতুলে দেখতে পাওয়া যায় না। হাতের কাজের মানকেও আর ততটা উৎকৃষ্ট বলা যায় না। তবু আশার কথা এই যে, আজও ঈদ, মহররম, দুর্গাপূজা আর পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে ময়মনসিংহ ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলগুলোতে ছোট-বড় যেসব মেলাগুলো হয় তাতে সাধারণ মানুষের জন্য প্লাস্টিকের পুতুলের তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যক টেপা পুতুলই দেখতে পাওয়া যায়। ক্রেতারাও কিন্তু ছাঁচে তৈরি প্লাস্টিকের পুতুলের মতো একচেহারার পুতুল থেকে যে কোনো একটি পুতুল তুলে নিয়েই সন্তুষ্ট হন না; বরং টেপা পুতুলগুলো প্রতিটি আলাদা আলাদাভাবে হাতে তৈরি হওয়ার কারণে প্রত্যেকটির মধ্যে যে কিঞ্চিৎ স্বাতন্ত্র্য তৈরি হয় তা ভালোভাবে পরখ করে, পছন্দমাফিক (বেশ কয়েকটি) বাছাই করে নেন। অনেক ক্ষেত্রে দক্ষ হাতের কাজ আকৃতিতে ছোট হলেও রসিক ক্রেতারা তা বেশি মূল্যে ক্রয় করতেও দ্বিধা বোধ করেন না। এই রসিক ক্রেতারাই আমজনতার লোকশিল্পকে এত রসালো ও হৃদয়গ্রাহী করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় অনুপ্রেরণার জোগান দিচ্ছেন। বাংলাদেশের মৃৎশিল্পের বহুকিছু নিয়ে আমরা যেমন এখনও আশাবাদী, তেমনি কিছু কিছু দিক এতটাই উদ্বেগজনক যে, ঠিক এই মুহূর্তে পর্যাপ্ত উদ্যোগ নেওয়া না হলে হাজার বছরে গড়ে ওঠা আমাদের মহামূল্যবান ঐতিহ্যের অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান চিরদিনের মতো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এই আশঙ্কার তালিকায় এ মুহূর্তে 'এসওএস' পর্যায়ে রয়েছে রাজশাহীর শখের হাঁড়ি, যা উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ ঐতিহ্য পোড়ামাটির ফলকচিত্রের মতোই করুন পরিণতি লাভ করবে। শখের হাঁড়ির ঐতিহ্যটি বিরাট অঞ্চলজুড়ে বিস্তার লাভ করেছিল। নওগাঁ, রাজশাহী এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে গড়ে ওঠা এ ঐতিহ্য যে খুবই প্রাচীন তার প্রমাণ আমরা নানাভাবে পেয়েছি। শখের হাঁড়ি শুধু লোক ঐতিহ্যই নয়, এ হচ্ছে সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্যর প্রতীক। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিনির্ভর লোকসমাজে লক্ষ্মী এবং সরস্বতীর যে জনপ্রিয়তা একসময় হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ সব সম্প্রদায়েই বিরাজ করত, তা এই হাঁড়ির জমিনের রঙ (একটি সাদা এবং অন্যটি হলুদ) এবং উৎকীর্ণ মটিফগুলো (মাছ, হাঁস, পদ্মফুল, চিরুনি, সিঁদুরের কৌটা, ধানের মঞ্জরি ইত্যাদি) অনুশীলন করলে নিশ্চিত হওয়া যায়। গত শতকের আশির দশকেও ওইসব অঞ্চলে অসংখ্য কুম্ভকার এই হাঁড়ি নির্মাণ ও চিত্রণের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। নব্বই দশকের শেষভাগ পর্যন্ত চাঁপাইনবাবগঞ্জের বারোঘরিয়া থেকে আমার ঘনিষ্ঠজনেরা শখের হাঁড়ি এনে দিতেন। শখের হাঁড়িকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ক্রেতারা বলতেন রঙ্গের পাতিল বা শিকার হাঁড়ি; আর নক্সাবহুল ছোট খেলনা-হাঁড়িগুলোকে বলতেন চুকাই। সম্প্রতি ক্ষেত্র অনুশীলন করে বিস্মিত হলাম এই তথ্য পেয়ে যে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে গড়ে ওঠা সেই শখের হাঁড়ি বা শিকার হাঁড়ির ঐতিহ্যটির শতভাগ পৃষ্ঠপোষক ছিল বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ। ৮-১০ বছর আগেও এই হাঁড়ি প্রচুর পরিমাণে তৈরি হতো মূলত ঈদের জামাত এবং ঈদ উপলক্ষে জমে ওঠা মেলাগুলোকে উদ্দেশ্য করে। ঈদের নামাজ শেষে মুসল্লিরা ঘরে ফিরতেন রঙিন শিকায় ঝুলানো, শখের হাঁড়ি হাতে নিয়ে। তা ছাড়া মেয়ের বিয়েতে উপঢৌকন বহন করতে কিংবা বিবাহিত মেয়েকে দেখতে যাওয়ার কালে মিষ্টি বা যে কোনো শৌখিন দ্রব্যে পরিপূর্ণ একটি শিকায় ঝোলানো শখের হাঁড়ি বহন করা ছিল পিতার জন্য অপরিহার্য কর্তব্য। সেই চাঁপাইনবাবগঞ্জ আজ সম্পূর্ণভাবেই শখের হাঁড়ি শূন্য। লেখক : নিসার হোসেন, চিত্রশিল্পী এবং অধ্যাপক, চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

মেলা : বৈশাখ-জৈষ্ঠ-আষাঢ়

ইমরান উজ-জামান

মেলা সেই অনুসঙ্গ যাতে একত্রিত হয় ধনী-গরীব, কালো-ধলো, নম-শুদ্র, আশ্রাফ-আত্রাফ, হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, ছোট-বড় আর জাত-অজাত।
বাংলাদেশে বর্ষবরণের মূল আয়োজন মূলত ঢাকার রমনা পাকের বটমূলকে ঘিরে। ছায়ানট রমনা পার্কে পহেলা বৈশাখ বর্ষবরণ উৎসব পালনের আয়োজন করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এসো হে বৈশাখ……এসো , এসো….গানের মাধ্যমে তারা স্বাগত জানায় নতুন বছরকে। ১৯৭২ সালের পর থেকে রমনা বটমূলে বর্ষবরণ জাতীয় উৎসবের স্বীকৃতি পায়। ১৯৮০ সালে বৈশাখী মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে এক ধাপ বাড়তি ছোঁয়া পায় বাংলা নববর্ষ বরণের অনুষ্ঠান। ১৯৮৯ সালে এই শোভাযাত্রার প্রচলন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থীরা। পহেলা বৈশাখের দিন সকাল গড়িয়ে যখন রমনা টি.এস.সি শাহবাগে মানুষের উপচে পরা ভিড় থাকে, তখন শুরু হয় মঙ্গলশোভা যাত্রা। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে শোভাযাত্রা বের হয়ে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। এখানে পশু পাখির মুখাকৃতির ছবিসহ গ্রামীণ ঐতিহ্যের নানা অনুসঙ্গকে ফুটিয়ে তোলা হয় নানা রং বেরং-এর মুখোশ ও আলপনার মাধ্যমে। ছেলে বুড়ো সবাই মেতে ওঠে বর্ষবরণের মঙ্গলশোভা যাত্রার আনন্দে। তবে প্রতি বছর মঙ্গল শোভাযাত্রায় একটি থিম শ্লোগান রাখা হয়, যা সমাজের সমসাময়িক সময়কে ধরে, কবি-সাহিত্যিকদের কবিতার পক্তি ব্যবহার করা হয়।
বৈশাখ মেলার মাস। বাংলা একাডেমির এক হিসাবে কেবল বৈশাখ মাসেই সারা বাংলাদেশে মেলা বসে ২শ ৪৫টি। আর দেশের বিভিন্ন স্থানে শুধু বৈশাখকে উপলক্ষ করে বসা মেলার সংখ্যা ১শ ৮০টি। অন্যান্যগুলো বার্ষিক ওরস ও ¯œান মেলা। আর আছে কালিপূজা উপলক্ষে মেলা। তবে প্রকৃতপক্ষে এই মেলার সংখ্যা দাড়াবে ৫শ’র বেশি। স্মরনকালে প্রবর্তিত হলেও বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুঠির শিল্প কর্পোরেশন আয়োজিত মেলা এখন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত। এছাড়া প্রতি জেলা শহরেই বৈশাখি মেলা বসে, অনেক জায়গায় আবার চৈত্র সংক্রান্তি থেকেই শুরু হয় মেলা ।
বাঙালি জীবনের অসাম্প্রদায়িক, সার্বজনীন একটি উৎসব হল পহেলা বৈশাখ, বর্ষবরণের দিন, শুভ নববর্ষ। রমনার বটমূল থেকে পুরো ঢাকা হয়ে প্রতিটি বিভাগীয় শহর, জেলা শহর, উপজেলা, ইউনিয়ন, গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে ঘটা করে নববর্ষ পালনের সংস্কৃতি। শুধু গ্রাম নয় শহর উপশহর রাজধানীর ঢাকারও বিভিন্ন অলিগলিতে বসে বৈশাখি মেলা। পান্তা- ইলিশ, বাঁশি, ঢাক-ঢোলের বাজনায় আর মঙ্গল শোভাযাত্রায় পূর্নতা পায় বাঙালির এ উৎসব মুখরতা।
হিন্দু সৌর পঞ্জিকামতে, আগে থেকেই পালিত হয়ে আসছে বাংলায় বারোমাস। কিন্তু গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় দেখা যায়, এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় এই সৌর বছর গণনা শুরু হত। ভারত বর্ষে মোঘল সা¤্রাজ্য শুরুর পর থেকে আরবী বছর হিজরী পঞ্জিকা অনুযায়ী তারা কৃষিপণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরী সাল চাঁদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় কৃষি ফলনের সাথে এর কোন মিল পাওয়া যেত না। যার কারনে স¤্রাট আকবর এর সুষ্ঠু সমাধানের জন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ আমীর ফতেহউল্লাহ সিরাজীর উপর নতুন বাংলা সনের প্রবর্তনের দায়িত্ব দেন। ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ ই মার্চ বা ১১ ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গননা পদ্ধতিকে কার্যকর ধরা হয় স¤্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহনের তারিখ ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর থেকে। প্রথমে এর নাম ফসলি সন বলা হলেও পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিতি পায়।
সেই অর্থে জৈষ্ঠ্য মাসে মেলা খুবই কম। কারন এই মাসকে মধু মাস বলা হয়, ঘরে ঘরে থাকে মধু ফলের উদযাপন। আম-কাঠাল সহযোগে ঘরে ঘরে নতুন জামাই সমাদরের ধুম পরে। মেলা এই মাসে মূলত ঘরে ঘরে।
একসময় শুধু গ্রাম গঞ্জে মেলা বসলেও এখন এর পরিধি ছড়িয়েছে সর্বত্র। তবে গ্রাম আর শহুরে মেলায় পার্থক্য বেশ। স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য কারুপণ্য, লোকশিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাত সামগ্রী, সকল প্রকার হস্ত শিল্পজাত ও মৃৎশিল্পজাত সামগ্রী উপস্থিত করার রেওয়াজ রয়েছে। এছাড়া শিশু-কিশোরদের খেলনা, মহিলাদের সাজ-সজ্জার সামগ্রী। থাকে সাপের খেলা, বাঁশ-বেতের তৈজষ, মাটির খেলনা-হাড়ি-পাতিল আর নানা জাতের খেলার সামগ্রী, নারকেল মুড়ি-মুড়কিসহ হাজারো পদ থাকে মেলায়। মেলা উপলক্ষে বসে নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা, কুস্তির আসর। যাত্রা, পালাগান, কবিগান, জারিগান, গম্ভীরাগান, গাজীর গানসহ বিভিন্ন ধরনের লোকসংগীত, বাউল-মারফতি-মুর্শিদি-ভাটিয়ালী। থাকে আঞ্চলিক গান পরিবেশনের আয়োজন। লাইলী-মজনু, ইউসুফ-জুলেখা, রাধা-কৃষ্ণ প্রভৃতি আখ্যানও উপস্থাপিত হয়। চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, নাটক, পুতুল নাচ, নাগরদোলা, সার্কাস বৈশাখী মেলার বিশেষ আকর্ষণ। এছাড়া শিশু-কিশোরদের আকর্ষণের জন্য থাকে বায়োস্কোপ। শহরাঞ্চলে নগর সংস্কৃতির আমেজে এখনও বৈশাখী মেলা বসে এবং এই মেলা বাঙালীদের কাছে এক আনাবিল আনন্দের মেলায় পরিণত হয়। বৈশাখী মেলা বাঙালীর আনন্দঘন লোকায়ত সংস্কৃতির ধারক।
বিখ্যাত সব বৈশাখি মেলার মধ্যে-নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, সাভার, রংপুরের পায়রাবন্দ, দিনাজপুরের ফুলছুড়ি ঘাট এলাকা, মহাস্থানগড়, কুমিল্লার লাঙ্গলকোট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মহেশপুর, খুলনার সাতগাছি, ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল অঞ্চল, সিলেটের জাফলং, মণিপুর, বরিশালের ব্যাসকাঠি-বাটনাতলা, গোপলগঞ্জ, মাদারীপুর, টুঙ্গিপারা, মুজিবনগরের বৈশাখি মেলা অন্যতম।
চট্টগ্রামে লালদীঘীর ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় জব্বারের বলি খেলা। পার্বত্য এলাকার উপজাতি অধ্যুষিত এলাকায় বিভিন্ন জাতি বিভিন্ন ভাবে বছরের শুরুটা পালন করে। যেমন চাকমা’রা বিজু, মারমা’রা সাংরাইং, ত্রিপুরা’রা বৈসু, তঞ্চঙ্গাদের বিষু। সব মিলিয়ে এক সঙ্গে বলা হয় বৈসাবি। রাঙামাটিতে বৈসাবিকে উপলক্ষ করে মেলার হাট বসে। র‌্যালি, জলকেলি, বলি খেলা আরো কত কি। বৈশাবির প্রধান আকর্ষন পানি খেলা। নৌকার মধ্যে বোঝাই পানি থাকে। নৌকার দুই পাশে ছেলে এবং মেয়ের দল দাড়িয়ে পানি ছোড়াছুড়ি করে। এই খেলাকে জলকেলি বলে।
তবে রাঙামাটির জেলেপাড়ায় বসে ভিন্ন রকমের আয়োজন। নতুন এবং পুরনো জেলে পাড়া মিলে দুই গ্রাম জেলে। হিন্দু অধ্যুসিত দুই গ্রামে বৈশাখ মাসের প্রথম দিন পাঁচন উৎসব হয়। বাঙালির নববর্ষের আদলে এই পাঁচন উৎসব। সকাল থেকেই পাড়ার বৌ-ঁিঝ’রা ঘাটে ভীর করে বড় হাঁড়ি বা গামলা নিয়ে। যার মধ্যে থাকে হরেক প্রকারের সবজি যা লেকের পানিতে পরিষ্কার করতে নিয়ে আসেন তারা। আর অন্য হাতে থাকে ছোট মাটির হাঁড়ি যার মধ্যে থাকে ফুল। এই ফুল স্থলে ফেলা যাবে না। তাহলে অনিষ্ঠ হবে। ফেলতে হবে পানিতে। পুজার ফুল পানিতে ভাসিয়ে দিয়ে, গোসল করে পবিত্র হয়ে তার পরে পাঁচনের কাঁটা সবজি গুলো ধুয়ে নিয়ে বাড়ী ফিরেন পাঁচন রান্নায় বসেন। রান্নার পদে থকে ১০৮ টি সবজি। ছোট ছোট মেহমানরা মহানন্দে বাড়ি বাড়ি ঘুরে পাঁচন খাচ্ছেন। পাঁচন খাওয়া শেষ হলে খই,মুড়ি-মুড়কি পলিথিনে নিয়ে তারা বাড়ি ছারছে। প্রত্যেকের হাতে একটি করে পলিথিনের পুটলি। পুটলিতে বাড়ি বাড়ি থেকে জমানো এইসব মুড়ি-মুড়কি। আর ঘরে ঘরে চলছে দেবতাকে তুষ্ট করার নানা আয়োজন। নিতাই মালির ঘরে বসেছে কীর্তনের আসর। মধুবালা দেবী মন্দিরা হাতে তান ধরেছেন। আর প্রিয়বালা ১৬ রকমের ফল ঝরো করেছেন দেবতার সামনে। প্রত্যেক ঘরের দরজায় সুতায় বেধে টানিয়ে দেয়া হয়েছে কিছু ফুল। প্রায় সবই বনফুল। তাদের পুঁজার বেদি কিন্তু খুবই সাধারন। কোন বাড়িতে একটা খুটির মাথায় কাঠের চারকোনাকৃতি ছোট ঘরে ফুল দিয়ে। কোথাও খুটির উপরে ড্রাম রেখে তার ভেতরে। কোথাও আবার শুধুই ঘরের সামনের খালি জায়গায় মাটিতে লেপে আল্পনা একে সেখানে প্লেটে পাঁচন আর পাশে ফুল রেখে চলে দেবতাকে তুষ্ট করার কাজ। সারা গ্রাম জুরে শিশু -কিশোরদের মেলা যেন এক। পাঁচনের মেলা।
প্রাচীন বর্ষবরণের রীতির সাথে অঙ্গাঅঙ্গি ভাবেই জড়িত হালখাতা। চাষাবাদ বাবদ চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করে দিত দেনাদাররা। পহেলা বৈশাখ ভূমির মালিকরা তাদের প্রজা সাধারণের জন্য মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়নের ব্যবস্থা রাখতেন। যা পরবর্তিতে ব্যবসায়িক পরিমন্ডলে ছড়িয়ে পড়ে। দোকানীরা সারা বছরের বাকীর খাতা সমাপ্ত করার জন্য পহেলা বৈশাখের দিনে নতুন সাজে বসে দোকানে। গ্রাহকদের মিষ্টিমুখ করিয়ে শুরু করেন নতুন বছরের ব্যবসার সূচনা। এ উৎসব গুলো সামাজিক রীতির অংশ হিসেবে পরিণত হয়েছে প্রতিটি বাঙালির ঘরে। এখনো গ্রাম গঞ্জে নববর্ষে হালখাতার হিড়িক পড়ে বাজার, বন্দর ও গঞ্জে। তবে ঢাকার তাঁতীবাজারে এখনো মহা ধুমধামে হালখাতা অনুষ্ঠান হয়।
বার ভূঁঈয়া প্রধান ঈশা খাঁর সোনারগাঁয় বৈশাখ উপলক্ষ্যে এক ব্যতিক্রমী মেলা বসে। যা বউমেলা নামে পরিচিত। জয়রামপুর গ্রামে প্রায় ১০০ বছর ধরে পয়লা বৈশাখে শুরু হওয়া এই মেলা পাঁচ দিনব্যাপী চলে। প্রাচীন একটি বটবৃক্ষের নিচে এই মেলা বসে, যদিও সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সিদ্ধেশ্বরী দেবীর পুঁজো হিসেবে এখানে সমবেত হয়। বিশেষ করে কুমারী, নববধূ, এমনকি জননীরা পর্যন্ত তাঁদের মনস্কামনা পূরণের আশায় এই মেলায় এসে পূজা-অর্চনা করেন। সন্দেশ-মিষ্টি-ধান দূর্বার সঙ্গে মৌসুমী ফলমূল নিবেদন করে ভক্তকূল। বটবৃক্ষের তলে পাঁঠাবলির রেওয়াজও রয়েছে। বদলে যাচ্ছে পুরনো অর্চনার পালা।এখন কপোত-কপোতী শান্তির বার্তা পেতে চায় দেবীর কাছ থেকে। কাঙ্খিত মানুষের আশায় কাঙ্খিত মানসীরা প্রার্থনা করে। হয়ত সফল হয়েই তারা ঘরে ফিরে। বউমেলা ছাড়াও সোনারগাঁ থানার পেরাব গ্রামের পাশে আরেকটি মেলায় আয়োজন করা হয় যার নাম ঘোড়ামেলা। লোকমূখে প্রচলিত জামিনী সাধক নামের এক ব্যক্তি ঘোড়ায় করে এসে নববর্ষের এই দিনে সকলকে প্রসাদ বিতরণ করতেন। জামিনী সাধক মারা গেলে ঐ স্থানে তার স্মৃতি স্তম্ব নির্মান করা হয়। প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে তার স্মৃতি স্তম্বে¢ সনাতন ধর্মাবলম্বীরা একটি করে মাটির ঘোড়া রাখে এবং এখানে মেলার আয়োজন করা হয়। এই হলো ঘোড়ামেলা। বৈশাখে সারা দেশ ভাসে মেলায়।

ঝড় এলো, এলো ঝড়
আম পর, আম পর।
কাঁচা আম, পাঁকা আম
টক টক মিষ্টি

