মোহাম্মদ সাইদুর
প্রাক কথন
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী লোকায়ত কারু ও চারু শিল্প পর্যায়ে বিশেষ বিশেষ কয়েকটি কারু কৃতির প্রতি দেশী-বিদেশী পন্ডিত ও গবেষকদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হলেও এখন পর্যন্ত বাংলার অসংখ্য ঐতিহ্যবাহী কারুকৃতি, পন্ডিত গবেষক ও শিল্প রসিকদের দৃষ্টির আড়ালেই রয়ে গেছে অথবা গবেষকরা এর প্রতি তেমন কোন গুরুত্বই আরোপ করেননি। ঐতিহ্যবাহী এমনি সব শিল্প সামগ্রির আমার নাম করতে পারি-বাংলার হাঁড়ি-কলসী ও সরার বিচিত্র গড়ন, – রূপ এবং আকৃতিগত শিল্প, লাক্ষা-শিল্প, কড়ির কারুকাজ,- কড়ি শিল্প, মাছের কাঁটা, পুঁতির বিচিত্রধর্মী কারু কাজ – পুঁতি শিল্প, ঝিনুক শিল্প, কাগজ কাটা শিল্প, ও আঁশের কারু-কাজ, পাখির পালক বা পাখনার কারুকাজ, ছাচ-শিল্প, নকশী পিঠার ছাঁচ শিল্প, শিংজাত শিল্প, চামড়াজাত শিল্প, রন্ধন শিল্প, গিঁট ও বুনটের কারুকাজ, পাখির খাঁচা ও পাখি ধরার বিভিন্ন শ্রেণীর ফাঁদ, দৈহিক সাজ-সজ্জা, গৃহ সজ্জা, উৎসবের পোষাক-আশাক, বাংলার মেয়েদের কেশবিন্যাস, দেশীয় কৃষি যন্ত্রপাতি, লৌকিক যানবাহন, শন ও বাঁশের কারুকাজ, পশমের কাজ, বাঙালির পোষাক শিল্প, বাঁশ বেতের বিচিত্র আকৃতিগত পাত্র শিল্প, প্রসাধন শিল্প, লক্ষীর ঝাঁপি ও ‘শিকা শিল্পের’ নাম করা যায়। এসব শিল্প সামগ্রিতে একদিকে যেমন রয়েছে বাঙালির হাজার হাজার বছরের ধ্যান ধারনা ও শিল্প ভাবনার ছাপ, অপরদিকে প্রতিটি শিল্পেই রয়েছে বাঙালির হাজার বছরের শিল্প রুচির স্বাতন্ত্র মহিমার উজ্জ্বল প্রজ্ঞাপন। এখানে সামগ্রিক শিল্প পর্যায় থেকে আজ আমাদের আলোচ্য বাঙালির রমণীয় শিল্প বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ‘শিকা শিল্প’।
শিকার উদ্ভব ও বিকাশ
বাংলাদেশে আজ আমরা শিকা হিসেবে যে শিল্পটি দেখছি এর উৎস ও উদ্ভবকাল সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব নয়-কারণ প্রাক কথনেই বলা হয়েছে যে শিকা শিল্পটি নিয়ে আজ পর্যন্ত তেমন কোন আলোচনা ও গবেষণা হয়নি-যার ফলে এর উদ্ভবের কাল নিয়ে আমাদেরই চিন্তা-ভাবনা করতে হচ্ছে। এ বিষয়ে আমাদের যতদূর ধারণা -মানব সভ্যতার আদি যাত্রা পর্বেই এর উদ্ভব হয়েছিলো। কারণ অরণ্যচারী মানব তাদের সারাদিনের আহরিত খাদ্যবস্তু-ব্যবহারের পর উদ্বৃত্ত অংশ সংরক্ষণের জন্যে হয়তো লতা-পাতায় বেঁধে কোন বৃক্ষের শাখায় ঝুলিয়ে রাখতেন। এ থেকে একদিকে সংরক্ষিত খাদ্যাংশ জন্তু জানোয়ার, বন্য পাখি ও কীট পতঙ্গের