বৈশাখ নিয়ে আছে এমন অনেক ছড়া। সারা দেশের গ্রামে গঞ্জে মেলার মধ্য দিয়ে যে উৎসবের সূচনা হয়। জৈষ্ঠ মাসের ফলের ম ম গন্ধ্যে সেই উৎসব পূর্ণতা পায়। বাড়ি বাড়ি জামাই বরন আর জামাই সমাদরের ধুম চলে। প্রতিটি ঘর এক একটি মেলায় পরিনত হয়।
দেশব্যাপী নাম ধরে বলার উল্লেখ্য করার মতো আছে অনেক বিখ্যাত মেলা।
মাতাই পুখির/ চৈত্র সংক্রান্তির মেলা- দেবতা পুকুর, নুনছড়ির, খাগড়াছড়ি।
বৈশাখী মেলা – বলীখেলা- লালদিঘি মাঠ, চট্টগ্রাম।
বৈশাখী মেলা – বলীখেলা -সাতকানিয়ার, চট্টগ্রাম।
বৈশাখী মেলা – বলীখেলা-তৈলারদ্বীপ, আনোয়ারা, চট্টগ্রাম।
বৈশাখী মেলা – ডিসি সাহেবের বলীখেলা- ডিসি মাঠ কক্সবাজার।
বৈশাখী মেলা – রাণী’র প্রাসাধ, কালী মন্দির, ময়নামতি, বুড়িচং ,কুমিল্লা। বৈশাখ থেকে আরম্ভ হয়ে মাস ব্যাপী মেলা।
বৈশাখী মেলা -লালমাই-ময়নামতি পাহাড়ের চূড়া, কুমিল্লা।
বৈশাখী মেলা/গডিয়া – কালিতারা বাজার, নোয়াখালী।
কুমারটেক (পালপাড়া), ঘোড়াশাল, পলাশ, নরসিংদী।
টেঙ্গরপাড়া, চরসিন্দুর ও পারুলিয়া কুমার পল্লী ,বরাব, জিনারদী, নরসিংদী।
গাজী, কালু মেলা – নিজসরাইল, সরাইল , ব্রাহ্মণবাড়িয়া ।
চড়ক পূজা ও বৈশাখী মেলা – হালির হাওর, জামালগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ।
চড়ক পূজা ও বৈশাখী মেলা -ছয়হারা খোজারগাও, ফেনারবাঁক, সুনামগঞ্জ ।
বৈশাখ মেলা/জামাইমেলা – বাছিরন নেছা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ, রসুলপুর, টাঙ্গাইল। ১১, ১২ ও ১৩ বৈশাখ।
বৈশাখী মেলা – পাউলদিয়া বটতলা, সিরাজদিখান, মুন্সীগঞ্জ। ১বৈশাখ।
বৈশাখী মেলা পঞ্চবটির অশ্বথমূলে, নামার বাজার, সাভার। ১ বৈশাখ।
চড়ক মেলা – বেলতলা, কাপাসিয়া- সংক্রান্তি।
সংক্রান্তি -বৈশাখী তিনদিন – সিংজুরী, রাধাকান্তপুর, পেঁচারকান্দা-বালিয়াখোড়া, পয়লা উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠ, নালী বাজার , ঘিওর, মানিকগঞ্জ।
বৈশাখী মেলা-মাইলাঘী, তরা কালীগঙ্গা নদীর পাড়, পঞ্চ রাস্তা এলাকা, পুখুরিয়া স্বপ্নের মোড়, মানিকগঞ্জ।
পাগলা গাছের মেলা, হামছাদী ,বৈদ্যোরবাজার, সোনারগাঁ, নারায়ণগঞ্জ। ৩১ বৈশাখ থেকে মাস।
চড়ক মেলা -ঠাকুরবাড়ি, কালিয়া, নড়াইল, ৩০ চৈত্র।
চড়কপূজার মেলা – শুড়িরডাঙ্গা সিদ্ধাশ্রম ও মহাশ্মশান, সুন্দলী, অভয়নগর, যশোর। ২৯ চৈত্র খেজুর ভাঙা, ৩০ চৈত্র। চড়কপূজা, পহেলা বৈশাখ বৈশাখী মেলা।
সতিমান ঠাকুরের মন্দির ও মেলা – বোচাগঞ্জের, দিনাজপুর
চৈত্র সংক্রান্তির মেলা-জম্বুলেশ্বর মন্ডবের মেলা শিবমন্দির-সাঁওতাল পাড়া,চন্ডিপুর, বিরামপুর মির্জাপুর, দিনাজপুর । সংক্রান্তি
বৈশাখী মেলা/গোপিনাথপুর মেলা/ঘোড়ার হাট – আক্কেলপুর, উপলক্ষে জয়পুরহাট –
বৈশাখী মেলা – নিমাইদীঘি, নন্দীগ্রাম/কাহালু, বগুড়া – চৈত্র সংক্রান্তি থেকে তিনদিন।
বৈশাখী মেলা – শিবগঞ্জ, মহাস্থানগড়, বগুড়া – একদিন এক রাত।
বৈশাখী মেলা – উত্তর শিহিপাশা, আগৈলঝাড়া, বরিশাল – সারা মাস।
বৈশাখী মেলা – দুরমুট, মেলান্দহ, জামালপুর – বৈশাখের প্রথম দিন থেকে মাস ব্যাপী।
জামাই মেলা/চৈত্রমেলা – গোপালপুর বাজার, ঘোড়াধাপ, জামালপুর। মাসব্যাপী
বৈশাখী মেলা – পোড়াবাড়ীয়া, নারান্দি,পাকুন্দিয়া, কিশোরগঞ্জ। মাস ব্যাপী।
ফকির মেলা-মৌতলা, শ্যামনগর, সাতক্ষীরা। সংক্রান্তি ও বৈশাখ।

চারন কবিদের গানে বঙ্গবন্ধু

রঞ্জনা বিশ্বাস


বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সবচেয়ে বেশি রচিত হয়েছে ১৯৯৬ এরপর, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার মধ্য দিয়ে। প্রায় সাড়ে চার হাজারের বেশি গ্রন্থ রচিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে। এর বেশির ভাগই ঐতিহাসিকের গভীর দৃষ্টিভঙ্গীতে রচিত নয়। যে দু একজন সত্যনিষ্ঠ ‘নিরপেক্ষ’ ইতিহাসের কথা ভেবেছেন তারাও জনজীবনকে উপেক্ষা করেছেন। আলোচনায় এনেছেন যুক্তিতর্ক আর ‘বঙ্গবন্ধু’কে মহান করে দেখাবার প্রচেষ্টা। বর্তমানে আওয়ামী গণরাজনীতির চাপে নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকের আরাধ্য বিষয়বস্তু একেবারই সংকুচিত হয়ে গেছে, কখনও কখনও উপেক্ষিত হয়েছে। ফলে ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে উঠেছেন একটি বিশেষ দলের নেতা। সামগ্রীকতাকে পরিহার করে সংকীর্ণ গোষ্ঠীচেতনায় সংকুচিত করে ফেলার এই প্রবনতার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে এক একটি আকবরনামা। অথচ বাংলাদেশে ‘বঙ্গবন্ধু’ বাঙালি জাতীয় ঐক্যের প্রতীক রূপে প্রতিভাত হন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের ‘গণরাজনীতির চাপে তিনিও হয়ে উঠছেন বিশেষ দলের প্রতীক। এ থেকে মুক্তির উপায় কী? মুক্তির উপায় জনজীবনের সঙ্গে ঐতিহাসিকের সামাজিক কমিটমেন্ট রক্ষা করা। আমরা যাদের ‘জন’ বলি এরা কারা? এদের সঙ্গে কেন্দ্রিয় শাসকদের সম্পর্ক কতটুকু? মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে এদের সম্পর্ক কেমন ছিল ? এই সব প্রশ্নের উত্তর কি আমাদের পাঠ্যবইয়ের চিন্তা ও রচনার সাহায্যে পাওয়া সম্ভব ? পাওয়া সম্ভব নয়, কেননাÑ সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক চেতনা ও তাদের সমাজচেতনার মুখ্য উপাদান এসব রচনায় উপস্থিত নয়। আর তাই ‘উচ্চবর্গের দৃষ্টিভঙ্গীর বাহন ইতিহাসবিদ্যার সাধ্য নেই যে জাতীয়তাবাদের এই গুরুত্বপূর্ণ দিকটাকে স্বীকার করে কিংবা ব্যাখ্যা করে।’১ অথচ বঙ্গবন্ধু জনসাধারনের ঐক্যের প্রতীক আকাক্সক্ষার ফল, যার মধ্য দিয়ে জনসমাজ স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহন করার চেষ্টায় রত হয়েছিল এবং জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে তারা ছিনিয়ে এনেছিল বিজয়। কিন্তু উচ্চবর্গ তাকে আত্মসাৎ করার চেষ্টা করেছে, তাকে চালিয়ে দিচ্ছে বিশেষ একটি গোষ্ঠীর মহানায়ক হিসেবে। তাই এই জাতীয় ইতিহাস হয়ে উঠছে একপেশে ভাবনায় পূর্ণ, নিরানন্দময়, অগভীর , অপ্রশস্ত আর চাটুকারিতায় পূর্ণ কীর্তিগাথা।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এটুকু বলেই সব শেষ হয়ে যায় না যে, ৭ই মার্চের ভাষণ বাঙালিদের বিজয়ের যথাযথ কাল নির্দেশক অবস্থানকে খুঁজে বের করার জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ কিংবা শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের সংকট ও উত্তরণ পন্থার অভিনবত্ব শাশ্বতরূপে চিত্রিত করার চেষ্টাই হবে ঐতিহাসিকের কাজ। কিন্তু এতে করে যে বিষয়টি আড়ালে থেকে যায় তা হলো জনগণের সঙ্গে ‘নায়ক’ মানুষটির পরিবর্তনের মুহূর্তটিকে চিহ্নিত করা, স্থীর করা। আবার সেই মুহূর্তটাও তো কোনো স্থীর সময় নয় বরং নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহের ভিতর দিয়ে অবিরাম পরিবর্তন। এই প্রবাহ যতটা না উপর থেকে নিচের দিকে ধাবমান ছিল তার চেয়ে বেশি নিচ থেকে উপরের দিকে উৎসারিত হয়েছিল ফোয়ারার মত। সেই প্রবাহকে অস্বীকার করা হয় প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাস চর্চায়। এখানে ঐতিহাসিকের দায়িত্ব কেবল নায়কের দিক থেকে ঘটনা সমুহকে বর্ণনা করা। অথচ তার একটি বিশেষ সামাজিক দায়িত্বও ছিল। জনজীবনের সঙ্গে নায়কের অবস্থানের যে স্বাভাবিক ও চিরন্তন ‘ঐক্য’ ও ‘সমগ্রভাবনা’ আছে তার অভেদতত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব সব সময়ই এড়িয়ে গেছেন তারা। কেন এড়িয়ে গেছেন ? কারণ Ñ জনজীবনে রাজনৈতিক নায়কের ইতিহাস কিভাবে প্রতিভাত হয়েছিল তার সন্ধান পাওয়ার চেষ্টা তারা করেননি। আবার মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক রচিত ইতিহাসেও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। যায়নি কারণ, ‘ নি¤œবর্গের রাজনীতির চরিত্র নির্ধারিত হচ্ছে নি¤œবর্গের নিজস্ব চেতনার রূপরেখানুসারে। সেই চেতনা গড়ে উঠেছে অধীনতার অভিজ্ঞতা থেকে।’২
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের জনযোদ্ধাগণ যুদ্ধ করেছেন ১১টা সেক্টরের অধীনে। যাদের অধীনে তারা যুদ্ধ করেছেন তারা প্রায় সকলেই সামরিক কর্মকর্তা, তাদের চেয়ে শিক্ষিত, সামরিক বিষয়ে প্রশিক্ষিত অতএব যুদ্ধের প্রসাশনিক বিন্যাসানুযায়ি ক্ষমতাটা চলে যায় উচ্চবর্গেরই হাতে। ফলে পরবর্তী ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধের কীর্তিগাথা ও চেতনার সাক্ষ্য প্রমাণ সংরক্ষিত হয়েছে উচ্চবর্গের দিক থেকে তাদের অধীনে এবং তাদেরকে ঘিরে। বলা বাহুল্য যে, স্বাধীনতার পরে ক্ষমতার কেন্দ্রেও তারাই ছিলেন। এমতাবস্থায় নি¤œবর্গের জনজীবন স্বাভাবিক ভাবেই ইতিহাসে উপেক্ষিত হয়েছে। তাই বলে কি নি¤œবর্গের উপস্থিতি একেবারেই অস্বীকার করা সম্ভব? সম্ভব নয়। ‘ একমাত্র একটি মুহূর্তেই শাসককুলের মানসপটে নি¤œবর্গ আবির্ভূত হয় স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের অধীকারি হয়ে। সেই মুহুর্তটি হল বিদ্রোহের মুহূর্ত।’৩ তাই সাবল্টার্ন স্টাডিজের গবেষনায় সবচেয়ে বড় অংশ জুড়ে রয়েছে বিদ্রোহের ইতিহাস, বিশেষত কৃষক বিদ্রোহ। এখানে নি¤œবর্গের চিন্তার স্বরূপটি কেমন ছিল তার কিছুটা হদিস পাওয়া যায়। আর তাই সাবল্টার্ন স্টাডিজের ঐতিহাসিক গণ বিদ্রোহের ইতিহাসগুলির মধ্যে নি¤œবর্গের চেতনার সন্ধান করেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া জনযোদ্ধারাও তো এক বিশেষ চেতনার বশবর্তী হয়ে যুদ্ধে নেমেছিলেন। সেই চেতনার পরিচয়টি পাবার জন্য আমরা কতটা এগিয়ে এসেছি? উচ্চবর্গের হাতে রচিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ভিতরে কোনো সাবল্টার্ন স্টাডিজের ঐতিহাসিকও ‘নি¤œবর্গের অবস্থান’ সনাক্ত করার জন্য আগ্রহী হননি। অথচ ইতিহাসের কর্মকান্ডের মধ্যে নি¤œবর্গের একটি স্বতন্ত্র ভূমিকা রয়েছে। সাবল্টার্ন স্টাডিজের ঐতিহাসিকের কাজ যদি হয় প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাসের সমালোচনা করা৪ তাহলেও আমাদের দেশে সেই অর্থে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নি¤œবর্গের ঐতিহাসিকের ভূমিকা চোখে পড়ে না। তবে সাবলটার্ন স্টাডিজের ঐতিহাসিকের কাজ যেখানে প্রচলিত ইতিহাসের মধ্যে নি¤œবর্গের অবস্থান সনাক্ত করা ও ব্যাখ্যা করা সেখানে ‘জনইতিহাসের ’ স জ্ঞা সে রকম নয়। আমরা জানি , বিশ্বাস করি, জনজীবনের মধ্যেই ইতিহাসের ঘটনা রয়ে গেছে। তাদের চেতনায় উপস্থিত ঐতিহাসিক ঘটনা, বিপ্লবী নায়কের চরিত্র ও তাদের প্রেষণা সমুহ তাদের ধর্মবিশ্বাস, সমাজ সংস্কৃতি, জীবনাচার, অলৌকিকতার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে লোকগান, লোকছড়া, কবিতায় রূপ নিয়েছে। রূপ নিয়েছে মিথ বা জনশ্রুতিতে। সেই সব উপাদানগুলি সংরক্ষণ করা গেলে তার ভেতরে নি¤œবর্গের যে ইতিহাস চেতনা কাজ করেছে তার স্বরূপ উদঘাটন করা সম্ভব হবে। আর তাই আমরা এই সব উপাদানগুলোকে প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসের ছকে ফেলে নি¤œবর্গের চেতনার সন্ধান পেতে চাই।
জনজীবনের মধ্যে ইতিহাসের কোন অংশগুলি কিভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে এবং তাদের ভাবনাকে উজ্জীবিত করেছে তার সন্ধান পেতে আমরা দ্বারস্থ হই লোকগান, লোকছড়া, লোক কবিতা প্রভৃতির কাছে। এই সব উপাদান লোকসংস্কৃতির অংশ বলে গবেষকগণ মনে করতেই পারেন জনইতিহাসও লোকসংষ্কৃতির অংশ। কিন্তু আমরা জনজীবনের সঙ্গে সম্পর্কহীন প্রচলিত ইতিহাসের বিপরীত অবস্থাকেই জনইতিহাস বলতে চাই। রাজ-রাজড়াদের বাইরে যে বিশাল জনতা, যারা যোদ্ধা, ভূক্তভোগী তারাও তো ইতিহাসের অংশ, যারা নিজেদের মধ্যে ইতিহাসের ঘটনা সমূহ বা মূলসূত্রটুকু সযতেœ আত্মস্থ করেন নিজেদের সুখ-দুঃখ-ব্যথা বেদনার সংমিশ্রণে। এই পাঠ কখনই প্রচলিত ইতিহাসবিদের বিবেচ্য নয় বলে তা জনগণের কাছে উম্মোচিত হয় না।
নি¤œবর্গের ইতিহাসবিদগণ নি¤œবর্গের চেতনা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখেছেন যে, তাদের চেতনা স্বতন্ত্র হয়েও পরাধীন, বহুধাবিভক্ত। ফলে তারা কখনওই গোটা সমাজের হয়ে কথা বলতে পারে না। তাই তাদের ইতিহাস চেতনা অসম্পূর্ণ, আংশিক। একারণে ভারতবর্ষের সকল নি¤œবর্গের বিদ্রোহ অসফল হয়েছে। কিন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী নি¤œবর্গের চেতনায় এক ধরনের বিশেষত্ব আছে। আর সেটা হল সমগ্র পূর্ববঙ্গের শোষিত মানুষের সংগঠিত স্বতস্ফুর্ত আন্দোলনের সচেতনতা। এই দিক থেকে ’৭১ এ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীগণ নি¤œবর্গ নন, তারা জনগণ (ঢ়বড়ঢ়ষব)।
‘জনে’র সঙ্গায় বলা হয়েছে Ñ লোক, (নর ও নারী) লোকসমুহ, শ্রমজীবী মজুর পামর ইত্যাদি। ‘জনে’র ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে কলিম খান ও রবী চক্রবর্তী তাদের বঙ্গীয় শব্দার্থ কোষে বলেন, ‘জন হচ্ছে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী আত্মবিক্রয় জীবী জন বা মজুর। যতদিন সে যৌথ সমাজব্যবস্থার অধীন ছিল – ততদিন ছিল Ñগণ” গণের সঙ্গায় মেধাতিথি বলেনÑ ‘যাহারা মিলিত ভাবে এক কার্য দ্বারা জীবীকার্জন করে তাদেরই গণ বলা হয়।’৫ গণের লোকেরা ব্যাক্তিস্বাতন্ত্র দাবী করে না। গোষ্ঠীর চেতনা দ¦ারা তারা পরিচালিত হয়। অন্য দিকে ‘জন’ এর লোকেরা প্রত্যেকেই ব্যাক্তি স্বাতন্ত্রবাদী। এই দু শ্রেণিকে একত্রে বলা হয় জনগণ। মুক্তিযুদ্ধের সময় শোষকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের যে অংশ রাজনৈতিক চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে জনযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল এখানে তারাই মুলত ‘জন’ নামে পরিচিত হবে। আর এই জনগণের ভেতরকার ইতিহাস চেতনাকেই আমরা বলছি জনইতিহাস। এই জনইতিহাসের উপাত্ত পাওয়া যাবে জনগনের স্মৃতিতে সংরক্ষিত লোককবিতায়, লোকছড়ায় ও গানে। সন্দেহ নাই যে সেই সব উপাদানের ভিত্তিতে একটি পূর্ণাঙ্গ এবং বিশুদ্ধ ইতিহাস রচনা সম্ভব নয় কিন্তু আমরা এতে করে একটা বিশেষ সত্যের মুখোমুখি হতে পারব। রবীন্দ্রনাথ এ প্রসঙ্গে বলেন- ‘ঐতিহাসিকের ঘটনার জনশ্রুতি বহুতর লোকের মন হইতে প্রতিফলিত হইয়া আসে এবং সেই ঘটনার বিবরনে সাময়িক লোকের মনের ছাপ পড়িয়া যায় তাহা হইতে ঘটনার বিশুদ্ধ সত্যতা আমরা না পাইতেও পারি কিন্তু তৎসাময়িক অনেক লোকের মনে তাহা কিরূপ প্রতিভাত হইয়াছিল সেটা পাওয়া যাইতে পারে। অতীত সময়ের অবস্থা কেবল ঘটনার দ্বারা নির্ণয় হয় না। লোকের কাছে তাহা কিরূপ ঠেকিয়াছিল সে ও একটা প্রধান দ্রষ্টব্য বিষয়। অতএব ঐতিহাসিক ঘটনার জনশ্রুতিতে বাস্তব ঘটনার সহিত মনব মন মিশ্রিত হইয়া যে পদার্থ উদ্ভুত হয় তাহাই ঐতিহাসিক সত্য। সেই সত্যের বিবরনই মানবের নিকট চিরন্তন কৌতুকাবহ এবং শিক্ষার বিষয়’।৬ আমরা এই সত্যের বিবরণকেই জনইতিহাসের বিষয় বস্তু রূপে উপস্থাপন করতে চাই। তাই লোকসংস্কৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে এখানে যে আলোচনা তা একপ্রকার জনইতিহাস।