হাত থেকে রেহাই পেতো, তেমনি অপর দিকে বাইরের মানব মানবীও তা সহজে গ্রহণ করতে সমর্থ হতো না। এমনি করেই বন্য লতা-পাতা দিয়ে আদিম মানবের মধ্যে বিভিন্ন খাদ্য ও ব্যবহার্য সামগ্রী সংরক্ষণের ঝুলানো পদ্ধতি থেকেই মানব সভ্যতার প্রথম স্তরেই হয়তো শিকা জাতীয় সামগ্রীর উদ্ভব হয়েছিল পরবর্তী পর্যায়ে মানুষের ক্রম বিবর্তন ও বিকাশে এ শিকাই পর্যায়ক্রমে উন্নত শিকায় বিকশিত হয়েছে বলে আমরা একটি প্রাথমিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি।
শিকা তৈরির উপকরণ
আজ আমরা গৃহে ব্যবহারগত যে শিকা শিল্পের সংগে পরিচিত অর্থ্যাৎ নকশী শিকা তৈরিতে যেসব উপাদান – উপকরণ ব্যবহার করা হয় -তার একমাত্র প্রধান উপকরণ পাট। এর উপযোগী উপকরণ হিসেবে থাকে পুরাতন শাড়ির পাড় থেকে তোলা বিভিন্ন রঙের সুতা, বাঁশের ফলি-কঞ্চি, সুতলী, কড়ি, পোড়ামাটির গুটি, আস্ত সুপারী, কাচের মার্বেল, বড়ই বীচি, খেজুর বীচি, হাঁস-কবুতর ও ময়ুরের পালক, রঙিন কাগজের টুকরো, ন্যাকড়া,শন, ঝিনুক কড়ি, সরিষা শঙ্খ, হাতের চুরি, বেত-এসব দ্রব্যাদিই সাধারণত শিকা শিল্পের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে।
তৈরি পদ্ধতি
নকশী শিকা বাংলাদেশে সর্বত্রই প্রতিটি গ্রাম এলাকার গ্রামীণ মহিলারাই তৈরি করে থাকেন। এ তৈরি পদ্ধতিটির কৌশল পারিবারিক ঐতিহ্য সূত্রে মেয়েরা কিশোরী বয়সেই দাদী-নানী ও মা-খালাদেও কাছ থেকে শিখেন। শিকাটি তৈরির আগে – যে পাত্রের জন্য শিকা তার আকৃতি অনুযায়ী প্রথমে কাঁচামাল – অথ্যাৎ উৎকৃষ্টমানের সাদা-পাট, পুরানো কাপড়ের পাড়ের সুতা, পুরাতন রঙ্গিন শাড়ির পাড়, সুই, বেত, বাঁশের কঞ্চি ইত্যাদি যোগাড়ের পালা। সব যোগাড় হয়ে গেলে এবার তৈরির পালা। প্রথমে একগুচ্ছ পাটকে বাঁ হাতে নিয়ে পাটের গুচ্ছটির ঠিক মাঝামাঝি অংশ রঙ্গিন সুতার ঘন প্যাঁচ দিয়ে দিয়ে দুই ইঞ্চিরমত জায়গা ভরাট করার পর, ভরাট অংশটি বাঁকিয়ে একটি চিমটার উপরের আকৃতি দেয়া হয়। এবার সেই চিমটাকৃতি অংশে আলাদা সুতার দড়ি লাগিয়ে ঘরের আকৃতি দেয়া হয়। এবার সেই চিমটাকৃতি অংশে আলাদা সুতার দড়ি লাগিয়ে ঘরের খুঁটি বা আড়ের বাঁশে ঝুলিয়ে নিয়ে এক এক করে প্রয়োজনীয় আকৃতি অনুযায়ী বিভিন্ন ডাল বা শাখায় বুনট করা হয়। এ শাখা বা বুনট প্রক্রিয়াটি একটি হয় চুলের বিনুনীর মত, আবার অন্যটি হয় প্যাঁচ দেয়া পাকানো দড়ির মত। এমনি করে একের পর এক শাখা প্রশাখা ও শিল্পীর দক্ষতা অনুযায়ী গিঁট ও নকশায় শিকাটি সমাপ্ত করা হয়। বুনটের বেলায় অনেক ক্ষেত্রে একটি শিকায় একজন শিল্পীই নয় দু’তিন জন শিল্পীও একত্রে বুনট করে থাকেন। বুনটের সময় শিল্পীর প্রধান কৃতি হচ্ছে বিভিন্ন শ্রেণীর গিঁট, বুনট ও পাকের মধ্যে। শিকার গিঁটের ও অসংখ্য নাম এবং নকশা রয়েছে যেমন- টেহা গিড়, কড়ি গিড়, ফুল কলি গিড়, বুবি গিড়, কদম ফুলি গিড়, এমনি অসংখ্য নকশানুযায়ী নাম। এমনি বুনটেরও নাম রয়েছে যেমন- বেনীবাইন, দরি বাইন, তিন প্যাঁচি বেনী, চার প্যাঁচি বেনী, পাঁচ প্যাঁচি বেনী ইত্যাদি।
শিকা একটি গৃহগত শিল্প
সাধারণত খাবার দ্রব্যাদি ও অন্যান্য গৃহজাত সামগ্রী সংগ্রহ ও সংরক্ষণের অধার হিসেবেই শিকার প্রয়োজন হলেও বাঙালী রমনীর মন মানসিকতায় সাদা-মাটা এ বস্তুটিই গৃহ সজ্জায়ও রুচির দ্যোতনায় প্রকাশ পেয়েছে। এই মানসিকতা ও রুচির দ্যোতনার দিকটি উদঘাটন করতে হলে আমাদের যেতে হবে আবহমান বাঙলা, বাঙালি ও বাঙলার বিচিত্র প্রকৃতি, রূপ, রস ও বিস্তৃত পরিবেশের কাছে। যে বিস্তৃত পরিবেশে – উঁচু টিলার উপর ঘর, চারদিকে ঢালু চাল, প্রশস্থ আঙ্গিনা, ঘন আম-জাম, তাল-তমাল, ঝোঁপ-ঝাড়, ছায়া ঘেরা যে গৃহ , এ গৃহকে অবলম্বন করেই পুরুষাণুক্রমিক ছিল বাঙালির আকর্ষণ।
এ আকর্ষণ থেকেই এ গৃহকে অবলম্বন করেই ছিল বাঙালির ধ্যান-ধারণা সামগ্রিক চিন্তা ও কর্ম যার ফলে এখানেই সঞ্চিত করেছিল বাঙালি নারী-পুরুষ তাদের কামনা-বাসনা ও কল্পনার সামগ্রী। এসব সামগ্রিতেই আত্মপ্রকাশ করেছিল বাঙালি রমনীয় কল্পনা, বিশ্বাস, আচার, সংস্কার ও সামগ্রিক রূপ-রস। বাঙালির বিস্তৃত পরিবেশ ছেড়ে সেখানেই শিল্প এসে ঘরের আঙ্গিনায় পা মিলিয়েছিল আর সেখানেই জন্ম হয়েছিল চলতি শিল্পের প্রাণ প্রতিষ্ঠা। শিল্প এখানে যে রূপ ও রস নিয়ে প্রাত্যহিক জীবনের নিত্য ব্যবহারের প্রতিটি জিনিসের মধ্যে প্রবিষ্ট হয়েছিল তারই ফসল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল- লোকায়ত গৃহশিল্প। আমাদের আলোচ্য শিকা শিল্পটি ও এর ব্যত্যয় নয়। যার ফলে আমার এ শিল্পটিকে একান্তই গৃহগত ও মেয়েলী শিল্প হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। বার বার গৃহগত শিল্প বলছি এ জন্যই যে-শিকা শুধু বুনটের পারি পাট্যেই নয়-এর আর একটি ব্যবহারগত দিক রয়েছে-যা দিয়ে বাঙালি রমনী তার স্বপ্নের ও কামনা বাসনার আবাস এ গৃহটিকে সাধ্যানুযায়ী শৈল্পিকরূপে সাজিয়ে নিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে শিকা গৃহসজ্জার উপকরণ শিল্প হিসেবেই চিহ্নিত হতে পারে। এ বিষয়ে অনেকেই হয়তো শিকা দিয়ে গৃহ সজ্জা দেখেছেন- তবে এ ক্ষেত্রে আমি আমার দুটি বাস্তব অভিজ্ঞতার প্রসংগ এখানে টেনে আনছি।