আর একথা একান্তভাবেই স্বীকার্য যে বাঙালির লোকসংস্কৃতিই শেষ পর্যন্ত তাকে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলো, যুদ্ধে যাওয়ার প্রেরণা যুগিয়েছিল। আর সেই ইতিহাসের যে ভিত্তি রচিত হয়েছিল এদেশের জনজীবনে, জনমানসে রবীন্দ্রনাথ একেই বলতে চেয়েছেন জনপ্রবাহের ভিতরকার ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধে বিদ্রোহী কৃষক শ্রমিক, মুটে, মজুর, কুলি, কামার, কুমার, জেলে, মাঝির যে চেতনার পরিচয় পাওয়া যায় তাতে উপস্থিত ধর্মভাব, অলৌকিকতা, দৈবশক্তিতে আস্থা ইত্যাদির ভেতর মোড়ানো যে রাজনৈতিক চেতনা, যে ইতিহাস চেতনা তাকে উচ্চবর্গের চেতনার ছকে ফেরে আত্মস্থ করার চেষ্টাও ঠিক জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের শর্ত নয়। এরকম চেষ্টার ফলে নি¤œবর্গের নিজস্ব ইতিহাস চেতনা ও কীর্তি হারিয়ে যেতে বাধ্য। নি¤œবর্গের ইতিহাস রচয়িতাগণ জাতীয়তাবাদী ও মার্কসবাদী ইতিহাসের ভেতর নি¤œবর্গের যে স¦তন্ত্র ঐতিহাসিক ভূমিকা উপেক্ষিত হয়েছে তা প্রমাণ করার উদ্দেশ্যেই নি¤œবর্গের ইতিহাস রচনার কথা বলেন। কিন্তু ইতিহাসে নি¤œবর্গের মানুষের চেতনা ও উচ্চবর্গের মানুষের চেতনা স্বতন্ত্র ভাবে প্রবাহিত হয়ে কোথায় কিভাবে মিলিত হয়েছে এবং বিদ্রোহের জন্ম দিয়েছে তার সম্মিলিত কর্মসূচি নিয়ে ইতিহাস লেখার চেষ্টাই হতে পারে বিকল্প ইতিহাস রচনার পদ্ধতি।
ইতিহাস শব্দটি এতটাই প্রাতিষ্ঠানিক অর্থে ব্যবহৃত হয় যেÑ শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে বেশির ভাগ সময় আমাদের মনে কেবলই অতীতের রাজ-রাজড়াদের কাহিনি ভিড় করে। আমাদের মন তখন ঝিমিয়ে পড়ে আর আমরা ক্লান্ত বোধ করি। এর কারণ আমাদের প্রচলিত ইতিহাস চর্চার শুরু হয়েছিল ইংরেজ শাসন ব্যবস্থা থেকে যেখানে ইতিহাস বিষয়টির সামগ্রীক ব্যাখ্যান অনুপস্থিত। ‘জয় যখন বিজিত দেশের ক্ষমতা কায়েম করার আকাক্সক্ষায় পরিণত হয়, বিজেতাকে ইতিহাস চেতনা ব্যবহার করতে হয় প্রভুসংস্কৃতির একটি উপাদান হিসেবে।’৭ ফলে সেই সব ইতিহাসে ইংরেজ শাসকদের শাসন ব্যবস্থার প্রয়োজনকেই কোনো না কোনো ভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং পরবর্তী কালে এই ধারাবাহিকতায়ই রচিত হয়েছে ভারতবর্ষের ইতিহাস। এই সব ইতিহাসে ঘটনার বর্ণনা আছে, সন-তারিখ উল্লেখ আছে, আছে রাজনৈতিক মতবাদ, সভা, সেমিনার, ভাষণের সংকলন কিন্তু প্রাণ নেই। আর একারণেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আক্ষেপ করে বলেনÑ‘ আজও ভারত বর্ষের একখানি পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচিত হয়নি।’ হয়নি, কারণÑ‘ তা জনপ্রবাহের দিক’ থেকে রচিত হয়নি। এই একই অভিযোগ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রসঙ্গেও উত্থাপন করা যায়।
জাতীয় জীবনে সাধারণ মানুষের ভেতর বা ‘জনপ্রবাহে’র ভেতর ইতিহাস বোধ কিভাবে দানা বেধেছিল, কিভাবে তা জাতীয় ঐক্যে পরিণত হয়েছিল তার হদিস আমরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কতটুকু পাই ? আমাদের পাঠ্যপুস্তকের ইতিহাসে কেবল জাতীয়তাবাদী ঐক্যের কল্পনা কাজ করেছে কিন্তু জনযুদ্ধের সামনে দাঁড়িয়ে সেই ইতিহাস চেতনা যতটুকু বস্তুনিষ্ঠ হয়েছে ততটুক কি সত্যনিষ্ঠ হয়েছে ? কেন সত্যনিষ্ঠ হয়ে উঠছে না ? এর কারণও রবীন্দ্রনাথ বলেছেনÑ‘ জনসমাজের সহিত শিক্ষিত সমাজের নানা প্রকারেই বিচ্ছেদ ঘটাতে জাতির ঐক্যবোধ সত্য হইয়া উঠিতেছে না।’৮ স্যার যদুনাথ সরকার বলেন,‘ … মানব সঙ্ঘের চিত্তের ভাব ও উদ্যম কোন পথে চলিয়াছিল, জাতীয় জীবনে পূর্ব্বপুরুষদের মনোবৃত্তি ও সভ্যতার প্রভাব কতদূর গিয়া দাঁড়ায়, মহাপুরুষ জননেতারা কিরূপে দেশমধ্যে বিপ্লবের সমান পরিবর্তন সংঘটিত করেন, নতুনকে ঝড়ের মত আনিয়া দিয়া প্রতিষ্ঠিত করিয়া দিয়া জাতিকে নবীন পথে প্রচলিত করেন, সেই সব মনস্তÍত্ত্বের কথা কাব্যের তুলিতে ইতিহাসে প্রকাশ করিতে পারিলে তবে সে ইতিহাসগ্রন্থ প্রকৃত ফলবান হইবে, অমর হইয়া থাকিবে Ñ নচেৎ নহে।’৯ তা হলে কী দাঁড়াচ্ছে ? আমাদের ইতিহাসে কি ‘জনপ্রবাহ’ ‘জনসমাজ’ কিংবা ‘মানব-সঙ্ঘ’ যাই বলি না কেন তাদের ‘চিত্তের ভাব বা উদ্যম’ ধরা পরেছে ? পরেনি কারণ তাদের সঙ্গে শিক্ষিত সমাজের ঐতিহাসিকদের দূরত্ব রয়েছে ফলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে জনযুদ্ধ সব সময়ই উপেক্ষিত হয়েছে। এই বক্তব্যে একটা কথা পরিস্কার যে আমরা এখানে দুটি শ্রেণির সন্ধান পাচ্ছি। একটা শ্রেণি ‘জনসমাজ’ আর অপরটি হচ্ছে জনসমাজ বহির্ভূত অপর সমাজ যারা জনসমাজের সঙ্গে সম্পর্ককে স্বীকার করে না, তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ। সাবল্টার্ন স্টাডিজে এদের একটি নি¤œবর্গ অন্যটি উচ্চবর্গ। নি¤œবর্গের ইতিহাস গবেষক রণজিৎ গুহ উচ্চবর্গ বলতে ইংরেজ শাসিত ভারত বর্ষে যারা প্রভুশক্তির অধিকারী ছিলেন তাদেরই বুঝিয়েছেন। এই প্রভুগোষ্ঠীকে তিনি আবার দুই ভাগে ভাগ করেছেনÑ বিদেশি ও দেশি। এদের মধ্যেও দুটি ভাগ ছিলÑ সরকারি ও বেসরকারি। এদের মধ্যে সরকারি ভাবে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের অভারতীয় কর্মচারী ও ভৃত্য সকলে, বেসরকারি অর্থে বিদেশি শিল্পপতি, বণিক, অর্থব্যবসায়ী, খনির মালিক, জমিদার, নীলকুঠি চা-বাগান কফিক্ষেত বা ওই জাতীয় যে সব সম্পত্তি প্লানটেশন প্রণালীতে চাষ করা হয় তার মালিক ও কর্মচারী, খ্রিষ্টান মিশনারি, যাজক, পরিব্রাজক ইত্যাদি। আর দেশি প্রভুগোষ্ঠীরা আঞ্চলিক বা স্থানীয় প্রতিনিধিদের স্বার্থ ও দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী কাজ করে। এরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাবে উচু শ্রেণির এবং এই সঙ্গা অনুযায়ী যারা উচ্চবর্গের মধ্যে পড়ল তাদেরকে সমগ্র জনসংখ্যা থেকে বাদ দিলে যারা থাকে তাদেরকেই রণজিৎ গুহ নি¤œবর্গ বলে চিহ্নিত করেছেন। আমরাও যদি সাবল্টার্নের এই সঙ্গা অনুসরন করি তাহলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে আশ্রয় করে যে জনসমাজকে আবর্তিত হতে দেখব তারা সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারী, কিছু জনপ্রতিনিধি, সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণি যারা মুসলিম লীগের সমর্থক এবং যুদ্ধের সময় শাসকগোষ্ঠীর চিন্তার সমর্থনকারী সম্প্রদায়। এরাই এখানে উচ্চবর্গ। অন্যদিকে এদের বিপরীতে যারা এদের নির্যাতন, শাসন ও শোষণের শিকার, সাধারণ মানুষ, তারাই নি¤œবর্গভুক্ত। এই যে শেষোক্ত শোষিত সমাজ এদের সঙ্গে শাসকগোষ্ঠীর এবং উচ্চবর্গের সম্পর্ক কী ? এই সম্পর্কের কি কোনো সমতা আছে ? সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাবে এরা বৈষম্যের শিকার । এদের চেতনার গড়নও তাই উচ্চবর্গের চেতনার গড়ন থেকে আলাদা। ফলে উচ্চবর্গের অন্তর্গত ইতিহাস চেতনার মধ্যে নি¤œবর্গের মানুষের চেতনার বাস্তবতা উপেক্ষিত হবে এটাই স্বাভাবিক। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যারা ইতিহাস রচনা করেছেন তারা কি এই আদর্শিক দন্দ্ব ও তার পরিনামের কথা মাথায় রেখেছেন ? কেন রাখেননি ? এটাই তো ঐতিহাসিকের কাজ, গবেষকের দায়িত্ব। গবেষক সাংবাদিক মোস্তফা হোসেইন জানানÑ‘ মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর প্রশাসন চলে যায় পাকিস্তানি ভাবাদর্শের কর্মকর্তাদের হাতে। স্বাধীনতা লাভের পরপর রাজনৈতিক সরকারকে ব্য¯ত থাকতে হয় নাগরিক অস্তিত্ব রক্ষায়, এককোটি মানুষের পুনর্বাসন, যোগাযোগসহ অবকাঠামোগত উন্নয়নে। প্রশাসনিক ব্যবস্থা রক্ষায় পাকিস্তানি বংশবদদের ওপর নির্ভর করতে হয় সরকারকে। যারা একাত্তরে পাকিস্তানি সামরিক সরকারকে সহযোগিতা করেছে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সুযোগ থাকার পরও , তারা যুদ্ধ পরবর্তীকালে সাদা কাগজে মুচলেকা দিয়ে নিজ নিজ অবস্থানে বহাল থেকেছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাদের আনুগত্য তাই প্রশ্নবিদ্ধই থেকে যায়।’১০ এ তো গেল উচ্চবর্গের ভাবাদর্শগত দিক। অন্যদিকে সামাজিক ভাবে যদি বিবেচনা করা হয় তা হলে দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী জনযোদ্ধাদের অবস্থান একেবারেই প্রান্তিক পর্যায়ে। অর্থনৈতিকভাবে এবং চিন্তাগত দিক থেকে তাদের অবস্থান ছিল একেবারেই প্রান্তে যেখানে উচ্চবর্গের ইতিহাস রচয়িতার দৃষ্টি কখনওই পড়েনি।।
এদিকে মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধের যে প্রশাসনিক কাঠামো আমরা দেখি সেখানে বাংলাদেশ তথা পূর্বপাকিস্তানকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছে। এই সেক্টরের অধিপতিরা সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে আদর্শিক ভাবে নি¤œবর্গেরই মানুষ ছিলেন। শাসক শোষকের বিপরীতেই ছিল তাদের অবস্থান। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আদর্শিকভাবে এই সামগ্রীক জনগোষ্ঠীর মধ্যেও উচ্চবর্গ ও নি¤œবর্গের ধারনা তৈরি হয়ে যায়। ফলে জনযোদ্ধাদের কেউ বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত হতে পারেননি। তারা সবাই সামরিক ব্যক্তি। জনযোদ্ধারা এখানে উপেক্ষিত। আবার মুক্তিযুদ্ধ শেষে যারা ইতিহাস রচনা করেছেন তারাও যুদ্ধের প্রশাসনিক অবকাঠামোগত দিক থেকেই একে বর্ণনা করেছেন। ফলে ্সামরিক কর্মকর্তা, বিডিআর, পুলিশবাহিনির ভূমিকা ও দলিলপত্র সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের নজর যতটা তিক্ষè ছিল ততটা সাধারন যোদ্ধাদের দিকে ছিল না। ফলে সে সব ইতিহাসে উপেক্ষিত হয়েছে জনযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা। তা ছাড়া এ যাবৎকালে যারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চা করেছেন তাদের একটা বড় অংশই সামরিক কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও বিভিন্ন পেশাজীবীর মানুষ। এদের রচনায় ব্যক্তিগত চিন্তার প্রতিফলন যতটা দেখা যায় ততটা নি¤œবর্গের পরিপ্রেক্ষিতের গভীরতা দেখা যায় না। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে যে উদ্যোগ তা নি¤œবর্গের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট নয়। ঔপনিবেশিক আমলের প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মনীতি ও আদর্শ ভেঙ্গে এদেশে এখনও কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে পারেনি। ফলে একাডেমিক ভাবে রচিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেও নি¤œবর্গের রাজনৈতিক চেতনা ও ইতিহাস চেতনা এক বিশেষ কায়দায় উপেক্ষিত হয়। অথচ ‘ রবীন্দ্রনাথ, অক্ষয়কুমার, যদুনাথÑ এরা সবাই চেয়েছিলেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠিত ও চর্চিত বিষয়গুলির ভিত্তি থাকুক জনজীবনে। ইতিহাস গবেষণার বিষয়টি এর ব্যতিক্রম নয়। জাতীয়তাবাদী চিন্তায় ইতিহাস অনুশীলন ইতিহাসের জনজীবনেরই অংশ।’১১ অথচ সেখানেও জনজীবনের দেখা মেলে না। রবীন্দ্রনাথ এ কথাও বলেন যে, বঃযহড়ষড়মুর বই পড়ে যদি দেখা যায় যে ‘আমাদের ঘরের পাশে যে হাড়ি- ডোম -কৈবর্ত-বাগদী রহিয়াছে তাহার সম্পূর্ণ পরিচয় পাইবার জন্য আমাদের লেশমাত্র ঔৎসুক্য জন্মে না তখনই বুঝিতে পারি, পুঁথি সমন্ধে আমাদের কতবড় একটা কুসংস্কার জন্মিয়া গেছে।…’১২ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ক্ষেত্রেও এই কুসংস্কার তৈরি হয়েছে সেই সব ঐতিহাসিকদের কারণে যারা শাসনদ-কে আশ্রয় করে ইতিহাস চর্চা করছেন। এরা শাসকের সুবিধাভোগী লোক। এদের দৃষ্টিতে জনযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী নি¤œবর্গের মানুষের যে নিজস্ব ইতিহস জ্ঞান আছে, যে সমাজ ভাবনা আছে, রাষ্ট্রভাবনা আছে তা উপেক্ষিত থেকে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের জাতীয়তাবাদী চেতনায় যে ঐক্যের সুর বেজেছিল তা পাঠ্যপুস্তকের ইতিহাসের এক তারে গ্রন্থিত হতে পারেনি। ফলে রবীন্দ্রনাথ যে তার সময়ে ‘ইতিহাস উৎসাহ’ জেগে উঠতে দেখেছিলেন তার প্রভাব এখানে লক্ষ করা যায় না।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সবচেয়ে বেশি রচিত হয়েছে ১৯৯৬ এরপর, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার মধ্য দিয়ে। প্রায় সাড়ে চার হাজারের বেশি গ্রন্থ রচিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে। এর বেশির ভাগই ঐতিহাসিকের গভীর দৃষ্টিভঙ্গীতে রচিত নয়। যে দু একজন সত্যনিষ্ঠ ‘নিরপেক্ষ’ ইতিহাসের কথা ভেবেছেন তারাও জনজীবনকে উপেক্ষা করেছেন। আলোচনায় এনেছেন যুক্তিতর্ক আর ‘বঙ্গবন্ধু’কে মহান করে দেখাবার প্রচেষ্টা। বর্তমানে আওয়ামী গণরাজনীতির চাপে নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকের আরাধ্য বিষয়বস্তু একেবারই সংকুচিত হয়ে গেছে, কখনও কখনও উপেক্ষিত হয়েছে। ফলে ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে উঠেছেন একটি বিশেষ দলের নেতা। সামগ্রীকতাকে পরিহার করে সংকীর্ণ গোষ্ঠীচেতনায় সংকুচিত করে ফেলার এই প্রবনতার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে এক একটি আকবরনামা। অথচ বাংলাদেশে ‘বঙ্গবন্ধু’ বাঙালি জাতীয় ঐক্যের পতীক রূপে প্রতিভাত হন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের ‘গণরাজনীতির চাপে তিনিও হয়ে উঠছেন বিশেষ দলের প্রতীক। এ থেকে মুক্তির উপায় কী ? মুক্তির উপায় জনজীবনের সঙ্গে ঐতিহাসিকের সামাজিক কমিটমেন্ট রক্ষা করা। আমরা যাদের ‘জন’ বলি এরা কারা ? এদের সঙ্গে কেন্দ্রিয় শাসকদের সম্পর্ক কতটুকু ?মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে এদের সম্পর্ক কেমন ছিল ? এই সব প্রশ্নের উত্তর কি আমাদের পাঠ্যবইয়ের চিন্তা ও রচনার সাহায্যে পাওয়া সম্ভব ? পাওয়া সম্ভব নয়, কেননাÑ সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক চেতনা ও তাদের সমাজচেতনার মুখ্য উপাদান এসব রচনায় উপস্থিত নয়। আর তাই ‘ উচ্চবর্গের দৃষ্টিভঙ্গীর বাহন ইতিহাস বিদ্যার সাধ্য নেই যে জাতীয়তাবাদের এই গুরুত্বপূর্ণ দিকটাকে স্বীকার করে কিংবা ব্যাখ্যা করে।’১৩ অথচ বঙ্গবন্ধু জনসাধারনের ঐক্যের প্রতীক আকাক্সক্ষার ফল, যার মধ্য দিয়ে জনসমাজ স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহন করার চেষ্টায় রত হয়েছিল এবং জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে তারা ছিনিয়ে এনেছিল বিজয়। কিন্তু উচ্চবর্গ তাকে আত্মসাৎ করার চেষ্টা করেছে, তাকে চালিয়ে দিচ্ছে বিশেষ একটি গোষ্ঠীর মহানায়ক হিসেবে। তাই এই জাতীয় ইতিহাস হয়ে উঠছে একপেশে ভাবনায় পূর্ণ, নিরানন্দময়, অগভীর, অপ্রশস্ত আর চাটুকারিতায় পূর্ণ কীর্তিগাথা।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এটুকু বলেই সব শেষ হয়ে যায় না যে, ৭ই মার্চের ভাষণ বাঙালিদের বিজয়ের যথাযথ কাল নির্দেশক অবস্থানকে খুঁজে বের করার জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ কিংবা শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের সংকট ও উত্তরণ পন্থার অভিনবত্ব শাশ্বতরূপে চিত্রিত করার চেষ্টাই হবে ঐতিহাসিকের কাজ। কিন্তু এতে করে যে বিষয়টি আড়ালে থেকে যায় তা হলো জনগণের সঙ্গে ‘নায়ক’ মানুষটির পরিবর্তনের মুহূর্তটিকে চিহ্নিত করা, স্থীর করা। আবার সেই মুহূর্তটাও তো কোনো স্থীর সময় নয় বরং নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহের ভিতর দিয়ে অবিরাম পরিবর্তন। এই প্রবাহ যতটা না উপর থেকে নিচের দিকে ধাবমান ছিল তার চেয়ে বেশি নিচ থেকে উপরের দিকে উৎসারিত হয়েছিল ফোয়ারার মত। সেই প্রবাহকে অস্বীকার করা হয় প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাস চর্চায়। এখানে ঐতিহাসিকের দায়িত্ব কেবল নায়কের দিক থেকে ঘটনা সমুহকে বর্ণনা করা। অথচ তার একটি বিশেষ সামাজিক দায়িত্বও ছিল। জনজীবনের সঙ্গে নায়কের অবস্থানের যে স্বাভাবিক ও চিরন্তন ‘ঐক্য’ ও ‘সমগ্রভাবনা’ আছে তার অভেদতত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব সব সময়ই এড়িয়ে গেছেন তারা। কেন এড়িয়ে গেছেন ? কারণ Ñ জনজীবনে রাজনৈতিক নায়কের ইতিহাস কিভাবে প্রতিভাত হয়েছিল তার সন্ধান পাওয়ার চেষ্টা তারা করেননি। আবার মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক রচিত ইতিহাসেও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। যায়নি কারণ, ‘ নি¤œবর্গের রাজনীতির চরিত্র নির্ধারিত হচ্ছে নি¤œবর্গের নিজস্ব চেতনার রূপরেখানুসারে। সেই চেতনা গড়ে উঠেছে অধীনতার অভিজ্ঞতা থেকে।’১৪