দুটি অভিজ্ঞতার কথা
প্রথম অভিজ্ঞতা : খ্রিস্টাব্দ ১৯৮৪ সাল। বাংলা একাডেমীর হয়ে গ্রাম সমীক্ষা করতে গিয়েছিলাম-বর্তমান নড়াইল জেলার কালিয়া থানার কালাবাড়িয়া গ্রামে। সমীক্ষার এক পর্যায়ে সে গ্রামেরই বিশিষ্ট ধনী-মানিব্যাক্তি মাহমুদ সাহেবদের বাড়ির ছনে ছাউয়া আট চালা ঘরটির ভেতরে যাই। মাহমুদ সাহেবের বৃদ্ধ মা সে ঘরে নিকানো উঠোনে মাদুর পেতে বসতে দিলেন। আমি বসে ঘরের ভেতরের চারপাশ দেখতে লাগলাম, – ঘরের দক্ষিণ অংশে মোটা কাঠের পাইল – এ মোটা দড়ির বুনটের শিকায় বড় বড় মাটির মটকা থরে থরে ঝুলানো। প্রত্যেকটি শিকার বিন্যাস একই প্রকার। নিচে বড় মাটির মটকা পরেরটি একটু ছোট এবং পরেরটি আরো ছোট এভাবে ক্রমান্বয়ে এক সারিতে সাজানো -সাতটি শিকায় কমপক্ষে পঁয়ত্রিশটি মটকা সাজানো। এগুলোতে বিভিন্ন জাতের বীজ ধান রাখা আছে। উত্তর দিকের পাইলে-একটি বাঁশের টানায় ঝুলানো আছে পঞ্চাশটি শিকা। এতে ছোট বড় আকৃতির প্রায় শতাধিক কলসী থরে থরে সাজানো রয়েছে। এসব কলসীগুলো কোন কোনটিতে বিভিন্ন পদের চাল, ডাল রাখা। পশ্চিম দিকের দরজার একপাশ থেকে ঘরের কোন অবধি অপর একটি বাঁশের পাইলে-বিচিত্র ধরনের বিশটি শিকায় কমপক্ষে কয়েক ডজন চিনামাটির প্লেট, ঘটি, বাটি রয়েছে। দরজার অপরদিকে রয়েছে বিভিন্ন প্রকার শিশি, বোতল, বৈয়াম ঝুলানো পঁচিশটি, বিচিত্র ধরনের নকশাযুক্ত শিকা। ঘরের দক্ষিণ অংশের মাঝামাঝি বিছানাপত্র রাখার জন্যে পাটের তৈরি-রঙ্গিন ঝালরযুক্ত একটি বড় ফুল চাং।
এখানেই শেষ নয়, ঘরের মধ্যের পালা যা তাদের আঞ্চলিক শব্দে “মধুপালা” নামে প্রচলিত তার পাশে ঝুলানো আছে কড়ি ও রঙ্গিনসুতার নকশায় সাজানো একটি লক্ষী শিকা। আজ শিকা বিষয়ক আলোচনা করতে গিয়ে সাধারণ শিকা ও হাঁড়ি পাতিল দিয়ে সাঝানো এ ঘরটি যেন আমার চোখে মাটির বিচিত্র হাঁড়ি-পাতিল ও শিকার একটি পূর্ণাঙ্গ মিউজিয়ার রূপে ফুটে উঠছে।
শুধু কালাবাড়িয়ার মাহমুদ সাহেবের বাড়িই নয়, ছোঠ বেলায় আমার দাদীর ঘরেও এমনি শিকা ঝুলিয়ে রাখতে দেখেছি। সে সময় আমার মাকেও দেখতম তুচ্ছ একটি শিশি বোতল ঝুলিয়ে রাখার জন্য কত আন্তরিক দরদ দিয়ে বিভিন্ন আকার আকৃতির শিশি বোতলের শিকা তৈরি করছে। এখনো আমার মনে আছে মা ও দাদীর সেই সংগ্রহ ভান্ডার থেকে প্রায় সত্তুরটির মদত বিভিন্ন ধরনের শিকা শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সাহেবের বাসায় এনে জমা করেছিলাম।