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের জনযোদ্ধাগণ যুদ্ধ করেছেন ১১টা সেক্টরের অধীনে। যাদের অধীনে তারা যুদ্ধ করেছেন তারা প্রায় সকলেই সামরিক কর্মকর্তা, তাদের চেয়ে শিক্ষিত, সামরিক বিষয়ে প্রশিক্ষিত অতএব যুদ্ধের প্রসাশনিক বিন্যাসানুযায়ি ক্ষমতাটা চলে যায় উচ্চবর্গেরই হাতে। ফলে পরবর্তী ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধের কীর্তিগাথা ও চেতনার সাক্ষ্য প্রমাণ সংরক্ষিত হয়েছে উচ্চবর্গের দিক থেকে তাদের অধীনে এবং তাদেরকে ঘিরে। বলা বাহুল্য যে, স্বাধীনতার পরে ক্ষমতার কেন্দ্রেও তারাই ছিলেন। এমতাবস্থায় নি¤œবর্গের জনজীবন স্বাভাবিক ভাবেই ইতিহাসে উপেক্ষিত হয়েছে। তাই বলে কি নি¤œবর্গের উপস্থিতি একেবারেই অস্বীকার করা সম্ভব ? সম্ভব নয়। ‘ একমাত্র একটি মুহূর্তেই শাসককুলের মানসপটে নি¤œবর্গ আবির্ভূত হয় স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের অধীকারি হয়ে। সেই মুহুর্তটি হল বিদ্রোহের মুহূর্ত।’১৫ তাই সাবল্টার্ন স্টাডিজের গবেষনায় সবচেয়ে বড় অংশ জুড়ে রয়েছে বিদ্রোহের ইতিহাস, বিশেষত কৃষক বিদ্রোহ। এখানে নি¤œবর্গের চিন্তার স্বরূপটি কেমন ছিল তার কিছুটা হদিস পাওয়া যায়। আর তাই সাবল্টার্ন স্টাডিজের ঐতিহাসিক গণ বিদ্রোহের ইতিহাসগুলির মধ্যে নি¤œবর্গের চেতনার সন্ধান করেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া জনযোদ্ধারাও তো এক বিশেষ চেতনার বশবর্তী হয়ে যুদ্ধে নেমেছিলেন। সেই চেতনার পরিচয়টি পাবার জন্য আমরা কতটা এগিয়ে এসেছি ? উচ্চবর্গের হাতে রচিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ভিতরে কোনো সাবল্টার্ন স্টাডিজের ঐতিহাসিকও ‘নি¤œবর্গের অবস্থান’ সনাক্ত করার জন্য আগ্রহী হননি। অথচ ইতিহাসের কর্মকান্ডের মধ্যে নি¤œবর্গের একটি স্বতন্ত্র ভূমিকা রয়েছে। সাবল্টার্ন স্টাডিজের ঐতিহাসিকের কাজ যদি হয় প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাসের সমালোচনা করা১৬ তাহলেও আমাদের দেশে সেই অর্থে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নি¤œবর্গের ঐতিহাসিকের ভূমিকা চোখে পড়ে না। তবে সাবলটার্ন স্টাডিজের ঐতিহাসিকের কাজ যেখানে প্রচলিত ইতিহাসের মধ্যে নি¤œবর্গের অবস্থান সনাক্ত করা ও ব্যাখ্যা করা সেখানে ‘জনইতিহাসের ’ সঙ্গা সে রকম নয়। আমরা জানি, বিশ্বাস করি, জনজীবনের মধ্যেই ইতিহাসের ঘটনা রয়ে গেছে। তাদের চেতনায় উপস্থিত ঐতিহাসিক ঘটনা, বিপ্লবী নায়কের চরিত্র ও তাদের প্রেষণা সমুহ তাদের ধর্মবিশ্বাস, সমাজ সংস্কৃতি, জীবনাচার, অলৌকিততার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে লোকগান, লোকছড়া, কবিতায় রূপ নিয়েছে। রূপ নিয়েছে মিথ বা জনশ্রুতিতে। সেই সব উপাদানগুলি সংরক্ষণ করা গেলে তার ভেতরে নি¤œবর্গের যে ইতিহাস চেতনা কাজ করেছে তার স্বরূপ উদঘাটন করা সম্ভব হবে। আর তাই আমরা এই সব উপাদানগুলোকে প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসের ছকে ফেলে নি¤œবর্গের চেতনার সন্ধান পেতে চাই।

জনজীবনের মধ্যে ইতিহাসের কোন অংশগুলি কিভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে এবং তাদের ভাবনাকে উজ্জীবিত করেছে তার সন্ধান পেতে আমরা দ্বারস্থ হই লোকগান, লোকছড়া, লোক কবিতা প্রভৃতির কাছে। এই সব উপাদান লোকসংস্কৃতির অংশ বলে গবেষকগণ মনে করতেই পারেন জনইতিহাসও লোকসংষ্কৃতির অংশ। কিন্তু আমরা জনজীবনের সঙ্গে সম্পর্কহীন প্রচলিত ইতিহাসের বিপরীত অবস্থাকেই জনইতিহাস বলতেচাই। রাজ-রাজড়াদের বাইরে যে বিশাল জনতা, যারা যোদ্ধা, ভূক্তভোগী তারাও তো ইতিহাসের অংশ, যারা নিজেদের মধ্যে ইতিহাসের ঘটনা সমুহ বা মূলসূত্রটুকু সযতেœ আত্মস্থ করেন নিজেদের সুখ-দুঃখ-ব্যথা বেদনার সংমিশ্রণে। এই পাঠ কখনই প্রচলিত ইতিহাসবিদের বিবেচ্য নয় বলে তা জনগণের কাছে উম্মোচিত হয় না।
নি¤œবর্গের ইতিহাসবিদগণ নি¤œবর্গের চেতনা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখেছেন যে, তাদের চেতনা স্বতন্ত্র হয়েও পরাধীন, বহুধাবিভক্ত। ফলে তারা কখনওই গোটা সমাজের হয়ে কথা বলতে পারে না। তাই তাদের ইতিহাস চেতনা অসম্পূর্ণ, আংশিক। একারণে ভারতবর্ষের সকল নি¤œবর্গের বিদ্রোহ অসফল হয়েছে। কিন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী নি¤œবর্গের চেতনায় এক ধরনের বিশেষত্ব আছে। আর সেটা হল সমগ্র পূর্ববঙ্গের শোষিত মানুষের সংগঠিত স্বতস্ফুর্ত আন্দোলনের সচেতনতা। এই দিক থেকে ’৭১ এ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীগণ নি¤œবর্গ নন, তারা জনগণ (ঢ়বড়ঢ়ষব)।
আর এই জনগণের ভেতরকার ইতিহাস চেতনাকেই আমরা বলছি জনইতিহাস। এই জনইতিহাসের উপাত্ত পাওয়া যাবে জনগনের স্মৃতিতে সংরক্ষিত লোককবিতায়, লোকছড়ায় ও গানে। সন্দেহ নাই যে সেই সব উপাদানের ভিত্তিতে একটি পূর্ণাঙ্গ এবং বিশুদ্ধ ইতিহাস রচনা সম্ভব নয় কিন্তু আমরা এতে করে একটা বিশেষ সত্যের মুখোমুখি হতে পারব। রবীন্দ্রনাথ এ প্রসঙ্গে বলেন-‘ ঐতিহাসিকের ঘটনার জনশ্রুতি বহুতর লোকের মন হইতে প্রতিফলিত হইয়া আসে এবং সেই ঘটনার বিবরনে সাময়িক লোকের মনের ছাপ পড়িয়া যায় তাহা হইতে ঘটনার বিশুদ্ধ সত্যতা আমরা না পাইতেও পারি কিন্তু তৎসাময়িক অনেক লোকের মনে তাহা কিরূপ প্রতিভাত হইয়াছিল সেটা পাওয়া যাইতে পারে। অতীত সময়ের অবস্থা কেবল ঘটনার দ্বারা নির্ণয় হয় না। লোকের কাছে তাহা কিরূপ ঠেকিয়াছিল সে ও একটা প্রধান দ্রষ্টব্য বিষয়। অতএব ঐতিহাসিক ঘটনার জনশ্রুতিতে বাস্তব ঘটনার সহিত মনব মন মিশ্রিত হইয়া যে পদার্থ উদ্ভুত হয় তাহাই ঐতিহাসিক সত্য। সেই সত্যের বিবরনই মানবের নিকট চিরন্তন কৌতুকাবহ এবং শিক্ষার বিষয়’।১৭ আমরা এই সত্যের বিবরণকেই জনইতিহাসের বিষয় বস্তু রূপে পেতে চাই।
১৯৪৭ সালের পরে বাংলাদেশে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে এবং বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামে অগ্রগামী ছিলেন এদেশের নি¤œবর্গের মানুষÑ ¤িœধ্যবিত্ত কৃষক,শ্রমিক, দিনমজুর। এমন কি এদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির সঙ্গে এদেরই সম্পর্ক ছিল গভীর। এক গবেষণায় দেখা গেছেন ১৯৬৯ এর আগে পূর্ব পাকিস্তানে কৃষিজীবীর সংখ্যা ছিল ৭৬.৯৬%।১৩ আবার দেশের বর্গাচাষী, কৃষিমজুর এবং শিল্পশ্রমিক (যাদের মোট পরিমান প্রায় ৬০ শতাংশ) ছিলেন মোট শ্রম শক্তির সংখ্যা গরিষ্ঠ অংশ।১৮ বাঙালিরা ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানি শাসন শোষনের বিরুদ্ধে ২৮১ বার ধর্মঘটের ডাক দেয়। এই আন্দোলনগুলির মধ্যে শিল্প ও অন্যান্য শ্রমিকদের ডাকা ধর্মঘটের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১০৫ ও ৪২।১৯ এদিকে ছাত্রদের ডাকা ধর্মঘটের সংখ্যা ছিল ১০৬। বলাই বাহুল্য যে এই ছাত্রদের বড় অংশই ছিল গ্রামের কৃষকের সন্তান। একটি সাধারণ সমীক্ষায় দেখা গেছে বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারীদের ৬০ শতাংশ ছিলেন গ্রামের অধিবাসী। সমীক্ষায় দেখা যায় যে, ৮৩ শতাংশের পারিবারিক আয়ের উৎস ছিল আংশিক অথবা পুরোপুরি কৃষি নির্ভর।২০ তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, গ্রামীন কৃষি সমাজই ছিল বাংলার অর্থনীতির প্রাণ। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে এবং উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটিশরা ভারতের জমিসংক্রান্ত নীতি নির্ধারণের কাজে নিজেদের ব্যস্ত রেখেছে।২১ তারা মুঘল আমলের কৃষিব্যবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন সাধন না করে তাদের আদলেই নিজেদের সুবিধা মাফিক জমিদারী প্রথা বহাল রেখে নীতি নির্ধারণ করে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হলে বাঙালিরা মনে করে যে, এখন তাদের সরকার হয়তো ভূমি সংস্কার ও কৃষি উন্নয়নে গুরুত্ব দেবে। কিন্তু ১৯৫১ সালে পাকিস্তান পার্লামেন্টে যে ভূমি সংস্কার বিল পাশ করা হয় তাতে জোতদারদের স¦ার্থ সংরক্ষিত হয়।২২ শাসকদের অসম ভূমি ব্যবস্থাপনা, জমির মালিক ও বর্গা চাষীদের মধ্যে ফসলেরর বন্টন প্রক্রিয়ায় আসমতা, ফসল ফলানোর ওপর নানারকম নিষেধাজ্ঞা জারি, কৃষকের কাছ থেকে বেশি করে ভূমি রাজস্ব আদায়, কর্ডন আইনের মাধ্যমে কৃষিদিনমজুরকে প্রতারনাসহ নানা রকম নিপীড়ন চলতে থাকে। এমতাবস্থায় বাঙলার গ্রামীন সমাজে অস্তিত্বের সংকট দেখা দেয়। খাদ্যাভাবে অনাহার অর্ধাহারে দিন কাটাতে শুরু করে মানুষ। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে বাড়তে থাকে অস্থিরতা। বিক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে গ্রামীন সমাজের মধ্যে। ১৯৫৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন-‘ গু য়ঁবংঃরড়হ রং যিড়ংব সড়হবু বি ধৎব ংঢ়বহফরহম হড়?ি ঞযরং সড়হবু নবষড়হমং ঃড় ঃযব ঢ়ড়ড়ৎ ভধৎসবৎ ড়ভ ঃযরং পড়ঁহঃৎুৃ’২৩ এই বিষয়টিও ততদিনে গ্রামীন কৃষক সমাজের কাছে পরিস্কার হয়ে গেছে। তাই
লোককবি মফিজ উদ্দিন বলেন-
দুইশ বছর গোলামির পর পেয়েচিলাম পাকিস্তান
কেউ হয়েছি নেস্তইনাবুদ কেউ হতেছে অপমান ॥
আজাদী পাইলো চাষী কাগজে আর কলমে
দুনিয়াতে বদনাম তোদের মরিবে এই শরমে ॥
চপ কাটরেট লুচি মাখন কর্তারা খায় দিনরাত
চাষীর ভাগ্যে জুটে নারে পোড়া মরিচ পান্তা ভাত ॥
তোদের ক্ষেতে জন্মে উঠে সোনার দানা সেরা পাট
তোরাই আজ পথের কাঙাল খালি তোদের তোদের হাত ॥
আন্য কলাই যব মুসুরি জন্মে তোদের ক্ষেতে
ছেলে মেয়ে নিয়ে আজ মরিস তোরা ভাতে ॥২৪
যেহেতু পূর্ব পাকিস্তানের বেশির ভাগ মানুষ ছিল কৃষির ওপর নির্ভরশীল তাই পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর সকল ধরনের বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হতেন সরাসরি এই সম্প্রদায়ের মানুষ। আর তাই ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট তাদের ইশতেহারের কারণে কৃষককূলের আস্তাভাজন হয়েছিল। তারা ২১ দফারমধ্যে কৃষকের মুক্তির বিষয়টি উপস্থাপন করতে সক্ষম হন। আর একারণে লোক কবি দেওয়ান ফরিদ উদ্দিন তার কবিতায় বলেন-
‘ মন্ত্রি সভা গঠন করে, ২১ দফা ওয়াদারে
পালন করো একে একে, নইলে হবে পরমাদ ॥
আমাদের এই মিনতি হক-আতা- ভাসানীর প্রতি
নিজ হাতে খুইদো গো নূরুল আমিনের খাদ ॥’২৫
কৃষকের একচেটিয়া সমর্থনের ফলে পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। কিন্তু শেষপর্যন্ত বেনিয়া শাসকদল তাদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেয়। বাঙালির ওপর নির্যাতন নিপীড়নের মাত্রা বাড়তে থাকে। শরীরের তল্লাশী থেকে শুরু করে স্থাবর- অফস্থাবর সম্পত্তি দখল, কৃষকদের ওপর নির্বিচারে পুলিশি গুলিবর্ষণ ইত্যাদি ছিল নিত্যকার ঘটনা।২৬ ১৯৬৯ সালে ৪ জানুয়ারি দৈনিক সংবাদের শিরোনাম-‘ খুলনার পল্লীতে ধান কাটা লইয়া হাঙ্গামায় পুলিশের গুলীবর্ষণে ১২ জন ব্যক্তি আহত।’ অপর শিরোনাম- ‘হাতিরদিয়ায় পুলিশের গুলীর প্রতিবাদে কৃষকদের সংঘবদ্ধ হওয়ার আহ্বান।’ ৯ জানুয়ারির একটি শিরোনাম- ‘ কুষ্টিয়ার আখচাষীরাও সরকারী পীড়নের শিকারে পরিণত হইয়াছে’। ১০ জানুয়ারির একটি শিরোনাম-‘ দিনাজপুর রাজশাহীর লক্ষ লক্ষ আধিয়া চাষী জোতদারদের সামন্তবাদী শোষণে মধ্যযুগীয় ভূমিদাসে পরিণত।’ এর সঙ্গে পাল্লাদিয়ে চলছিল নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল বৃদ্ধির উর্দ্ধোগতি, খাদ্য সংকট যা নিয়ন্ত্রণ ও নিরসনের জন্য সরকারে কোনো বাস্তব উদ্যোগই ছিল না। ১৯৬৯ এর ১৪ জানুয়ারি দৈনিক সংবাদের একটি শিরোনাম-‘ পাবনায় খাদ্য সংকট চূড়ান্ত: চাষীরা জমি বিক্রি করিতেছে।’ ৬ মার্চের শিরোনাম ‘ মাদারীপুর মহকুমায় চরম খাদ্যাভাব: শতকরা ৯০জন লোক অনাহারে দিন কাটাইতেছে।’ ২২ মার্চ একই পত্রিকার শিরোনাম ছিল- ক্ষুধার জ্বালায় মানুষ হন্যে হইয়া ফিরিতেছে: পাবনায় চাউলের মণ ৬০ টাকা। ১৩ ডিসেম্বরের ভয়াবহ শিরোনাম-‘ মাগুরা মহকুমায় আত্মহত্যার হিড়িক: অভাব অনটনই কারণ বলিয়া ধারণা।’ সংবাদপত্রের এই শিরোনাম থেকেই পাকিস্তানি শাসকদের নির্যাতন নিপীড়ন ও অত্যাচারের প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা করা যায়। পূর্ব বাংলার কৃষকদের দুর্দশা আরও চরম আকার ধারণ করছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে। কিন্তু তাতে পশ্চিমা পাকিস্তানি শাসকদের কোনও রকম সহমর্মিতা প্রকাশ পেত না। সংবাদ পত্রে এইসব দুর্যোগের খবর প্রচার পেলেও কর্তৃপক্ষ সে বিষয়ে একেবারেই উদাসীন থাকত। এর ওপর চাষীদের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থাও ছিল ভঙ্গুর। কলেরা বসন্তে হাজার হাজার লোক মারা গেলেও প্রশাসন ছিল এ বিষয়েও নিস্পৃহ। এতে পূর্ব বাংলার কৃষক সমাজ মুসলিম লীগের শাসন ব্যবস্থার প্রতি হতাশ হয়ে পড়ে এবং বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার দাবীতে তারা স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে অংশগ্রহণ করে। ফলে ৭০ এর নির্বচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্রাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী নির্বচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চ লাইট পরিচালনা করে। শুরু হয় বাঙালিদের মুক্তির সংগ্রাম। গবেষনায় দেখা গেছে- ‘প্রায় চার-পঞ্চমাংশ মুক্তিযোদ্ধাই ছিলেন কৃষক পরিবারের সন্তান।’২৭ পশ্চিম পাকিস্তানিদের শাসন শোষন ও অত্যাচারে নিঃস্ব কৃষকেরা ভাগ্যের কাছে নতি স্বীকার না করে, ভবিতব্যের কাছে আত্ম সমার্পন না করে তারা এক এক জন যোদ্ধা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। কেননা পাকিস্তান আমলের কৃষিজ সমাজের অর্থনৈতিক সংকটই তাদের সামগ্রীকভাবে অস্তিত্বের সংকট তৈরি করে যার ফলে তারা বাধ্য হয়েছিল মরণকে তুচ্ছ করে মুক্তির সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই জনমানুষের উপস্থিতি আমরা লক্ষ করি না। তবু তারা নিজেদের মতো করেই ইতিহাসের বয়ান করে নিজেদের ভাষায়। সেখানে তারা তাদের কথা বলে, তাদের নেতার কথা বলে। আর সেটাই হচ্ছে জনইতিহাস, লোক সংস্কৃতির ভেতরকার নির্যাস। এর মধ্যে স্বার্থন্বেষণের চেষ্টা নেই, খ্যাতির মোহ নেই, প্রাপ্তির আকাক্সক্ষা নেই। তাই লোকসংস্কৃতির মধ্যে লুকিয়ে থাকা এই ইতিহাস যদি ছড়িয়ে পড়ে জাতীয় জীবনে, বৃহত্তর সমাজে তাহলে আমরা একটি সামগ্রীক ইতিহাসের ধারণা লাভ করতে সক্ষম হব। নইলে যে ইতিহাসে জনজীবন উপেক্ষিত হয় তার কাছ থেকে আমাদের কিছুই শেখার থাকবে না। আমাদের চেতনার মধ্যে ঐক্যের বন্ধন স্থাপিত হবে না। আমাদের মধ্যে বাঙালি হিসেবে গর্ববোধ করার প্রত্যয় প্রতিষ্ঠিত হবে না। আর তা না হলে আমাদের চিন্তা ভাবনা ক্রমেই অসংহত হয়ে পড়বে, সেই ফাঁকগলে ঢুকে পরবে সাম্প্রদায়িকতার নানা ভেদজ্ঞান।