আবার কালাবাড়িয়ার মাহমুদ সাহেবের কথায় ফিরে আসি। এই কিছুদিন পূর্বে খোঁজ নিয়ে জেনেছি মাহমুদ সাহেবের সেই ঘরটি আর নেই। সে ভিটেতেই এখন একটি ইমারত শোভা পাচ্ছে। ইমারতে তো আর মাটির হাঁড়ি-পাতিল বা পাটের শিকা রাখার কথা নয়। শুনেছি সেখানে এখন বিদ্যুৎও চলে গেছে, সুতরাং খাদ্য সামগ্রী রাখার জন্যে একটি ফ্রীজও হয়তো সে ঘরে ঠাঁই করে নিয়েছে।
দ্বিতীয় অভিজ্ঞতাটি আমার দেখা নয়-শোনা। তখন আমি গ্রামের বাড়ি নিচু ক্লাসে পড়ি। একদিন দেখলাম পাশের বাড়ির উঠতি এক ধনি ব্যক্তির বাড়িতে ইট আসছে-অর্থ্যাৎ ছনের ঘরটি ভেঙে সেখানে দালান করা হবে। কিন্তু এতে বাদ সাজছেন ঐ ধনী ব্যক্তির স্ত্রী। তিনি কোন মতেই তার ভিটার ঘর ভাংতে দেবেন না। কারণ একেতো পূর্ব পুরুষের ঘর, ঘরে বোঝাই কয় পুরুষের জমানো শিকা-কলসী। এখন দালান হলে তিনি তার এ সাধের শিকাগুলো টানাবেন কোথায়? আর হাঁড়ি-কলসিগুলোই বা রাখবেন কোথায়? এ নিয়ে দীর্ঘ দিন তাদের স্বামী-স্ত্রীর বচ্সা। শেষ পর্যন্ত সে ব্যক্তি চার পাশে ইঁটের দেয়াল গেঁথে উপরে টিন সেড দিয়ে উভয়কূল রক্ষা করলেন।
নকশী শিকার ব্যবহারগত শ্রেণি
বাংলাদেশে অসংখ্য শ্রেণীর শিকার প্রচলন রয়েছে। এর মাধ্যে আবার আছে ব্যবহারগত শ্রেণি যেমন :
পাতিল রাখার শিকা, কলসী রাখার শিকা, কাঁথা/বালিশ রাখার শিকা, বই/পত্র রাখার শিকা, আয়না-কাঁকই রাখার শিকা, নকশী হাড়ির শিকা, বৈয়াম রাখার শিকা, বাসনপত্র রাখার শিকা, শিশি/বেতাল রাখার শিকা, মাটির ঝাড় রাখার শিকা, পাখা রাখার শিকা, আলনা শিকা, খিলাই রাখার শিকা, ঘরের শোভা বর্ধনের ঝাড় শিকা, ধামা রাখার শিকা, দোলনা শিকা, বিছানাপত্র রাখার শিকা, বাঁক শিকা, ঝালড় শিকা, দেয়ালী শিকা, হিংলা শিকা ব্যবহারগত শ্রেণীর এ নামগুলোই বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য।
নকশী শিকার নকশার আঞ্চলিক নাম
নকশার নাম ব্যবহার সংগ্রহীত অঞ্চল
১। চাদরের বেড় বড় পাত্র ও বাসনপত্র রাখার শিকা ময়মনসিংহ
২। উল্টা বেড়ী একত্রে গ্লাস/বাসন রাখার শিকা
৩। সরফুশ বেতের ধান/চাল রাখার পাত্র
৪। ফুলমালা বাসন/পত্র রাখার
৫। লাটিম শিকা বড় থেকে ছোট পাত্র রাখারব্রাহ্মণবাড়িয়া
৬। ফুলঝুড়ি ময়মনসিংহ
৭। আওলা আংটি
৮। আংটি বেড়
৯। পাতা শিকা বড় বাটি/ঘটি রাখার ব্রহ্মণবাড়িয়া
১০। ইচাঁর ঠ্যাং বৈয়াম রাখার
১১। বেলকী বাইন শিশি/বোতল রাখার শিকা ময়মনসিংহ
১২। মাছের কাঁটা ঘটি/বাটি রাখার
১৩। চমক পাটি কলসী/পাতিল রাখার
১৪। চিলের চোখ হাঁড়ি/পাতিল রাখার