তথ্যসূত্র:
১. দীপেশ চক্রবর্তী, ইতিহাসের জনজীবন ও অন্যান্য প্রবন্ধ, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা: লি:, ৩য় মুদ্রণ, পৃ: ২৯।
২. পার্থ চট্টপাধ্যায়. ভ’মিকা: নি¤œবর্গের ইতিহাস চর্চার ইতিহাস, নি¤œবর্গের ইতিহাস, প্রাগুক্ত, পৃ: ১২।
৩. প্রাগুক্ত, পৃ: ১২।
৪. প্রাাগুক্ত, পৃ: ১৩।
৫. রবি চক্রবর্তী ও কলিমখান,বঙ্গীয় শব্দার্থ কোষ,ভাষাবিন্যাস, কলকাতা, প্রথমখন্ড, পুনর্মদ্রণ ১৪১৭, পৃ ২৫৮।
৬. ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়,২২ শ্রাবণ,১৩৬২,পৃ:১১৭-১১৮।
৭. রণজিৎ গুহ, নি¤œবর্গের ইতিহাস, নি¤œবর্গের ইতিহাস, সম্পাদনা: গৌতম ভদ্র ও পার্থ চট্টোপাধ্যায়, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা:লি:, ষষ্ঠ মুদ্রণ, পৃ: ২৩।
৮. দীপেশ চক্রবর্তী, প্রাগুক্ত, ৩য় মুদ্রণ, পৃ: ৩৩।
৯. যদুনাথ সরকার, যদুনাথ সরকার রচনা সম্ভার, সম্পাদক: নিখিলিশ গুহ ও রাজনারায়ণ পাল, এম সি সরকার এ- প্রাইভেট লি:, ২য় সংস্করণ২০১২, পৃ:২১।
১০. মোস্তফা হোসেইন, উপেক্ষিত জনযুদ্ধ, বাংলা ট্রিবিউন, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৬।
১১. দীপেশ চক্রবর্তী, প্রাগুক্ত, পৃ: ৩২।
১২. প্রাগুক্ত, পৃ: ৩০।
১৩. প্রাগুক্ত, পৃ: ২৯।
১৪. পার্থ চট্টপাধ্যায়. ভ’মিকা: নি¤œবর্গের ইতিহাস চর্চার ইতিহাস, নি¤œবর্গের ইতিহাস, প্রাগুক্ত,পৃ: ১২।
১৫. প্রাগুক্ত, পৃ: ১২।
১৬. প্রাাগুক্ত, পৃ: ১৩।
১৭. রবি চক্রবর্তী ও কলিমখান,বঙ্গীয় শব্দার্থ কোষ,ভাষাবিন্যাস, কলকাতা, প্রথমখন্ড, পুনর্মদ্রণ ১৪১৭, পৃ ২৫৮।
১৮. ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়,২২ শ্রাবণ,১৩৬২,পৃ:১১৭-১১৮।
১৯. মহিউদ্দিন আলমগীর এবং লড উইক জে. বি বারলেজ, (১৯৭৪); বাংরাদেশ: ন্যাশনাল ইনকামএন্ডএক্সপেন্ডিচার ১৯৪৯-১৯৬৯-৭১, বিআইডিএস, পৃ: ১৭৫-৭৬। উদ্ধৃত, আতিউর রহমান, মুক্তিযুদ্ধ জনযুদ্ধ আর্থ- সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০০৩, পৃ:৪৪।
২০. আতিউর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ:৫০।
২১. প্রাগুক্ত, পৃ:৫১।
২২. প্রাগুক্ত, পৃ: ৫৩।
২৩. গৌতম ভদ্র, মুঘলযুগে কৃষি অর্থনীতি ও কৃখশ বিদ্রোহ, সুবর্ণরেখা, ৫ম সংস্করণ, কলকাতা, ১৪২০, পৃ:২।
২৪. আতিউর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ: ৫৫।
২৫. প্রাগুক্ত,পৃ: ৫৭।
২৬. মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান, বাংলাদেশের ভাট-কবি ও কবিতা, অনিন্দ্য প্রকাশ, ঢাকা- ২০১২,পৃ :২২২, রঞ্জনা বিশ্বাস, লোকসংস্কৃতিতে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ,রোদেরা প্রকাশনী ,ঢাকা, ২০১৭,পৃ:১০৩।
২৭. মুহম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান, প্রাগুক্ত, পৃ: ১৯৬। রঞ্জনা বিশ্বাস, প্রাগুক্ত,পৃ: ৯৪।

বাংলায় প্রাতিষ্ঠানিক ফোকলোর-চর্চার সূচনা-পর্ব

উদয় শংকর বিশ্বাস

সূচনা
বাংলার ফোকলোরের ইতিহাস ব্যাখ্যায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কিছু প্রতিষ্ঠানের কথা প্রথমে বলতে হয়। বিভিন্ন মনীষীদের শ্রমে গড়া প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলার ফোকলোর-চর্চার ধারাবাহিকতা ইতিহাস তৈরি করেছে। যদিও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বর্তমানে সীমিত। অল্প কিছু প্রতিষ্ঠান বর্তমানেসচল আছে। ব্রিটিশভারতে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহ ফোকলোরের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নেই বরং স্বাধীন ভারতে প্রতিষ্ঠিত সংগঠনগুলোই সচল আছে। যদিও ভারতের অন্য রাজ্যর তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক বেশি গবেষণামুখী এবং তা সর্বভারতীয় ফোকলোর গবেষণায় যথেষ্ট প্রভাব রাখছে। ফোকলোরকে ভারতে প্রথম পরিচয় করিয়েছে কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি। প্রতিষ্ঠানটির গবেষণামূলক পত্রিকায় ফোকলোর-নৃবিজ্ঞান-সমাজবিজ্ঞান সম্পর্কিত দেশি-বিদেশি লেখকদের প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। যদিও এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ইংরেজরা। অপরদিকে, বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়া প্রতিষ্ঠান ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ’-এর কার্যক্রম প্রথম দিকে ফোকলোরের জন্য অনেকটাই সহায়ক ছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ও ফোকলোর-চর্চায় জোরালো ভূমিকা রেখেছে।
এশিয়াটিক সোসাইটি
ভারতবর্ষে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ফোকলোর-চর্চার শুরু হয় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে। এশিয়ার অধিবাসীদের প্রাচীন সভ্যতা, কলা, বিজ্ঞান এবং সাহিত্যের ইতিহাস অনুসন্ধানের লক্ষ্যে কলকাতা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি উইলিয়াম জোনস্-এর উদ্যোগে ১৭৮৪ সালের ১৫ই জানুয়ারি কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়। জোনস্ ছিলেন প্রাচ্যবিদ্যার একজন অসাধারণ প-িত। ভাষা ও সাহিত্যে তাঁর প্রগাঢ় অনুরাগ ছিল। তিনি সংস্কৃত, লাতিন, আরবি, ফারসিসহ বেশ কয়েকটি ভাষা জানতেন। কালিদাসের অভিজ্ঞান শকুন্তলম ইংরেজিতে অনুবাদ করে যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছিলেন। ভারতের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস (১৭৩২-১৮১৮)-কে জোনস্ সোসাইটির প্রথম সভাপতি হওয়ার অনুরোধ জানান। কিন্তু হেস্টিংস সৌজন্যবশত তা প্রত্যাখ্যান করেন, তিনি বরং প্রতিষ্ঠানটির পৃষ্ঠপোষক হতে সম্মতি জানান। হেস্টিংসের অস্বীকৃতিতে অনেকটা বাধ্য হয়ে জোনস্ এশিয়াটিক সোসাইটির প্রথম সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রথম দশ বছর (১৭৮৪-১৭৯৪) একই পদে তিনি আসীন থাকেন। ইতিহাস বলে, প্রতিষ্ঠানটি প্রথমে ‘ঞযব অংরধঃরপশ ঝড়পরবঃুʼ নামে পরিচিত ছিল। বেশ কয়েকবার এর নাম পরিবর্তন হয়। ১৯৫১ সালে ‘ঞযব অংরধঃরপ ঝড়পরবঃুʼ নাম হয়। শুরুর দিকে এর সদস্যপদ ইংরেজদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। ১৮২৯ সালে ভারতীয়রা প্রথম সদস্য হন। বাঙালিদের মধ্যে সদস্যপদ লাভ করেন রসময় দত্ত (১৭৭৯-১৮৫৪), রামকমল সেন (১৭৮৩-১৮৪৪), দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৭৯৪-১৮৪৬), প্রসন্নকুমার ঠাকুর (১৮০১-১৮৬৮), হরময় দত্ত, শিবচন্দ্র সেন প্রমুখ ব্যক্তি। রামকমল সেন ১৮৩৩ সালে সোসাইটির প্রথম অ-ইংরেজ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এশিয়াটিক সোসাইটির বহুমুখী জ্ঞানচর্চা দু’টি কমিটির মাধ্যমে হতো। যার একটি ছিল বিজ্ঞান-বিষয়ক এবং অপরটি সাহিত্য-বিষয়ক। উইলিয়াম কেরি সাহিত্য-বিষয়ক কমিটির সদস্য ছিলেন। এই কমিটির মাধ্যমে ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস ও পুরাতত্ত্ব বিষয়ের চর্চা হতো। এশিয়াটিক সোসাইটিতে শুরু থেকেই গুরুত্ব পেয়েছে ভারতের সংস্কৃত, পালি, প্রাকৃত, আরবি ও ফারসি সাহিত্য। কিন্তু দেশজ ভাষাও যে অবহেলিত ছিল না, তার সাক্ষ্য বাংলা ভাষাচর্চায় পথিকৃৎ উইলিয়াম কেরির স্বীকৃতি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এশিয়াটিক সোসাইটি চারটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। আর তা হলো :
১. ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাতে লেখা পুঁথি, মুদ্রা, চিত্র, অনুশাসন, ভূতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, প্রাণিবিদ্যা প্রভৃতির নিদর্শন সংগ্রহ করা;
২. জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা;
৩. পাঠাগার স্থাপন এবং
৪. গবেষণামূলক পত্রিকা, বুলেটিন ও প্রসিডিংস প্রকাশ করা।
প্রতিষ্ঠানটি ফোকলোর-চর্চায় আজও এই চারটি বিষয়কে গুরুত্ব দিচ্ছে। ভারতীয় প্রাচীন ইতিহাস-সাহিত্য বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে সোসাইটি পাথর খোদাই লিপি, পুথি, হস্তশিল্প, পোড়ামাটির ফলক এবং দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহƒত নানা উপাদানের সন্ধান পায়। ১৭৯৬ সালে এসব বস্তুধর্মী সংগ্রহ নিয়ে এশিয়াটিক সোসাইটি তার নিজস্ব ভবনে একটি সমৃদ্ধ সংগ্রহশালা গড়ে তোলে। চিত্রকলা, প্রাচীন পুথি, মূর্তি, তাম্রশাসন, মুদ্রাসহ বস্তুধর্মী নানা জিনিসে সোসাইটির সংগ্রহশালা ধীরে-ধীরে গড়ে ওঠে। ১৮১৪ সালে সোসাইটির সংগৃহীত উপাদান নিয়ে কলকাতায় গড়ে তোলা হয় ভারতবর্ষের প্রথম জাদুঘর। সংগ্রহশালার প্রথম তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন ডেনমার্কের উদ্ভিদতত্ত্ববিদ নাথানিয়েল ওয়ালিক। এশিয়ার বৃহত্তম এই সংগ্রহশালা আজ সকলের কাছে ʻওহফরধহ ঘধঃরড়হধষ গঁংবঁসʼ নামে পরিচিত। ভারতীয় জাদুঘরে ‘শনির পাঁচালি’, ‘খনার বচন’, ‘ষষ্ঠী মঙ্গল’, ‘সত্যপীরের পাঁচালি’, ‘গঙ্গার পাঁচালি’, ‘চিকিৎসার জলপড়া’, ‘চিকিৎসার চাউল পড়া’, ‘শিবরাত্রীর ব্রতকথা’– এই আটটি ফোকলোর-সংশ্লিষ্ট পাঁচালি আছে। জাদুঘরে লোকশিল্পের বিশেষত শোলা, পাট, বয়নশিল্প, বাঁশের কাজের নিদর্শন সংরক্ষিত আছে। সংগৃহীত এসব উপকরণ সংগ্রহশালাটিকে সমৃদ্ধ করেছে। এ ছাড়া এশিয়াটিক সোসাইটির উদ্যোগেই ʻঅহঃযৎড়ঢ়ড়ষড়মরপধষ ঝঁৎাবু ড়ভ ওহফরধʼ, ʻএবড়ষড়মরপধষ ঝঁৎাবু ড়ভ ওহফরধʼ, ʻঝরাঢ়ঁৎ ইড়ঃধহরপধষ এধৎফবহʼ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানসহ বেশ কয়েকটি সারস্বত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়।
এশিয়াটিক সোসাইটির গ্রন্থাগারটি বেশ সমৃদ্ধ। এই গ্রন্থাগারে প্রায় ৪৭ হাজার পা-ুলিপি সংরক্ষিত আছে। এর মধ্যে অধিকাংশ দুর্লভ। এখানে হর্ষবর্ধনের সময়কার পা-ুলিপি যেমন আছে, তেমনি অতিদুর্লভ প্রজ্ঞাপারমিতার একটি পা-ুলিপি সংরক্ষিত আছে। এখানে প্রায় ১০ হাজার আরবি ও ফারসি ভাষার পা-ুলিপি আছে। এর মধ্য থেকে বাছাই করে কিছু পুথি অনুবাদ করা হয়েছে। বিশাল আকারের কাঠ খোদাই লিথোগ্রাম আছে প্রায় সাড়ে সাতশ। যদিও এই বিপুল সংগ্রহ এক দিনে গড়ে ওঠেনি। দেশি-বিদেশি অসংখ্য প-িতের শ্রমে গড়ে উঠেছে এশিয়ার অন্যতম সমৃদ্ধ এশিয়াটিক সোসাইটির গ্রন্থাগারটি। এটি এ অঞ্চলের মানুষের এগিয়ে যাওয়ার পথে আলোকবর্তিকা হিসেবে সব সময় ভূমিকা পালন কর আসছে। বাঙালি মনীষীদের মধ্যে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮৫৩-১৯৩১), যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি, যদুনাথ সরকার (১৮৭০-১৯৫৮), রমেশচন্দ্র মজুমদার (১৮৮৮-১৯৮০), সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় (১৮৯০-১৯৭৭), সত্যেন্দ্রনাথ বসু (১৮৯৪-১৯৭৪), চিন্তাহরণ চক্রবর্তী (১৯০০-১৯৭২), নির্মলকুমার বসু (১৯০১-১৯৭২), নীহাররঞ্জন রায় (১৯০৩-১৯৮১), বিনয় ঘোষ (১৯১৭-১৯৮০) প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ বিভিন্ন সময় সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
এশিয়াটিক সোসাইটির মুখপত্র হিসেবে ১৭৯০ সালে অংরধঃরপশ জবংবধৎপয নামে একটি গবেষণা পত্রিকা প্রকাশিত হয়। সম্পাদক ছিলেন উইলিয়াম জোনস্ নিজে। তাঁর সম্পাদনায় ১৭৯০, ১৭৯২, ১৭৯৪ এবং ১৭৯৭ সালে পত্রিকাটির চারটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। অল্প সময়ের মধ্যে পত্রিকাটি সুধীমহলে পরিচিতি লাভ করে। বিভিন্ন সময়ে এর বিন্যাসগত কিছু পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে এটি ঞযব ঔড়ঁৎহধষ ড়ভ ঃযব অংরধঃরপ ঝড়পরবঃু ড়ভ ইবহমধষ নামে সাহিত্য ও বিজ্ঞান- এই দুই ভাগে প্রকাশিত হচ্ছে। সাহিত্য শাখায় ফোকলোরের বিভিন্ন ধারা, যেমন : লোককাহিনী, লোকক্রীড়া, লোকভাষা, লোকচিকিৎসা, গীতিকা, বিশ্বাস-সংস্কার, উৎসব, আচার-অনুষ্ঠান, প্রবাদ, ধাঁধা, মন্ত্র, লৌকিক দেবদেবী ইত্যাদি বিষয়ে অসংখ্য প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া এর বিভিন্ন সংখ্যায় দেশি-বিদেশি লেখকদের আদিবাসী সংস্কৃতি নিয়ে শতাধিক প্রবন্ধ প্রকাশ পেয়েছে। ১৮৩৩ সালে ইংরেজ লেখক ঔ. ঝ. খঁংযরহমঃড়হ-এর ফোকলোর-বিষয়ক প্রথম যে প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়, তার শিরোনাম ছিল ʻঙহ ঃযব গধৎৎধমব জরঃবং ধহফ টংধমবং ড়ভ ঃযব ঔধঃং ড়ভ ইযধৎধঃঢ়ঁৎʼ। তাঁর দেখানো পথে পরবর্তীকালে অনেকে হেঁটেছেন। বিদেশিদের মধ্যে ফোকলোর নিয়ে সবচেয়ে বেশি প্রবন্ধ লিখেছেন চ. ঙ. ইড়ফফরহম. তিনি সাঁওতাল আদিবাসীদের আচার-বিশ্বাস-লোকচিকিৎসা প্রভৃতি বিষয়ে এই পত্রিকায় বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ হলো : ʻঙহ ঞধনড়ড় ধহফ ঈঁংঃড়সং ঈড়হহবপঃবফ ঃযবৎবরিঃয ধসড়হমংঃ ঃযব ঝধহঃধষʼ (১৮৯৮), ʻঙহ ঃযব উরভভবৎবহঃ করহফং ড়ভ ঝড়ষঁঃরড়হ টংবফ নু ঝধহঃধষংʼ (১৮৯৮), ʻগড়হমড়ষরধহ জধপব-সধৎশং অসড়হমংঃ ঃযব ঝধহঃধষংʼ (১৯০৪), ʻঝঃঁফরবং রহ ঝধহঃধষ গবফরপরহব ধহফ ঈড়হহবপঃবফ ঋড়ষশ-ষড়ৎবʼ (১৯২৫), ʻঅ ঘড়ঃব ড়হ ঃযব ডরষফ চবড়ঢ়ষব ড়ভ ঃযব ঝধহঃধষংʼ (১৯৩১) ইত্যাদি। বিদেশি প্রাবন্ধিকদের মধ্যে আরো ছিলেন ঔধসবং অননড়ঃঃ, ঊফধিৎফ এৎববহ ইধষভড়ৎব, ঈ. অ. ইবষষ, ঈ. ঐ. ইধসঢ়ধং, খ. ঈড়ৎফড়হ, চ. উবযড়হ, অ. ঐ. ঋৎধহবশব, ঔ. এবৎমধহ, এ. অ. এৎরবৎংড়হ, জ. এ. খবরিংড়হ, ডরষষরধস অহফবৎংড়হ, ঝ. ঝষধঃবৎ, ঊফধিৎফ ঝঃরৎষরহম, ঐ. ঈ. ঝঃৎবধঃভবরষফ প্রমুখ। আর ভারতীয়দের মধ্যে এই পত্রিকায় প্রথম ফোকলোর নিয়ে প্রবন্ধ লেখেন রাসবিহারী বসু। ১৮৭১ সালে গীতিকা ও কিংবদন্তী নিয়ে লেখা তাঁর প্রবন্ধটির শিরোনাম ছিল ʻখবমবহফ ধহফ ইধষষধফং ঈড়হহবপঃবফ রিঃয চবৎংড়হং ফবরভরবফ ড়ৎ যবষফ রহ মৎবধঃ ঠবহবৎধঃরড়হ রহ ইযধমধষঢ়ঁৎ ধহফ ঃযব ঘবরমযনড়ঁৎরহম উরংঃৎরপঃং (নবরহম বীঃৎরপঃং ভৎড়স ফরধৎরবং)ʼ। ভারতীয় তথা বাঙালিদের মধ্যে নৃবিজ্ঞানী শরৎচন্দ্র মিত্রেরই বেশিসংখ্যক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর লিখিত প্রবন্ধের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ʻঘড়ৎঃয ওহফরধহ ভড়ষশষড়ৎব ধনড়ঁঃ ঃযরবাবং ধহফ জড়ননবৎংʼ (১৮৮৫), ʻঞযরৎফ ওহংঃধষসবহঃ ড়ভ ওহফরধহ ঋড়ষশষড়ৎব নবষরবভং ধনড়ঁঃ ঃযব ঞরমবৎʼ (১৮৮৫), ʻঙহ ঃযব ঐধৎঢ়ধৎড়ৎির ড়ৎ ঃযব ইরযধৎর ড়িসধহ’ং পবৎবসড়হু ভৎড়স ঃযব ফরংঃৎরপঃ ড়ভ গঁৎংযরফধনধফ, ইবহমধষʼ (১৮৮৯), ʻজরফফষবং পঁৎৎবহঃ রহ ইরযধৎʼ (১৯০১), ʻজরফফষবং পঁৎৎবহঃ রহ ঃযব উরংঃৎরপঃ ড়ভ ঝুষযবঃ রহ ঊধংঃবৎহ ইবহমধষʼ (১৯১৭) ইত্যাদি। এ ছাড়া ভারতীয়দের মধ্যে অনেকেই নানা বিষয়ে একাধিক প্রবন্ধ লিখেছেন। ই. অ. এঁঢ়ঃধ রচিত ʻঋড়ষশষড়ৎব ড়ভ ঃযব ড়ৎরমরহ ড়ভ ঃযব পড়হংঃবষষধঃরড়হ গৎরমধ-ংযড়ৎংযধʼ (১৯১১), গ. গ. ঈযধঃঃবৎলবব রচিত ʻঝড়সব সধৎৎরধমব পঁংঃড়সং রহ ইবহমধষʼ (১৯২৬), ক. চ. ঈযধঃঃবৎলবব রচিত ʻঞযব পধফধশ ভবংঃরাধষ রহ ইবহমধষʼ (১৯৩৫) প্রভৃতি প্রবন্ধ উল্লেখযোগ্য। এশিয়াটিক সোসাইটির পত্রিকায় প্রকাশিত ফোকলোর-বিষয়ক প্রবন্ধের অধিকাংশ আঞ্চলিক বিষয়ে রচিত। প্রবন্ধগুলি একই সঙ্গে বর্ণনামূলক আবার বিশ্লেষণধর্মী।
মূলত এশিয়াটিক সোসাইটির পত্রিকায় প্রকাশিত ফোকলোর-বিষয়ক নানা প্রবন্ধের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির ফোকলোর-চর্চা অব্যাহত আছে। ফোকলোর নিয়ে বড় পরিসরে প্রতিষ্ঠানটি কাজ করেনি। ভারতে তথা বাংলায় ফোকলোর-চর্চার সূচনায় প্রতিষ্ঠানটির অবদান ছিল।
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ
এশিয়াটিক সোসাইটির অনুসরণে উনিশ শতকের শেষভাগে বাঙালিদের উদ্যোগে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ’। প্রতিষ্ঠার পেছনে কাজ করেছে বাঙালিদের স্বদেশ চেতনাবোধ। যদিও অবাঙালি জন বিমস্ (১৮৩৭-১৯০২) ছিলেন পরিষদের প্রথম উদ্যোক্তা। বিমস্ কর্মজীবনে ছিলেন বাংলা প্রেসিডেন্সির বিভিন্ন বিভাগে কমিশনার ও বোর্ড অব রেভিনিউয়ের সম্মানিত সদস্য। বাংলায় কর্মরত অবস্থায় বাংলা ভাষার ঐশ্বর্যের প্রতি অনুুরাগী হয়ে পড়েন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতি বিধানে নিরলস কাজ শুরু করেন। ১৮৭২ সালে প্রকাশিত একটি পুস্তিকায় অন্যান্য দেশের মতো কলকাতাতেও বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে বিমস্ একটি প্রতিষ্ঠান গড়ার বিষয়ে সুধীজনের কাছে প্রস্তাব রাখেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪) সম্পাদিত বঙ্গদর্শন পত্রিকায় এই বিষয়ে তাঁর একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। নিবন্ধটি প্রকাশের একুশ বছর পর বিমস্রে স্বপ্ন পূরণে কলকাতার কতিপয় বাঙালি মনীষী এগিয়ে আসেন, তাঁরা প্রতিষ্ঠা করেন ʻঞযব ইবহমধষ অপধফবসু ড়ভ খরঃবৎধঃঁৎবʼ নামক প্রতিষ্ঠানটি। ১৮৯৩ সালের জুলাইয়ের ২৩ তারিখ কলকাতার শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিটে মহারাজা কুমার বিনয়কৃষ্ণ বাহাদুরের বাসভবনে ঞযব ইবহমধষ অপধফবসু ড়ভ খরঃবৎধঃঁৎব-এর প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৮৯৫ সালের মে মাসের সভায় বেঙ্গল একাডেমি অব লিটারেচারকে ভিত্তি করে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ’ নামক প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠিত হয়। পরিষৎ-এর প্রথম সভার সভাপতি ছিলেন রমেশচন্দ্র দত্ত (১৮৪৮-১৯০৯)। এই সভায় বিনয়কৃষ্ণ দত্ত (১৮৬৬-১৯১২)-এর প্রস্তাবে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় (১৮৪৭-১৯১৯)-এর সমর্থনে সকল সদস্যের অনুমোদনে নবীনচন্দ্র সেন (১৮৪৭-১৯০৯)-কে পরিষৎয়ের সহকারি সভাপতি এবং রজনীকান্ত গুপ্ত (১৮৪৯-১৯০০) ও চ-ীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৫৮-১৯১৬)-কে সদস্য নির্বাচন করা হয়। ১৮৯৩ সালের ১৭ই জুন তারিখে অনুষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানটির দ্বিতীয় অধিবেশনে তিন মাস অন্তর পরিষৎ-এর পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এর সঙ্গে বাঙালি-অবাঙালি, দেশি-বিদেশি বিদ্যোৎসাহী বিভিন্ন মনীষী সরাসরি যুক্ত হন। তাঁদের কর্ম-উৎসাহে পরিষৎ বিচিত্রমুখী কাজ সম্পাদন করে। পরিষৎ কর্তৃক সম্পাদিত কাজের মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করা যায়, ১৮৯৩ সালের ২৯শে অক্টোবরে প্রতিষ্ঠিত গ্রন্থাগারটির কথা। সমৃদ্ধ এই গ্রন্থাগারে বিচিত্র বিষয়ের প্রায় আড়াই লক্ষ গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা সংরক্ষিত আছে। এখানে সংরক্ষিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকার সিংহভাগ-ই দুর্লভ। ন্যাশনাল লাইব্রেরির পরে সাহিত্য পরিষৎ-এর সংগ্রহে এতো বিপুল বৈচিত্র্যপূর্ণ গ্রন্থরাজি আছে। শতবর্ষ অতিক্রান্ত গ্রন্থাগারটি সমৃদ্ধ হয়েছে দেশি-বিদেশি মনীষীদের দানকৃত গ্রন্থে। ক্রয়কৃত ও দানের মাধ্যমে প্রাপ্ত বিপুল এই গ্রন্থ প্রতিদিন ব্যবহার করছেন অসংখ্য গবেষক, বিশেষত বাংলা ও বাঙালির সামাজিক ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তিবর্গ। ফোকলোরের সঙ্গে পুথি-সাহিত্যের সম্পর্ক অনেক গভীর। এ গ্রন্থাগারে শুধু যে বিভিন্ন ভাষার গ্রন্থ আছে তাই নয়; এখানে বাংলা, সংস্কৃত, তিব্বতি, ওড়িয়া, হিন্দি, অসমিয়া, ফারসি ভাষায় লিখিত প্রায় ৭ হাজারের ওপর পুথি সংগৃহীত আছে। পরিষৎ কর্তৃক প্রকাশিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যটি এর অন্যতম। গ্রন্থ প্রকাশের পাশাপাশি পরিষৎ ১৮৯৩ সাল থেকে তাদের মুখপত্র হিসেবে সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা নামক ত্রৈমাসিক পত্রিকাটিও প্রকাশ হয়ে চলেছে। এই পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধের মধ্যে আছে ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, জাতিতত্ত্ব, প্রাচীন সাহিত্য, গ্রাম্য সাহিত্য প্রভৃতি বিচিত্র বিষয়। প্রথম থেকেই পত্রিকাটিতে ফোকলোরের বিভিন্ন বিষয়, যেমন : ছড়া, ধাঁধা, প্রবাদ-প্রবচন, পাঁচালি, মঙ্গলকাব্য, লোকক্রীড়া, লোককাহিনী, লোকাচার, লোকসংগীত, লোকদেবতা, লোকশিল্প, আঞ্চলিক শব্দ ইত্যাদি বিষয়ে প্রবন্ধ প্রকাশ হয়ে আসছে। বাংলা ১৩০১সন থেকে ১৪১০ সন পর্যন্ত শতবর্ষ সময়কালে পরিষৎ-এর পত্রিকার পাতায় শতাধিক ফোকলোর-বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এটা বেশ উৎসাহব্যঞ্জক।
১৩০১ সনের সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকার প্রথম ভাগ তৃতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছেলে ভুলানো ছড়া’ নামে উৎকৃষ্ট মানের প্রবন্ধটি। এই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতা থেকে সংগৃহীত ৩০টি ছড়ার উল্লেখ করেছিলেন। প্রবন্ধটি পাঠ করে সে সময় অনেকেই ফোকলোর বিষয়ে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। ছড়া নিয়ে আরো লিখেছেন বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বলভ ‘ছেলে ভুলানো ছড়া’, রজনীকান্ত গুপ্ত ‘ছেলেভুলানো ছড়া’, কুঞ্জলাল রায় ও অম্বিকাচরণ গুপ্ত ‘ছড়া’, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ‘চট্টগ্রামী ছেলে ভুলান ছড়া’ শীর্ষক নানা প্রবন্ধ। এ ছাড়া ছড়া নিয়ে আরো লিখেছেন তারাপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় ‘দেলপূজার ছড়া’, অনিমা মুখোপাধ্যায় ‘ছড়া ও গাথায় আঠার শতকের বাঙলার বিপর্যয়ের ইতিহাস’ ইত্যাদি প্রবন্ধ।
শুধু ছড়া নয়, ফোকলোরের অন্যান্য উপাদান- ধাঁধা, প্রবাদ, লোকসংগীত, লোকশিল্প, লোকদেবতা, লোকভাষা, লোকাচার, লোকক্রীড়া, লোককবি, লোকধর্ম, লোকাচার, লোকউৎসব, গীতিকা, পাঁচালি, কিংবদন্তী ইত্যাদি বিষয়ে সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায় অনেক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ধাঁধাবিষয়ক প্রবন্ধের মধ্যে আছে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের ‘চট্টগ্রামী ছেলে ঠকান ধাঁধা’, প্রভাষচন্দ্র ভট্টাচার্যের ‘কোচবিহারের হেঁয়ালী’, দেবেন্দ্র নারায়ণ রায়ের ‘মুর্শিদাবাদে প্রচলিত কতিপয় হেঁয়ালী’, দ্বারকানাথ চৌধুরীর ‘শ্রীহট্টের পইঁ’ ইত্যাদি। লোকসাহিত্যের অন্যতম উপাদান প্রবাদ নিয়ে প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা খুব কম, কল্যাণী দত্তের ‘অতিরিক্ত বাংলা প্রবাদ’, জগদীশ গণ চৌধুরীর ‘ত্রিপুরার কক-বরক প্রবাদ প্রবচন’ প্রবন্ধ দুটি উল্লেখ করার মতো।
সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা-র পাতায় লোকসংগীত নিয়ে বেশ কিছু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে আছে কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্রাচীন কবি সঙ্গীত’, রাজেন্দ্রকুমার মজুমদারের ‘বরিশালের গ্রাম্য-গীতি’, হরিদাস পালিতের ‘আদ্যের গম্ভীরা’, জীবেন্দ্রকুমার দত্তের ‘কয়েকটি প্রাচীন পল্লী সংগীত’, নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘খুলনা জেলার মাঝির গান’, নগেন্দ্রনাথ বসুর ‘গাজী সাহেবের গান’, শরৎচন্দ্র মিত্রের ‘ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমার গ্রাম্য সংগীত’, প্রিয়নাথ সেনের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ও জাগের গান’, মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের ‘কয়েকটি জাগের গান’, অমলেন্দু মিত্রের ‘বোলান গান’, অমরকৃষ্ণ চক্রবর্তীর ‘ওলাবিবির গান’ ইত্যাদি প্রবন্ধ।
লোকদেবতা-লোকধর্মবিষয়ক প্রবন্ধের মধ্যে আছে : বিশ্বেরাজ চৌধুরীর ‘ত্রিনাথের উপাখ্যান’, রঞ্জনবিলাস রায় চৌধুরীর ‘একখানি সত্যপীরের পুথি’, অমলেন্দু রায়ের ‘রাঢ়ে ধর্মঠাকুরের পূজা’, অমলেন্দু মিত্রের ‘ধর্মঠাকুরের সূর্যমূর্তি’, চিন্তাহরণ চক্রবর্তীর ‘ত্রিনাথ’, ‘বাংলার লৌকিক দেবদেবী’, ‘লৌকিক বারা ঠাকুর’, ‘মদনপালা’ প্রভৃতি প্রবন্ধ। বস্তুধর্মী ফোকলোরের অন্যতম উপাদান লোকশিল্প বিষয়ক প্রবন্ধ সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে আছে হরিদাস পালিতের ‘রাঢ়ী-বাংলার আলপনা-চিত্র’, বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মেদিনীপুর জেলার চিত্রকর’, অমরেন্দ্রনাথ রায়ের ‘বাংলার মধ্যযুগীয় মৃৎশিল্প’, হিতেশরঞ্জন সান্ন্যালের ‘বাংলার মধ্যযুগীয় মৃৎশিল্প’, অদ্রীশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চালশৈলীর ঐতিহ্য’, অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বাংলার মধ্যযুগীয় মন্দির গার্হস্থ্য ভাস্কর্যে প্রতিফলিত সমাজ চিত্র’ ইত্যাদি প্রবন্ধ।
১৯০৭ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎয়ের একটি কক্ষে অস্থায়ীভাবে ‘চিত্রশালা’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর আগে, অর্থাৎ ১৯০৬ সালের ২১শে ডিসেম্বর শুরু হওয়া এবং ১৯০৭ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারিতে শেষ হওয়া কলকাতার জাতীয় মহাসভার অধিবেশনে ‘ভারতীয় শিল্প ও কৃষি প্রদর্শনী’তে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ সংগৃহীত দুর্লভ হস্তলিখিত প্রাচীন পুথি, বাংলায় মুদ্রিত দুষ্প্রাপ্য বইপত্র, তাম্রশাসন, খোদিত লিপি, প্রাচীন চিত্র, টেরাকোটা, ধাতুমূর্তি ও শিল্পকলার নিদর্শন এবং মনীষীদের ব্যবহƒত দ্রব্য, হস্তাক্ষর ও পা-ুলিপি প্রদর্শন করা হয়। প্রদর্শনীটি জনসাধারণের মধ্যে প্রাচীন ইতিহাস ও প্রতœবস্তু সংগ্রহে আগ্রহ তৈরি করে। এ থেকে উৎসাহিত হয়ে পরিষৎ অযতœরক্ষিত লুপ্তপ্রায় প্রতœবস্তু ও শিল্পকলার নিদর্শন সংগ্রহ-সংরক্ষণে আরো বেশি যতœবান হয়। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎয়ের উল্লেখযোগ্য সংগ্রহের মধ্যে আছে ১১শ শতকের তিনটি ব্রোঞ্জের দুর্লভ বিষ্ণুমূর্তি, হরপার্বতী, সপ্তমাতৃকা, দুর্গামূর্তি প্রভৃতি। এ ছাড়া প্রাচীন মুদ্রা সংগ্রহও চিত্রশালার এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র ও মিশ্র ধাতুর কয়েক হাজার মুদ্রা চিত্রশালায় সংগৃহীত আছে। বাংলার মৃৎশিল্পীদের অনুপম সৃষ্টি পোড়ামাটির সূক্ষ্ম কারুকাজ পরিষৎয়ের চিত্রশালাকে আরো বেশি আকর্ষণীয় করে তুলেছে। মিনা করা ইট থেকে শুরু করে বাংলার বিভিন্ন স্থান থেকে সংগৃহীত টেরাকোটার অলংকার ও মূর্তি চিত্রশালাকে সমৃদ্ধতর করেছে। এসব টেরাকোটার নিদর্শন মূলত সংগৃহীত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের বিষ্ণুপুর, সপ্তগ্রাম, গৌড়, পান্ডুয়া, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, হুগলি, চব্বিশ পরগনা এবং বাংলাদেশের ফরিদপুর, পাবনা, ময়মনসিংহ, যশোর প্রভৃতি এলাকা থেকে। শুধু তা-ই নয়, বাংলার বাইরে রাজগৃহ, বুদ্ধগয়া, বৃন্দাবন থেকেও বেশ কিছু পোড়ামাটির ভাস্কর্য সংগ্রহ করা হয়েছিল। বাংলায় ঘটে যাওয়া ঐতিহাসিক বিভিন্ন যুদ্ধের স্মারকও সংগৃহীত আছে এই সংগ্রহশালায়। ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় (১৮৬১-১৯৩০)-র দানকৃত পলাশী যুদ্ধে ব্যবহƒত একটি কামানের গোলা পরিষৎ-এ সযতেœ রক্ষিত আছে। এ ছাড়া রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩), দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫), ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১), রাজেন্দ্রলাল মিত্র (১৮২৪-১৮৯১), দীনবন্ধু মিত্র (১৮৩০-১৮৭৩), কেশবচন্দ্র সেন (১৮৩৮-১৮৮৪), বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৯০৩), দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪০-১৯২৬), শিবনাথ শাস্ত্রী (১৮৪৭-১৯১৯), রমেশচন্দ্র দত্ত (১৮৪৮-১৯০৯), স্বর্ণকুমারী দেবী (১৮৫৫-১৯৩২), তরু দত্ত (১৮৫৬-১৮৭৭), গিরিন্দ্রমোহন দাসী (১৮৫৮-১৯২৪), বিপিনচন্দ্র পাল (১৮৫৮-১৯৩২), জগদীশচন্দ্র বসু (১৮৫৮-১৯৩৭), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), প্রফুল্লচন্দ্র রায় (১৮৬১-১৯৪৪), চিত্তরঞ্জন দাস (১৮৭০-১৯২৫), সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮২-১৯২২), রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৮৬-১৯৩০) প্রমুখ বাঙালি মনীষীদের ব্যক্তিগত ব্যবহার্য জিনিসপত্র বা স্মৃতিচিহ্ন সযতেœ রক্ষিত আছে এই সংগ্রহশালায়। বিশিষ্ট ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ চিত্রশালার অন্যতম প্রাণপুরুষ। তাঁর অক্লান্ত চেষ্টায় বহু প্রাচীন মুদ্রা ও মূর্তি সংগৃহীত হয়েছে। ১৯১২ সালের ২৮শে এপ্রিল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ চিত্রশালাটি স্বতন্ত্র বিভাগরূপে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। চিত্রশালা পরিচালনা ও সংরক্ষণের জন্য অন্যতম অবৈতনিক ‘চিত্রশালাধ্যক্ষ’ পদের সৃষ্টি করা হয়। নগেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন পরিষৎ-এর প্রথম চিত্রশালাধ্যক্ষ। পরে এই পদ অলংকৃত করেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রমেশচন্দ্র মজুমদার, মনোমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, অজিত ঘোষ প্রমুখ ব্যক্তি। চিত্রশালাটি ফোকলোরের বস্তুগত সংস্কৃতি সংরক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি করেছিল।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
১৮৫৭ সালে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইনের বলে কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজÑ এই তিন শহরে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল সবার শীর্ষে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, রামগোপাল ঘোষ (১৮১৫-১৮৬৮), রমাপ্রসাদ রায় (১৮১৭-১৮৬২), মৌলবী মুহম্মদ ওয়াজি, প্রিন্স গোলাম মহম্মদ প্রমুখ ব্যক্তি। প্রতিষ্ঠার প্রায় ৭২ বছর পর ১৯১৯ সালে ফেব্রুয়ারির ৩ তারিখে ভারতীয় ভাষা (বঙ্গভাষা ও সাহিত্য) বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বিভাগের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি ছিলেন বিশিষ্ট ভাষাবিদ দীনেশচন্দ্র সেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং দীনেশচন্দ্র সেনের উদ্যোগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে লোকসাহিত্য-চর্চার সূচনা হয়। দীনেশচন্দ্র সেন ‘রামতনু লাহিড়ী রিসার্চ ফেলোশিপ’-এর আওতায় ‘বঙ্গসাহিত্য পরিচয়’, ‘চৈতন্য ও তাঁর পার্ষদগণ’, ‘বাংলা রামায়ণ’, ‘বাংলার লোকসাহিত্য’, ‘বাংলার লোকজীবন’ ইত্যাদি বিষয়ে বক্তব্য রাখেন। ১৯২০ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ঞযব ঋড়ষশ খরঃবৎধঃঁৎব ড়ভ ইবহমধষ গ্রন্থটি। রূপকথা ও উপকথা-সংবলিত সংকলনধর্মী এই গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি বাংলা লোকসাহিত্য বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেন।