১৫। জয়ফুল মালা বৈয়াম/বাটি
১৬। ঝালর বেড় বাসন/পত্র রাখার
১৭। রসুন দানা বড়পাত্র ও পাতিল
১৮। বুবি শিকা
১৯। আনারসি
২০। কটির ঘর
২১। বড়ই ফুল
২২। মাকড়ের ঘর কিশোরগঞ্জ
২৩। ছিহল বেড়
২৪। ঝিংগা বেড়ি
২৫। বলদের চোখ
২৬। হরু ফুল
২৭। বেঁট ফুল
২৮। কাঁকই বেড়
২৯। কাউয়্যার ঠ্যাং
৩০। মারুয়া গিঁট্যা
৩১। কাঁঠালী নরসিংদী
৩২। গান্জা
৩৩। জোথ্
৩৪। ফুলটুংগী
৩৫। খিলাইটুংগী
৩৬। খিলাইদানী
৩৭। ময়ুর পেখম
৩৮। পাংখা দানী ঢাকা
৩৯। ফুল মাচাং
৪০। জালি বাইন
৪১। বান্দর লড়ি
৪২। কাঞ্চন সুন্দরী
৪৩। উড়ি ফুল
৪৪। চিলা বাঁছা
৪৫। বেতা বাইন
৪৬। ঝুপরী টানা
৪৭। হাঁপ বেড়ি
৪৮। কেঞ্চিবেড়ি
৪৯। উল্টা বেড়ি
৫০। চাইর গুচা ফুলপুর, ময়মনসিংহ
৫১। গরুর দানহা
৫২। ডালিম ফুল
৫৩। লারের শিকা
৫৪। জাওলা বেড়ি
৫৫। তলি ছাড়া
৫৬। বাজু শিকা
৫৭। বলাকতলী
৫৮। জিলাপির প্যাঁচ
৫৯। ঝাঁপড়ি
৬০। আলহা দানহা
৬১। চিলা বাঁহা
৬২। লাউয়ের আলী ব্রহ্মণবাড়িয়া
৬৩। ঘাষড়ি ছিকা
৬৪। বলাক বেড়ি
৬৫। কদম ফুলি
৬৬। কঞ্চন বেড়ি কিশোরগঞ্জ
৬৭। জোড় বেড়ি
৬৮। মাকড়শী
৬৯। পাংখা বেড়ী
৭০। ফুল ঝাড়
৭১। মাদারফুলি
৭২। বালুক ঝাঁপা
৭৩। সাতেশ্বরী
৭৪। কানফুলি
৭৫। কাউয়্যা কাঠি
৭৬। আঠ ঘড়ি
৭৭। গোলক বেড় শিবপুর, নরসিংদী
৭৮। কড়ি দানা
৭৯। আম ঝুপি
৮০। পঞ্চমুখী কোটালীপাড়া
৮১। ত্রিমুখী গোপালগঞ্জ
৮২। সপ্তমুখী
৮৩। চান্দা
৮৪। বুচকা
৮৫। বাঁওটি
৮৬। কাঠি শিকা
৮৭। বেলফুলি
৮৮। ধান্দাবেড়ী
৮৯। নাহা দড়ি
৯০। মুখ বেড়
৯১। ফুল চাং
৯২। এক চোখা গুলি
৯৩। তিন চোখা গুলি
৯৪। সাত চোখা গুলি
৯৫। নয় চোখা গুলি
৯৬। পল বেড়
৯৭। ডাউক ফান্দ
৯৮। ডালিম শিকা
৯৯। কইতর ছতি
১০০। বাঁউক ঝোল
১০১। লক্ষী ঝাড়
১০২। মাগুন্দা বেড় ইত্যাদি
সত্তর দশকের চমক
বাংলাদেশে নকশী শিকা সাধারণত নিজেদের প্রযোজন ও ব্যবহার এবং খাদ্য সামগ্রী ও গৃহগত বস্তু সামগ্রী নিরাপদে রাখার আধার হিসেবেই আবহমানকাল থেকে এর ব্যবহার চলে আসছে। কিন্তু খুব সম্ভবত ষাটের দশকে এর কিছু শিকা’র শিল্প কৌশলে আকৃষ্ট হয়ে কিছু বিদেশী-বিদেশিনী পর্যটক বাঙালির একান্ত নিজস্ব এ শিল্পটিকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিয়ে যান। সে থেকে দেখা যায় আমাদের শিকা শিল্পটির বিদেশে একটি বিশেষ আবেদন, রয়েছে। সে আবেদন সৌখিনতা থেকে হোক বা প্রয়োজনের তাগিদেই হোক এ দেশ থেকে বিদেশে ব্যবসায়িক ভিত্তিতে বিভিন্ন প্রকার শিকা রপ্তানী হতে থাকে। যত দূর সম্ভব এ রপ্তানী প্রক্রিয়ায় সত্তুরের দশক একটি