১৯২০ সালে দীনেশচন্দ্র সেনের উদ্যোগে নলিনীকান্ত ভট্টশালী (১৮৮৮-১৯৪৭) সম্পাদিত ময়নামতীর গান গ্রন্থটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এমএ পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯২২ সালে দীনেশচন্দ্র সেন ও বসন্তরঞ্জন রায়ের যুগ্ম সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় গোপীচন্দ্রের গান গ্রন্থের প্রথম খ-। গানগুলো সঞ্চয়ন করেন বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য। এর দ্বিতীয় খ- প্রকাশিত হয় ১৯২৪ সালে। সংকলিত গ্রন্থের তিনটি পাঠের প্রথমটি হলো ‘গোপীচন্দ্রের গান’। এটি মৌলিক সংগ্রহ। দ্বিতীয় পাঠটি ভবানীদাস বিরচিত ‘গোপীচন্দ্রের পাঁচালি’ ও সুকুর মামুদ বিরচিত ‘গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাস’। ১৯২০-এর দশকের সূচনায় দীনেশচন্দ্র সেন হাত দেন ময়মনসিংহ ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা সংগ্রহে। বেশ কয়েকটি খ-ে তা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ১৯২৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয় মৈমনসিংহ গীতিকার প্রথম খ-। এতে ‘মহুয়া’, ‘মলুয়া’, ‘চন্দ্রাবতী’, ‘কমলা’, ‘দেওয়ান ভাবনা’, ‘দস্যু কেনারামের পালা’, ‘রূপবতী’, ‘কঙ্ক ও লীলা’, ‘কাজলরেখা’, ‘দেওয়ানা মদিনা’ প্রভৃতি গীতিকা মুদ্রিত হয়। এগুলো বৃহত্তর ময়মনসিংহ থেকে সংগৃহীত। গীতিকাগুলির মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত দ্বিজ কানাই প্রণীত ‘মহুয়া’ পালাটি। এটি পূর্ব ময়মনসিংহ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন বিশিষ্ট সংগ্রাহক চন্দ্রকুমার দে। অন্য পালাগুলো তাঁর-ই সংগ্রহ। তিনি কিছু কিছু পালার নামকরণ বদল করেছিলেন। যেমন : ‘বাদিয়ানির পালা’র ‘মহুয়া’ নামকরণ অথবা ‘উনার বাইদ্যা’কে ‘মহুয়াবেদে’ বলে উল্লেখ করেছিলেন, ‘আলাল দুলাল’ পালার ‘দেওয়ানা মদিনা’ নামকরণ ইত্যাদি।
১৯২৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চৌদ্দটি গীতিকা নিয়ে প্রকাশিত হয় পূর্ববঙ্গ গীতিকার দ্বিতীয় সংখ্যা। এতে স্থান পায় ‘ধোপার পাট’, ‘মইষাল বন্ধু’, ‘কাঞ্চন মালা’, ‘শান্তি’, ‘নীলা’, ‘ভেলুয়া’, ‘কমলা রানীর গান’, ‘মানিকতারা পালা’, ‘মদনকুমার ও মধুমালা’, ‘সাঁওতাল হাঙ্গামার ছড়া’, ‘নেজাম ডাকাইতের পালা’, ‘দেওয়ান ঈশা খাঁ মসনদ আলি’, ‘সুরৎ জামাল ও অধুয়া’ এবং ‘ফিরোজ খাঁ দেওয়ান’ নামক গীতিকাসমূহ। চার বছর পর ১৯৩০ সালে এর তৃতীয় খ- প্রকাশিত হয়। এখানে ‘মাঞ্জুর মা’, ‘কাফন চোরা’, ‘ভেলুয়া’, ‘হাতীখেদা’, ‘আয়না বিবি’, ‘কমল সদাগর’, ‘শ্যাম রায়’, ‘চৌধুরীর লড়াই’, ‘গোপিনী কীর্তন’, ‘সুজা তনয়ার বিলাপ’, ‘বয়াতীর গান’ ইত্যাদি গীতিকা স্থান পায়। পূর্ববঙ্গ গীতিকার চতুর্থ তথা শেষ খ-টি প্রকাশিত হয় ১৯৩২ সালে। এই খ-ে দীনেশচন্দ্র সেন ‘নছর মালুম’, ‘শীলা দেবী’, ‘রাজা রঘুর পালা’, ‘নুরন্নেছা ও কবরের কথা’, ‘মুকুট রায়’, ‘ভরাইয়া রাজার কাহিনী’, ‘আন্ধা বন্ধু’, ‘বগুলার বারমাসী’, ‘চন্দ্রাবতীর রামায়ণ’, ‘সন্নমালা’, ‘বীর নারায়ণের পালা’, ‘রতন ঠাকুরের পালা’, ‘পীরবাতাসী’, ‘রাজা তিলক বসন্ত’, ‘মলয়ার বারমাসী’, ‘জিরালনী’, ‘পরীবানুর হাঁহলা’, ‘সোনারায়ের জন্ম’, ‘সোনাবিবির পালা’ নামক উনিশটি পালা সংকলিত করেন। মৈমনসিংহ গীতিকা এবং পূর্ববঙ্গ গীতিকার তিনটি খ-ে সংকলিত ৫৪টি মধ্যে বেশ কয়েকটি গীতিকা আছে, যেগুলো গীতিকা হিসেবে বিবেচিত হবার যোগ্য নয়। কিন্তু দীনেশচন্দ্র সেন সেগুলোকে গীতিকা বলেই বিবেচনা করেছেন। সামান্য কিছু ভুল-ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও দীনেশচন্দ্র সেনের গীতিকা সংগ্রহের এই উদ্যোগ বাংলা লোকসাহিত্য তথা গীতিকা সংগ্রহের ইতিহাসে অনন্য ঘটনা হিসেবে আজও বিবেচিত হচ্ছে। গীতিকা সংগ্রহে তিনি সংগ্রাহক নিযুক্ত করেছিলেন। সংগ্রাহকদের মধ্যে ছিলেন চন্দ্রকুমার দে, আশুতোষ চৌধুরী, জসীম উদ্দীন, মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন প্রমুখ। এঁদের পাশাপাশি নগেন্দ্রচন্দ্র দে, মনোরঞ্জন চৌধুরী, বিহারীলাল রায়, বিজয় নারায়ণ আচার্য (১৮৬৯-১৯২৭), শিবরতন মিত্র প্রমুখ সংগ্রাহকও গীতিকা সংগ্রহ করে জমা দিয়েছিলেন দীনেশচন্দ্রকে। সংগ্রাহকদের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক গীতিকা সংগ্রাহক ছিলেন চন্দ্রকুমার দে। সংগ্রহকর্মের কাজটি পরিচালিত হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নে এবং এর মূল পৃষ্ঠপোষক ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। এই উদ্যোগের ফলে বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ গীতিকাসমূহ বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল। ক্রমশ বিলীয়মান এসব গীতিকা ইংরেজিভাষীদের কাছে পৌঁছানোর লক্ষ্যে দীনেশচন্দ্র সেন ১৯২৩, ১৯২৬, ১৯২৮ এবং ১৯৩২ সালে তা ইংরেজিতে ঊধংঃবৎহ ইবহমধষ ইধষষধফং গুসবহংরহময নামে প্রকাশ করেন। যদিও দীনেশচন্দ্র পূর্ববঙ্গগীতিকার সব পালাগুলিকে ঊধংঃবৎহ ইবহমধষ ইধষষধফং গুসবহংরহময-এ স্থান দেননি। যেমন পূর্ববঙ্গগীতিকার দ্বিতীয় খ-ের দ্বিতীয় সংখ্যায় ‘নীলা’ এবং ‘মদনকুমার মধুমালা’ পালাটি ঊধংঃবৎহ ইবহমধষ ইধষষধফং গুসবহংরহময, াড়ষ-ষষ, চধৎঃ ষ-এ বাদ দিয়েছেন। ঊধংঃবৎহ ইবহমধষ ইধষষধফং এর তৃতীয় খ-টিকে তিনি াড়ষ-ষষষ, চধৎঃ ষ-এ বলে চিহ্নিত করেছেন। এটিতে স্থান দিয়েছেন পূর্ববঙ্গ গীতিকার তৃতীয় খ-ের দ্বিতীয় সংখ্যার পালাগুলির সংক্ষিপ্ত অনুবাদ। ঊধংঃবৎহ ইবহমধষ ইধষষধফং -এর াড়ষ-ষঠ, চধৎঃ ষ-এ রয়েছে পূর্ববঙ্গ গীতিকার চতুর্থ খ-ের ধৃত পালাগুলির অনুবাদ। দীনেশচন্দ্র সেনের এই উদ্যোগ প্রশংসিত হয়। যদিও গীতিকাগুলির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন। সুকুমার সেন (১৯০১-১৯৯২), নন্দগোপাল সেনগুপ্তসহ অনেকের ধারণা, এসব দীনেশচন্দ্র সেন বানিয়ে লিখেছেন। পালাগুলির অস্তিত্ব জনসমাজে নেই অথবা তা আর মঞ্চস্থ হয় না। তাই, বাংলা গীতিকার বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্নে চেক গবেষক দুশান জাভিতাল (১৯২৫-২০১২) জসীম উদ্দীনকে সঙ্গে করে বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিস্তৃত অঞ্চল ঘুরে বেড়ান। তাঁর প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল গীতিকাগুলির স্বরূপ অনুসন্ধান। যদিও তিনি এসব অঞ্চলে গীতিকাগুলির জীবন্ত প্রদর্শন সেভাবে দেখতে পাননি, তবে তিনি এ কথা নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছেন, লোক মনোরঞ্জনের জন্য এসব গীতিকা একসময়ে বহুলভাবে এসব অঞ্চলে প্রদর্শিত হতো। মৈয়মনসিংহ গীতিকার বিশ্বাসযোগ্যতা, মূল বিষয়বস্তু এবং গঠনবৈশিষ্ট্য নিয়ে তাঁর লেখা ইবহমধষ ঋড়ষশ-ইধষষধফং ভৎড়স গুসবহংরহম ধহফ ঃযব ঢ়ৎড়নষবস ড়ভ ঃযবরৎ অঁঃযবহঃরপরঃু গ্রন্থটি ১৯৬৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়। গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি দীনেশচন্দ্র সেন ও চন্দ্রকুমার দে-র উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত গীতিকার মতো আরেকটি উল্লেখযোগ্য ফোকলোর-বিষয়ক গ্রন্থ পটুয়া সঙ্গীত। এটি ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত হয়। শশীচিত্রকর, পঞ্চানন চিত্রকর, উপেন্দ্র চিত্রকর, ভূপতি চিত্রকর প্রমুখ চিত্রকরের কাছ থেকে সংগৃহীত ২৯টি পটুয়াসংগীত সংকলিত করে প্রকাশ করেন গুরুসদয় দত্ত। গানগুলো তিনি সংগ্রহ করেন ১৯৩০-১৯৩৩ সালের মধ্যে, যখন তিনি বীরভূমে কর্মরত ছিলেন। গুরুসদয় দত্তই প্রথম বাঙালি, যিনি হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের কাছে অবহেলিত পটুয়া সম্প্রদায়ের পট ও পটের গান সংগ্রহ করেছিলেন। সামাজিক ইতিহাস রচনায় মূল্যবান এই গ্রন্থের ২৯টি পটুয়াসংগীতের মধ্যে ১২টিই কৃষ্ণলীলা-বিষয়ক। এর মধ্যে আছে ‘শ্রীকৃষ্ণের জন্ম’, ‘পুতনা বধ’, ‘নন্দোৎসব’, ‘বস্ত্রহরণ’, ‘ননীচুরি’, ‘দানখ-’, ‘কালিয় দমন’ প্রভৃতি বিষয়। এ ছাড়া ‘সিন্ধুবধ’, ‘শ্রীরামের বিবাহ’ ‘তাড়কাবধ’, ‘অহল্যা উদ্ধার’, ‘শ্রীরামের বনবাস’ ইত্যাদি রামলীলা-বিষয়ক গান আছে ছয়টি। এ সংকলনে ‘শিবের মাছধরা’, ‘ভগবতীর শঙ্খপরাণ পালা’, ‘গৌরাঙ্গ অবতার’, ‘জগন্নাথ ও গৌরাঙ্গের গান’ ইত্যাদি বিষয়েও বেশ কয়েকটি গান আছে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত ফোকলোর-বিষয়ক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের হারামণি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশীর্বাদধন্য বাউল সংগীতের সংকলন গ্রন্থটিতে বাউল বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে। রবীন্দ্রনাথের বাউল প্রীতির কথা সর্বজনস্বীকৃত। তিনি লেখককে আশীর্বাদ করে বলেন :
মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন বাউল-সঙ্গীত সংগ্রহে প্রবৃত্ত হয়েছেন। এ-সম্বন্ধে পূর্ব্বেই তার সঙ্গে আমার মাঝে মাঝে আলাপ হয়েছিল, আমিও তাঁকে অন্তরের সঙ্গে উৎসাহ দিয়েছি। আমার লেখা যাঁরা পড়েছেন, তাঁরাও জানেন, বাউল পদাবলীর প্রতি আমার অনুরাগ আমি অনেক লেখায় প্রকাশ করেছি। শিলাইদহে যখন ছিলাম, বাউল দলের সঙ্গে আমার সর্বদাই দেখাসাক্ষাৎ ও আলাপ-আলোচনা হ’ত। আমার অনেক গানেই আমি বাউল সুর গ্রহণ করেছি। এবং অনেক গানে অন্য রাগরাগিণীর সঙ্গে আমার জ্ঞাত ও অজ্ঞাতসারে বাউল সুরের মিল ঘটেছে। এর থেকে বোঝা যাবে, বাউল সুর বাণী কোন এক সময়ে আমার মনের মধ্যে সহজ হ’য়ে মিশে গেছে।
রবীন্দ্রনাথের এ বক্তব্যে বাংলার মরমি সংগীত বাউল গানের প্রতি তাঁর তীব্র অনুরাগের কথা প্রতিফলিত হয়েছে। ফোকলোর-বিষয়ক এ ধরনের প্রকাশনা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরো হয়েছে। ক্ষিতিমোহন সেন (১৮৮০–১৯৬০)-এর বাউল সঙ্গীত এমনই আরেকটি প্রকাশনা।
১৯৬৬ সালে নির্মলেন্দু ভৌমিকের সম্পাদনায় গুরুসদয় দত্তের শ্রীহট্টের লোকসঙ্গীত গ্রন্থটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়। সিলেট অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা প্রায় চারশ গানের সংকলন শ্রীহট্টের গণগীতি শীর্ষক গ্রন্থের পা-ুলিপি গুরুসদয় দত্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৩৯ সালে জমা দিয়েছিলেন কিন্তু অনিবার্য কারণবশত তাঁর মৃত্যুর পরে শ্রীহট্টের লোকসঙ্গীত নামে প্রকাশিত হয়। গানের সংখ্যা সম্পাদনা কালে ৪৩টি কমে যায়। ফলে গানের মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৮০টি। গ্রন্থের নাম পরিবর্তন ও গানের সংখ্যা কমানোর ব্যাখ্যা হিসেবে সম্পাদক নির্মলেন্দু ভৌমিক বলেন :
দত্ত মহাশয়ের পা-ুলিপিতে গান ছিল মোট ৪২৩টি। বইয়ের নাম ছিল, “শ্রীহট্টের গণগীতি”। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনা বিভাগের অনুমোদনক্রমে বর্তমানে তাহা ‘শ্রীহট্টের লোকসঙ্গীত’ নামে প্রকাশিত হইল। পা-ুলিপিতে রক্ষিত ৪২৩টি গানের মধ্যে অনাবশ্যক মনে হওয়ায় ৪৩টি পরিত্যক্ত হইল। গানের সংখ্যা তাই দাঁড়াইয়াছে ৩৮০।
ফোকলোরিক দৃষ্টিতে এই ধরনের কাজ সমর্থনযোগ্য নয়। কী কারণে ৪৩টি গানকে পরিত্যক্ত করা হয়েছে তার ব্যাখ্যা সম্পাদক যথার্থভাবে দেননি, তাছাড়া কারো সংগ্রহকর্মের ওপর নিজের ভালো-মন্দ বোধকে চাপিয়ে দেওয়া ফোকলোর গবেষকের পক্ষে সমীচীন নয়। ভবিষ্যৎ গবেষকেরা ঐতিহাসিক মূল্যবান এই গান থেকে যে বঞ্চিত হয়েছে সে কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। সংকলনটিতে ৫৯টি ভাটিয়ালি গান, ১৪টি রাগ প্রধান গান, ৩৮টি ধামাইল গান, ৯টি সারি গান, ১৯টি বিয়ের গান এবং অল্প কিছু বাউল গান আছে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে ফোকলোরকে যুক্ত করেন বিশিষ্ট ফোকলোরবিদ আশুতোষ ভট্টাচার্য। তিনি ১৯৬০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগদান করে এই বিভাগের পাঠ্যক্রমে কিছুটা পরিবর্তন আনেন। শশিভূষণ দাশগুপ্ত (১৯১১-১৯৬৪)-এর সহযোগিতায় বঙ্গভাষা ও সাহিত্যের এমএ-র পাঠ্যক্রমের সপ্তম পত্রে ‘লোকসাহিত্য’ বিশেষ পত্র যুক্ত করেন। এ ছাড়া আশুতোষ ভট্টাচার্য বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন যা ফোকলোরকে নতুন মাত্রা দেয়। তিনি দীর্ঘদিন বিশিষ্ট নৃবিজ্ঞানী ভেরিয়ার এলুইন (১৯০২-১৯৬৪)-এর গবেষণা সহকারি ছিলেন। এলুইনের সঙ্গে ক্ষেত্রসমীক্ষার অভিজ্ঞতা তাঁকে ভাবী জীবনে গবেষণামনস্ক করে। সঞ্চিত অভিজ্ঞতা তিনি প্রয়োগ করেন বাংলা বিভাগের শিক্ষাকার্যক্রমে। তিনি বিশ্বাস করতেন, ক্ষেত্রসমীক্ষা ছাড়া ফোকলোর চর্চা কখনোই সম্পূর্ণ হতে পারে না। তাই তিনি বিশেষ পত্রের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রসমীক্ষা করান। ১৯৬২ সালের এপ্রিল মাসে আশুতোষ ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গ ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের বিশেষ পত্রের একদল ছাত্রছাত্রী পুরুলিয়া জেলার বাগমু-ী থানার অন্তর্গত অযোধ্যা পাহাড়ে লোকসাহিত্য সংগ্রহের জন্য শিবির স্থাপন করেন। এই শিবিরে ১৬ জন শিক্ষার্থী ছিলেন। তারা বিপুল পরিমাণ লোকউপাদান সংগ্রহ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৩ সালে মেদিনীপুর জেলার ঝাড়গ্রাম মহকুমার বাঁশপাহাড়ীতে দ্বিতীয় ক্ষেত্রসমীক্ষা করা হয়েছিল। অংশগ্রহণ নিয়েছিলেন ২৫ জন শিক্ষার্থী এবং তাঁরা পাতানাচের গান, কাঠিনাচের গান, করমগীতি, ঢেঁকির গান, বাউল, ভাদু গান, টুসু গান, গাজনের গান ইত্যাদি সংগ্রহ করেছিল। ১৯৬৪ সালে একই এলাকায় প্রাক্তন ও বর্তমান ২৫ জন সংগ্রহকারীকে নিয়ে তৃতীয়বারের মতন ক্ষেত্রসমীক্ষা করা হয়। ১৯৬৫ সালের ক্ষেত্রসমীক্ষাকর্ম হয় মেদিনীপুর জেলার বেলপাহাড়ীতে, এখানে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ২০ জন। ১৯৬৬ সালের এপ্রিল-মে মাসে মেদিনীপুর জেলার ঝাড়গ্রাম মহকুমার হাতিবাড়ি অঞ্চলে একইভাবে ক্ষেত্রসমীক্ষা করা হয়। অংশগ্রহণ করা ২০ জন শিক্ষার্থী বিপুল পরিমাণ লোককাহিনী, ছড়া, ধাঁধাসহ লোকসাহিত্যের নানা উপাদান সংগ্রহ করে। ১৯৬৭ সালের সমীক্ষাকর্মটি হয় পুরুলিয়ার কুইলাপালে ও বাঁকুড়ার কয়েকটি গ্রামে। লোকসংগীত, লোককাহিনী, ধাঁধা, প্রবাদ সংগৃহীত হয়। ১৯৬৮ সালে পুরুলিয়ার বাগমু-ীতে সমীক্ষাকর্ম করে বিশেষ পত্রের ২৫ জন শিক্ষার্থী। ১৯৬৯ ও ১৯৭১ সালে যথাক্রমে মাঠা ও বাঁকুড়ার শালতোড়া থানার মুরুল গ্রামে ক্ষেত্রসমীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ১০ বছর পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় শিবির স্থাপন করে আশুতোষ ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ক্ষেত্রসমীক্ষাকর্ম পরিচালিত হয়। এসব ক্ষেত্রসমীক্ষায় অংশগ্রহণ করা শিক্ষার্থীদের অনেকেই পরবর্তীকালে ফোকলোর-চর্চায় উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন। তুষার চট্টোপাধ্যায়, দিব্যজ্যোতি মজুমদার, সুভাষ বন্দ্যোপাধ্যায়, সনৎকুমার মিত্র, দুলাল চৌধুরী, বরুণকুমার চক্রবর্তী, শীলা বসাক, বিমলকুমার মুখোপাধ্যায়, সত্যবতী গিরি, পল্লব সেনগুপ্ত প্রমুখ ফোকলোরবিদদের সবাই-ই ছিলেন আশুতোষ ভট্টাচার্যের প্রত্যক্ষ ছাত্র। এঁদের প্রত্যেকেই ফোকলোর বিষয়ক একাধিক গ্রন্থের রচয়িতা। পশ্চিমবঙ্গে আশুতোষ ভট্টাচার্যের শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ফোকলোর বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে ফোকলোরপ্রীতি জন্মানোর ক্ষেত্রে আশুতোষ ভট্টাচার্য একক ভূমিকা পালন করেছিলেন । শুধু তা-ই নয়, তিনি ক্ষেত্রসমীক্ষায় প্রাপ্ত বিভিন্ন লোকউপাদান ব্যবহার করে নিজে ফোকলোর-বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে প্রথমেই বলতে হয় বাংলার লোকসাহিত্যর কথা। এর বেশ কয়েকটি খ- প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত এর দ্বিতীয় খ-ের পুরোটাই ছড়া বিষয়ক। তৃতীয় খ-টি গীত ও নৃত্য বিষয়ক, এটি ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত হয়। লোককথা-বিষয়ক চতুর্থ খ-টি প্রকাশিত হয় ১৯৬৬ সালে। লোকসাহিত্যের অন্যতম উপাদান ধাঁধা নিয়ে পঞ্চম খ- প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে। ষষ্ঠ খ-টি প্রবাদ-বিষয়ক, তা প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালে। লোকসংগীত নিয়ে পাঁচ খ-ের বাংলার লোকসঙ্গীত ((১৯৬৩৮-১৯৬৬) এবং চার খ-ের বঙ্গীয় লোকসঙ্গীত রতœাকর (১৯৬৬-১৯৬৭) গ্রন্থসমূহ তাঁর ক্ষেত্রসমীক্ষারই ফসল। এ ছাড়া দুই খ-ের বাংলার লোকনৃত্য শিক্ষার্থীদের সংগৃহীত কাজের ওপর রচিত। আশুতোষ ভট্টাচার্য ফোকলোর-বিষয়ক এসব গ্রন্থ রচনা করতে পেরেছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থীদের সংগৃহীত উপাদান-উপকরণের সাহায্যে। তাই বলাই যায়, ফোকলোরের উপাদান সংগ্রহে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু লোকউপাদান-উপকরণ সংগ্রহ করেছে তা-ই নয়, বরং এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফোকলোরে বেশ কিছু উচ্চতর গবেষণাও সম্পাদিত হয়েছে। বাংলা বিভাগের শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, সুকুমার সেন, শশিভূষণ দাশগুপ্ত, আশুতোষ ভট্টাচার্য, বিজনবিহারী ভট্টাচার্য, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, মানস মজুমদার, ক্ষুদিরাম দাস, দুলাল চৌধুরী, তুষার চট্টোপধ্যায়, হরিপদ চক্রবর্তী, নির্মলেন্দু ভৌমিক প্রমুখ অধ্যাপকের তত্ত্বাবধানে লোকসাহিত্য, লোকউৎসব, লোকধর্ম, লোকসংগীত, লোককাহিনী, লোকাচার-লোকবিশ্বাস, গীতিকাসহ লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয়ে সম্পাদিত পিএইচডি গবেষণাপত্রের বেশিরভাগই উচ্চমানসম্পন্ন। এসব গবেষণাপত্রের উল্লেখযোগ্য হলো : হরিপদ চক্রবর্তীর ‘দাশরথি রায় ও তাঁহার পাঁচালী’ (১৯৫৮), সুধীরকুমার করণের ‘পশ্চিমবঙ্গের আঞ্চলিক লোকযানের কতিপয় বৈশিষ্ট্য’ (১৯৬১), নির্মলেন্দু ভৌমিকের ‘প্রান্তউত্তরবঙ্গের লোকসঙ্গীত’ (১৯৬১), দুলাল চৌধুরীর ‘লোকসংস্কৃতি ও বাংলার লোকউৎসব’ (১৯৬৯), সুভাষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আধুনিক বাংলা সাহিত্যে লোকঐতিহ্য’ (১৯৭২), প্রদোষকুমার দত্তের ‘রূপকথার গানবৈচিত্র্য ও ভাষা বৈশিষ্ট্য’ (১৯৮৬), শীলা বসাকের ‘বাংলা ধাঁধার বিষয় বৈচিত্র্য ও সামাজিক পরিচয়’ (১৯৮৮), মৃত্যুঞ্জয় গুঁইয়ের ‘পশ্চিমবাংলার সাহিত্যে লোকাচার ও লোকবিশ্বাস’ (১৯৮৮), মধুপকুমার দের ‘জঙ্গলমহলের লোককথা’ (১৯৯০), চিত্তরঞ্জন মাইতির ‘বাংলা লোকসঙ্গীতে লোকজগৎ’ (১৯৯১), সন্ধ্যা রায়চৌধুরীর ‘লোকসাহিত্য ও গণমাধ্যম’ (১৯৯৩), আয়েত্রী শীলের ‘বাংলার মৌখিক ঐতিহ্য খোশগল্প’ (১৯৯৪), শশাঙ্কশেখর দাসের ‘বনবিবি ও গ্রামবাংলা’ (১৯৯৫), শেখ মকবুল ইসলামের ‘বাংলা-ওড়িয়া প্রবাদ ও তুলনামূলক আলোচনা’ (১৯৯৭), নির্মলেন্দু দের ‘জেতোর লোকজীবন ও লোকসংস্কৃতি’ (১৯৯৮), সত্যরঞ্জন বিশ্বাসের ‘দেল বা চড়ক-গাজন উৎসব ও লোকসাহিত্য’ (১৯৯৮), মুনমুন চট্টোপাধ্যায়ের ‘মৈমনসিংহ গীতিকা : পুনর্বিচার’ (১৯৯৯), সুব্রত মান্নার ‘পটচিত্র, পটুয়া সঙ্গীত ও লোকসংস্কৃতি বিজ্ঞান’ (২০০৮) ইত্যাদি। ডিগ্রিপ্রাপ্ত গবেষকদের অনেকেই পরবর্তীকালে ফোকলোরের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত রেখেছেন। তাঁদের লেখা গ্রন্থসমূহ আজ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত, যেমন : সুধীরকুমার করণের সীমান্তবাংলার লোকযান (১৯৬৪), দুলাল চৌধুরীর বাংলার লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতি (১৯৬৯), নির্মলেন্দু ভৌমিকের বাংলা ধাঁধার ভূমিকা (১৯৮৮), শক্তিনাথ ঝার বস্তুবাদী বাউল (১৯৯৯), সুভাষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলার লোকসংস্কৃতি চর্চা ও আশুতোষ ভট্টাচার্য (২০০৯), পুষ্পজিৎ রায়ের গম্ভীরা (২০০০), শীলা বসাকের বাংলার নকশী কাঁথা (১৯৯৮), নির্মলেন্দু দের জেতোর লোকসাহিত্য (১৯৯৮), মুনমুন চট্টোপাধ্যায়ের মৈমনসিংহ গীতিকা : পুনর্বিচার (২০০৩), শেখ মকবুল ইসলামের লোকসংস্কৃতিবিজ্ঞান : তত্ত্ব পদ্ধতি ও প্রয়োগ (২০১১) ইত্যাদি।
ফোকলোর যে শুধু এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তা নয় বরং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গের রবীন্দ্রভারতী, কল্যাণী, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের এমএ পাঠ্যক্রমে ‘লোকসাহিত্যে’র স্থলে ‘ফোকলোর’ বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
লোকশিল্পের বিভিন্ন উপাদানের সঙ্গে সাধারণ মানুষকে পরিচিত করতে ১৯৩৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয় অনন্য এক সংগ্রহশালা, যা ‘আশুতোষ সংগ্রহশালা’ নামে পরিচিত। এটি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রতিষ্ঠিত প্রথম সংগ্রহশালা। স্বনামখ্যাত শিক্ষাবিদ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের নামাঙ্কিত এই সংগ্রহশালার অন্যতম লক্ষ্য ছিল পূর্বভারতের প্রাচীন শিল্পকীর্তির যথাযথ সংরক্ষণ ও তার প্রদর্শন। সংগ্রহশালাটির অধিকাংশ উপাদান লোকশিল্পজাত আর তা অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন জেলা থেকে সংগৃহীত। ভারতের অন্যান্য রাজ্য যথা : বিহার, উড়িষ্যা ও রাজস্থানের বেশ কিছু লোকশিল্পের উপাদান এখানে সংরক্ষিত আছে। খেলনা ও পুতুল সংগ্রহশালাটির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। শিশুরা তাদের খেলার অনুষঙ্গ হিসেবে পুতুল ব্যবহার করে। পোড়ামাটি, কাঠ, বাঁশ, শোলার তৈরি এসব খেলনা-পুতুলের গুরুত্ব বস্তুধর্মী ফোকলোরের ক্ষেত্রে অনেক। সংরক্ষিত পোড়ামাটি পুতুলের মধ্যে আছে গৌরাঙ্গ, গৌর-নিতাই, পাখি, টেপা-পুতুল, ছেলেকোলে মা, নাড়–গোপাল, মাছ, ঘোড়া, মহিষ, হাতির পিঠে মানুষ, তেলের ঘানি, পক্ষীরাজ ঘোড়া, নকশা করা কলসি কাঁখে বউ এবং বিভিন্ন ধরনের ছোট মূর্তি। কাঠের কাজের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের পুতুল, গৌরাঙ্গ, কালী, ঘোড়া, পেঁচা, বাঘের মুখ, এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের ছোট-বড় মূর্তি আছে। শোলার কাজের মধ্যে আছে ময়ূর, ছেলে কোলে মা, বউ, পুতুল, শিব, হাতির উপর মূর্তি, ঘোড়ায় চড়া পুতুল, চৌকিদার ইত্যাদি। বাঁশের কাজের মধ্যে রয়েছে ময়ূর, হরিণ, ঘোড়া ইত্যাদি। এছাড়া আছে পোড়ামাটির তৈরি ধর্মীয় পুতুল : মনসা, গণেশ, দুর্গার কোলে গণেশ, রাধাকৃষ্ণ, বাঘের উপর বনবিবি, শিবের উপর কালী ইত্যাদি। উড়িষ্যা থেকে সংগৃহীত লোকশিল্পের মধ্যে আছে কাঠের তৈরি মন্দির, হাতি, ঘোড়া, হরিণ, সিংহ, হাতির পিঠে সিংহ, জগন্নাথ, পাখি, হনুমানের কাঁধে রাম ইত্যাদি। বিহারের লোকশিল্পের মধ্যে আছে ঘোড়ায় চড়া মূর্তি, শস্যদানীর নিদর্শন, বিভিন্ন ধরনের লোকাচারে ব্যবহƒত পাত্র, বাস্তু নিদর্শন, দীপলক্ষ্মী ও লৌকিক দেবদেবীর মৃন্ময় মূর্তি। আর মধ্যপ্রদেশের লোকশিল্পের মধ্যে আছে মাটির তৈরি পুতুল ও খেলনা হিসেবে মহিষ ও ষাঁড়। পুতুল সংগ্রহের পাশাপাশি এই সংগ্রহশালার অন্যতম সংগ্রহ পটচিত্র। এখানে জড়ানো ১৯টি ও চৌকো ২৪টি পট আছে। পটগুলো মূলত পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর থেকে সংগৃহীত। পটচিত্রের মতো বাংলার অন্যতম লোকশিল্পের স্মারক সরাচিত্রের বিপুল সংগ্রহ আছে। সরাচিত্রগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে বাংলাদেশ থেকে। সরার মতো পাটাচিত্র আছে। ৬৮টি পাটাচিত্রের বেশিরভাগ উড়িষ্যার পুরী থেকে সংগৃহীত। বাংলার গৌরবময় শিল্প নকশিকাঁথা আছে ৩১টি। সুজনী, বেতন, লেপ, আরশিলতা, বটুয়া ও জোথ কাঁথাগুলো বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে সংগৃহীত। মুখোশ শিল্পে এ সংগ্রহশালা সমৃদ্ধ। পুরুলিয়ার ছৌ নাচের অনুষঙ্গ দৃষ্টিনন্দিত মুখোশ আছে সংগ্রহশালাটিতে। এ ছাড়া হুগলি, মেদিনীপুরের বিভিন্ন লোকনৃত্যে ব্যবহƒত মুখোশ সযতেœ সংরক্ষিত আছে এখানে। বরিশাল ও বাঁকুড়ার মনসার ঘট, পিঠার ছাঁচ, বিষ্ণুপুরের দশাবতার তাস প্রভৃতি লোকশিল্পের উপাদান সংগ্রহশালাটিকে সমৃদ্ধ করেছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর চর্চায় আশুতোষ সংগ্রহশালার কথা স্মরণে রাখতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত প্রথম সংগ্রহশালাটি বাংলার লোকশিল্পের ঐতিহ্যকে বারংবার স্মরণ করিয়ে দেয়।
উপসংহার
ফোকলোর-চর্চার সূচনাকারী প্রতিষ্ঠান তিনটির কার্যক্রম বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ফোকলোর কার্যক্রম বর্তমানে স্তিমিত আছে। যদিও বাঙালিদের কাছে ফোকলোরের মতো আপাত-অপরিচিত বিষয়টিকে সূচনাকারী এসব প্রতিষ্ঠান একসময় পরিচয় করিয়েছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান কোনো না কোনোভাবে ফোকলোর নিয়ে কাজ করেছে। যেমন : এশিয়াটিক সোসাইটির কার্যক্রম সীমাবদ্ধ ছিল ফোকলোর-বিষয়ক গ্রন্থ ও প্রবন্ধ প্রকাশের মধ্যে। বিশেষত প্রতিষ্ঠানটির জার্নালে ফোকলোর-বিষয়ক অসংখ্য প্রবন্ধ প্রকাশ হয়েছে কিন্তু বর্তমানে প্রবন্ধ প্রকাশের সেই ধারা এখন নেই বললেই চলে। প্রতিষ্ঠানটির গ্রন্থ প্রকাশনাও আর অব্যাহত নেই। একই চিত্র বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এর ক্ষেত্রেও। সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকাটি অনেক দিন ধরে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে না। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের তুলনায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর গবেষণার চরিত্র কিছুটা ভিন্ন। আজও প্রতিষ্ঠানটি ফোকলোর বিষয়ে উচ্চতর গবেষণার ধারা অব্যাহত রেখেছে। মাঝেমধ্যে বিশিষ্ট ফোকলোর-তাত্ত্বিকদেরকে দিয়ে আলোচনাচক্রের আয়োজন করে। যদিও এখন পর্যন্ত স্বতন্ত্র ফোকলোর বিভাগ প্রতিষ্ঠা করতে না পারাকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম ব্যর্থতা বলা যায়। অনেক পরে হলেও সে দায়িত্ব পালন করেছে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়। পশ্চিমবঙ্গে একমাত্র কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘লোকসংস্কৃতি বিভাগ’-এ ফোকলোর বিষয়ে উচ্চতর পড়াশোনার সুযোগ আছে। অনেক আগেই যে সুযোগটা তৈরি করার কথা ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের। এসব কথা মাথায় রেখে বলা যায় আলোচিত তিনটি প্রতিষ্ঠান বাংলা অঞ্চলে ফোকলোর-চর্চার পথপ্রদর্শকের ভূমিকাই পালন করেছে।

তথ্যসূত্র
সিরাজুল ইসলাম ‘এশিয়াটিক সোসাইটি, কলকাতা’, সিরাজুল ইসলাম (সম্পা.), বাংলা পিডিয়া, দ্বিতীয় খ- (ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ২০১১), পৃ. ২৩০।
মুহম্মদ আবদুল জলিল, বাংলাদেশের ফোকলোর চর্চার ইতিবৃত্ত (ঢাকা: অনার্য, ২০১১), পৃ. ১৫১।
দুলাল চৌধুরী ‘দি এশিয়াটিক সোসাইটি”, ঐতিহ্য, তৃতীয় বর্ষ (২০১০), পৃ. ২৩০।
বাংলা পিডিয়া, দ্বিতীয় খ-, পৃ. ২৩০।
অশোক ভট্টাচার্র্য, ‘এশিয়াটিক সোসাইটি ও বাংলাভাষাচর্চা’, অরুণকুমার বসু (সম্পা.), সারস্বত (কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ২০০৮), পৃ. ১২৫।
অমিতা চৌধুরী, প্রতিষ্ঠান ও লোকসংস্কৃতিচর্চা (দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা: আশুরালী গ্রামোন্নয়ন পরিষদ, ২০০৫), পৃ. ১৮।
মুহম্মদ আবদুল জলিল, বাংলাদেশের ফোকলোর চর্চার ইতিহাস (ঢাকা: আফসার ব্রাদার্র্স, ২০০০), পৃ. ৪০।
রমাকান্ত চক্রবর্তীর সাক্ষাৎকার ‘নাড়ির টানে ৬০ বছর পর: এশিয়াটিক সোসাইটি কলকাতার ২২৫ বছর ’, রুটস, প্রথম বর্ষ, নবম সংখ্যা (২০০৯), পৃ. ৪৪।
প্রতিষ্ঠান ও লোকসংস্কৃতিচর্চা, পৃ. ২১।
রমাকান্ত চক্রবর্তী, ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ’, অরুণকুমার বসু (সম্পা.), সারস্বত (কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ২০০৮), পৃ. ২৫।
‘বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষদের কার্য্যবিবরণ ও সভ্যগণের তালিকা’, সাহিত্য-পরিষদ পত্রিকা, প্রথম ভাগ, প্রথম সংখ্যা (১৩০১), পৃ. ৫২।
তদেব, পৃ. ৫৩।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ছেলেভুলানো ছড়া’, সাহিত্য-পরিষদ পত্রিকা, প্রথম ভাগ, তৃতীয় সংখ্যা (১৩০১), পৃ. ১৮৯-২০২।
সুনীল দাস, ‘সাহিত্য পরিষদের আত্মা ’, দেশ, ৬৭ বর্ষ, ১৯ সংখ্যা (২০০০), পৃ. ৩২-৩৩।
দীনেশচন্দ্র সিংহ, প্রসঙ্গ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (কলকাতা: কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ২০০৭), পৃ. ১।
রওশন ইজদানী, মোমেনশাহীর লোকসাহিত্য (ঢাকা: বাংলা একাডেমি, ১৯৬৮), পৃ. ৫৭।
সুভাষচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলার লোকসংস্কৃতি চর্চা ও ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য (কলকাতা: একুশশতক, ২০০৯), পৃ. ৩৮-৩৯।
বরুণকুমার চক্রবর্তী, বাংলা লোকসাহিত্য চর্চার ইতিহাস (কলকাতা, পুস্তক বিপণি, ১৯৯৯), পৃ. ৪৯৮।
উঁংধহ তনধারঃবষ, ইবহমধষ ঋড়ষশ-ইধষষধফং ভৎড়স গুসবহংরহময ধহফ ঃযব ঢ়ৎড়নষবসং ড়ভ ঃযবরৎ অঁঃযবহঃরপরঃু (কড়ষশধঃধ: টহরাবৎংরঃু ড়ভ ঈধষপঁঃঃধ, ১৯৬৩), ঢ়. ী.
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘আশীর্বাদ’, মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন, হারামণি, প্রথম খ- (কলকাতা: কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৪২)।
গুরুসদয় দত্ত ও নির্মলেন্দু ভৌমিক (সম্পা.), শ্রীহট্টের লোকসঙ্গীত (কলকাতা: কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৬৬), ভূমিকাংশ দ্রষ্টব্য।
বাংলার লোকসংস্কৃতি চর্চা ও ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য, পৃ. ৫৫।
প্রতিষ্ঠান ও লোকসংস্কৃতিচর্চা, পৃ. ৫৭।

লেখক : উদয় শংকর বিশ্বাস, সহযোগী অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।