সমাজ উন্নয়ন সংস্থা করিতাস প্রথমে এগিয়ে আসেন, এদের পর পরই কারিকা, কুমুদিনী, ব্র্যাক, শৈঁতুলী নামের কয়েকটি সংস্থা শিকা রপ্তানী শুরু করে। কিন্তু শিকা রপ্তানীর এ হুজুগ এক দশকের বেশী স্থায়ীত্ব লাভ করেনি। নব্বইয়ের দশক থেকেই বলতে গেলে এ রপ্তানী ও তৈরির খাত শতাংশের পাঁচের কোটায় নেমে আসে। এটি কাদের এবং কি কারণে হয়েছে তা এখনো অজ্ঞাত।
যাক সে কথা। কারণ বাঙলার এ শিল্পটি রপ্তানীর জন্যে উৎকর্ষতা লাভ করেনি এর মূল লক্ষ্য ছিল বাঙালির নিজস্ব শিল্পরস বোধ বা নিজের ঘরের শোভা বর্ধন করবে এবং দানের মাধ্যমে আপনাজনদের কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনাই ছিল যার প্রধান লক্ষ্য। সে ক্ষেত্রে এ রপ্তানী প্রক্রিয়াটি আমাদের জন্য সুফল নয় বরং কুফলই বয়ে নিয়ে আসছিল।
জন জীবনে শিকা’র প্রভাব
যে কোন শিল্প সামগ্রী জন জীবনে মিশে গেলে সাধারণ মানুষ একে নানা ক্ষেত্রে ব্যবহার করে থাকেন। আমাদের শিকা শিল্পটিও জনজীবনের সঙ্গে যে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে তার প্রমাণ পাই আমাদের কয়েকটি প্রাচীন রোক সংগীতে এই শিকা’র অনুপ্রবেশ থেকে। এখানে ক’টি প্রাচীন লোক সংগীতের ছত্র উদ্ধৃত করা হলো –
বাঘাই শিন্নীর গান
-ছিক্কা লড়ে ছিক্কা লড়ে
ঝপ ঝপাইয়া টেহা পড়ে
একটি টেহা পাইলাম রে
বাইন্যা বাড়ি গেলামরে .. . . .।।
বাইদ্যানীর গান
আমার বাড়ি যাইও বন্ধু
এই না বরা বর।
পূব দোয়াইরা বাড়িরে বন্ধু
উত্তর দোয়ারিয়া ঘর। ।
আমার বাড়ি গেলেরে বন্ধু
খাইতে দিবাম শরবীকলা
গামছা বান্ধা দৈ।
আরো দিবাম শিক্যায় তোলা
বিন্নী ধানের খৈ . . . ।।
উল্টা বাউলের গীত
হা-হা-একি আচানক কারবার
তালগাছে লোলের পনা
বগা ধইরা খায়,
ইন্দুরে যে বিলাই মারলো
এর কি হইলো উপায়. . . . ।।
এখানে উল্টা বাউলের গীতে “উন্দুরে বিলাই মারলো”
এর অর্থ-শিকা’র নিচে বিড়াল বসা ছিল উপর দিকে ইঁদুরে শিকা কেটে দেয়ায়-শিকা’র তৈজস পত্রের চাপে পরে বিড়াল মারা যায়। আমাদের লোক সাহিত্য-লোক সংগীতের পরতে পরতে শিকা সম্পর্কে এমনি উল্লেখ আছে।
উপসংহার
এ আলোচনার উপসংহার টানতে গিয়ে ‘শিকা’ সম্পর্কে আমি আশা ও নিরাশা দুটোই পোষণ করছি। আশা পোষণ করছি এক্ষেত্রেই যে যতদিন গ্রাম বাংলা এবং বাঙলার রমনীকূল থাকবে ততদিন ‘শিকা’ ও থাকবে। কিন্তু শিকার যে বৈচিত্রময় নকশা যেভাবে হারিয়ে যাচ্ছে তাকে রোধ করা সম্ভব নয়। কাজেই অচিরেই শিকা নয় – বরং শিকার বৈচিত্রময় নকশাগুলো জাতীয় পর্যায়ে সংরক্ষণের আবেদন জানাচ্ছি।